তখন আশুবাবু মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, কমল, বুড়ো-মন তুমি কাকে বল? দেখি নিজের সঙ্গে একবার মিলিয়ে এ সত্যিই সেই কি না।
কমল কহিল, মনের বার্ধক্য আমি তাকেই বলি আশুবাবু, যে-মন সুমুখের দিকে চাইতে পারে না, যার অবসন্ন, জরাগ্রস্ত মন ভবিষ্যতের সমস্ত আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে কেবল অতীতের মধ্যেই বেঁচে থাকতে চায়। আর যেন তার কিছু করবার, কিছু পাবারই দাবী নেই,—বর্তমান তার কাছে লুপ্ত, অনাবশ্যক, অনাগত অর্থহীন। অতীতই তার সর্বস্ব। তার আনন্দ, তার বেদনা—সেই তার মূলধন। তাকেই ভাঙ্গিয়ে খেয়ে সে জীবনের বাকী দিন-কটা টিকে থাকতে চায়। দেখুন ত আশুবাবু, নিজের সঙ্গে একবার মিলিয়ে।
আশুবাবু হাসিলেন, বলিলেন, সময়মত একবার দেখব বৈ কি।
অজিতকুমার এতক্ষণের এত কথার মধ্যে একটি কথাও বলে নাই, শুধু নিষ্পলক চক্ষে কমলের মুখের প্রতি চাহিয়া ছিল, সহসা কি যে তাহার হইল, সে আপনাকে আর সামলাইতে পারিল না, বলিয়া উঠিল, আমার একটা প্রশ্ন—দেখুন মিসেস্—
কমল সোজা তাহার দিকে চাহিয়া বলিল, মিসেস্ কিসের জন্যে? আমাকে আপনি কমল বলেই ডাকুন না?
অজিত লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল—না না, সে কি, সে কেমনধারা যেন—
কমল কহিল, কিছুই কেমনধারা নয়। বাপ-মা আমার নাম রেখেছিলেন আমাকে ডাকবার জন্যেই ত। ওতে আমি রাগ করিনে। অকস্মাৎ মনোরমার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, আপনার নাম মনোরমা, তাই বলে যদি আমি ডাকি, আপনি রাগ করেন নাকি?
মনোরমা মাথা নাড়িয়া বলিল, হাঁ রাগ করি।
এ উত্তর তাহার কাছে কেহই প্রত্যাশা করে নাই, আশুবাবু ত কুণ্ঠায় ম্লান হইয়া পড়িলেন।
শুধু কুণ্ঠিত হইল না কমল নিজে। কহিল, নাম ত আর কিছুই নয়, কেবল একটা শব্দ। যা দিয়ে বোঝা যায়, বহুর মধ্যে একজন আর একজনকে আহ্বান করচে। তবে অনেক লোকের অভ্যাসে বাধে এ কথাও সত্যি। তারা এই শব্দটাকে নানারূপে অলঙ্কৃত করে শুনতে চায়। দেখেন না, রাজারা তাঁদের নামের আগে-পিছে কতকগুলো নিরর্থক বাক্য দিয়ে, কতকগুলো শ্রী জুড়ে তবে অপরকে উচ্চারণ করতে দেয়? নইলে তাদের মর্যাদা নষ্ট হয়। এই বলিয়া সে হঠাৎ হাসিয়া উঠিয়া শিবনাথকে দেখাইয়া কহিল, যেমন ইনি। কখনও কমল বলতে পারেন না, বলেন, শিবানী। অজিতবাবু, আপনি বরঞ্চ আমাকে মিসেস্ শিবনাথ না বলে শিবানী বলেই ডাকুন। কথাও ছোট, বুঝবেও সবাই। অন্ততঃ আমি ত বুঝবই।
কিন্তু কি যে হইল, এমন সুস্পষ্ট আদেশ লাভ করিয়াও অজিত কথা কহিতে পারিল না, প্রশ্ন তাহার মুখে বাধিয়াই রহিল।
তখন বেলা শেষ হইয়া অঘ্রাণের বাষ্পাচ্ছন্ন আকাশে অস্বচ্ছ জ্যোৎস্না দেখা দিয়াছে, সেই দিকে পিতার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া মনোরমা বলিল, বাবা, হিম পড়তে শুরু হয়েছে, আর না। এইবার ওঠো।
আশুবাবু বলিলেন, এই যে উঠি মা।
অবিনাশ বলিলেন, শিবানী নামটি বেশ। শিবনাথ গুণী লোক, তাই নামটিও দিয়েচেন মিষ্টি, নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়েছেনও চমৎকার।
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 6 Page: 31
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 147