রাজলক্ষ্মী কহিল, হাঁ, সে তোমার মত ত্যাগীর পক্ষে।
আনন্দ উত্তর দিল, এও মিথ্যে নয় দিদি। আপনি গৃহিণী বলেই এর মর্মগ্রহণ করতে পারেন নি। নইলে আমরা ত্যাগীর দল যখন আনন্দে মশগুল হয়ে আছি, আপনি তখন তিন দিন ধরে কেবল পরকে খাওয়াচ্ছেন, আর নিজে মরছেন উপবাস করে।
রাজলক্ষ্মী বলিল, মরচি আর কৈ ভাই? দিনের পর দিন ত দেখচি এ দেহটার কেবল শ্রীবৃদ্ধি হয়ে চলচে।
আনন্দ কহিল, তার কারণ, হতে বাধ্য। সেবারেও আপনাকে দেখে গিয়েছিলাম, এবারেও এসে দেখচি। আপনার পানে চাইলে মনে হয় না যে পৃথিবীর জিনিস দেখচি, এ যেন দুনিয়া ছাড়া আর কিছু।
রাজলক্ষ্মীর মুখখানি লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল। আমি তাহাকে হাসিয়া কহিলাম, তোমার আনন্দর যুক্তির প্রণালীটা দেখলে?
শুনিয়া আনন্দও হাসিল, কহিল, এ ত যুক্তি নয়, স্তুতি। দাদা, সে দৃষ্টি থাকলে কি আর বর্মায় যেতেন চাকরির দরখাস্ত করতে? আচ্ছা দিদি, কোন্ দুষ্টবুদ্ধি দেবতাটি দিয়েছিলেন এই অন্ধ মানুষটিকে আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে? তাঁর কি আর কাজ ছিল না?
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া ফেলিল। নিজের কপালে করাঘাত করিয়া কহিল, দেবতার দোষ নেই ভাই, দোষ এই ললাটের। আর ওঁর দোষ ত অতিবড় শত্রুতেও দিতে পারবে না। এই বলিয়া সে আমাকে দেখাইয়া কহিল, পাঠশালে উনি ছিলেন সর্দার-প’ড়ো, যত না দিতেন পড়া ব’লে তার ঢের বেশি দিতেন বেত। তখন পড়ি ত সবে বোধোদয়, বইয়ের বোধ ত খুবই হ’ল, বোধ হ’ল আর একরকমের। ছেলেমানুষ, ফুল পাব কোথায়, বনের বঁইচিফলের মালা গেঁথে ওঁকে করলাম বরণ। এখন ভাবি, তার সঙ্গে তার কাঁটাগুলোও যদি গেঁথে দিতাম! বলিতে বলিতে তাহার কুপিত কন্ঠস্বর চাপাহাসির আভায় অপরূপ হইয়া উঠিল।
আনন্দ কহিল, উঃকি ভয়ানক রাগ !
রাজলক্ষ্মী বলিল, রাগ নয়ত কি? কাঁটা তুলে দেবার আর কেউ থাকলে নিশ্চয় দিতাম। এখনো পাই ত দি। এই বলিয়া সে দ্রুতপদে বাহির হইয়া যাইতেছিল, আনন্দ ডাকিয়া কহিল, পালাচ্ছেন যে বড়?
কেন, আর কাজ নেই নাকি? চায়ের বাটি হাতে নিয়ে ওঁর কোঁদল করবার সময় আছে, কিন্তু আমার নেই।
আনন্দ বলিল, দিদি, আমি আপনার অনুগত ভক্ত। কিন্তু এ অভিযোগে সায় দিতে আমারও লজ্জা করচে। উনি একটা কথাও কইলে নাহয় পাকিয়ে তোলবার চেষ্টা করা যেত, কিন্তু একদম বোবা মানুষকে ফাঁদে ফেলা যায় কি করে? করলেও ধর্মে সইবে না।
রাজলক্ষ্মী বলিল, ঐ ত হয়েছে আমার জ্বালা। বেশ, ধর্মে যা সয়, তাই না হয় কর। চায়ের বাটিগুলো সব জুড়িয়ে জল হয়ে গেলআমি ততক্ষণ রান্নাঘরটা একবার ঘুরে আসি গে। বলিয়া সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
উপন্যাস : শ্রীকান্ত (তৃতীয় পর্ব) Chapter : 14 Page: 104
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শ্রীকান্ত (তৃতীয় পর্ব)
- Read Time: 1 min
- Hits: 221