দয়াময়ী বলিলেন, সে হয়ত সত্যি, কিন্তু ওর বিয়ের ব্যাপারটা শুনলে তোরই কি ঘেন্না হয় না বিপিন? তুই বলিস কি বল ত!

বিপ্রদাস স্মিতমুখে কহিল, তার বিয়ে এখনো হয়নি, কিন্তু হলেও আমার রাগ করা উচিত নয় মা। বরঞ্চ এই ভেবে শ্রদ্ধাই করবো যে ওদের বিশ্বাস সত্য কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেলে, ওরা ঠকালে না কাউকে। কিন্তু কলকাতায় অনেককে দেখেচি যারা বাক্যের আড়ম্বরে মানে না কিছুই, জাতিভেদ বিশ্বাসও করে না, গালও দেয় প্রচুর, কিন্তু কাজের বেলাতেই গা ঢাকা দেয়,—আর তাদের খুঁজে মেলে না। তাদেরই অশ্রদ্ধা করি আমি সবচেয়ে বেশি। রাগ করো না মা, তোমার দ্বিজুটি হলো এই জাতের।

শুনিয়া দয়াময়ী মনে মনে যে অখুশী হইলেন তা নয়। দ্বিজুর সম্বন্ধে বলিলেন, ওটা ঐ রকম ফাঁকিবাজ। কিন্তু, আচ্ছা বিপিন, বন্দনাকে যদি তুই ঘৃণাই করিস নে, তবে তার ছোঁয়া কিছু খাসনে কেন? ওকে রান্নাঘরে পাঠাতুম বলে তুই সে-ঘরে খাওয়াই ছেড়ে দিলি, খেতে লাগলি আমার ঘরে। আর কেউ না বুঝুক, আমিও বুঝতে পারিনি ভাবিস?

বিপ্রদাস বলিল, তুমি বুঝবে না ত মা হয়েছিলে কেন? কিন্তু আমি যে সত্যিই জাত মানি মা, আমি ত তার ছোঁয়া খেতে পারিনে। যেদিন মানবো না সেদিন প্রকাশ্যেই তার হাতে খাবো, একটুও লুকোচুরি করবো না!

দয়াময়ী বলিলেন, তুই জানিস নে বিপিনি, কি করে আমি তার কাছ থেকে এইটি ঢেকে বেড়াতুম। মেয়েটা এখানে আসুক না আসুক, দেখিস যেন একথা কখনো সে টের না পায়। তার ভারী লাগবে। তোকে সে বড় ভক্তি করে। তাঁহার শেষের কথাগুলি যেন সহসা স্নেহরসে আর্দ্র হইয়া উঠিল।

বিপ্রদাস হাসিয়া কহিল, আমাকে সে ভক্তি করে কিনা জানিনে মা, কিন্তু তার ছোঁয়া যে খাইনে এ সে জানে।

অমন অভিমানী মেয়ে এ জেনেও তোকে অত ভক্তি করতো? তার মানে?

ভক্তি করার কথা তোমরাই জানো মা, কিন্তু আমি জানি সে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, তোমাদের সমস্ত ঢাকাঢাকিই সেখানে নিষ্ফল হয়েছে।

দয়াময়ী ক্ষণকাল নীরবে কি ভাবিলেন, তার পরে বলিলেন, তাই বুঝি সে অতো করে পীড়াপীড়ি করতো?

কিসের পীড়াপীড়ি মা?

দয়াময়ী বলিতে লাগিলেন, আমি বিধবা মানুষ, আমার ভাতে-ভাত হলেই চলে, কিন্তু সে তা কিছুতে দেবে না। মার্কেট থেকে নানা নতুন তরকারি আনাবে, নিজে কুটে বেছে দেবে, বামুনপিসিকে দিয়ে দশখানা তরকারি জোর করে রাঁধিয়ে নিয়ে তবে ছাড়বে। ও জানতো সামনে এসে যার দেওয়া চলে না তাকে পরের হাত দিয়ে ঘুষ পাঠাতে হয়। কেন, খেয়েও কি বুঝতে পারিস নি বিপিন, অমন রান্না পিসি তার বাপের জন্মেও রাঁধতে জানে না?

বিপ্রদাস সহাস্যে উত্তর দিল, না মা, অত লক্ষ্য করিনি। শুধু মাঝে মাঝে সন্দেহ হতো তোমার অতিথিদের সে-রান্নাঘরের বিপুল আয়োজনের টুকরা-টাকরা হয়ত আমাদের এ-রান্নাঘরেও ছিটকে এসে পড়েছে। কিন্তু সে যে দৈবকৃত নয় একজনের ইচ্ছাকৃত এ খবর আনন্দের। কিন্তু তোমার শেষ আদেশ জানিয়ে দাও মা। ট্রেনের সময় হয়ে এলো, আমাকে এখনি ছুটতে হবে,—তার নিমন্ত্রণ তুমি রাখলে, না প্রত্যাহার করলে তাই বলো।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়