কমল কহিল, করে। মন্দ বলে নয়, পুরাতনমাত্রকেই স্বতঃসিদ্ধ ভাল মনে ক’রে করে। একটা কথা আপনাকে প্রথমেই বলতে চেয়েছিলাম আশুবাবু, কিন্তু আপনি কান দেননি। লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানই হোক বা পারলৌকিক ধর্ম-কর্মই হোক, কেবলমাত্র দেশের বলেই আঁকড়ে থাকায় স্বদেশ-প্রীতির বাহবা পাওয়া যায়, কিন্তু স্বদেশের কল্যাণের দেবতাকে খুশী করা যায় না। তিনি ক্ষুণ্ণ হন।
আশুবাবু অবাক হইয়া শুধু কহিলেন, তুমি কি বল কমল? দেশের ধর্ম, দেশের আচার-অনুষ্ঠান ত্যাগ করে বাইরে থেকে ভিক্ষে নিতে থাকলে নিজের বলতে আর বাকী থাকবে কি? জগতে মানুষ বলে দাবী জানাতে যাব কোন্ পরিচয়ে?
কমল কহিল, দাবী আপনি এসে ঘরে পৌঁছবে, পরিচয়ের প্রয়োজন হবে না। বিশ্বজগৎ বিনা পরিচয়েই চিনতে পারবে।
আশুবাবু ব্যাকুল হইয়া কহিলেন, তোমাকে ত বুঝতে পারলাম না কমল!
বোঝবার কথাও নয় আশুবাবু। এমনিই হয়। এই চলমান সংসারে গতিশীল মানব-চিত্তে পদে পদে যে সত্য নিত্য-নূতনরূপে দেখা দেয়, সবাই তাকে চিনতে পারে না। ভাবে এ কোন্ আপদ কোথা থেকে এল। সেদিন তাজমহলের ছায়ার নীচে শিবানীকে মনে পড়ে? আজ কমলের মাঝখানে তাকে আর চিনতে পারাও যাবে না। মনে হবে সে যাকে দেখেছিলাম কোথায় গেল সে! কিন্তু এই মানুষের সত্য পরিচয়,—এমনিভাবেই লোকের কাছে যেন চিরদিন পরিচিত হতে পারি আশুবাবু।
একটুখানি থামিয়া বলিল, কিন্তু তর্ক-বিতর্কের ঝড়ো হাওয়ায় আমাদের খেই হারিয়ে গেল,—আসল ব্যাপার থেকে সবাই সরে গেছি। আমি কিন্তু অত্যন্ত ক্লান্ত, এখন উঠি।
আশুবাবু নিরুত্তরে বিহ্বলের ন্যায় চাহিয়া রহিলেন। এই মেয়েটিকে কোথাও তিনি অস্পষ্ট বুঝিলেন, কোথাও বা একেবারেই বুঝিলেন না। শুধু ইহাই মনে হইতে লাগিল, এইমাত্র সে যে ঝোড়ো-হাওয়ার উল্লেখ করিয়াছিল, সেই প্রচণ্ড ঝঞ্ঝা-মুখে তৃণখণ্ডের ন্যায় তাঁহার সর্বপ্রকার আবেদন-নিবেদন ভাসিয়া গেছে।
কমল উঠিয়া দাঁড়াইল। অজিতকে ইঙ্গিতে আহ্বান করিয়া কহিল, সঙ্গে করে এনেছিলেন, চলুন না পৌঁছে দেবেন।
কিন্তু আজ সে সঙ্কোচে যেন মুখ তুলিতেই পারিল না। কমল মনে মনে একটু হাসিয়া আগাইয়া আসিয়া সহসা রাজেন্দ্রের কাঁধের উপর একটা হাত রাখিয়া বলিল, রাজেনবাবু, তুমি চল না ভাই আমাকে রেখে আসবে।
এই আকস্মিক আত্মীয় সম্বোধনে রাজেন বিস্মিত হইয়া একবার তাহার প্রতি চাহিল, তাহার পরে কহিল, চলুন।
দ্বারের কাছে আসিয়া কমল হঠাৎ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আশুবাবু, আমার প্রস্তাব কিন্তু প্রত্যাহার করিনি। ঐ সর্তে ইচ্ছা হয় পাঠিয়ে দেবেন, আমি যথাসাধ্য করে দেখব। বাঁচেন ভালই, না বাঁচেন অদৃষ্ট। এই বলিয়া চলিয়া গেল। ঘরের মধ্যে স্তব্ধ হইয়া সকলে বসিয়া রহিলেন,—অসুস্থ গৃহস্বামীর চোখের সম্মুখে প্রভাতের আলোটা পর্যন্ত বিবর্ণ ও বিস্বাদ হইয়া উঠিল।
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 16 Page: 104
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 190