অজিত বলিল, তিনি হয়ত আপনাকে সত্যিই আত্মীয় মনে করেন। বোধ হয় কাউকেই ছলনা করা তাঁর স্বভাব নয়।
না না, কথাটা ঠিক ওভাবে বলিনি অজিত। এই বলিয়া তিনি নিজের কাছেই যেন জবাবদিহি করিলেন। সেই লোকটিকে হঠাৎ ঝোঁকের উপর বিদায় করা পর্যন্ত মনের মধ্যে তাঁহার ভারী একটা গ্লানি চলিতেছিল; কহিলেন, সে আমাকে আত্মীয় বলেই যদি জানে, আর দু-পাঁচশো টাকার যদি দরকারই পড়েছিল, সোজা নিজে এসে ত নিয়ে গেলেই হত। খামকা একটা বাইরের লোককে সকলের সামনে পাঠানোর কি আবশ্যকতা ছিল? আর যাই বল, মেয়েটার বুদ্ধি-বিবেচনা নেই।
বেহারা আসিয়া খাবার দেওয়া হইয়াছে, জানাইয়া গেল। অজিত উঠিতে যাইতেছিল, আশুবাবু কহিলেন, লোকটাকে মার্ক করেছিলে অজিত, বিশ্রী চেহারা—মনি-লেন্ডার কিনা। ফিরে গিয়ে হয়ত নানান্খানা করে বানিয়ে বলবে।
অজিত হাসিয়া কহিল, বানানোর দরকার হবে না আশুবাবু, সত্যি বললেই যথেষ্ট হবে। এই বলিয়া সে যাইতে উদ্যত হইতেই তিনি বাস্তবিকই বিচলিত হইয়া উঠিলেন, কহিলেন, এই অক্ষয় লোকটা একেবারে নুইসেন্স। মানুষের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়। না হয় একটা কাজ কর না অজিত। যদুকে ডেকে ঐ দেরাজটা খুলে দেখ না কি আছে। অন্ততঃ পাঁচ-সাতশো টাকা,—আপাততঃ যা আছে পাঠিয়ে দাও। আমাদের ড্রাইভার বোধ হয় তাদের বাসাটা চেনে—শিবনাথকে মাঝে মাঝে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। এই বলিয়া তিনি নিজেই চীৎকার করিয়া বেহারাকে ডাকাডাকি শুরু করিয়া দিলেন।
অজিত বাধা দিয়া বলিল, যা হবার তা হয়েই গেছে, আজ রাত্রে থাক, কাল সকালে বিবেচনা করে দেখলেই হবে।
আশুবাবু প্রতিবাদ করিলেন, তুমি বোঝ না অজিত বিশেষ প্রয়োজন না থাকলে সে রাত্রেই কখনো লোক পাঠাতো না।
অজিত কিছুক্ষণ স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। শেষে বলিল, ড্রাইভার বাড়ি নেই, মনোরমাকে নিয়ে কখন ফিরবে তাও ঠিকানা নেই। ইতিমধ্যে কমল সমস্তই শুনতে পাবেন। তার পরে আর টাকা পাঠান উচিত হবে না আশুবাবু। বোধ হয় আপনার হাত থেকে আর তিনি সাহায্য নেবেন না।
কিন্তু এ ত তোমার শুধু অনুমানমাত্র অজিত।
হাঁ, অনুমান বৈ আর কি।
কিন্তু, বিদেশে তার টাকার প্রয়োজন ত এর চেয়েও বড় হতে পারে?
তা পারে, কিন্তু তাঁর আত্মমর্যাদার চেয়েও বড় না হতে পারে।
আশুবাবু বলিলেন, কিন্তু এ-ও ত শুধু তোমার অনুমান।
অজিত সহসা উত্তর দিল না। ক্ষণকাল অধোমুখে নিঃশব্দে থাকিয়া কহিল, না, এ আমার অনুমানের চেয়ে বড়। এ আমার বিশ্বাস। এই বলিয়া সে ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
আশুবাবু আর তাহাকে ফিরিয়া ডাকিলেন না, কেবল বেদনায় দুই চক্ষু প্রসারিত করিয়া সেইদিকে চাহিয়া রহিলেন। কমলের সম্বন্ধে এ বিশ্বাস অসম্ভবও নয়, অসঙ্গতও নয়। ইহা তিনি নিজেও জানিতেন। নিরুপায় অনুশোচনায় বুকের ভিতরটা যেন তাঁহার আঁচড়াইতে লাগিল।
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 12 Page: 70
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 166