ছয়

এক বৎসর কাটিয়াছে। এ বৎসর দুই আনা ফসলও পাওয়া যায় নাই। যে জমিগুলা হইতেই প্রায় সারা বছরের ভরণপোষণ চলিত, তাহার অনেকটাই ও-পাড়ার মুখুয্যেমশাই কিনিয়া লইয়াছেন। ভদ্রাসন পর্যন্ত বাঁধা পড়িয়াছে, ছোটভাই পীতাম্বর তাহা গোপনে নিজের নামে ফিরাইয়া লইয়াছে—তাহাও জানাজানি হইয়াছে। হালের একটা গরু মরিয়াছে। পুকুর রোদে ফাটিতেছে—বিরাজ কোনদিকে চাহিয়া আর কূলকিনারা দেখিতে পাইল না। দেহের কোন একটা স্থান বহুক্ষণ পর্যন্ত বাঁধিয়া রাখিলে একটা অসহ্য অব্যক্ত মন্দ যাতনায় সর্বদেহটা যেরকম করিয়া ধীরে ধীরে অবসন্ন হইয়া আসিতে থাকে, সমস্ত সংসারের সহিত সম্বন্ধটা তাহার তেমনই হইয়া আসিতে লাগিল। আগে সে যখন তখন হাসিত, কথায় কথায় ছল ধরিয়া পরিহাস করিত, কিন্তু এখন বাড়ির মধ্যে এমন একটি লোক নাই যে সে কথা কহে। অথচ কেহ দেখা করিতে আসিলে, সংবাদ লইতে আসিলেও সে ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হয়। অভিমানী প্রকৃতি তাহার, পাড়ার লোকের একটা কথাতেও বিদ্রোহী হইয়া উঠে। সংসারের কাজে তাহার যে আর লেশমাত্র উৎসাহ নাই, তাহা তাহার কাজের দিকে চোখ ফিরাইলেই চোখে পড়ে। তাহার ঘরের শয্যা মলিন, কাপড়ের আলনা অগোছান, জিনিসপত্র অপরিচ্ছন্ন—সে ঝাঁট দিয়া ঘরের কোণে জঞ্জাল জড় করিয়া রাখে—তুলিয়া ফেলিয়া দিবার মত জোরও সে যেন নিজ়ের দেহের মধ্যে আর খুঁজিয়া পায় না। এমনি করিয়া দিন কাটিতেছিল। ইতিমধ্যে নীলাম্বর ছোটবোন হরিমতিকে দুইবার আনিবার চেষ্টা করিয়াছে। তাহারা পাঠায় নাই। দিন-পনর হইল একখানা চিঠি লিখিয়াছিল, হরিমতির শ্বশুর তাহার জবাব পর্যন্ত দেয় নাই। কিন্তু বিরাজের কাছে তাহার নামটি পর্যন্ত করিবার জো নাই। সে একেবারে আগুনের মত জ্বলিয়া উঠে। পুঁটিকে মানুষ করিয়াছে, মায়ের মত ভালবাসিয়াছে, কিন্তু তাহার সমস্ত সংস্রব পর্যন্ত আজকাল তাহার কাছে বিষ হইয়া গিয়াছে।

আজ সকালে নীলাম্বর গ্রামের পোস্ট আপিস হইতে ঘুরিয়া আসিয়া বিমর্ষমুখে ঘরে ঢুকিয়া বলিল, পুঁটির শ্বশুর একটা জবাব পর্যন্ত দিলে না—এ পূজ়াতেও বোধ করি বোনটিকে একবার দেখতে পেলেম না।

বিরাজ কাজ করিতে করিতে একধার মুখ তুলিল। কি একটা বলিতে গেল, কিন্তু কিছুই না বলিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল।

সেইদিন দুপুরবেলা আহারে বসিয়া নীলাম্বর আস্তে আস্তে বলিল, তার নাম করলেও তুমি জ্বলে ওঠ—সে কি কোন দোষ করেছে?

বিরাজ অদূরেই বসিয়া ছিল, চোখ তুলিয়া বলিল, জ্বলে উঠি কে বললে?

কে বলবে, আমি নিজেই টের পাই।

বিরাজ ক্ষণকাল স্বামীর মুখাপানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, পেলেই ভাল। বলিয়া উঠিয়া যাইতেছিল, নীলাম্বর
ডাকিয়া বলিল, আচ্ছা, আজকাল এমন হয়ে উঠচ কেন? এ যেন একেবারে বদলে গেছ।

বিরাজ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কথাটা মন দিয়া শুনিয়া বলিল, বদলালেই বদলাতে হয়, বলিয়া বাহির হইয়া গেল।

ইহার দুই-তিন দিন পরে অপরাহ্নবেলায় নীলাম্বর বাহিরের চন্ডীমণ্ডপে একা বসিয়া গুন্‌গুন্‌ করিয়া গান গাহিতেছিল, বিরাজ পিছনে আসিয়া কিছুক্ষন নিঃশব্দে থাকিয়া সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

নীলাম্বর মুখ তুলিয়া বলিল, কি?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়