হরেন্দ্র স্তব্ধ হইয়া রহিল। কিছুক্ষণ এইভাবে থাকিয়া শেষে ধীরে ধীরে কহিল, তা হলে কি তোমার নিশ্চয় বোধ হয় যে রাজেন—

সতীশ মিনতির স্বরে বলিল, আমাকে জিজ্ঞেসা করবেন না। সে আমার বন্ধু।

হরেন খুশী হইল না, কহিল, আমারও ত সে ভাইয়ের মত।

সতীশ কহিল, একটা কথা ভেবে দেখবার যে, তারা আমাকে বিনা-দোষে লাঞ্ছনা করেচে সত্যি, কিন্তু ছেড়েও দিয়েছে।

হরেন বলিল, বিনা-দোষে লাঞ্ছনা করাটাও ত আইন নয়। যারা তা পারে, তারা এ-ই বা পারবে না কেন? এই বলিয়া সে তখনকার মত কলেজে চলিয়া গেল, কিন্তু মনের মধ্যে তাহার ভারী অশান্তি লাগিয়া রহিল। শুধু কেবল রাজেনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করিয়াই নয়, দেশের কাজে দেশের ছেলেদের মানুষের মত মানুষ করিয়া তুলিতে এই যে সে আয়োজন করিয়াছে, পাছে, তাহা অকারণে নষ্ট হইয়া যায়। হরেন স্থির করিল, ব্যাপারটা সত্যই হউক, বা মিথ্যাই হউক, পুলিশের চক্ষু অকারণে আশ্রমের প্রতি আকর্ষণ করিয়া আনা কোনমতেই সমীচীন নয়। বিশেষতঃ সে যখন স্পষ্টই এখানকার নিয়ম লঙ্ঘন করিয়া চলিতেছে, তখন কোথাও চাকরি করিয়া দিয়া হোক বা যে-কোন অজুহাতে হোক, তাহাকে অন্যতর সরাইয়া দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।

ইহার দিন-কয়েক পরেই মুসলমানদের কি একটা পর্বোপলক্ষে দু’দিনের ছুটি ছিল। সতীশ কাশী যাইবার অনুমতি চাহিতে আসিল। আগ্রা আশ্রমের অনুরূপ আদর্শে ভারতের সর্বত্র প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিবার বিরাট কল্পনা হরেন্দ্রর মনের মধ্যে ছিল এবং এই উদ্দেশ্যেই সতীশের কাশী যাওয়া। শুনিয়া রাজেন আসিয়া কহিল, হরেনদা, ওর সঙ্গে আমিও দিনকতক বেড়িয়ে আসি গে।

হরেন বলিল, তার কাজ আছে বলে সে যাচ্ছে।

রাজেন বলিল, আমার কাজ নেই বলেই যেতে চাচ্চি। যাবার গাড়িভাড়ার টাকাটা আমার কাছে আছে।

হরেন জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু ফিরে আসবার?

রাজেন চুপ করিয়া রহিল।

হরেন বলিল, রাজেন, কিছুদিন থেকে তোমাকে একটা কথা বলি-বলি করেও বলতে পারিনি।

রাজেন একটুখানি হাসিয়া কহিল, বলবার প্রয়োজন নেই, হরেনদা, সে আমি জানি। এই বলিয়া সে চলিয়া গেল।

রাত্রির গাড়িতে তাহাদের যাইবার কথা। বাসা হইতে বাহির হইবার কালে হরেন্দ্র দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া হঠাৎ তাহার হাতের মধ্যে একটা কাগজের মোড়ক গুঁজিয়া দিয়া চুপি চুপি বলিল, ফিরে না এলে বড় দুঃখ পাবো রাজেন। এবং বলিয়াই চক্ষের পলকে নিজের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল।

ইহার দিন-দশেক পরে দুজনেই ফিরিয়া আসিল। হরেনকে নিভৃতে ডাকিয়া সতীশ প্রফুল্ল মুখে কহিল, আপনার সেদিনের ঐটুকু বলাতেই কাজ হয়েছে হরেনবাবু। কাশীতে আশ্রম স্থাপনের জন্যে এ কদিন রাজেন অমানুষিক পরিশ্রম করেচে।

হরেন কহিল, পরিশ্রম করলে ত সে অমানুষিক পরিশ্রমই করে সতীশ।

হাঁ, তাই সে করেছে। কিন্তু এর সিকি ভাগ পরিশ্রমও যদি সে আমাদের এই নিজেদের আশ্রমটুকুর জন্যে করত!

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়