ব্রজবাবু আরও কিছুক্ষণ তাঁহার মুখের প্রতি নীরবে চাহিয়া রহিলেন। অপরাহ্ণ সূর্যের কতকটা আলো জানালা দিয়া মেঝের উপর রাঙ্গা হইয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, তাহার প্রতি সবিতার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, এর মতোই আমার বেলা পড়ে এলো নতুন-বৌ, পাওনা বুঝে নেবার আর সময় নেই। কিন্তু তুমি ছাড়া সংসারে বোধ হয় আর কেউ নেই যে বোঝে আমি কত ক্লান্ত। ছুটির দরখাস্ত পেশ করে বসে আছি, মঞ্জুরি এলো বলে। যা, নিয়েচি, যা দিয়েছি, তার হিসেব-নিকেশ হয়ে গেছে। হিসেব ভালো হয়নি জানি, গোঁজামিল অনেক রয়ে গেছে, কিন্তু তবু তার জের টানতে আর আমি পারবো না। তোমার এ অনুরোধ ফিরিয়ে নাও।

সবিতা একদৃষ্টে চাহিয়া শুনিতেছিল স্বামীর কথাগুলি, শেষ হইলে শুধু জিজ্ঞাসা করিল, সত্যিই কি আর পারবে না মেজকর্তা? সত্যিই কি বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েচো?

সত্যিই বড় ক্লান্ত নতুন-বৌ, সত্যিই আর পারবো না। কত যে ক্লান্ত সে তুমি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না; তারা বলবে আলস্য, বলবে জড়তা, ভাববে আমার নিরাশার হা-হুতাশ। তারা তর্ক করবে, যুক্তি দেবে, মেরে মেরে এখনো ছোটাতে চাইবে—তারা এই কথাটাই কেবল জেনে রেখেছে যে, কলে দম দিলেই চলে। কিন্তু তারও যে শেষ আছে এ তারা বিশ্বাস করতে পারে না।

আমি বিশ্বাস করলে তুমি খুশী হবে?

খুশী হবো কিনা জানিনে, কিন্তু শান্তি পাবো।

কি এখন করবে?

রেণুকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি যাবো। সেখানে সব গিয়েও যা বাকী থাকবে তাতে কোনমতে আমাদের দিনপাত হবে। আর যারা আমাদের ত্যাগ করে কলকাতায় রইলো তাদের ভাবনা নেই, সে তো তুমি আগেই শুনেচো।

রেণুর ভার কাকে দিয়ে যাবে মেজকর্তা?

দিয়ে যাবো ভগবানকে। তাঁর চেয়ে বড় আশ্রয় আর নেই, সে আমি জেনেচি।

সবিতা স্তব্ধভাবে বসিয়া রহিল। ভগবানে তাহার অবিশ্বাস নাই, কিন্তু নিজের মেয়ের সম্বন্ধে অতবড় নির্ভরতায় নিশ্চিন্ত হইতেও পারে না। শঙ্কায় বুকের ভিতরটায় তোলপাড় করিয়া উঠিল, কিন্তু ইহার উত্তর যে কি তাহাও ভাবিয়া পাইল না। শুধু যে কথাটা তাহার মনের মধ্যে অহরহ কাঁটার মত বিঁধিতেছিল তাহাই মুখে আসিয়া পড়িল, বলিল, মেজকর্তা, আমাকে টাকাটা ফিরিয়ে দিলে কি আমার অপরাধের দণ্ড দিতে? প্রতিশোধের আর কি কোন পথ খুঁজে পেলে না?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়