তারক সবিনয়ে কহিল, এটি কিন্তু তার চেয়েও অন্যায় হল যে রাখাল-রাজের পৈতৃক মুড়োটা স্বচ্ছন্দে বাদ দিয়ে করে দিলেন ওকে ছোট একটুখানি রাজু, আর আমারই অদৃষ্টে এসে জুটল এক উটকো বাবু? ভার সইবে না নতুন-মা, ওটা বাতিল করতে হবে।

তিনি ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, তাই হবে তারক।

সম্মতি লাভ করিয়া তারক সকৃতজ্ঞ-চিত্তে কি-একটা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সময় পাইল না, তাঁহার সস্মিত মুখের উপর হঠাৎ যেন একটা বিষণ্ণতার ছায়া আসিয়া পড়িল, গলার স্বরটাও গেল বদলাইয়া, বলিলেন, রাজু, আজকাল ও-বাড়িতে কি তুমি বড়-একটা যাও না?

যাই বৈ কি নতুন-মা। তবে নানা ঝঞ্ঝাটে দিন পনের-কুড়ি—

রেণুর কাল বিয়ে,—জান?

কৈ না! কে বললে?

হাঁ, তাই। আজ বেলা দশটায় তার গায়ে-হলুদ হয়ে গেল। এ বিয়ে তোমাকে বন্ধ করতে হবে।

কেন?

হওয়া অসম্ভব বলে। বরের পিতামহ পাগল হয়ে মারা যায়, এক পিসি পাগল হয়ে আছে, বাপ পাগল নয় বটে, কিন্তু হলে ছিল ভাল। হাতে-পায়ে দড়ি বেঁধে লোকে ফেলে রাখতে পারতো।

কি সর্বনাশ! কর্তা কি এ-সব খোঁজ করেন নি?

রমণী কহিলেন, জানোই তো কর্তাকে। ছেলেটি রূপবান, লেখাপড়া করেছে, তা ছাড়া ওদের অনেক টাকা। ঘটক সম্বন্ধ এনেছে, যা বলেচে তিনি বিশ্বাস করেছেন। আর জানলেই বা কি? সমস্ত শুনেও হয়তো শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝতেই পারবেন না এতে ভয়ের কি আছে?

রাখাল বিষণ্ণ-মুখে কহিল, তবেই ত!

তারক চুপ করিয়া শুনিতেছিল, বন্ধুর এই নিরুৎসুক কণ্ঠস্বরে সে সহসা উত্তেজিত হইয়া উঠিল—তবেই তো মানে? বাধা দেবার চেষ্টা করবে না, আর এই বিয়ে হয়ে যাবে? এ তো বড় ভীষণ অন্যায়?

রাখাল কহিল, সে বুঝি, কিন্তু আমার কথায় বিয়ে বন্ধ হবে কেন ভাই? আর কর্তাই তো শুধু নয়, আর সবাই রাজী হবে কেন?

তারক বলিল, কেন হবে না? বরের বাড়ির মত মেয়ের বাড়িরও কি সবাই পাগল বললেও শুনবে না—বিয়ে দেবেই?

কিন্তু গায়ে-হলুদ হয়ে গেছে যে! এটা ভুলচো কেন?

হলোই বা গায়ে-হলুদ! মেয়েকে তো জ্যান্ত চিতায় তুলে দেওয়া যায় না! বলিয়াই তাহার চোখ পড়িল সেই অপরিচিতা রমণী তাহার প্রতি নীরবে চাহিয়া আছেন। লজ্জিত হইয়া সে কণ্ঠস্বর শান্ত করিয়া বলিল, আমি জানিনে এঁরা কে, হয়তো কথা কওয়া আমার উচিত নয়, কিন্তু মনে হয় রাখাল, তোমার প্রাণপণে বাধা দেওয়া কর্তব্য। কোনমতেই এ ঘটতে দেওয়া চলে না।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়