না, যাবে না, একটা কোন পথ ঠাকুর নিশ্চয় দেখিয়ে দেবেন।
যদি কখনো তোমার ডাক পড়ে, ফিরে যাবে সেখানে?
না।
তাঁরা যদি অনুতপ্ত হয়ে তোমাকে ফিরে চান?
তবুও না।
একটু পরে কি ভাবিয়া কহিল, শুধু যাব যদি তুমি যেতে বল। আর কারো কথায় না।
কিন্তু কোথায় তোমার দেখা পাব?
এ প্রশ্নের সে উত্তর দিল না, চুপ করিয়া রহিল। বহুক্ষণ নিঃশব্দে কাটিলে ডাকিলাম, কমললতা? সাড়া আসিল না, চাহিয়া দেখিলাম সে গাড়ির এককোণে মাথা রাখিয়া চোখ বুজিয়াছে। সারাদিনের শ্রান্তিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে ভাবিয়া তুলিতে ইচ্ছা হইল না। তারপরে নিজেও যে কখন ঘুমাইয়া পড়িলাম জানি না। হঠাৎ একসময়ে কানে গেল—নতুনগোঁসাই?
চাহিয়া দেখি সে আমার গায়ে হাত দিয়া ডাকিতেছে। কহিল, ওঠ, তোমার সাঁইথিয়ায় গাড়ি দাঁড়িয়েছে।
তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিলাম, পাশের কামরায় কিষণ ছিল, ডাকিয়া তুলিতে সে আসিয়া ব্যাগ নামাইল, বিছানা বাঁধিতে গিয়া দেখা গেল যে দু-একখানায় তাহার শয্যা রচনা করিয়া দিয়াছিলাম সে তাহা ইতিপূর্বেই ভাঁজ করিয়া আমার বেঞ্চের একধারে রাখিয়াছে। কহিলাম, এটুকুও তুমি ফিরিয়ে দিলে?—নিলে না?
কতবার ওঠানামা করতে হবে, এ বোঝা বইবে কে?
দ্বিতীয় বস্ত্রটিও সঙ্গে আনোনি—সেও কি বোঝা? দেব দু-একটা বার করে?
বেশ যা হোক তুমি। তোমার কাপড় ভিখিরির গায়ে মানাবে কেন?
বলিলাম, কাপড় মানাবে না, কিন্তু ভিখারিকেও খেতে হয়। পৌঁছতে আরও দু’দিন লাগবে, গাড়িতে খাবে কি? যে খাবারগুলো আমার সঙ্গে আছে তাও কি ফেলে দিয়ে যাব—তুমি ছোঁবে না?
কমললতা এবার হাসিয়া বলিল, ইস্, রাগ দ্যাখো। ওগো, ছোঁব গো ছোঁব, থাক ও-সব, তুমি চলে গেলে আমি পেটভরে গিলবো।
সময় শেষ হইতেছে, আমার নামিবার মুখে কহিল, একটু দাঁড়াও ত গোঁসাই; কেউ নেই, আজ লুকিয়ে তোমায় একটা প্রণাম করে নিই। এই বলিয়া হেঁট হইয়া আজ সে আমার পায়ের ধূলা লইল।
প্ল্যাটফর্মে নামিয়া দাঁড়াইলাম। রাত্রি তখনো পোহায় নাই। নীচে ও উপরে অন্ধকার স্তরে একটা ভাগাভাগি শুরু হইয়াছে, আকাশের একপ্রান্তে কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর ক্ষীণ শীর্ণ শশী, অপর প্রান্তে ঊষার আগমনী। সেদিনের কথা মনে পড়িল, যেদিন ঠাকুরের ফুল তুলিতে এমনি সময়ে তাহার সাথী হইয়াছিলাম। আর আজ?
উপন্যাস : শ্রীকান্ত (চতুর্থ পর্ব) Chapter : 14 Page: 133
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শ্রীকান্ত (চতুর্থ পর্ব)
- Read Time: 1 min
- Hits: 197