উনিশ
হরেন্দ্র ও কমল আশুবাবুর গৃহে আসিয়া যখন উপস্থিত হইল তখন বেলা অপরাহ্ণপ্রায়। শয্যার উপরে অর্ধশায়িতভাবে বসিয়া অসুস্থ গৃহস্বামী সেইদিনের পাইয়োনিয়ার কাগজখানা দেখিতেছিলেন। দিনকয়েক হইতে আর জ্বর ছিল না, অন্যান্য উপসর্গও সারিয়া আসিতেছিল, শুধু শরীরের দুর্বলতা যায় নাই। ইঁহারা ঘরে প্রবেশ করিতে আশুবাবু কাগজ ফেলিয়া উঠিয়া বসিলেন, কি যে খুশী হইলেন সে তাঁহার মুখ দেখিয়া বুঝা গেল। তাঁহার মনের মধ্যে ভয় ছিল কমল হয়ত আর আসিবে না। তাই হাত বাড়াইয়া তাহাকে গ্রহণ করিয়া কহিলেন, এস আমার কাছে এসে বস। এই বলিয়া তাহাকে খাটের কাছেই যে চৌকিটা ছিল তাহাতে বসাইয়া দিলেন, বলিলেন, কেমন আছ বল ত কমল?
কমল হাসিমুখে জবাব দিল, ভালই ত আছি।
আশুবাবু কহিলেন, সে কেবল ভগবানের আশীর্বাদ। নইলে যে দুর্দিন পড়েচে তাতে কেউ যে ভাল আছে তা ভাবতেই পারা যায় না। এতদিন কোথায় ছিলে বল ত? হরেন্দ্রকে রোজই জিজ্ঞাসা করি, সে রোজই এসে একই উত্তর দেয়, বাসায় তালাবন্ধ, তাঁর সন্ধান পাইনে। নীলিমা সন্দেহ করছিলেন হয়ত বা তুমি দিন-কয়েকের তরে কোথাও চলে গেছ।
হরেন্দ্রই ইহার জবাব দিল, কহিল, আর কোথাও না,—এই আগ্রাতেই মুচীদের পাড়ায় সেবার কার্যে নিযুক্ত ছিলেন। আজ দেখা পেয়ে ধরে এনেচি।
আশুবাবু ভয়ব্যাকুলকণ্ঠে কহিলেন, মুচীদের পাড়ায়? কিন্তু কাগজে লিখচে যে পাড়াটা উজোড় হয়ে গেল। এতদিন তাদের মধ্যেই ছিলে? একা?
কমল ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, একলা নয়, সঙ্গে রাজেন্দ্র ছিলেন।
শুনিয়া হরেন্দ্র তাহার মুখের প্রতি চাহিল, কিছু বলিল না। তাহার তাৎপর্য এই যে, তুমি না বলিলেও আমি অনুমান করিয়াছিলাম। যেথায় দৈবের এতবড় নিগ্রহ শুরু হইয়াছে সে দুর্ভাগাদের ত্যাগ করিয়া সে যে কোথাও এক পা নড়িবে না এ আমি জানিব না ত জানিবে কে?
আশুবাবু কহিলেন, অদ্ভুত মানুষ এই ছেলেটি। ওকে দু-তিনদিনের বেশী দেখিনি, কিছুই জানিনে, তবু মনে হয় কি যেন এক সৃষ্টিছাড়া ধাতুতে ও তৈরি। তাকে নিয়ে এলে না কেন, ব্যাপারগুলো জিজ্ঞাসা করতাম। খবরের কাগজ থেকে ত সব বোঝা যায় না।
কমল বলিল, না। কিন্তু তাঁর ফিরতে এখনও দেরি আছে।
কেন?
পাড়াটা এখনো নিঃশেষ হয়নি। যারা অবশিষ্ট আছে তাদের রওনা না করে দিয়ে তিনি ছুটি নেবেন না, এই তাঁর পণ।
আশুবাবু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, তা হলে তোমারই বা কি করে ছুটি হলো? আবার কি সেখানে ফিরতে হবে? নিষেধ করতে পারিনে, কিন্তু সে যে বড় ভাবনার কথা কমল!
কমল মাথা নাড়িয়া বলিল, ভাবনার জন্যে নয় আশুবাবু, ভাবনা আর কোথায় নেই? কিন্তু আমার ঘড়িতে যেটুকু দম ছিল সমস্ত শেষ করে দিয়েই এসেচি। সেখানে ফিরে যাবার সাধ্য আমার নেই। শুধু রয়ে গেলেন রাজেন্দ্র।
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 19 Page: 127
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 159