বিপ্রদাস বলিল, তোমার মনের মধ্যে যে ঝড় বইচে তার ভয়ানক বেগের সঙ্গে আমি চলতে পারবো কেন বন্দনা, কাজেই চুপ করে আছি।
বন্দনা বলিল, না সে হবে না, এমন করে এড়িয়ে যেতে আপনাকে আমি দেবো না। জবাব দিন।
কিন্তু শান্ত না হলে জবাব দিয়ে লাভ কি? তোমার আজকের অবস্থা যে স্বাভাবিক নয় এ কথা তুমি বুঝতে পারবে কেন?
কেন পারবো না মুখুয্যেমশাই, বুদ্ধি ত আমার যায়নি।
যায়নি কিন্তু ঘুলিয়ে আছে। এখন থাক। সন্ধ্যের পরে সমস্ত কাজকর্ম সেরে আমার কাছে এসে যখন স্থির হয়ে বসবে তখন বলবো। পারি তখনি এর জবাব দেবো।
তবে সেই ভালো, এখন আমারও যে সময় নেই—এই বলিয়া বন্দনা বাহির হইয়া গেল। বস্তুতঃ, তাহার কাজের অবধি নাই। সকালে ছুটি লইয়া অন্নদা কালীঘাটে গেছে, সে কাজগুলাও আজ তাহারই কাঁধে পড়িয়াছে। কত চাকর-বাকর, কত ছেলে এখানে থাকিয়া স্কুল-কলেজে পড়ে,—তাহাদের কত রকমের প্রয়োজন। কাজের ভিড়ে তাহার মনেও পড়িল না সে সারারাত্রি ঘুমায় নাই, সে আজ ভারী ক্লান্ত।
সন্ধ্যার পরে বিপ্রদাসের রাত্রির খাওয়া সাঙ্গ হইল, নীচের সমস্ত ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করিয়া বন্দনা তাহার শয্যার কাছে আসিয়া একটা চৌকি টানিয়া বসিল, বলিল, মুখুয্যেমশাই, একটা কথার সত্যি জবাব দেবেন?
বিপ্রদাস বলিল, সচরাচর তাই ত দিয়ে থাকি। প্রশ্নটা কি?
বন্দনা বলিল, মেজদিদিকে আপনি কি সত্যিই ভালবাসেন? ছেলেবেলায় আপনাদের বিয়ে হয়েছে—সে কতদিনের কথা—কখনো কি এর অন্যথা ঘটেনি?
বিপ্রদাস অবাক হইয়া গেল। এমন কথা যে কাহারও মনে আসিতে পারে সে কল্পনাও করে নাই। কিন্তু আপনাকে সামলাইয়া লইয়া সহাস্যে কহিল, তোমার মেজদিদিকেই বরঞ্চ এ প্রশ্ন জিজ্ঞেসা করো।
বন্দনা বলিল, তিনি জানবেন কি করে? আপনার আসল মনের কথা ত শুনেচি কেউ জানতে পারে না। না বলতে চান বলবেন না, আমি এরকম করে বুঝে নেবো, কিন্তু বললে সত্যি কথাই আপনাকে বলতে হবে।
সত্যি কথাই বলবো, কিন্তু আমাকে কি তোমার সন্দেহ হয়?
হয়। আপনি অনেক বড় মানুষ, কিন্তু তবুও মানুষ। মনে হয় কোথায় যেন আপনি ভারী একলা, সেখানে আপনার কেউ সঙ্গী নেই। এ কথা কি সত্যি নয়?
বিপ্রদাস এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিল না, বলিল, স্ত্রীকে ভালবাসা যে আমার ধর্ম বন্দনা।
বন্দনা বলিল, ধর্ম যতদূর প্রসারিত ততদূর আপনি খাঁটি, কিন্তু তার চেয়েও বড় কি সংসারে কিছু নেই?
দেখতে ত পাইনে বন্দনা।
বন্দনা বলিল, আমি দেখতে পাই মুখুয্যেমশাই। বলবো সে কথা?
বিপ্রদাসের মুখ সহসা যেন পাণ্ডুর হইয়া উঠিল,—বলিষ্ঠ গৌরবর্ণ মুখে যেন রক্তের লেশ নাই, দুই হাত সম্মুখে বাড়াইয়া বলিল, না, একটি কথাও নয় বন্দনা। আজ তোমার ঘরে যাও,—কাল হোক, পরশু হোক,—আবার যখন প্রকৃতিস্থ হয়ে আলোচনার বুদ্ধি ফিরে পাবে তখন এর জবাব দেবো। কিংবা হয়তো আপনিই তখন বুঝবে, ঐ যারা তোমার মাসীর বাড়িতে বুদ্ধিকে তোমার আচ্ছন্ন করেছে তারাই সব নয়। ধর্ম যাদের কাছে অত্যাজ্য তারাও আছে, জগতে তারাও বাস করে। না না, আর তর্ক নয়,—তুমি যাও।
বন্দনা বুঝিল, এ আদেশ অবহেলার নয়। এই হয়ত সেই বস্তু যাহাকে বাড়িসুদ্ধ সকলে ভয় করে। বন্দনা নিঃশব্দে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 18 Page: 85
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 158