একুশ
অনেকদিনের পরে বিপ্রদাস নীচের আফিসঘরে আসিয়া বসিয়াছে। সম্মুখে টেবিলের পরে কাগজপত্রের স্তূপ—কতদিনের কত কাজ বাকী। দেহ ক্লান্ত, কিন্তু দ্বিজুর ভরসায় ফেলিয়া রাখাও আর চলে না। একটা খেরো-বাঁধানো মোটা খাতা টানিয়া লইয়া সে পাতা উলটাইতেছিল, বাহিরে মোটরের বাঁশী কানে গেল এবং অনতিবিলম্বে পূবের খোলা দরজা দিয়া বন্দনা প্রবেশ করিল। আজ একা নয়, সঙ্গে একটি অপরিচিত যুবক, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে ফুলকাটা কটকি চটি এবং কাঁধ হইতে তির্যক ভঙ্গিতে জড়ানো মোটা সাদা চাদর। বয়স ত্রিশের নীচে, দেহের গঠন আর একটু দীর্ঘচ্ছন্দের হইলে অনায়াসে সুপুরুষ বলা চলিত। বিপ্রদাস অভ্যর্থনা করিতে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
বন্দনা কহিল, মুখুয্যেমশাই, ইনিই মিস্টার চাউড্রি—বার-অ্যাট-ল। কিন্তু এখানে অশোকবাবু বলে ডাকলেও অফেন্স নিতে পারবেন না এই শর্তে আলাপ করিতে দিতে রাজী হয়ে সঙ্গে এনেচি। আলাপ হবে, কিন্তু তার আগে আপন কর্তব্যটা সেরে নিই—এই বলিয়া সে কাছে আসিয়া হেঁট হইয়া নমস্কার করিয়া বলিল, পায়ের ধূলোটা কিন্তু এঁর সুমুখে নিতে পারলুম না পাছে মনে করে বসেন ওঁদের সমাজের আমি কলঙ্ক। কিন্তু তাই বলে যেন অভিমানভরে আপনিও ভেবে নেবেন না নতুন কায়দাটা আমার মাসীর কাছে শেখা। তাঁর পরে আপনার প্রসন্নতার বহরটা আমার পরিমাপ করা কি না!
বিপ্রদাস কহিল, তোমার মাসীমার কাছে এইভাবেই আমার গুণগান করো নাকি? নবাগত যুবকটির প্রতি ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, বন্দনার মুখে আপনার কথা এত বেশি শুনেচি যে অসুস্থ না থাকলে আমি নিজেই যেতুম আলাপ করতে। দেখেই মনে হলো চেহারাটা পর্যন্ত চেনা, যেন কতবার দেখেচি। ভালোই হলো অযথা বিলম্ব না করে উনি নিজেই সঙ্গে করে আনলেন।
ভদ্রলোক প্রত্যুত্তরে কি একটা বলিতে চাহিল, কিন্তু তাহার পূর্বেই বন্দনা শাসনের ভঙ্গীতে তর্জনী তুলিয়া কহিল, মুখুয্যেমশাই, অত্যুক্তি অতিশয়োক্তিকে ছাড়িয়ে প্রায় মিথ্যার কোঠায় এলো, এবার থামুন নইলে হাঙ্গামা করবো।
ইহার অর্থ?
ইহার অর্থ এই হয় যে আমাদের অতি-সাধারণদের মত সত্যি-মিথ্যে যা খুশি বানিয়ে বলা আপনারও চলে। আপনি মোটেই অসাধারণ ব্যক্তি নয়,—ঠিক আমাদের মতোই সাধারণ মনুষ্য।
বিপ্রদাস কহিল, না। সকলকে জিজ্ঞেসা করো, তারা একবাক্যে সাক্ষ্য দেবে তোমার অনুমান অশ্রদ্ধেয়, অগ্রাহ্য।
বন্দনা বলিল, এবার তাদের কাছেই আপনাকে নিয়ে গিয়ে বাইরের ঐ সিংহচর্মটি দু’হাতে ছিঁড়ে ফেলে দেবো, তখন আসল মূর্তিটি তারা দেখতে পাবে,—তাদের ভয় ভাঙবে। আমাকে আশীর্বাদ করে বলবে তুমি রাজরানী হও।
বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, আশীর্বাদে আপত্তি নেই, এমন কি নিজে করতেও প্রস্তুত, কিন্তু আশীর্বাদ ত তোমরা চাও না, বলো কুসংস্কার, বলো ও শুধু কথার কথা।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 21 Page: 100
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 175