মা। তা জানি না।

সুরেন্দ্রনাথ কৃত্রিম গম্ভীর হইয়া বলিলেন, তুমি পূজা কর?

মা। করি।

সু। তবে তোমার বাড়িতে চন্দন আছে; চন্দন এনে আমাকে সাজিয়ে দাও—আজ আমার বিবাহ!

মা। কার সঙ্গে?

সু। আগে সাজাও, তার পরে শুনিও।

মালতী নীচে হইতে চন্দন ঘষিয়া আনিয়া বেশ করিয়া সাজাইয়া বলিল, এখন বল!

সু। তা কি এখনো বুঝিতে পারনি!

তাহার পর গলদেশ হইতে পুষ্পমালা খুলিয়া একটির পর একটি করিয়া তাহাকে পরাইলেন, মখমল-বাক্স হইতে নানাবিধ রত্নজড়িত অলঙ্কার বাহির করিয়া যথাস্থানে যথাক্রমে নিবেশ করিলেন—মালতী জন্মে কখন সেইরূপ দেখেন নাই, বিস্মিত হইয়া দেখিতে লাগিল—সব শেষ করিয়া মুখচুম্বন করিয়া বলিলেন, তোমাকে বিবাহ করিলাম, এতদিনে তুমি আমার স্ত্রী হইলে; আর কোথাও পালাতে পারবে না—যে মালা আজ পরাইলাম, জন্ম-জন্মান্তরে তা আর খুলিতে পারিবে না।

উভয়ের চক্ষেই জল আসিল, উভয়েই কিছুক্ষণ ধরিয়া কথা কহিতে পারিলেন না। তাহার পর অশ্রু মুছাইয়া সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, এখন বাড়ি চল—আপনার সংসার আপনি বুঝিয়া লও—আশীর্বাদ করি এ জীবনে চিরসুখী হও!

মালতী প্রণাম করিয়া পুনর্বার নিকটে উপবেশন করিল। চক্ষের জল আজ তাহার বড় বাড়িয়া উঠিয়াছে। শতবার মুছিল, শতবার চক্ষু তিতিয়া উঠিল—কিছুতেই নিবৃত্ত হইতেছে না। সুরেন্দ্রনাথ তাহা বুঝিলেন, বুঝিয়া বলিলেন, মালতী, আজ পিতা-মাতার কথা মনে হইতেছে?

মালতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ।

যাহা ইচ্ছা ছিল তাহাতে তুমি নিজেই বাদ সাধিলে। মনে করিয়াছিলাম, আর এমন করিয়া থাকিব না, তোমাকে যখন পাইয়াছি তখন প্রকাশ্যভাবে বিবাহ করিব, আর একবার সংসারী হইব। তোমার পিতা-মাতাকে এখানে আনিব—লোকে তখন যাই বলুক না কেন—আমি নিজে সুখী হইব। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, সে আশা এখন দুরাশা।

এখন বাড়ি যাইবে?

মালতী বলিল, কোথায়?

যে তোমার বাড়ি—যেখানে আমি থাকি।

এটা কি আমার বাড়ি নয়?

তবে কি সেখানে যাইবে না?

না।

আমিও ঠিক তাই ভাবিয়াছিলাম।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়