কিছুক্ষণ আগেও টক-টক করে ঘড়ির শব্দ হচ্ছিল।

এখন সেই শব্দও শোনা যাচ্ছে না। পুরো বাড়িটা হঠাৎ করেই যেন শব্দহীন হয়ে গেল। এত বড় একটা বাড়িতে কত রকমের শব্দ হবার কথা–বাতাসের শব্দ, পর্দা নড়ার শব্দ, টিকটিকি ডেকে ওঠার শব্দ। এখন কিছু নেই। এই যে পারুল নিঃশ্বাস ফেলছে সেই নিঃশ্বাসের শব্দও সে নিজে শুনতে পাচ্ছে না। আজ যে এটা প্রথম হচ্ছে তাই না, আগেও কয়েকবার হয়েছে। কেন এ রকম হয়? না কি পারুলের কোন অসুখ করেছে? বিচিত্র কোন অসুখ, যাতে মানুষ কিছু সময়ের জন্যে বধির হয়ে যায়। তার পৃথিবী হয় শব্দশুন্য। পৃথিবীতে কত ধরনের অসুখ আছে–এ ধরনের অসুখ থাকতেও তো পারে।

রাত কটা বাজে? দুটা না তিনটা? সময় জানার উপায় নেই। পারুল যে কামরায় শুয়েছে সেখানে কোন ঘড়ি নেই। ঘড়ি দেখতে হলে পাশের কামরায় যেতে হবে। সেখানে মানুষের চেয়েও উঁচু একটা ঘড়ি আছে। গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। সেই ঘড়ির। পেন্ডুলামই এতক্ষণ টক-টক করছিল। এখন করছে না, কিংবা হয়তো এখনো করছে, পারুল শুনতে পারছে না, কারণ তার বিচিত্র কোন অসুখ করেছে।

পারুল পাশ ফিরল। কান পেতে রাখল–পাশ ফেরার কারণে তোষকে কোন শব্দ হয় কি না। তাও হল না। কি আশ্চর্য কথা। সে ভয়ার্ত গলায় ডাকল, এই এই। শুনছ, এই।

তাহের সঙ্গে সঙ্গে বলল, উঁ।

এতে পারুলের ভয় কাটল। যে ভয় হঠাৎ আসে, সেই ভয় হঠাৎই কাটে। পারুল এখন পুরোপুরি নিশ্চিন্ত বোধ করছে। দেয়াল ঘড়ির টক-টক শব্দটাও এখন পাওয়া যাচ্ছে। না, টক-টক শব্দ না, শব্দটা হল টক টকাস, টক টকাস। পারুল তাহেরের গায়ে একটা হাত তুলে দিল। তাহের কিছু বলল না। কারণ তার ঘুম ভাঙেনি। পারুলের ডাক শুনে সে উ বলেছে ঠিকই, সেই কথা ঘুমের মধ্যে বলা। জেগে থাকলে তাহেরের গায়ে হাত রাখা যেত না। বিরক্ত হয়ে সে হাত সরিয়ে দিত। শরীবের সঙ্গে শরীর লাগিয়ে ঘুমুতে তার নাকি অসহ্য লাগে।

ঘামে তাহেরের গা ভেজা।

সে পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে শুয়েছে। ঘামে সেই পাঞ্জাবি ভিজে চপচপ করছে। অথচ গরম তেমন না। আজকের আবহাওয়া এম্নিতেই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা, তার উপর সিলিং ফ্যান রছে ফুল স্পীডে। মশারি খাটানো হয়নি বলে ফ্যানের পুরো বাসটা গায়ে লাগছে। জানালা খোলা। খোলা জানালা দিয়ে ভাল হাওয়া আসছে। পারুলের বরং শীত শীত লাগছে। অথচ মানুষটা কেমন ঘামছে। ঘামে ভেজা একটা মানুষের শরীরে হাত রাখতে ভাল লাগে না। কিন্তু হাতটা সরিয়ে নিতেও পারুলের ইচ্ছা করছে না। তার মনে হচ্ছে হাত সরিয়ে নিলেই আবার আগের মত হবে। জগৎ আবারো শব্দহীন হয়ে যাবে। তারচে ঘামে ভেজা মানুষের গা ঘেঁসে থাকা অনেক ভাল। পারুল তাহেরের আরো কাছে এসে ডাকল, এই এই।

তাহের সঙ্গে সঙ্গে বলল, উঁ।

কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে। বাতি জ্বালিয়ে রাখি?

আচ্ছা।

তুমি কি ঘুমের মধ্যে কথা বলছ না, জেগে আছ?

উঁ!

উঁ আবার কি? ঠিক করে বল, জেগে আছ?

আছি।

পারুল মনে মনে হাসল। পৃথিবীতে কত বিচিত্র স্বভাবের মানুষ থাকে। লোকটা ঘুমের মধ্যে কি স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই না কথা বলছে। তার স্বভাব-চরিত্র না জানা থাকলে অন্য যে কেউ ভাববে সে জেগে।

ঘুমন্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলার অনেক মজা। পারুল তাহেরের সঙ্গে এই মজাটা মিই করে। এখনো করতে ইচ্ছা করছে। পারুল বলল, এই, ঠাণ্ডা পেপসি খাবে?

হুঁ।

আনব?

আন।

বরফ দিয়ে আনব না বরফ ছাড়া?

বরফ।

আচ্ছা বেশ, বরফ দিয়েই আনব। পেপসি খাবার পর কি খাবে? ইঁদুর মারা বিষ বে? র‍্যাটম?

হুঁ।

হুঁ না, মুখে বল। যদি খেতে চাও বল–খাব।

খাব।

পারুল খিলখিল করে খানিকক্ষণ হাসল। এই বাড়ির ছাদ অনেক উঁচু সে জন্যেই বোধহয় হাসির শব্দ অনেকক্ষণ ঘরে হলে থাকল। হাসা উচিত হয়নি। আসার কারণে। পারুলের ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেছে। এখন আর বিছানায় শুয়ে থেকেও কিছু হবে না। শুধু শুধু শুয়ে থেকেই বা কি হবে? সে খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামল। এই ঘরের বাতি জ্বালানো যাবে না। কারণ বাতি চোখে পড়া মাত্র তাহের উঠে বসে বিরক্ত ভঙ্গিতে। বলবে–ব্যাপার কি? লাইট জ্বালাল কে?

পারুল পা টিপে টিপে পালের ঘরে যাচ্ছে। পাশের ঘরের গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের সামনে বসে থাকতে তার মন্দ লাগে না। লম্বা পেন্ডুলামটা এমনভাবে দুলে মনে হয় ওটা কোন মন্ত্র না, জীবন্ত কিছু। হাত-পা দুলছে। এই ঘরে স্ট্যান্ড বসানো ছয় ফুট লম্বা একটা আয়নাও আছে। আয়নাটা পারুলের ভাল লাগে না। আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনে হয় আয়নায় যাকে দেখা যাচ্ছে সে অন্য একটা মেয়ে। অচেনা কেউ। বুকের মধ্যে ধ্বক করে ওঠে। তাহেরকে সে বেশ কয়েকবার বলেছে, আচ্ছা, এই আয়নায় নিজেকে দেখে আমি চমকে উঠি কেন?

তাহের বলেছে– এত বড় আয়না দেখে তো তোমার অভ্যেস নেই। সারাজীবন দেখেছ ছোট ছোট আয়না। এখন হঠাৎ করে নিজের পুরো শরীর দেখে চমকাচ্ছ। তাছাড়া…

তাছাড়া কি?

তোমার চমকানো রোগ আছে। অকারণেই তমি চমকাও।

কে বলল অকারণে চমকাই?

ঐদিন নিজের ছায়া দেখে চমকে চিৎকার করে উঠলে না?

ছায়া দেখে চমকানোর অবশ্যি কারণ ছিল। এই বাড়ির বাতিগুলি এমন যে, বিশ্রী বিশ্রী ছায়া পড়ে। গতকাল রাতে তার একটা সরু ছায়া পড়েছিল দেয়ালে। লম্বাটে লাঠির মত ছায়া–সেই লাঠিতে আবার হাত আছে, পা আছে। যে কোন মানুষ এটা দেখলে ভয়ে চিৎকার দিত।

এই বাড়িটায় কিছু আছে কি না কে জানে। কিছু কিছু বাড়ি থাকে দেশ লাগা। জীবন্ত প্রাণীর মত স্বভাব থাকে সেসব বাড়ির। জীবন্ত প্রাণী যেমন মানুষকে আগ্রহ। নিয়ে দেখে–দোষ লাগা বাড়িগুলিও তাই করে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এই যে পারুল চুপি চুপি পাশের ঘরে যাচ্ছে–বাড়িটা সে ব্যাপারটা দেখছে। আগ্রহ নিয়েই দেছে। পারুলের ভয় ভয় করছে–ইচ্ছা করছে আবার তাহেরের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়তে। এই বাড়িতে বেশিদিন থাকা ঠিক হবে না। বেশিদিন থাকলে ভয়েই পারুলের কোন অসুখ-বিসুখ হয়ে যাবে। শরীরের এই অবস্থায় অসুখ-বিসুখ হওয়া ভাল না। পারুলের এখন দুমাস চলছে। এই সময়টাই সবচে খারাপ সময়। বেশিরভাগ এবোরশন এই সময়ে হয়।

তাদের অবশ্যি বেশিদিন থাকতে হবে না। আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত থাকবে। মঙ্গলবার আসতে আর মাত্র চারদিন।

 

অন্ধকারে সুইচ বোর্ড খুঁজে পাওয়া যায় না। দিক এলোমেলো হয়ে যায়। পুবকে মনে হয় পশ্চিম। পশ্চিমকে মনে হয় দক্ষিণ। পারুলের ভাগ্য ভাল, প্রথমবারেই সে সুইচ খুঁজে পেল। বাতি জ্বালাল। তার সামনেই আমন। পানি দেখলে যেমন ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে, আয়না দেখলেই তেমন তাকাতে ইচ্ছা করে। আয়নার ভেতর। নিজেকে দেখতে ইচ্ছা করে। পারুল কিন্তু তাকাল না। চোখ ঘুরিয়ে নিল এ্যাডফাদার ক্লকে। কি সুন্দর তালে তালে শব্দ হচ্ছে—টক-টকাস, টক-টকাস। তার প্রচণ্ড ইচ্ছা করছে মাথা ঘুরিয়ে আয়নাটার দিকে তাকাতে। এত জোরালো ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করতে হলে এই ঘরে থাকা যাবে না। পারুল বসার ঘরের দিকে রওনা হল।

বসার ঘরের সুইচ বোর্ডে অনেকগুলি সুইচ। তার ইচ্ছা করছে ঝাড়বাতির সুইচটা জ্বালাতে। এই বাড়ির ঝাড়বাতি কি যে সুন্দর! মনে হয় দশ হাজার মোমবাতি এক সঙ্গে জ্বলে ওঠে। শুধু জ্বলেই শেষ না–জোনাকি পোকার মত মিটমিট করতে থাকে। এরকম একটা ঝাড়বাতির দাম কত হবে? তাহের সারা জীবন কত টাকা রোজগার করবে তা দিয়ে কি একটা ঝাড়বাতি কেনা যাবে? মনে হয় না। তবে মানুষের ভাগ্য তো। কিছুই বলা যায় না। পথের ফকিরও কোটিপতি হয়। তাদের জীবনেও এমন কিছু ঘটতে পারে। যদি ঘটে তাহলে পারুল ঠিক করে রেখেছে সে প্রথম যে জিনিসটা করবে তা হচ্ছে–ঝাড়বাতি কেনা। ঠিক এরকম একটা ঝাড়বাতি। ঝাড়বাতিটা সে শুধু জ্বালাবে বিশেষ বিশেষ রাতে। যেমন তাদের বিয়ের রাত।

পারুল সুইচ টিলপ। ফ্যানের শব্দ হচ্ছে। ফ্যান ঘুরছে। সুইচ অফ করতে ইচ্ছা করছে না। ঘুরুক ফ্যান। ইলেকট্রিসিটি খরচ হচ্ছে? হোক না। তাদের তো আর ইলেকট্রিসিটির বিল দিতে হবে না। যার বাড়ি তিনি দেবেন এবং তিনি নিশ্চয়ই লেকট্রিসিটির বিলের মত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে মাথা ঘামান না। হয়ত কোনদিন দেখেনও কত বিল এসেছে। পারুল আরেকটা সুইচ টিপল–রকিং চেয়ারের পাশে লম্বা চার ল্যাম্প জ্বলে উঠল। জোর ল্যাম্পের আলো নীলভি। কেমন যেন চাঁদের আলোর ত মায়া মায়া ধরনের আলো। সবগুলি সুইচ টিপে ধরলে কেমন হয়? যার বাড়ি তিনি তো আর আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখেছেন না–পারুল কি করছে।

যার বাড়ি তার নাম মেসবাউল করিম। তিনি আছেন হাজার হাজার মাইল দূরে। সুইজারল্যান্ড নামের একটা দেশে। যে শহরে আছেন সে শহরের নাম কেপহর্ন সিটি। সেই সিটি পাহাড়ের উপর। পাহাড়ি বরফে ঢাকা। সবই তাহেরের কাছে শোনা। তাহের এমনভাবে চোখ বড় বড় করে গল্প করে যে পারুলের মনে হয়–সে বোধহয় বরফে ঢাকা কেপহর্ন সিটির পাহাড় নিজে গিয়ে দেখে এসেছে।

বুঝলে পারুলমণি–সে এক দেখার মত দৃশ্য। ঢেউয়ের মত পাহাড়ের সাড়ি। চূড়াগুলি বরফে ঢাকা। পাহাড়ের নিচে ঝাউবন। ঝাউবনের ফাঁকে ফাঁকে ছবির মত সব ভিলা। এরা বলে উইন্টার রিসোর্ট। ঐসব বাড়িতে যারা থাকে তারা কি করে জান? তারা ফায়ার প্রেসে আগুনের সামনে বসে। হাতে থাকে বিয়ারের ক্যান। বিয়ারের ক্যানে একটা করে চুমুক দেয় আর অলস চোখে তাকায় জানালার দিকে…

তুমি জানলে কি করে? তুমি কি দেখেছ কখনো?

সিনেমায় দেখেছি। বুঝলে পারুল, ঐ সব দেশ হচ্ছে যাকে বলে ভূস্বর্গ। আর আমাদের দেশ সেই তুলনায় ভূক। ময়লা নর্দমা। ডাস্টবিনে পচাগলা বিড়ালের। ডেডবড়ি, মুরগীর পাখনা, নাড়িভুড়ি। ফুটপাথগুলি হচ্ছে–হোমলেস মানুষের লেট্রিন। কোন সুন্দর দৃশ্য বলে কিছু নেই।

চল এক কাজ করি, এই দেশ ছেড়ে সুন্দর কোন দেশে চলে যাই।

তাহের কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ক্ষুব্ধ গলায় বলল, ঠাট্টা করছ? তোমাকে না বলেছি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করবে না। ঠাট্টা করলে মনে কষ্ট পাই।

ঠাট্টা না। একদিন আমাদের প্রচুর টাকা হবে। লক্ষ লক্ষ টাকা। তখন আমরা। একটা ঝাড়বাতি কিনব। ঝাড়বাতিটা সঙ্গে নিয়ে এই দেশ ছেড়ে দূরের কোন সুন্দর দেশে চলে যাব।

তোমার মাথাটা খারাপ পারুল। সত্যি খারাপ।

 

পারুল সব কটা সুইচ জ্বালিয়ে দিল। বসার ঘটা এখন আলোয় আলোয় ঝলমল করছে। সুন্দর লাগছে। পারুল নীল রঙের রকিং চেয়ারটায় বসল। চেয়ারটা। আপনাআপনি দুলছে। পারুলের মনে হল, এখন যদি কোন কারণে তাহেরের ঘুম ভেঙে যায়, সে ভয়ানক অবাক হবে। পারুলের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলবে–তোমার মাথাটা খারাপ পারুল। তোমার মাথাটা সত্যি খারাপ।

যার বাড়ি তিনি যদি পারুলকে দেখেন তাহলে তিনি কি ভাববেন? ধরা যাক, তিনি কেপহর্ন সিটি থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। পেন থেকে নেমে বিকল্প ট্যাক্সি ভাড়া করে সোজা চলে এসেছেন। দারোয়ান গেট খুলে দিয়েছে। তিনি গেটের ভেতর ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেলেন, কারণ ড্রয়িং রুমের সব বাতি জ্বলছে। তিনি দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, এই বাতি জ্বলছে কেন? দারোয়ান বলল, জানি না, স্যার।

তিনি রাগী চোখে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। দারোয়ান মাথা চুলকাতে কবে। তখন ড্রয়িং রুমে খুট করে শব্দ হবে। তিনি বলবেন না–ড্রয়িং রুমে কে? রোয়ান সে কথার জবাব না দিয়ে আরো দ্রুত মাথা চুলকাতে থাকবে।

মেসবাউল করিম সাহেবের কাছে চাবি আছে, তিনি সেই চাবি দিয়ে ড্রয়িং রুমের প্রজা খুলে দেখবেন অত্যন্ত পিবতী একটি মেয়ে রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে। গর ল্যাম্পের আলোয় তাকে পরীর মত দেখাচ্ছে। মেয়েটার গায়ে কাপড়ও বেশি ই। শুধু একটা শাড়ি। ঘুমুবার সময় সে শাড়ি ছাড়া আর কিছু পরতে পারে না। তিনি হতভম্ব গলায় বললেন, হু আর ইউ? তুমি কে?

আমি পারুল।

পারুল। পারুল কে? তুমি এখানে কি করছ?

দোল খাচ্ছি।

দোল থাছি মানে কি?

আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করছি না। আপনার রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছি। আর বাতিগুলি শুধু জ্বালিয়ে রেখেছি।

তুমি কে? তুমি আমার বাড়িতে ঢুকলে কি করে?

এত চেঁচিয়ে কথা বলছেন কেন? আমার স্বামী ঘুমুচ্ছে। ঘুম ভেঙে গেলে ও খুব করে।।

স্বামী-সংসার নিয়ে উঠে এসেছ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কে তোমার স্বামী?

ওর নাম তাহের। আপনার গ্রাম সম্পর্কের চেনা মানুষ। আপনি যখন দেশের রে যান তখন ওকে বলেন মাঝে মাঝে আপনার বাড়ি পাহারা দিতে। ও হচ্ছে একজন পাহারাদার। ভদ্র ভাষায় কেয়ারটেকারও বলতে পারেন। বছরে এক মাস দু মাস সে আপনার বাড়ি পাহারা দেয়। বিনিময়ে প্রায় কিছুই পায় না। তারপরও হাসিমুখে পাহারা দেয় এই আশায় যে, একদিন আপনি তাকে কোন একটা সুবিধা করে দেবেন। কোন একটা চাকরি জোগাড় করে দেবেন। ও বেকার। এখন কি আপনি ওকে চিনতে পেরেছেন? সুন্দর মত চেহারা। লম্বা, মাথা ভর্তি চুল। সুন্দর হলে কি হবে—মাকাল ফল। কোন কাজের ফল না। চিনতে পারলেন?

হ্যাঁ। কিন্তু ও যে বিয়ে করেছে তা তো জানতাম না।

ওর বিয়ে তো এমন কোন বড় ব্যাপার না যে আপনার মত মানুষ জানবে। গরীব মানুষের আবার বিয়ে কি? আমরা বিয়ে করেছি কাজির অফিসে। আমাদের বিয়েতে কত খরচ হয়েছিল জানেন? সর্বমোট খরচ হয়েছে তিনশ একুশ টাকা। তারপরেও তাহের মুখ কালো করে বলেছে–ইস, এতগুলি টাকা চলে গেল।

তোমার এইসব কেচ্ছা কে শুনতে চাচ্ছে?

আহা, একটু শুনুন না। কেউ তো শুনতে চায় না। বিয়ের পর কি ঘটনা ঘটল শুনলে আপনার আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে। আমাদের গোপন বিয়ের ছবির পরদিন রাত। দশটার দিকে জানাজানি হয়ে গেল। আমি থাকি বড়চাচার সঙ্গে। তিনি হাউই বাজির মত লাফালাফি করতে লাগলেন। কি রাগ! তারপর তিনি করলেন কি জানেন–চাচীকে বললেন–লাথি দিয়ে হারামজাদীকে বের করে দাও। আমাকে রাত এগারোটায় সত্যি সত্যি বের করে দিল। আচ্ছা, গল্পটা কি আপনার বিশ্বাস হচ্ছে? ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছেন কেন?

তুমি আমার বাড়িতে এসে জুটলে কি করে?

ও এনে তুলেছে। ওর একা একা থাকতে খারাপ লাগে, তাই নিয়ে এসেছে। নতুন বিয়ে তো, বৌকে সব সময় কাছে রাখতে ইচ্ছে করে। এর মত অবস্থায় পড়লে আপনিও তাই করতেন। ভাল কথা, আপনার স্ত্রীর নাম কি?

আমার স্ত্রীর নাম দিয়ে তোমার দরকার নেই। তাহের কোথায়?

একটু আগেই না আপনাকে বললাম, ঘুমুচ্ছে। পাশের ঘরে ঘুমুচ্ছে। ডাকব?

তোমরা কি আমার বেডরুমে ঘুমুচ্ছ?

ছি না। আপনার বেডরুম তালাবন্ধ। তালা খোলা হয়নি। এখন ঘুমুচ্ছি গেস্টরুমে। একতলায় আপনি যে ঘরে ওকে ঘুমুতে বলেছিলেন ও সেখানেই থাকত। কিন্তু আপনি বোধহয় জানেন ঐ ঘরের ফ্যানটা নষ্ট। ও আবার গরম সহ্য করতে পারে না। কাজেই আমরা দোতলায় গেস্টরুমে চলে এসেছি। ওর খুব ইচ্ছা ছিল গেস্টরুমের এসিটা চালানোর। চেষ্টাও করেছে। চলে না। আচ্ছা, আপনার গেস্টরুমের এসিটা কি নষ্ট?

গেস্টরুম তো তালাবন্ধ ছিল, তোমরা ঢুকলে কি করে?

আমি তালা খুলেছি। কি ভাবে খুলেছি জানেন? চুলের কাটা দিয়ে। চুলের কাটা দিয়ে তালা খোলায় আমি একজন বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশের যে কোন চোরের দল আমার এই প্রতিভার খবর পেলে আমাকে তাদের দলে নিয়ে নিত।

 

ঢং ঢং করে দুটা ঘন্টা পড়ল। গ্রান্ডফাদার ক্লকে দুটা বাজার সংকেত দিচ্ছে। পারুল চমকে উঠল। মনে হল ঘণ্টাগুলি ঠিক বুকের মধ্যে পড়েছে। অবিকল পরীক্ষার হলের ঘন্টার মত। আশ্চর্য, ঘণ্টার শব্দ থেমে যাচ্ছে না, ঘরে ভেসে বেড়াচ্ছে। টননননন শব্দ হচ্ছেই। এরকম তো কখনো হয় না। আজ হচ্ছে কেন? ঝাড়বাতিটাও দুলছে। আগে তো দুলেনি। ঘরে এত আলো। দিনের মত চরিদিক ঝক ঝক করছে, তারপরেও তীব্র ভয়ে পারুল অস্থির হয়ে গেল। ভয়ের আসল কারণ ঘণ্টার শব্দ না, ঝাড়বাতির দুলুনিও না–আসল কারণ হচ্ছে পারুলের মনে হচ্ছে মেসবাউল করিম নামের ঐ ভদ্রলোক সত্যি সত্যি চলে এসেছেন। একা আসেননি, পুলিশ নিয়ে এসেছেন। পুলিশ তাদের ধরিয়ে দেবেন। পুলিশ তাদের কোন কথাই শুনবে না–সরাসরি জেলখানায় ঢুকিয়ে দেবে। কখন ছড়িবে কে জানে? যদি সাত-আট মাস রেখে দেয় তাহলে তো সর্বনাশ। তখন বাবুর পৃথিবীতে আসার সময় হয়ে যাবে। তার জন্ম কি জেলখানায় হবে নাকি? তাদের যেন জেলখানায় না দেয়া হয় এই ব্যবস্থা করতে হবে। পারুল বলল–

আমরা যে আপনার গেস্টরুম দখল করে বসে আছি তার জন্যে কি আপনি রাগ করেছেন?

রাগ করারই তো কথা।

প্লীজ, রাগ করবেন না। আমাদের পুলিশের হাতে তুলে দেবেন না। যদি না দেন তাহলে…।

তাহলে কি?

আপনাকে খুশি করার ব্যবস্থা করব।

আমাকে কিভাবে খুশি করবে?

পারুল বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল, আর ঠিক তখন তাহেরের বিস্মিত গলা শোনা গেল–পারুল।

পারুল পাশ ফিরে দেখল–তাহের ঠিক তার পেছনে পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ শুকিয়ে এতটুক। সে তাকিয়ে আছে চোখ বড় বড় করে।

তার লঙ্গির গিঁট খুলে গেছে। এক হাতে সে লুঙ্গি সামলাচ্ছে। অন্য হাতে পর্দা ধরে।

পারুল!

কি?

করছ কি তুমি এখানে?

কিছু করছি না। ঘুম আসছে না তাই চেয়ারে বসে আছি। দোল খাচ্ছি।

তোমার কাণ্ডকারখানা আমি কিছুই বুঝি না। দুনিয়ার সব বাতি জ্বালিয়ে রেখেছ।

কি করব, ভয় লাগে যে!

ভয় লাগলে আমাকে ডেকে তুলবে। কত করে বলেছি বাতি জ্বলাবে না। বাড়ির দারোয়ান আছে, সে দেখে কি না কি রিপোর্ট করবে।

রিপোর্ট করলে ভালই হয়।

ভাল হয় মানে?

পারুল চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল, তুমি তো আর এই বাড়ির মালিকের র চাকরি কর না যে রিপোর্ট করলে তোমার চাকরি চলে যাবে। যা হবে তা হচ্ছে উনি তোমাকে আর কখনো পাহারা দিতে বলবেন না। তুমি বেঁচে যাবে।

বেঁচে যাবার কি আছে এর মধ্যে? বাড়ি পাহারা দেয়া এমন কি কঠিন কাজ?

তোমার জন্যে কঠিন না, আমার জন্যে কঠিন। এই বাড়িতে আর কিছুদিন থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব।

পারুল উঠে দাঁড়াল। তাহের বলল, তুমি যাচ্ছ কোথায়?

খিদে লেগেছে। আমি একটা বিস্কিট খাব আর এক কাপ চা খাব। তুমি চা খাবে।

রাত দুটার সময় আমি কোন দিন চা খাই?

খাও না বলেই খেতে বলছি। আজ খেয়ে দেখ, ভাল লাগবে।

তাহের বসার ঘরের সবগুলি বাতি নেভাল। ঘুমে তার চোখ জুড়িয়ে আসছে, তারপরেও সে গেল পারুলের পেছনে পেছনে। মেয়েটাকে এই বাড়িতে আনাই ভুল হয়েছে। বড়লোকি কাণ্ডকারখানা দেখে মাথা গেছে খারাপ হয়। মাথা খারাপ হবারই কথা।

স্টোভ থেকে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। স্টোভে চায়ের কেতলি চাপিয়ে পারুল বসে আছে। এ বাড়িতে বিশাল রান্নাঘর আছে। একটি না, দুটি। একতলায় একটা, দোতলায় একটা। করিম সাহেব রান্নাঘর তালাবন্ধ করে গেছেন। তাহেরের জন্যে স্টোভ দিয়ে গেছেন। চাল-ডাল আছে, তার উপর প্রতিদিন ২৫ টাকা হিসেবে ৭৫০ টাকা, হাতখরচ হিসেবে আরো ২৫০। সব মিলিয়ে এক হাজার টাকা দিয়ে গেছেন। সবই চকচকে ৫০ টাকার নোট–খরচ হতে মায়া লাগে। মাস প্রায় শেষ হতে চলল, খরচ হয়েছে চারশ। আর ছয়শ টাকা আছে। তাহের পারুলকে বাকি টাকা দিয়ে দিয়েছে। বিয়ের পর থেকে তো কখনো হাতে কিছু দেয়া হয়নি–থাকুক এই টাকাগুলি।

তাহের দেখল, পারুল দুকাপ চা বানাচ্ছে। গরম খানিকটা মিষ্টি পানি। কি হয় খৈলে? এই জিনিস পারুল এত আগ্রহ করে কেন খায় সে বুঝতে পারে না। রাত তিনটার সময় চা খেলে ঘুমের দফা রফা। তব খেতে হবে। বানানো জিনিস নষ্ট করা যায়  না। চা বানাতে দেখেই তাহেরের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে প্রকাশ করল না। পোয়াতী বউয়ের সঙ্গে মেজাজ করতে নেই। মেজাজ করলে বাচ্চাও মেজাজী হবে। বড় হয়ে বাপ-মার সঙ্গে মেজাজ করবে। বাবার সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করবে।

পারুল বলল, আচ্ছা, তুমি কখনো হাত দেখিয়েছ?

তাহের কিছু বলল না। হাত দেখার প্রসঙ্গ কেন আসছে বুঝতে পারছে না। রাত তিনটা হল ঘুমের সময়, বকবকানির সময় না।

হাত দেখাও নি?

না।

আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন একজন বড় জ্যোতিষকে হাত দেখিয়েছিলাম। তিনি আমার হাত দেখে বলেছিলেন আমার হাতে মীন পুচ্ছ আছে।

তাহের চায়ের কাপে বিরক্ত মুখে চুমুক দিচ্ছে। স্ত্রীর হাতের মীন পুচ্ছের ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ দেখা গেল না। পারুলের চোখ গল্প বলার উত্তেজনায় চকচক করছে।

মীন পুচ্ছ কাকে বলে জান? মনিবন্ধের কাছে মাছের লেজ্জের মত একটা চিহ্ন।

মীন পুচ্ছ থাকলে কি হয়?

টাকা হয়–লক্ষ লক্ষ টাকা। কোটি কোটি টাকা।

ও, আচ্ছা।

শুধু টাকা না–গাড়ি বাড়ি…দেখি তোমার হাতটা দেখি। আমার মনে হয় তোমার হাতে মীন পুচ্ছ আছে। কারণ আমার টাকা হওয়া মানে তো তোমারও হওয়া।–আমার মীন পুচ্ছ থাকলে তোমারও থাকতে হবে। হাতটা দাও তো।

তাহের চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল, চল শুয়ে পড়ি।

হাতটা দিতে বললাম না।

মীন পুচ্ছ-তুচ্ছ দেখে লাভ নেই। ঘুমতে চল।

এর আমার এখন ঘুম আসবে না।

ঘুম না আসলেও বিছানায় শুয়ে থাক।

পারুল বলল, শুধু শুধু বিছানায় শুয়ে থাকতে পারব না।

কি করবে? এখানে বসে থাকবে?

হুঁ।

এইসব পাগলামির কোন মানে হয়?

পারুল হাসছে। মনে হচ্ছে তাহেরের বিরক্তিতে সে মজা পাচ্ছে।

হাসছ কেন?

একটা কথা মনে করে হাসছি।

কি কথা।

ব্যাঞ্জের মাথা।

তাহেরের এখন রাগ লাগছে। কি কথা ব্যান্ডের মাথা জাতীয় ছেলেমানুষীর বয়স কি পারুলের আছে? দুদিন পর যে মেয়ে মা হতে যাচ্ছে। তাহের উঠে দাঁড়াল। পারুল বলল, চলে যাচ্ছি না কি?

হুঁ।

কথাটা শুনে যাবে না? আমি কেন হাসলাম না জেনেই চলে যাবে? কেন হাসছি জেনে তারপর চলে যাও। যখন চা বানাচ্ছিলাম তখন ঐ জ্যোতিষের কথা আমার মনে পড়ল। উনিও খুব চা খেতেন। এক কাপ চায়ে চার চামুচ করে তাঁর চিনি লাগত।

ঘাটনটি কি সেটা বল।

বলছি তো–তুমি এত তাড়াহুড়া করছ কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি এক্ষণি টন ধরতে যাবে। আরাম করে বোস তো। বাসে একটা সিগারেট খাও। আমি সিলেট এনে দিচ্ছি।

সিগারেট আনতে হবে না–আমি বসছি। কি বলবে তাড়াতাড়ি বল। স্টোটা নিভিয়ে দাও না–খামাখা তেল খরচ হচ্ছে।

আমি আরেক কাপ চা খাব। এই জন্যে স্টোভ জ্বালিয়ে রেখেছি।

তাহের হতাশ ভঙ্গিতে বসল। পারুল কেতলি আবার স্টোভে বসাতে বসাতে বয়ল, ঐ জ্যোতিষ ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ায় হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিল। কেন বল তো?

আমি কি করে বলব কেন?

গায়ে কাঁটা দিল, কারণ উনি বলেছিলেন–অন্যের অর্থ আমার হাতে চলে সিলে। আমি ধনী হব পরের ধনে।

এতে গায়ে কাঁটা দেবার কি আছে?

গায়ে কাঁটা দেবার অনেক কিছুই আছে। পরের ধনে ধনী হবে কথাটা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল–আচ্ছা, এই মেসবাউল করিম সাহেবের ধনে আমরা ধনী হব না তো?

এইসব কি নাই, আজেবাজে কথা?

আমার যা মনে হল বললাম। রেগে যাচ্ছ কেন?

পাগলের মত কথাবার্তা বললে রাগব না?

পাগলের মত কথা তো বলছি না। এটা কি খুব অসম্ভব ব্যাপার?

তুমি নিজে খুব ভাল করেই জান এটা কত অসম্ভব।

মোটেই অসম্ভব না। ধর, ভদ্রলোক ঠিক করলেন–তিনি আরো এক বছর সুইজারল্যান্ড থাকবেন। কাজেই আমরা এক বছর থাকলাম এ বাড়িতে। এক বছর পর ভদ্রলোক মারা গেলেন। আমরা তখন…

তাহের রাগী গলায় বলল, এইসব আজেবাজে জিনিস কখনো ভাববে না। উনি মারা গেলে সব কিছু আমাদের হয়ে যাবে–এটা কেন মনে করছ? আমরা কে?

পারুল চায়ের কাপে চা ঢালছে। তাহের লক্ষ করল, পারুল চায়ে চার চামচ চিনি দিল। এম্নিতে সে দুচামচ চিনি খায়। আজ চার চামচ চিনি কেন নিচ্ছে? জ্যোতিষের কথা মনে করে? সেই বেটা চার চামচ চিনি স্মেত বলে পারুলকেও খেতে হবে?

তাহের বলল, ঐ জ্যোতিষ ভদ্রলোকের নাম কি?

উনার নাম অরবিন্দ দাস।

হিন্দু না কি?

হুঁ। চিরকুমার।

রেগুলার আসত তোমাদের বাসায়?

হুঁ। এসেই আমার হাত দেখতেন। আমার নাকি খুব ইন্টারেস্টিং হাত। হাতে। সোলেমানস রিংও আছে।

তাহের বিরক্ত গলায় বলল, সোলেমানস রিং-ফিং কিছু কিছু না। তোমার হাত ধরার লোভে আসত। এক ধরনের লোকই থাকে যারা মেয়েদের হাত ধরতে ওস্তাদ। ও নির্ঘাৎ এই কারণে আসত।

পারুল হাসতে হাসতে বলল, শেষের দিকে আমারও সেই রকম মনে হত। কারণ একদিন কি হল জান … একদিন হঠাৎ ভরদুপুরে তিনি এসে উপস্থিত। বড়চাচী ঘুমে, বাচ্চারা সব স্কুলে, শুধু আমি মেট্রিকের পড়া পড়ছি। আমি উনাকে এনে বসালাম। উনি বললেন–ঘরে খুব গোমট লাগছে, চল ছাদে যাই। আজ ম্যাগনিফ্রাইং গ্লাস নিয়ে এসেছি, তোমার হাত ভাল করে দেখব। আমি বললাম–চলুন। ছাদে যাওয়ার পর সিঁড়িতে…

তাহের অস্বস্তির সঙ্গে বলল, থামলে কেন? সিঁড়িতে কি?

থাক, শোনার দরকার নেই।

বল, কি হয়েছে শুনি।

তেমন কিছু হয়নি।

যা হয়েছে সেটাই শুনি …।

পারুল হাই তুলতে তুলতে বলল, কোন স্বামীরই উচিত না তার সুন্দরী স্ত্রীর জীবনের সব ঘটনা শোনা। একটা রূপবতী মেয়ের জীবনে অনেক ঘটনাই ঘটে যা বলে বেড়ানোর না। চল ঘুমাতে যাই। আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।

অরবিন্দ দাস–ঐ ভদ্রলোক থাকেন কোথায়?

কোথায় থাকেন জেনে কি করবে? দেখা করবে?

তাহের কিছু বলল না। তার মুখ খানিকটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। পারুল জানে রেগে গেলে এই মানুষটার মুখে বিষণ্ণ ভাব চলে আসে। পারুল উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ভদ্রলোক ইন্ডিয়া চলে গছেন।

কবে গেছেন?

কবে গেছেন সেই দিন-তারিখ তো আমি জানি না। অনেকদিন বাসায় আসেন না, তারপর এক সময় শুনলাম ইন্ডিয়াতে চলে গেছেন।

ছাদের সিঁড়িতে ঐ লোক কি করেছিল? চুমু খাবার চেষ্টা করেছিল?

প্রায় সে রকমই।

প্রায় সে রকমটা আবার কি?

বললাম তো স্ত্রীর জীবনকথা সব শুনতে নেই।

তুমি তখন কি করলে?

কখন কি করলাম?

এখন ঐ হারামজাদা তোমাকে চুমু খেতে চাইল তখন?

ভদ্রলোককে শুধু শুধু গালি দিচ্ছ কেন?

চুমু খেয়ে বেড়াবে আর আমি গালি দেব না?

গালি দিতে হলে আমি দেব। তুমি কেন দেবে? তোমাকে তো চুমু খায়নি।

তোমার সঙ্গে কথা বলাই উচিৎ না।

দুজন আবার এসে বিছানায় বসল। পারুল তাহেরের দিকে ঘন হয়ে এল। ঘুম জড়ানো হালকা গলায় বলল–অরবিন্দ দাসের কথা ভেবে মাথা গরম করো না তো। অরবিন্দ দাসের কথা আমি তোমাকে বানিয়ে বানিয়ে বলেছি। আমার বাসার অবস্থা তুমি জান না? আমার চাচা-চাচী থাকতে কার কি সাধ্য আছে রোজ রোজ আমাদের বাসায় এসে আমার হাত ধরে বসে থাকার? আমার চাচা তাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। না? শুধু কি খাবে? খাওয়ার আগে কচলে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে।

বানিয়ে বানিয়ে এ রকম গল্প বলার মানে কি?

তোমার ঘুম চটিয়ে দেবার জন্যে গল্পটা বলেছি। আমার চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই–আর তুমি আরাম করে ঘুমাবে, তা হবে না। এখন নিশ্চয়ই তোমার আর ঘুম দুম ভাব নেই–না কি আছে?

না, নেই।

তাহলে এক কাজ কর। আমাকে আদর কর। এমন রূপবতী একটা মেয়ে, তাকে তোমার আদর করতে ইচ্ছা করে না। আশ্চর্য!

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ