গ্রামের সবাই শুনিল, সবাই বিশ্বাস করিল, বিরাজবৌ জলে ডুবিয়া মরিয়াছে; বিশ্বাস করিল না শুধু ধূর্ত পীতাম্বর। সে মনে মনে তর্ক করিতে লাগিল, এই নদীতে এত বাঁক, এত ঝোপঝাড়, মৃতদেহ কোথাও-না-কোথাও আটকাইবে। নদীতে নৌকা লইয়া, ধারে ধারে বেড়াইয়া, তটভূমের সমস্ত বন-জঙ্গল লোক দিয়া তন্ন তন্ন অনুসন্ধান করিয়াও যখন শবের কোন চিহ্নই পাওয়া গেল না, তখন তাহার নিশ্চয় বিশ্বাস হইল, বৌঠান আর যাই করুক, নদীতে ডুবিয়া মরে নাই। কিছুকাল পূর্বে একটা সন্দেহ তাহার মনে উঠিয়াছিল, আবার সেই সন্দেহটাই মনের মধ্যে পাক খাইতে লাগিল। অথচ কাহারো কাছে বলিবার জো নাই। একবার মোহিনীকে বলিতে গিয়াছিল, সে জিভ কাটিয়া কানে আঙুল দিয়া পিছাইয়া দাঁড়াইয়া বলিল, তা হলে ঠাকুর-দেবতাও মিছে, রাতও মিছে, দিনও মিছে। দেয়ালে টাঙানো অন্নপূর্ণার ছবির দিকে চাহিয়া বলিল, দিদি ওঁর অংশ ছিলেন। এ কথা আর কেউ জানুক আর না জানুক, আমি জানি, বলিয়া চলিয়া গেল।

পীতাম্বর রাগ করিল না—হঠাৎ সে যেন আলাদা মানুষ হইয়া গিয়াছিল।

মোহিনী ভাসুরের সহিত কথা কহিতে শুরু করিয়াছে। ভাত বাড়িয়া দিয়া একটুখানি আড়ালে বসিয়া একটু একটু করিয়া সমস্ত ঘটনা শুনিয়া লইল। সমস্ত সংসারের মাঝে শুধু সেই জানিল কি ঘটিয়াছিল, শুধু সেই বুঝিল, কি মর্মান্তিক ব্যথা ওঁর বুকে বিঁধিয়া রহিল।

নীলাম্বর বলিল, মা, যত দোষই করে থাকি না কেন, জ্ঞানে ত করিনি, তবে কি করে মায়া কাটিয়ে চলে গেল? আর সইতে পারছিল না, তাই কি গেল মা?

মোহিনী অনেক কথা জানিত। একবার ইচ্ছা হইল বলে, দিদি যাবে বলিয়াই একদিন স্বামীর ভার তাহার উপর দিয়াছিল; কিন্তু চুপ করিয়া রহিল।

পীতাম্বর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি দাদার সঙ্গে কথা কও?

মোহিনী জবাব দিল, বাবা বলি, তাই কথা কই।

পীতাম্বর হাসিয়া বলিল, কিন্তু লোকে শুনলে নিন্দে করবে যে!

মোহিনী রুষ্টভাবে বলিল, লোকে আর কি পারে যে করবে? তাদের কাজ তারা করুক, আমার কাজ আমি করি। এ যাত্রা ওঁকে যদি বাঁচিয়ে তুলতে পারি ত লোকের নিন্দে আমি মাথায় পেতে নেব।—বলিয়া কাজে চলিয়া গেল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়