সন্ধ্যা হইল, এ বাড়িতে কেহ দীপ জ্বালিল না; রাত্রি হইল, রান্নাঘরে কেহ রাঁধিতে প্রবেশ করিল না; কাঁদিয়া কাঁদিয়া তাহার চোখ-মুখ ফুলিয়া গেল, কেহ মুছাইয়া দিল না। দুদিনের উপবাসীকে কেহ খাইতে ডাকিল না। বাহিরে চাপিয়া বৃষ্টি আসিল, ঘনান্ধকার বিদীর্ণ করিয়া বিদ্যুতের শিখা তাহার মুদ্রিত চক্ষুর ভিতর পর্যন্ত উদ্ভাসিত করিয়া দুর্যোগের বার্তা জানাইয়া যাইতে লাগিল; তথাপি সে উঠিয়া বসিল না, চোখ মেলিল না, একভাবে মুখ গুঁজিয়া গোঁ গোঁ করিতে লাগিল।

যখন তার ঘুম ভাঙ্গিল তখন সকাল। বাহিরের দিকে একটা অস্পষ্ট কোলাহল শুনিয়া ছুটিয়া আসিয়া দেখিল, দরজায় একটা গো-শকট দাঁড়াইয়া আছে, ব্যস্ত হইয়া সম্মুখে দাঁড়াইতেই ছোটবৌ ঘোমটা টানিয়া দিয়া নামিয়া পড়িল। অগ্রজের প্রতি একটা বক্র কটাক্ষ করিয়া পীতাম্বর ওধারে সরিয়া গেল। ছোটবৌ কাছে আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেই নীলাম্বর অস্ফুটস্বরে কি-একটা আশীর্বাদ উচ্চারণ করিতে গিয়া হুহু করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। বিস্মিত ছোটবৌ হেঁট মাথা তুলিতে সে দ্রুতপদে কোন্‌ দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল।

ছোটবৌ জীবনে আজ প্রথম স্বামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিয়া বাঁকিয়া দাঁড়াইল। অশ্রুভারাক্রান্ত রক্তাক্ত চোখ দুটি তুলিয়া বলিল, তুমি কি পাথর দিয়ে তৈরি? দুঃখ-কষ্টে দিদি আত্মঘাতী হলেন, তবুও আমরা পর হয়ে থাকব? তুমি থাকতে পার থাক গে, আমি আজ থেকে ও-বাড়ির সব কাজ করব।

পীতাম্বর চমকাইয়া উঠিল—সে কি কথা!

মোহিনী তুলসীর কাছে যতটুকু শুনিয়াছিল এবং নিজে যাহা অনুমান করিয়াছিল, কাঁদিতে কাঁদিতে সমস্ত কহিল।

পীতাম্বর সহজে বিশ্বাস করিবার লোক নয়। কহিল, তাঁর দেহ ভেসে উঠবে ত!

ছোটবৌ চোখ মুছিয়া বলিল, না উঠতেও পারে। স্রোতে ভেসে গেছেন, সতী-লক্ষ্মীর দেহ মা গঙ্গা হয়ত বুকে তুলে নিয়েচেন। তা ছাড়া কে বা সন্ধান করচে , কে বা খুঁজে বেড়িয়েচে বল?

পীতাম্বর প্রথমটা বিশ্বাস করিল না, শেষটা করিল; বলিল, আচ্ছা, আমি খোঁজ করাচ্চি। একটু ভাবিয়া বলিল, বৌঠান মামার বাড়ি চলে যায়নি ত?

মোহিনী মাথা নাড়িয়া বলিল, কখ্‌খনো না। দিদি বড় অভিমানী, তিনি কোথাও যাননি, নদীতেই প্রাণ দিয়েচেন।

আচ্ছা, তাও দেখচি, বলিয়া পীতাম্বর শুষ্কমুখে বাহিরে চলিয়া গেল। বৌঠানের জন্য আজ হঠাৎ তাহার প্রাণটা খারাপ হইয়া গেল। লোকজন নিযুক্ত করিয়া একজন প্রজাকে বিরাজের মামার বাড়ি পাঠাইয়া জীবনে আজ প্রথম পুণ্যের কাজ করিল। স্ত্রীকে ডাকিয়া বলিল, যদুকে দিয়ে উঠানের বেড়াটা ভাঙ্গিয়ে দাও, আর যা পার কর। দাদার মুখের পানে চাইতে পারা যায় না, - বলিয়া গুড় মুখে দিয়া একটু জল খাইয়া দপ্তর বগলে করিয়া কাজে চলিয়া গেল। চাঁর-পাঁচ দিন কামাই হওয়ায় তাহার অনেক ক্ষতি হইয়াছিল।

কাজ করিতে করিতে ছোটবৌ ক্রমাগত চোখ মুছিতে মুছিতে ভাবিতেছিল , ইনি যে মুখের পানে চাহিতে পারেন নাই, সে মুখ না জানি কি হইয়া গিয়াছে!

নীলাম্বর চন্ডীমণ্ডপের মাঝখানে চোখ বুজিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিল। সুমুখের দেয়ালে টাঙ্গান রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির পট। এই পটখানি নাকি জাগ্রত। যখন রেলগাড়ি হয় নাই, তখন তাহাদের পিতামহ পায়ে হাঁটিয়া এখানি বৃন্দাবন হইতে আনিয়াছিলেন। তিনি পরম বৈষ্ণব ছিলেন, তাঁহার সহিত পটখানি মানুষের গলায় কথা কহিত, এ ইতিহাস নীলাম্বর তাহার জননীর কাছে বহুবার শুনিয়াছিল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়