লোকটি জানাইল যে, সকালে একবাটি সাগু দিয়াছিল তাহা সে কোন্‌কালে খাইয়া ফেলিয়াছে। তখন হইতে সে গেটের কাছে বসিয়া থাকে, ভিক্ষা পায় ত আর একবেলা খাওয়া চলে, না হয় ত উপবাসে কাটে। ডাক্তার একজন আছেন, বোধ হয় যৎসামান্য হাতখরচা মাত্র বন্দোবস্ত আছে, সকালবেলায় একবার করিয়া তাঁহার দেখা পাওয়া যায়। আর একটি লোক নিযুক্ত আছে, তাহাকে কম্পাউণ্ডারি হইতে শুরু করিয়া লন্ঠনে তেল দেওয়া পর্যন্ত সমস্তই করিতে হয়। পূর্বে একজন চাকর ছিল বটে, কিন্তু মাস-ছয়েক হইল মাহিনা না পাওয়ায় রাগ করিয়া চলিয়া গেছে, এখনও নূতন কেহ ভর্তি হয় নাই।

জিজ্ঞাসা করিলাম, ঝাঁটপাট কে দেয়?

লোকটি বলিল, আজকাল আমিই দি। আমি চলে গেলে আবার যে নতুন রোগী আসবে সেই দেবে।

কহিলাম, বেশ ব্যবস্থা। হাসপাতালটি কার জান?

লোকটি আমাকে ওদিকের বারান্দায় লইয়া গেল। কড়ি হইতে একটি টিনের লন্ঠন ঝুলিতেছে। কম্পাউণ্ডারবাবু বেলাবেলি সেটি জ্বালিয়া দিয়া কাজ সারিয়া ঘরে চলিয়া গেছেন। দেয়ালের গায়ে আঁটা মস্ত একটি মর্মর প্রস্তর-ফলক—সোনার জল দিয়া ইংরাজী অক্ষরে আগাগোড়া খোদাই-করা সন-তারিখ সংবলিত শিলালিপি। জেলার যে সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট দয়া করিয়া ইহার উদ্বোধনকার্য সম্পন্ন করিয়াছিলেন তাঁহার নাম-ধাম সর্বাগ্রে, নীচে প্রশস্তি-পাঠ। কে একজন রায়বাহাদুর তাঁহার রত্নগর্ভা মাতার স্মৃতিরক্ষার্থে জননী-জন্মভূমিতে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। আর শুধু মাতা-পুত্রই নয়, ঊর্ধ্বতন তিন-চারি পুরুষের বিবরণ। বোধ করি ছোটখাটো কুলকারিকা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। লোকটি যে রাজসরকারে রায়বাহাদুরির যোগ্য তাহাতে লেশমাত্র সন্দেহ নাই। কারণ টাকা নষ্ট করার দিক দিয়া ত্রুটি ছিল না। ইট ও কাঠ এবং বিলাতের আমদানি লোহার কড়ি-বরগার বিল মিটাইয়া অবশিষ্ট যদি বা কিছু থাকিয়া থাকে সাহেব শিল্পীর হাতে বংশগৌরব লিখাইতেই তাহা নিঃশেষিত হইয়াছে। ডাক্তার ও রোগীর ঔষধ-পথ্যাদির ব্যাপারের ব্যবস্থা করিবার হয়ত টাকাও ছিল না, ফুরসতও ছিল না।

প্রশ্ন করিলাম, রায়বাহাদুরের বাড়ি কোথায়?

সে কহিল, বেশি দূরে নয়, কাছেই।

এখন গেলে দেখা হবে?

আজ্ঞে না, বাড়িতে তালাবন্ধ, তাঁরা সব কলকাতায় থাকেন।

জিজ্ঞাসা করিলাম, কবে আসেন জান?

লোকটি বিদেশী, সঠিক সংবাদ দিতে পারিল না, তবে কহিল যে, বছর-তিনেক পূর্বে একবার আসিয়াছিলেন একথা সে ডাক্তারবাবুর মুখে শুনিয়াছে। সর্বত্র একই দশা, অতএব দুঃখ করিবার বিশেষ কিছু ছিল না।
৭৫০

এদিকে অপরিচিত স্থানে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইতেছিল, সুতরাং রায়বাহাদুরের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করার চেয়ে জরুরি কাজ বাকি ছিল। লোকটিকে কিছু পয়সা দিয়া জানিয়া লইলাম যে, নিকটই একঘর চক্রবর্তী ব্রাহ্মণের বাটী। তাঁহারা অতিশয় দয়ালু, এবং রাত্রিটার মত আশ্রয় মিলিবেই। সে নিজেই রাজি হইয়া আমাকে সঙ্গে লইয়া চলিল, কহিল, তাহাকে ত মুদির দোকানে যাইতেই হইবে, একটুখানি ঘুরপথ, কিন্তু তাহাতে কিছু আসে যায় না।

চলিতে চলিতে তাহার কথাবার্তায় বুঝিলাম, এই দয়ালু ব্রাহ্মণ পরিবার হইতে সে পথ্যাপথ্য অনেক রাত্রিই গোপনে সংগ্রহ করিয়া খাইয়াছে।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়