কথাটা আশুবাবুর ভাল লাগিল না, কহিলেন, তুমি কি তা হলে বলতে চাও বাধা দেওয়া আমার কর্তব্য নয়?

কমল কহিল, অন্ততঃ ভয় দেখিয়ে নয়—এইটুকুই বলতে পারি। আমি আপনার মেয়ে হলে বাধা হয়ত পেতাম, কিন্তু এ জীবনে আর কখনো আপনাকে শ্রদ্ধা করতে পারতাম না। আমার বাবা আমাকে এইভাবেই গড়ে গিয়েছিলেন।

আশুবাবু বলিলেন, অসম্ভব নয় তোমার কল্যাণের পথ তিনি এদিকেই দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু আমি পাইনে। তবু, আমিও পিতা। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্চি, শিবনাথকে কেউ যথার্থ ভালবাসা দিতে পারে না,—এ তার মোহ। এ মিথ্যে। এই ক্ষণস্থায়ী নেশার ঘোর যেদিন কেটে যাবে মণির দুঃখের অন্ত থাকবে না। কিন্তু তখন তাকে বাঁচাবে কিসে?

কমল কহিল, নেশার মধ্যেই বরঞ্চ ভাবনা ছিল, কিন্তু সে ঘোর কেটে গিয়ে যখন সে সুস্থ হয়ে উঠবে তখন তার আর ভয় নেই। তার স্বাস্থ্যই তখন তাকে রক্ষে করবে।

আশুবাবু অস্বীকার করিয়া বলিলেন,এ-সব কথার মারপ্যাঁচ কমল, যুক্তি নয়। সত্য এর থেকে অনেক দূরে। ভুলের দণ্ড তাকে বড় করেই পেতে হবে,—ওকালতির জোরে তার থেকে অব্যাহতি মিলবে না।

কমল কহিল, অব্যাহতির ইঙ্গিত আমি করিনি আশুবাবু। ভুলের দণ্ড পেতে হয়, এ আমি জানি। তার দুঃখ আছে, কিন্তু লজ্জা নেই। মণি কাউকে ঠকাতে যায়নি, ভুল ভেঙ্গে সে যদি ফিরে আসে, তাকে মাথা হেঁট করে আসতে হবে না—এই ভরসাই আপনাকে আমি দিতে চেয়েছিলাম।

তবু ত ভরসা পাইনে কমল। জানি, ভুল তার ভাঙ্গবেই, কিন্তু তার পরেও যে তাকে দীর্ঘদিন বাঁচতে হবে, তখন সে থাকবে কি নিয়ে? বাঁচবে কোন্‌ অবলম্বনে?

অমন কথা আপনি বলবেন না। মানুষের দুঃখটাই যদি দুঃখ পাওয়ার শেষ কথা হ’তো, তার মূল্য ছিল না। সে একদিকের ক্ষতি আর একদিকের মস্ত সঞ্চয় দিয়ে পূর্ণ করে তোলে, নইলে, আমিই বা আজ বেঁচে থাকতাম কি করে? বরঞ্চ, আপনি আশীর্বাদ করুন, ভুল যদি ভাঙ্গে তখন যেন সে নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারে, তখন যেন কোন লোভ, কোন ভয় না তাকে রাহুগ্রস্ত করে রাখে।

আশুবাবু চুপ করিয়া রহিলেন। জবাব দিতে বাধিল, কিন্তু স্বীকার করিতেও ঢের বেশী বাধিল। বহুক্ষণ পরে বলিলেন, পিতার দৃষ্টি দিয়ে আমি মণির ভবিষ্যৎ-জীবন অন্ধকার দেখতে পাই। তুমি কি তবুও সত্যিই বল যে আমার বাধা দেওয়া উচিত নয়, নীরবে মেনে নেওয়াই কর্তব্য?

আমি মা হলে মেনেই নিতাম। তার ভবিষ্যতের আশঙ্কায় হয়ত আপনারই মত কষ্ট পেতাম, তবু এই উপায়ে বাধা দেবার আয়োজন করতাম না। মনে মনে বলতাম, এ জীবনে যে রহস্যের সামনে এসে আজ সে দাঁড়িয়েছে, সে আমার সমস্ত দুশ্চিন্তার চেয়েও বৃহৎ। একে স্বীকার করতেই হবে।

আশুবাবু আবার কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া কহিলেন, তবু বুঝতে পারলাম না কমল। শিবনাথের চরিত্র, তার সকল দুষ্কৃতির বিবরণ মণি জানে। একদিন এ বাড়িতে আসতে দিতেও তার আপত্তি ছিল, কিন্তু আজ যে সম্মোহনে তার হিতাহিত-বোধ, তার সমস্ত নৈতিক-বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়ে গেছে, সে ত যথার্থ ভালবাসা নয়, সে যাদু, সে মোহ; এ মিথ্যে যেমন করে হোক নিবারণ করাই পিতার কর্তব্য।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়