ললনা কলসী কাঁকালে গঙ্গার ঘাটে আসিল। জল লইয়া দুই পদ অগ্রসর হইতে না হইতেই মেঘ হইতে বড় বড় ফোঁটা জল পড়িতে লাগিল। ললনা হনহন করিয়া পথ বাহিয়া চলিতে লাগিল। আসিবার পথেই সদানন্দর বাটী; পথের ধারের আটচালাঘরের বারান্দায় বসিয়া সে তখন রামপ্রসাদী সুরে কালীনাম গাহিতেছিল। ললনাকে দেখিয়া সে গান থামাইয়া বলিল, ললনা, ভিজচ কেন?
ললনা ঈষৎ হাসিয়া বলিল, তুমি গান থামালে কেন?
সদানন্দও হাসিল; হাসি গান তাহার মুখে অষ্টপ্রহর লাগিয়াই আছে। সুর করিয়া বলিল, গান থামিয়া গেছে ; তাহার পর স্বাভাবিক স্বরে কহিল, সেকথা যাক, মিছামিছি ভিজো না, এইখানে একটু দাঁড়াও।
ললনা বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল।
সদানন্দ তাহার মুখপানে কিছুক্ষণ চাহিয়া বলিল, দাঁড়িও না, বাড়ি যাও।
সে কি?
পিসিমা বাড়ি নাই, বেশি জল আসিলে যাইবে কেমন করিয়া?
ললনা ভাবিল, সেকথাও বটে; দুই পদ অগ্রসর হইয়া আবার পিছাইয়া আসিল।
সদানন্দ বলিল, ফিরিলে কেন?
কাল রাত্রে আমার জ্বর হয়েছিল, জলে ভিজলে অসুখ বাড়তে পারে।
তবে যেও না, এইখানে দাঁড়িয়ে থাক।
সদানন্দ তখন আপন মনে গান ধরিল—
কভু তারে পাব না বুঝি, মিছে হাত বাড়ায়ে দাঁড়ায়ে আছি।
কত জ্বালায় জ্বলে মরি, তুই কি জানবি পাষাণী মা!
আমার সোনার তরি ডুববে এবার—
ললনা কলসী নামাইয়া গান শুনিতেছিল; মিষ্ট গলায় মিষ্ট গান তাহার বড় ভাল লাগিতেছিল। হঠাৎ মাঝপথে থামিয়া যাওয়ায় বলিল, ওকি থামিলে যে?
আর গাইব না।
কেন?

আর মনে নাই।
ললনা মৃদু হাসিয়া বলিল, তবে গাইলে কেন?
আমি অমন গেয়ে থাকি। তাহার পর কিছুক্ষণ আকাশপানে চাহিয়া বলিল, মেঘের উপর পদ্ম ফোটে, তুমি দেখেচ?
ললনা সহাস্যে বলিল, কই না, তুমি দেখেচ?
হ্যাঁ দেখেচি। কবে দেখলে?
প্রায়ই দেখি।যখন আকাশে মেঘ হয় তখনই দেখতে পাই।
সদানন্দর গম্ভীর মুখশ্রী দেখিয়া ললনার হাসি আসিল। মুখে কাপড় দিয়া বলিল, তা কি হয়?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়