শুভদা আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না।

পরদিন দুপুরবেলা কৃষ্ণপ্রিয়া আবার আসিলেন। নানা কথাবার্তার পর বলিলেন, বৌ, সেকথা জিজ্ঞাসা করেছিলি?

হাঁ।

কি বললে?

বললেন যে, গাছতলায় ছিলাম।

আবার অন্যান্য কথাবার্তা চলিতে লাগিল। উঠিবার সময় কৃষ্ণপ্রিয়া কাপড়ের নীচ হইতে দু’খানা থান কাপড় বাহির করিয়া বলিলেন, ঘরে ছিল তাই নিয়ে এলাম। হারাণকে পরতে দিস।

শুভদা তাহা হাত পাতিয়া গ্রহণ করিল।

কৃষ্ণপ্রিয়া কিছুক্ষণ তাহার মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া ঈষৎ মৃদুস্বরে বলিলেন, দেখ বৌ, হারাণ যদি জিজ্ঞাসা করে, কে দিয়েচে, তা হলে আর কারো নাম করিস। আমার নাম করিস নে।

শুভদা ঈষৎ হাসিয়া বলিল, কেন?

কৃষ্ণপ্রিয়া ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, না অমনি।

আর যদি নাম করি?

এবার কৃষ্ণপ্রিয়াও সহাস্যে বলিলেন, তা হলে তোর কেষ্টঠাকুরঝির মাথা খাবি।

আবার একদিন–দুইদিন করিয়া দিন কাটিতে লাগিল। হারাণচন্দ্র এবার আসিয়া অবধি আর বাটীর বাহির হন না। শুভদার সে পক্ষে কিছু ভয় দূর হইয়াছে; কিছু দুর্ভাবনা দূর হইয়াছে, কিন্তু সংসার চলে কিরূপে? দুর্ভাবনার মূল হইয়াছে এইখানেই। কে একদিন একটাকা দান করিল, কে আর–একদিন দুই টাকা ভিক্ষা দিল, এমন করিয়া কি একটা পরিবার প্রতিপালিত হয়? ভাবনার কথা কি শুধু ইহাই? মাধবের মুখ দেখিলে ত শরীরের অর্ধেক রক্ত জল হইয়া যায়; তাহার উপর ছলনা। সে দিন দিন বাড়িয়া উঠিতেছে; বিবাহের বয়স হইয়াছে, এমন কি দুই–চারি মাসের মধ্যে হয়ত সে–বয়স উত্তীর্ণ হইয়াও যাইতে পারে। এদিকে চাহিলে শুভদা আর কূলকিনারা দেখিতে পায় না। মাধবের নিকট পার আছে, কিন্তু বাঙ্গালীর ঘরে ছলনার নিকট পার নাই। তাহার মুখ দেখিলে রক্ত জল হইয়া যায়, কিন্তু ইহার মুখ দেখিলে শরীরের অস্থিপঞ্জর পর্যন্ত তরল হইয়া পড়িবার উপক্রম করে। দুর্ভাবনায় দুর্ভাবনায় শুভদা যে প্রতিদিন শুকাইয়া যাইতেছে, তাহা আর কেহ না দেখিতে পাইলেও ললনা দেখিতে পাইত। গঙ্গার ঘাট হইতে এক কলসী জল আনিতে জননী যে হাঁপাইতে থাকেন, ললনা তাহা দেখিতে পাইত; তরকারি কুটিবার সময় আলু–পটলের খোসা ছাড়াইতে গিয়া হাত আটকাইয়া বাধিয়া যায়, ললনা তাহা জানিতে পারিত; গ্রামে শুভদার মত কেহ সুপারি কাটিতে পারিত না, সেই শুভদার সুপারি কাটা আজকাল সরু–মোটা হইয়া যায়,

ললনা তাহা বুঝিতে পারিত; আহার কমিয়া গিয়াছে, দুইবেলার পরিবর্তে আজকাল বেলা চারিটার সময় একবার দাঁড়াইয়াছে; পীড়াপীড়ি করিলে বলে আদতে ক্ষুধা নাই। ললনা এসব দেখিত আর লুকাইয়া চক্ষু মুছিত; কখন কখন ঘরে দ্বার দিয়া মাথা কুটিত। ইহাতে ফল হইবার হইলে হইতে পারিত, কিন্তু জগতে তাহা হয় না।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়