তিন
উপরোক্ত ঘটনার পরে সপ্তাহকাল গত হইয়াছে। দিন-দুই হইতে অসময়ে মেঘ করিয়া বৃষ্টি হইতে আরম্ভ করিয়াছিল, আজও সকাল হইতে মাঝে মাঝে জল পড়িয়া মধ্যাহ্নে খানিকক্ষণ বন্ধ ছিল, কিন্তু মেঘ কাটে নাই। যে কোন সময়েই পুনরায় শুরু হইয়া যাইতে পারে, এমনি যখন আকাশের অবস্থা, মনোরমা ভ্রমণের জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিয়া তাহার পিতার ঘরে দেখা দিল। আশুবাবু মোটা রকমের একটা বালাপোশ গায়ে দিয়া আরামকেদারায় বসিয়া ছিলেন, তাঁহার হাতে একখানা বই। মেয়ে আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কৈ বাবা, তুমি এখনও তৈরি হয়ে নাও নি, আজ যে আমাদের এতবারী খাঁর কবর দেখতে যাবার কথা।
কথা ত ছিল মা, কিন্তু আজ আমার সেই কোমরের বাতটা—তা হলে মোটরটা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলে দি। কাল না হয় যাওয়া যাবে, কি বল বাবা?
পিতা বাধা দিয়া বলিলেন, না না, না বেড়ালে তোর আবার মাথা ধরে। তুই না হয় একটুখানি ঘুরে আয় গে মা, আমি ততক্ষণ এই মাসিকপত্রটায় চোখ বুলিয়ে নিই। গল্পটা লিখেচে ভাল।
আচ্ছা, চললাম। কিন্তু ফিরতে আমার দেরি হবে না। এসে তোমার কাছে গল্পটা শুনব তা বলে যাচ্চি, এই বলিয়া সে একাকীই বাহির হইয়া গেল।
ঘণ্টা-খানেকের মধ্যেই মনোরমা বাড়ি ফিরিয়া পিতার ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে প্রশ্ন করিল, কেমন গল্প বাবা? শেষ হল? কি লিখেচে?
কিন্তু, কথাটা উচ্চারণ করিয়াই সে চমকিয়া দেখিল তাহার পিতা একা নহেন, সম্মুখে শিবনাথ বসিয়া।
শিবনাথ উঠিয়া দাঁড়াইয়া নমস্কার করিল, কহিল, কতদূর বেড়িয়ে এলেন?
মনোরমা উত্তর দিল না, শুধু নমস্কারের পরিবর্তে মাথাটা একটুখানি হেলাইয়া তাহার প্রতি সম্পূর্ণ পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া পিতাকে কহিল, পড়া শেষ হয়ে গেল বাবা? কেমন লাগল?
আশুবাবু শুধু বলিলেন, না।
কন্যা কহিল, তা হলে আমি নিয়ে যাই, পড়ে এখ্খুনি তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব। এই বলিয়া সে কাগজখানা হাতে করিয়া চলিয়া গেল। কিন্তু নিজের শয়নকক্ষে আসিয়া সে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার কাপড়-ছাড়া, হাত-মুখ ধোয়া পড়িয়া রহিল, কাগজখানা একবার খুলিয়াও দেখিল না, কোন্ গল্প, কে লিখিয়াছে কিংবা কেমন লিখিয়াছে।
এইভাবে বসিয়া সে যে কি ভাবিতে লাগিল তাহার স্থিরতা নাই; এই সময়ে চাকরটাকে সম্মুখ দিয়া যাইতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ওরে, বাবার ঘর থেকে লোকটি চলে গেছে?
বেহারা বলিল, হাঁ।
কখন গেল?
বৃষ্টি পড়বার আগেই।
মনোরমা জানালার পর্দা সরাইয়া দেখিল, কথা ঠিক, পুনরায় বৃষ্টি শুরু হইয়াছে, কিন্তু বেশী নয়। উপরের দিকে চাহিয়া দেখিল পশ্চিম দিগন্তে মেঘ গাঢ়তর হইয়া আসিতেছে, রাত্রে মুষলধারায় বারি-পতনের সূচনা হইয়াছে। কাগজখানা হাতে করিয়া পিতার বসিবার ঘরে আসিয়া দেখিল, তিনি চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। বইটা তাঁহার কেদারার হাতলের উপর ধীরে ধীরে রাখিয়া দিয়া কহিল, বাবা, তুমি জান এ-সব আমি ভালবাসিনে। এই বলিয়া সে পার্শ্বের চৌকিটায় বসিয়া পড়িল।
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 3 Page: 11
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 146