মালতী কক্ষে প্রবেশ করিয়া নিম্নমুখে একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া রহিল।

সুরেন্দ্রবাবু একখানা কাগজ লইয়া কি লিখিতেছিলেন, বোধ হয় কোথাও পত্র লিখিতে ছিলেন। মালতী আড়চক্ষে ভয়ে ভয়ে দেখিল তাঁহার সমস্ত মুখ অতিশয় ম্লান, চক্ষু রক্তবর্ণ হইয়া আছে, মাথার চুলগুলা নিতান্ত রুক্ষভাবে দাঁড়াইয়া আছে, বস্ত্রের স্থানে স্থানে এখনো কাদা লাগিয়া আছে, মালতী আপনা-আপনি শিহরিয়া উঠিল, তাহার বোধ হইল যেন নিতান্ত গর্হিত অপরাধে তাহাকে বিচারালয়ে আনয়ন করা হইয়াছে।

সুরেন্দ্রবাবু অর্ধলিখিত কাগজখানা পার্শ্বে রাখিয়া মুখ তুলিয়া তাহার পানে চাহিয়া বলিলেন, তোমার শরীর বেশ সুস্থ হইয়াছে কি?

মালতী অধোবদনে ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, হইয়াছে।

আমি আজি বজরা খুলিয়া দিব। পরপারে কলিকাতা— তোমার যেখানে ইচ্ছা চলিয়া যাইতে পার।

কথা শুনিয়া মালতীর চক্ষে জল আসিল, কোন কথা সে কহিল না।

সুরেন্দ্রবাবু পার্শ্বের কাগজখানা হাতে লইয়া বলিলেন, এখানে আমার একজন বন্ধু আছেন, এই পত্রখানা লইয়া সন্ধান করিয়া তাঁহার নিকট যাইও, তিনি তোমার কোনরূপ উপায় করিয়া দিবেন।

টপ্‌ করিয়া একফোঁটা জল মালতীর চক্ষু হইতে পদতলে কার্পেটের উপর পড়িল।

সুরেন্দ্রবাবুও বোধ হয় তাহা দেখিতে পাইলেন। একটু থামিয়া বলিলেন, তোমার নিকট টাকাকড়ি বোধহয় কিছুই নাই?

মালতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।

তাহা আমি জানিতাম। এই নাও, বলিয়া একটা মনিব্যাগ উপাধানের নিম্ন হইতে বাহির করিয়া তাহার পায়ের নিকট ফেলিয়া দিয়া বলিলেন, ইহাতে যাহা আছে, কোনরূপ উপায় না হইলেও এক বৎসর ইহা হইতে তোমার স্বচ্ছন্দে চলিবে; তাহার পর ঈশ্বরের আশীর্বাদে যাহা হয় করিও।

আর একফোঁটা জল কার্পেটের উপর আসিয়া পড়িল।

সেদিন উন্মত্ত ছিলাম, তাই জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, কাহার পাপে এমন ঘটিল? কিন্তু এখন জ্ঞান হইয়াছে, এখন দেখিতেছি আমারই পাপের এই ফল— তুমি নির্দোষ! আমার জয়াকে আমিই মারিয়া ফেলিয়াছি।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়