ললনা মৃদু হাসিয়া বলিল, আমিও সুখে থাকব বোন—ঐ আমাকে মা ডাকছেন।
ললনা চলিয়া গেল। যথার্থই মা তখন ডাকিতেছিলেন। কাছে আসিয়া বলিল, কেন মা?
তোমার বাবা এসেচেন, ঐ ঘরে—
কথা শেষ হইবার পূর্বেই ললনা চলিয়া গিয়াছে।
আহার করিতে বসিলে রাসমণি জিজ্ঞাসা করিলেন, এতদিন কোথায় ছিলে?
মুখে গ্রাস তুলিয়া হারাণবাবু গম্ভীরভাবে বলিলেন, সে অনেক কথা!
রাসমণি মুখব্যাদান করিলেন, অনেক কথা কি রে?
সে গ্রাস গলাধঃকরণ করিয়া হারাণবাবু পূর্বমত গম্ভীরমুখেই বলিলেন, অনেক কথা এই যে, মাথার উপর দিয়ে প্রলয়ের ঝড় বয়ে গিয়েছে।
রাসমণির বিস্ময়ের সীমা নাই, ভাবনার শেষ নাই; প্রায় রুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, খুলেই বল হারাণ।
হারাণ গম্ভীরমুখে ঈষৎ হাস্য প্রকাশ করিয়া কহিল, নষ্টচন্দ্রের কলঙ্কের কথা জান? আমার তাই হয়েছিল। চুরি করেছি বলে নন্দীরা আমাকে—না, আমার নামে নালিশ করেছিল।
নালিশ করেছিল?
হাঁ, নালিশ করেছিল; কিন্তু মিছে কথা কতক্ষণ থাকে? কিছুই প্রমাণ হ’ল না—আজ মকদ্দমা জিতে তাই বাড়ি আসচি।

ঘোমটার অন্তরালে শুভদা চক্ষু মুছিল। রাসমণি নন্দীদের বহু মঙ্গল কামনা করিলেন, তাহাদিগকে সগোষ্ঠী মুক্তি দিবার জন্য দুর্গার চরণে অনুযোগ করিলেন; তাহার পর বলিলেন, কিন্তু ওরা চাকরিতে তোকে আর রাখবে কি?

হারাণবাবু চক্ষু রক্তবর্ণ করিলেন—চাকরিতে রাখবে? আমি করলে তবে ত রাখবে? হারামজাদা ভগবান নন্দীর এজন্মে আমি আর মুখ দেখব? যদি বেঁচে থাকি ত প্রতিশোধ নেব—আমাকে যেমন অপমান করেচে, তার শোধ তুলবই তুলব!

রাসমণি কিছুক্ষণ ভয়বিস্মিত চক্ষে বীর ভ্রাতার পানে চাহিয়া থাকিয়া মৃদু মৃদু বলিলেন, তাহলে কিন্তু খরচপত্রের—
সে ভাবনা ভেব না দিদি—বেটাছেলে, আমার ভাবনা কি? কালই আর এক জায়গায় চাকরি জুটিয়ে নেব।
হারাণবাবুর কথা যে রাসমণি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিলেন, তাহা নহে, তথাপি কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইলেন। সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করা অপেক্ষা কিঞ্চিৎ বিশ্বাস করিয়া এ দারুণ দুর্ভাবনার হাত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিতে এসময়ে সকলেরই ইচ্ছা হয়। রাসমণিও তাহাই করিলেন। মনকে প্রবোধ দিলেন, হয়ত সে যাহা বলিতেছে তাহাই করিবে; এ বিপদের সময়ও অন্ততঃ চক্ষু ফুটিবে। কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া কহিলেন, যা ভাল হয় তাই করিস— নাহলে, অসুখ-বিসুখ, কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে বিপদের সীমা-পরিসীমা থাকবে না।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়