চতুর্থ পরিচ্ছেদ

রামমণি ও দুর্গামণি নাম না রাখিয়া যে শুভদা কন্যা দুইটির নাম ললনা ও ছলনা রাখিয়াছিল, তাহাতে ঠাকুরঝি রাসমণির আর মনস্তাপের অবধি ছিল না।

বাজারের তাদের মত ললনা ছলনা নাম দুটা অষ্টপ্রহর তাঁর কর্ণে বিঁধিতে থাকিত। ললনা নামটা তবু কতক মাফিকসই; কিন্তু ছিঃ—ছলনা আবার কি নাম ! ছলনাকে না দেখিতে পারার কারণ অর্ধেক তার ঐ নামটা। লোকে ঠাকুরদের নামে ছেলেমেয়ের নাম রাখে ; কেননা, তাদের ডাকিতেও ভগবানের নাম করা হয়, কিন্তু এ দুটো মেয়েকে ডাকলে যেন পাপের ভার একটু একটু করে বাড়ছে মনে হয়।

ললনাময়ী, ছলনাময়ী হারাণবাবুরই দুই কন্যা। একজন বড়, একজন ছোট; একজন সপ্তদশবর্ষীয়া, একজন একাদশবর্ষীয়া; একজন বিধবা, একজন অনূঢ়া।

এই ত গেল পরিচয়ের কথা। এখন রূপ-গুণের কথা, তাহা আমি বলিতে পারিব না। তবে গঙ্গার ঘাটে ললনা স্নান করিতে যাইলে বর্ষীয়সীরা বলাবলি করিতেন, ঠাকুর বিধবা করিবেন বলেই ছুঁড়ির এত রূপ দিয়েছিলেন ! ললনা অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া ডুব দিতে থাকিত। সমবয়স্কারা কানাকানি করিত। কি বলিত তাহারাই জানে, তবে ভাবে বোধ হয় বিশেষ প্রশংসা করিত না। ললনার তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না। সে বেশি কথাও কহিত না, বেশি কথায় থাকিতও না—দুই-চারিটা কথা কহিত, স্নান করিত, জল লইত—উঠিয়া বাটী চলিয়া আসিত। কিন্তু ছলনার স্বতন্ত্র কথা। সে অধিক কথা কহিতে ভালবাসিত, অধিক কথায় থাকিতে ভালবাসিত, আটটার সময় স্নান করিতে গিয়া এগারটার কম বাটী ফিরিয়া আসিত না, গায়ে গহনা নাই বলিয়া মুখ ভারী করিত, মোটা চালের ভাত খাওয়া যায় না বলিয়া কলহ করিত, পাতে মাছ নাই কেন বলিয়া থালাসুদ্ধ ঠেলিয়া ফেলিয়া দিত; এইরূপে দিনের মধ্যে শতসহস্র কাজ করিত। তাহারও শরীরে রূপ ধরে না। তপ্ত কাঞ্চনের মত বর্ণ, গোলাপপুষ্পের মত মুখখানি। তাহাতে ভ্রূদুটি যেন তুলি দিয়া চিত্রিত করা, পাতলা দুখানি ঠোঁট পান খাইয়া লাল করিয়া দর্পণ লইয়া নির্জনে ছলনাময়ী আপনার রূপ দেখিয়া আপনি গৌরবে ভরিয়া উঠিত।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়