বিপ্রদাস সহাস্যে হাত বাড়াইয়া বলিল, করলুম তোমাকে সেই আশীর্বাদ। আজ থেকে মানুষ খোঁজা যেন তোমার শেষ হয়, যে তোমার চিরদিনের তাকে যেন তিনিই তোমাকে দান করেন।

কথাটাকে অপমানকর পরিহাস মনে করিয়া বন্দনা রাগিয়া বলিল, আপনি ভুল করচেন মুখুয্যেমশাই, মানুষ খুঁজে বেড়ানোই আমার পেশা নয়। তারা আলাদা। কিন্তু হঠাৎ আজ কেন এসেচি এখনো সেই কথাটা আপনাকে বলা হয়নি। এদিক দিয়ে সত্যিই আমার একটা মস্ত ভুল ভেঙ্গে গেছে। এখানে আপনাদের সংস্রবে এসে ভেবেছিলুম এই-সব আচার-বিচার বুঝি সত্যিই ভালো, খাওয়া-ছোঁয়ার নিয়ম মেনে চলা, ফুল তোলা, চন্দন ঘষা, পূজোর সাজ-গোছ করা—আরও কত কি খুঁটিনাটি,—মনে করতুম এ-সব বুঝি সত্যিই মানুষকে পবিত্র করে তোলে, কিন্তু এবার মাসীমার বাড়িতে গিয়ে এ মূঢ়তা ঘুচেছে। দিন-কয়েক কি পাগলামিই না করেছিলুম মুখুয্যেমশাই, যেন সত্যিই এ-সব বিশ্বাস করি, যেন আমাদের শিক্ষায় সংস্কারে সত্যিই কোথাও এর থেকে প্রভেদ নেই। এই বলিয়া সে জোর করিয়া হাসিতে লাগিল।

ভাবিয়াছিল কথাটা হয়ত বিপ্রদাসকে ভারী আঘাত করবে, কিন্তু দেখিতে পাইল একেবারেই না। তাহার ছদ্মহাসিতে সে প্রসন্নহাসি যোগ করিয়া বলিল, আমি জানতুম বন্দনা। তোমার কি মনে নেই আমি সতর্ক করে একদিন তোমাকে বলেছিলুম এ-সব তোমার জন্যে নয়, এ-সব করতে তুমি যেয়ো না। সেই মূঢ়তা ঘুচেছে জেনে আমি খুশীই হলুম। মনে করেছিলে শুনে বুঝি বড় কষ্ট পাবো, কিন্তু তা নয়। যার যা স্বাভাবিক নয় তা না করলে আমি দুঃখ বোধ করিনে। তোমার ত মনে আছে আমি কিসের ধ্যান করি তুমি জানতে চাইলে আমি চুপ করে ছিলুম। বলতে বাধা ছিল বলে নয়, অকারণ বলে। কিন্তু এ-সব কথাবার্তা এখন থাক। তোমার বোম্বায়ে ফিরে যাবার কি কোন দিন স্থির হলো?

অভিমানে বন্দনার মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল, বিপ্রদাসের প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলিল, না।

সেদিন তোমার মাসীর ভাইপো অশোকের কথা বলেছিলে। বলেছিলে ছেলেটিকে তোমার ভালই লেগেছে। এ কয়দিনে তার সম্বন্ধে আর কিছু কি জানতে পারলে?

না।

তোমাদের বিয়েই যদি হয় আমি আশীর্বাদ করবো, কিন্তু মাসীর তাড়ায় যেন কিছু করে বসো না। তাঁর তাগাদাকে একটু সামলে চলো।

বন্দনার চোখে জল আসিয়া পড়িল, কিন্তু মুখ নিচু করিয়া সামলাইয়া বলিল, আচ্ছা।

বিপ্রদাস বলিল, আমি পরশু বাড়ি যাব। দু-তিন দিনের বেশি থাকতে পারবো না। ফিরে আসার পরেও যদি কলিকাতায় থাকো একবার এসো।

বন্দনা মুখ নীচু করিয়াই ছিল, মাথা নাড়িয়া কি একটা জবাব দিল তাহার স্পষ্ট অর্থ বুঝা গেল না।

বিপ্রদাস কহিল, শুনলে ত আমার ছুটি মঞ্জুর হলো, এখন থেকে সব ভার দ্বিজুর। সংসারের ঘানিতে বাবা আমাকে ছেলেবেলাতেই জুড়ে দিয়েছিলেন, কখনো অবকাশ পাইনি কোথাও যাবার। আজ মনে হচ্চে যেন নিশ্বাস ফেলে বাঁচবো।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়