গেটের দরজা খুলে পারুল হাসিমুখে বলল, আসুন পল্টু ভাই, আপনি সত্যি সত্যি আসবেন ভাবতেই পারিনি।

পল্টু সাহেবের গায়ে সুন্দর একটা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির বোতামগুলি সোনার। আলো পড়ে ঝকঝক করছে। তার চোখে সানগ্লাস। তিনি সানগ্লাস খুলে হাতে নিতে নিতে খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, এত বড় বাড়ি।

হুঁ। বিরাট বাড়ি।

বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভেতরে এত সুন্দর একটা বাড়ি। তোমার স্বামী কোথায়? তাহের, আবু তাহের?

ও বাসায় নেই। এ তো সকালে যায়। একেবারে সন্ধ্যায় আসে।

তাহেরকে বলেছিলাম ছবিসহ বায়োডাটা দিতে। দেয়নি। আমি দু-এক জায়গায় কথা বলেছি। ওকে পাঠিয়ে দিও।

জ্বি আচ্ছা, পাঠাব।

পারুল গেটে তালা দিতে দিতে বলল, আপনি আসায় আমি কি যে খুশি হয়েছি। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল, আবার একবার আপনার সঙ্গে দেখা হবে।

তুমি খুব সুন্দর হয়েছ পারুল।

সত্যি বলছেন তো?

হ্যাঁ সত্যি।

আপনি কিন্তু আগের মতই আছেন।

বুড়ো হয়েছি তো।

বুড়ো বুড়ো কিন্তু লাগছে না।

তুমি ছাড়া আর কেউ এ বাড়িতে থাকে না?।

না।

পারুল হাসছে। খিল খিল করে হাসছে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, একটু দাঁড়ান পল্টু ভাই। এক মিনিট। আমার তিনটা কুকুর আছে। এদের ছেড়ে দিয়ে আসি। এই সময় এরা খানিকক্ষণ বাগানে চক্কর দেয়। সময়মত না ছাড়লে খুব রাগ করে।

কি ধরনের কুকুর?

গ্রে হাউন্ড।

গ্রে হাউড ভাল কুকুর। বাড়ি পাহারার জন্যে আদর্শ। আমার নিজেরো একটা ছিল। কুমিল্লার সরাইলের কুকুর। গ্ৰ হাউরেই একটা ভ্যারাইটি। মারা গেছে। তোমার এই কুকুরগুলির ভেতর মাদি কুকুর আছে?

আছে–নিকি। নিকি হল মেয়ে কুকুর।

বাচ্চা হলে দেখ তো আমাকে একটা দেয়া যায় কি-না।

আপনি চাইলে অবশ্যই দেব। আপনি কিছু আমার কাছে চাইবেন আর আমি দেব না, তা কখনো হবে না। যা চাইবেন তাই পাবেন। কুকুরের ছানা ছাড়া আর কিছু চান?

পল্টু সাহেব আনন্দের হাসি হেসে বললেন–আপাতত এক কাপ চা চাচ্ছি। তারপর দেখা যাক…

পারুল কুকর ছেড়ে দিয়েছে। তারা একবার অপরিচিত মানুষটার দিকে তাকালো, তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে বাড়ির চারদিকে হাঁটতে শুরু করল। পল্টু সাহেব বললেন–এ তো দেখি ভংয়কর কুকুর। এদের ম্যানেজ কর কিভাবে?

এরা আমাকে খুব পছন্দ করে। আমাকে খুব মানে। যা করতে বলি তাই করে। পল্টু ভাই আসুন, আমরা বাগানে বসে চা খাই। চা খাবার পর আপনাকে ঘরে নিয়ে যাব। এখানে দাঁড়ান, আমি চেয়ার নিয়ে আসি।

চেয়ার লাগবে না। আমি ঘাসের উপরই বসছি।

তাহলে বসুন। আমি চা বানিয়ে আনছি।

তিনি বসলেন। সিগারেটের জন্যে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়েই তার গা হিম হয়ে গেল। তিনটা কুকুর পায়ে পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তিনজন তিন দিক থেকে আসছে। পালিয়ে যাবার পথ নেই। তিনি ভাঙা গলায় ডাকলেন–পারুল, এই পারুল।

পারুল স্টোভ জ্বালিয়ে চায়ের কেতলি বাসিয়েছে। তার মুখ হাসি হাসি। পল্টু সাহেব উঁচু গলায় ডাকলেন–পারুল, পারুল!

পারুল বলল, চা বানাচ্ছি তো।

দুটি কুকুর পটু সাহেবকে ঘিরে চক্রাকারে ঘুরছে। একজন স্থির হয়ে আছে। তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। সে কোন একটা সংকেতের অপেক্ষা করছে। সংকেত পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।

তার পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে জব জব করছে। তিনি পেছনে ফিরলেন–পিছনে বড় একটা গর্ত।

তিনি ব্যাকুল হয়ে ডাকলেন, পারুল, পারুল!

পারুল চায়ের কাপ হাতে বের হয়ে এল। তিনি ভীত গলায় বলল, দেখ কুকুরগুলি কেমন যেন করছে।

পারুল হাসতে হাসতে বলল, ওরা এরকম করে। এটা ওদের একটা খেলা।

খেলা দেখে আমি ভয়ে প্রায় মারা যাচ্ছিলাম। শুধু আমার জন্যে চা এনেছে? তুমি খাবে না?

না। চিনি হয়েছে কি-না দেখুন।

তিনি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন–পারফেক্ট চিনি হয়েছে। ভেরি গুড। বুঝলে পারুল, তোমার ঐ কুকুর তিনটার কাণ্ডকারখানা দেখে ভয় যা পেয়েছিলাম বলার না। একবার ইচ্ছা করছিল লাফ দিয়ে গর্তে পড়ে যাই।

পারুল হাসছে। খিল খিল করে হাসছে। তিনি হৃষ্ট গলায় বললেন, তোমার হাসি খুব সুন্দর।

পারুল বলল, আমার শরীরও খুব সুন্দর, তাই না পল্টু ভাই? ছোটবেলায় যত সুন্দর ছিল এখন তারচেয়েও সুন্দর হয়েছে। আমার স্বামী তো বোকা মানুষ। সৌন্দর্য নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু আপনি হলেন রূপের উপাসক।

পল্টু সাহেব আবার অস্বস্তি বোধ করা শুরু করেছেন। পারুল তার কাছ থেকে দূরে। সরে গেছে। কুকর দুটি আবার চক্রাকারে ঘোরা শুরু করেছে। একটা কুকর শুধু স্থির হয়ে আছে।

পারুল ডাকল, নিকি।

নিকির শরীর ঋজু হয়ে গেলো। তাকে এখন আর কুকুর বলে মনে হচ্ছে না। মনে। হচ্ছে গ্রানাইট পাথরের মূর্তি। পল্টু সাহেবের হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল। তিনি কি যেন বলতে গেলেন–বলতে পারলেন না। নিকি বিদ্যুতের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ