রতন কহিতে লাগিল, মায়ের খরচের হিসাবপত্রও আমরা কোনদিন ভেবে পেলাম না। সেখানে না আছে ঘরদোর, না আছে কিছু। একজন গোমস্তা আছে, তার কাছে হাজার-দুই টাকা পাঠানো হয়েছে একটা মেটে বাড়ি তৈরি করবার জন্যে। দেখুন দেখি বাবু, এ কি-সব অনাছিষ্টি কাণ্ডকারখানা! চাকর বলে যেন আর আমরা কেউ মানুষ নয়!
তাহার ক্ষোভ এবং বিরক্তি দেখিয়া বলিলাম, নাই গেলে রতন অমন জায়গায়! জোর করে ত তোমাকে কেউ কোথাও নিয়ে যেতে পারে না!
আমার কথায় রতন কোন সান্ত্বনা লাভ করিল না। কহিল, মা পারেন। কি জানি বাবু কি জাদুমন্ত্র জানেন, যদি বলেন, তোমাদের সব যমের বাড়ি যেতে হবে, এতগুলো লোকের মধ্যে আমাদের এমন সাহস কারও নেই যে বলে, না। বলিয়া সে মুখ ভারী করিয়া চলিয়া গেল।
কথাটা রতন নিতান্তই রাগ করিয়া বলিয়া গেল, কিন্তু আমাকে সে যেন অকস্মাৎ একটা নূতন তথ্যের সংবাদ দিয়া গেল। কেবল আমিই নয়, সকলেরই ঐ এক দশা! ওই জাদুমন্ত্রের কথাটাই ভাবিতে লাগলাম। মন্ত্রতন্ত্রে যে সত্যই বিশ্বাস করি তাহা নয়, কিন্তু এক-বাড়ি লোকের মধ্যে কাহারও যখন এতটুকু শক্তি নাই যে যমের বাড়ি যাইবার আদেশটাকে পর্যন্ত অবহেলা করে, তখন সে বস্তুটাই বা কি!
ইহার সমস্ত সংস্রব হইতে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করিবার জন্য আমি কি না করিয়াছি! বিবাদ করিয়া বিদায় লইয়াছি, সন্ন্যাসী হইয়া দেখিয়াছি, এমন কি দেশত্যাগ করিয়া বহু দূরে চলিয়া গেছি—জীবনে আর না দেখা হয়; কিন্তু আমার সকল চেষ্টাই একটা গোল বস্তুর উপর সরলরেখা টানিবার মত বারংবার কেবল ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। আপনাকে সহস্র ধিক্কার দিয়া নিজের দুর্বলতার কাছেই পরাজিত হইলাম, এই কথাটা মনে করিয়া অবশেষে যখন আত্মসমর্পণ করিলাম, তখন রতন আসিয়া আজ আমাকে এই খবরটা দিয়া গেল—রাজলক্ষ্মী জাদুমন্ত্র জানে!
তাই বটে! অথচ, এই রতনকেই জেরা করিলে জানা যাইবে, সে নিজেও ইহা বিশ্বাস করে না।
হঠাৎ দেখি মস্ত একটা পাথরের বাটিতে কি কতকগুলো লইয়া এই পথেই রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া নীচে চলিয়াছে। ডাকিয়া কহিলাম, শোন, সবাই বলে তুমি নাকি জাদুমন্ত্র জান?
সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া দুই ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া কহিল, কি জানি?
বলিলাম, জাদুমন্ত্র!
রাজলক্ষ্মী মুখ টিপিয়া একটু হাসিয়া কহিল, হাঁ জানি। বলিয়া চলিয়া যাইতেছিল, হঠাৎ আমার গায়ের জামাটা ঠাওর করিয়া দেখিয়া উদ্বিগ্নকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, ওটা কালকের সেই বাসী জামাটা না?
নিজের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলাম, হাঁ সেইটাই বটে; কিন্তু থাক, বেশ ফর্সা আছে।
রাজলক্ষ্মী কহিল, ফর্সার কথা নয়, পরিষ্কারের কথা বলছি। তার পরে একটুখানি হাসিয়া বলিল, বাহিরের ওই দেখান ফরসাটা নিয়েই চিরকাল গেলে। ওটা তাচ্ছিল্য করতেও আমি বলিনে, কিন্তু যে ভেতরটা ঘামে-ঘামে নোংরা হয়ে ওঠে সেটা দেখতে শিখবে কবে? বলিয়া সে রতনকে ডাক দিল। কেহই জবাব দিল না। কারণ কর্ত্রীর এইপ্রকার উচ্চ মধুর আহ্বানের সাড়া দেওয়া এ বাড়ির বিধি নয়; বরঞ্চ মিনিট পাঁচ-ছয় গা-ঢাকা দিয়া থাকাই নিয়ম।
উপন্যাস : শ্রীকান্ত (তৃতীয় পর্ব) Chapter : 2 Page: 8
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শ্রীকান্ত (তৃতীয় পর্ব)
- Read Time: 1 min
- Hits: 203