রহমান সাহেব আজ তাহেরকে দেখামাত্র চিনলেন। হাতের ফাইল বন্ধ করে বললেন, ও তুমি।

তাহের বলল, স্যার কেমন আছেন?

ভদ্রতার প্রশ্ন। এই প্রশ্ন করার কোন অর্থ হয় না, তবু করতে হয়। সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসে একটু উপরে যাদের অবস্থান তারা নিচের অবস্থান থেকে আসা এই প্রশ্নের জবাব দেন না। রহমান সাহেবও দিলেন না। তাহের বলল, বড় সাহেব কবে আসবেন একটু খোঁজ নিতে এসেছিলাম স্যার।

বোস।

তাহের হকচকিয়ে গেল। ম্যানেজার সাহেব তাকে বসতে বলবেন ভাবাই যায় না। হঠাৎ করে তিনি এই বাড়তি খাতির কেন করছেন তা বুঝতে না পেরে তাহের খানিকটা ঘাবড়ে গেল।

দাঁড়িয়ে আছ কেন, বোস।

তাহের বসল। রহমান সাহেব বললেন, স্যারের কাছে থেকে ফ্যাক্স পেয়েছি, তাঁর আসতে দেরি হবে।

কতদিন দেরি স্যার?

কতদিন দেরি এইসব কিছু লেখা নেই। উনার শরীর ভাল যাচ্ছে না। ফুল মেডিকেল চেক-আপ করবেন। তোমাকে আরো এক মাসের খরচ দিতে বলেছেন। আমি ক্যাশিয়ারকে বলে দিয়েছি, তুমি তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেও।

তাহের তো তোমার নাম?

জ্বি স্যার।

কিছু মনে করো না তাহের, বড় সাহেবের সঙ্গে তোমার কি কোন আত্মীয়তা আছে?

জি না। একই গ্রামে বাড়ি।

আচ্ছা।

স্যার, আমি উঠি?

একটু বোস, কি একটা কথা তোমাকে যেন বলতে চাচ্ছিলাম… ভুলে গেলাম, মনে পড়ছে না। একুট বস, দেখি মনে পড়ে কি না।

তাহের অস্বস্তি নিয়ে বসে রইল। ম্যানেজার সাহেব ভুরু কুঁচকে রাখলেন। তিনি আজ শেভ করেননি। খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি বের হয়ে এসেছে। তাকে বুড়ো বুড়ো লাগছে।

ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আচ্ছা শোন, তুমি কি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে ঐ বাড়িতে উঠেছ না কি?

তাহের খুক খুক করে কাশল। রহমান সাহেব সরু চোখে তাকালেন, আমি খবর পেয়েছি তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে উঠেছ। নিজেদের ঘরবাড়ি করে নিয়েছ।

কথাটা সত্যি না স্যার।

তুমি তাহলে স্ত্রীকে নিয়ে উনি?

উঠেছি স্যার।

তাহলে কথাটা সত্যি না বললে কেন?

তাহের হড়বড় করে বলল, আমি একা একা থাকি–কিভাবে থাকি দেখতে এসেছিল। আমি বললাম, দু-একটা দিন থাক আমার সঙ্গে…

কাজটা খুবই অন্যায় করেছ। আজ দিনের মধ্যে তুমি তোমার স্ত্রীকে সরিয়ে দেবে। স্যারের বাড়ি অন্যের সংসার পাতার জন্যে না। বুঝতে পারছ?

পারছি স্যার।

আমি তো খবর শুনে হতভম্ব। স্ত্রীকে নিয়ে বাস করছ–ভাল কথা, স্যারের শোবার ঘরে না কি রাতে ঘুমাও?

তাহের শুকনো মুখে বলল, জ্বি না স্যার। এই মিথ্যা কথাটা বলতে তার খুব কষ্ট হল। মিথ্যা বলা তাহেরের একেবারেই অভ্যাস নেই। মিথ্যা বলতে গেলেই কথা জড়িয়ে যায়। রহমান সাহেব বললেন, আমি অবশ্যি কামরুলের কথা বিশ্বাস করিনি। সে এক আধা পাগল। স্যারের শোবার ঘর চাবি দেয়া, সেখানে ঢুকবে কিভাবে? কামরুল এইসব বানিয়ে বানিয়েই বলেছে তা বুঝতে পেরেছি। যাই হোক, আজ দিনের মধ্যেই তোমার স্ত্রীকে অন্য কোথাও রেখে আসবে।

জি আচ্ছা। স্যার, আমি যাই।

যাও।

তাহের উঠে দাঁড়াল। রহমান সাহেব ফাইল খুলতে খুলতে বললেন, আজ রাতে আমি একবার তোমাদের এখানে যাব। স্বচক্ষে দেখে আসব।

জি আচ্ছা স্যার।

সন্ধ্যাবেলা গিয়ে যেন না দেখি তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে সংসারধর্ম করছ।

তাহের ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলল। নিঃশ্বাস ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই তার মাথা ধরে গেল। দুঃশ্চিন্তার মাথা ধরা। দুঃশ্চিন্তা না কাটা পর্যন্ত এই ব্যথা কমবে না।

ম্যানেজার সাহেব বললেন, যাও, দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু বলবে?

জি না।

 

তাহের এখন কি করবে? সিরাজ সাহেবের বাসায় যাবে? আজ তো যাওয়াই যাবে না। কাল যদি মেয়ের গায়ে হলুদ হয়ে থাকে আজই বোধহয় বিয়ে। বিয়েবাড়িতে সে তার বৌ নিয়ে উঠবে? এটাও মন্দ না। বিয়ে উপলক্ষে সে তার বৌ নিয়ে উঠল। বিয়েশাদীতে আত্মীয়স্বজনরা স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বিয়েবাড়িতে উপস্থিত হয়। কয়েক দিন থাকে। এটা ছাড়া সে আর কি করতে পারে? জসিমের মেসে যাবে? সে একা হলে জসিমের কাছে যাওয়া যেত। স্ত্রী নিয়ে যাবে কিভাবে? পারুলের বড় চাচার সঙ্গে দেখা করতে পারে। বাসায় না গিয়ে উনার অফিসে চলে গেলে কেমন হয়? অফিসে তিনি তো আর রাগারাগি করতে পারবেন না। অফিস থেকে বের করে দিতে পারবেন না।

তাহের ক্যাটিনে ঢুকল। এক কাপ চা খাবে। চা খেলে যদি মাথাধরাটা কমে। পারুল মাথা ধরলেই চা খায়। তার না কি এতে মাথা ধরা কমে।

চা শেষ করেও তাহের বসে রইল। এক হাজার এক বার দোয়া ইউনুসটা পড়তে পারলে কাজ হত। চরম বিপদে এই দোয়া খুব কাজ করে। ইউনুস নবী মাছের পেটে বসে এই দোয়া পড়েছিলেন বলে অক্ষত শরীরে মাছের পেট থেকে বের হতে পেরেছিলেন। সেও বলতে গেলে এখন মাছের পেটের ভেতরই আছে।

 

পারুলের বড় চাচা অফিসে ছিলেন। তাহের ঘরে ঢুকেই টেবিলের নিচে ঝুঁকে পড়ে তাঁর পা খুঁজে বের করল। টেবিলের নিচ থেকেই বলল, চাচা ভাল আছেন?

আজহার সাহেব উত্তর দিলেন না। গলা টেনে কাশলেন। তাহের টেবিলের নিচ থেকে হাসি মুখে বের হয়ে এল। আবারও জিঞ্জেস করল, চাচা ভাল আছেন?

আজহার সাহেব ঘোঁৎ জাতীয় শব্দ করলেন। তাহের বলল, পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম চাচাকে ভাল খবরটা দিয়ে যাই।

আজহার সাহেব চোখ ছোট ছোট করে বললেন, কি ভাল খবর?

তাহের বিপদে পড়ে গেল। কথার টানে সে বলে ফেলেছে চাচাকে ভাল খবরটা দিয়ে যাই। আসলে ভাল খবর কিছু নেই। সবই মন্দ খবর। ভয়ংকর ধরনের খবর।

তাহের ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। তার পা কাঁপছে। পা কাঁপার কিছু নেই, তবু কাঁপছে। খিদের জন্যে বোধহয়। এখন বাজছে দুটি। সে সকালে নাশতা না খেয়ে বের হয়েছে। এখন পর্যন্ত এক কাপ চা ছাড়া কিছু খায়নি।

আজহার সাহেব বললেন, বোস।

তাহের বসল। না বসতে বললেও সে বসত। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না।

ভাল খবরটা কি বললে না তো। চাকরি পেয়েছ?

জ্বি।

কি চাকরি?

তাহের রীতিমত ঘামছে। আশ্চর্য কাণ্ড। সে একের পর এক মিথ্যা বলছে কেন? একবার মিথ্যা শুরু করলে অনেকক্ষণ ধরে বলতে হয়। মিথ্যার এই নিয়ম। মিথ্যা হল চাকার মত। একবার চলতে শুরু করলে চলতেই থাকে।

আজহার সাহেব কে এসে বললেন, কি চাকরি?

চা বাগানের চাকরি।

চা বাগানে তো অনেক রকম চাকরি আছে। কুলীর চাকরিও আছে। তোমার পোস্টটা কি?

এ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার।

তাহের অবাক হয়ে লক্ষ করল, আজহার সাহেব তার এই মিথ্যা কথাটা বিশ্বাস করেছেন। এতক্ষণ সরু চোখে তাকিয়েছিলেন, এখন চোখের সরু ভাব দূর হয়েছে। সেখানে জমা হয়েছে বিস্ময়।

বেতন কি?

বেতন বেশ ভাল।

চা বাগানের চাকরিতে বেতন তো ভাল হবেই। বিদেশী কোম্পানী, এরা পেটে ভাতে কর্মচারি রাখে না। কোয়ার্টার দিয়েছে?

দি চাচা দিয়েছে। ফার্নিসড্‌ কোয়ার্টার।

ওদের নিয়মই এরকম। ফ্রী ফানিসড কোয়ার্টার–বেয়ারা বাবুর্চি। গাড়ি দিয়েছে?

ছি না, তবে দিবে বলেছে।

দিবে বলেছে যখন তখন অবশ্যই দেবে। আর এদের বাংলোগুলিও খুবই সুন্দর। ছবির মতন। আমি একবার একটা টি গার্ডেনে দুরাত ছিলাম অপূর্ব। তুমি এই চাকরি জোগাড় করলে কিভাবে?

আমার এক বন্ধুর খালু সাহেবের গার্ডেন…

বুঝেছি রেফারেন্সে চাকরি হয়েছে। এইসব চাকরি এডভাটাইজে হয় না। রেফারেন্সে হয়। তোমার ভাগ্য খুবই ভাল।

জঙ্গলে মন টিকলে হয়।

টিকবে, মন টিকবে। পেট শান্ত থাকলে মন শান্ত থাকবে। তোমার সুসংবাদ শুনে খুশী হয়েছি। তুমি কি খাওয়া-দাওয়া করেছ?

জ্বি না।

খাও, আমার সঙ্গে খাও। আমি টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে আসি। তোমার চাচী দিয়ে দেয়। দুজনের হবে না, কাচ্চি বিরিয়ানী খাবে? এখানে একটা বিহারীর দোকান আছে, ভাল বিরিয়ানী বানায়। আমার বয়স হয়ে গেছে, রিচ ফুড সহ্য হয় না।

আজহার সাহেব বিরিয়ানী আনতে তাঁর বয়কে পাঠালেন। হাফ বিরয়ানী আর একটা ঠাণ্ডা সেভেন আপ। তাহের বসে বসে ঘানতে পাগল। এ কি করছে সে? মিথ্যার পর মিথ্যা বলে যাচ্ছে। মিথ্যা বলতে একটু গলা পর্যন্ত কাঁপছে না। অভাব-অনটনে তার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? অভাবী মানুষরা কি বেশি মিথ্যা বলে?

তাহের।

জ্বি।

পারুল আছে কেমন?

ভাল আছে।

ওকে বাসায় নিয্যে এসো, অনেকদিন দেখি না।

আজই নিয়ে আসব।

আচ্ছা, এসো।

কয়েকদিন থাকুক আপনাদের সঙ্গে।

থাকুক।

বিকেলে নিয়ে আসব। ও আপনাদের দেখতে চাচ্ছে।

আজহার সাহেব টেবিল থেকে ফাইলপত্র সরিয়ে খবরের কাগজ বিছিয়ে দিলেন। নিজেই দুগ্লাস পানি এনে রাখলেন। তাঁর টিফিন ক্যারিয়ার খুললেন। তাহের বলল, আপনি খেতে শুরু করুন চাচা।

একসঙ্গেই খাই। তোমার চা বাগানের নাম কি?

তাহের অতি দ্রুত কোন একটা নাম ভাবতে চেষ্টা করল। নাম মনে আসছে না। মাথার যন্ত্রণাটা হঠাৎ আরও বেড়ে গেল। চোখ পর্যন্ত জ্বালা করছে। চোখে-মুখে পানির ঝাপ্টা দিতে পারলে ভাল হত। তাহের বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চা বাগানের নাম মনে পড়ছে না চাচা।

আমাদের কোম্পানীর নাম জানতে চাচ্ছি।

কোম্পানীর নামটাও মনে পড়ছে না।

আজহার সাহেব বিস্মিত হয়ে তাকালেন। তাহের ঢোঁক গিলে বলল, আপনাকে এতক্ষণ মিথ্যা কথা বলেছি চাচা।

আজহার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, মিথ্যা কথা বলেছ?

জ্বি। আমার চাকরি বাকরি এখনো কিছু হয়নি।

আজহার সাহেব তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখে পলক পর্যন্ত পড়ছে না। তাহের খুক খুক করে কাশল। আজহার সাহেব বললেন, এতগুলি মিথ্যা বললে কেন? কারণটা কি?

তাহের অস্পষ্ট গলায় বলল, জানি না। এম্নি বলে ফেলেছি। চাচা, আমি তাহলে যাই?

আজহার সাহেব কিছু বললেন না। তাহের উঠে পাড়াল। টেবিলের নিচে ঢুকে পড়ে কদমবুসি করল। আবারও বলল, চাচা যাই। আজহার সাহেব তাকিয়ে রইলেন। কিছুই বললেন না।

তাহের বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল–যদি আজহার সাহেব তাকে ডাকেন। কাচ্চি বিরিয়ানীর প্যাকেট থেকে আসা গন্ধটা বাতাসে ভাসছে। ক্ষুধার্ত মানুষ খাবারের গন্ধে খুব বিচলিত হয়–বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। তাহের দাঁড়িয়ে আছে বোধহীন একজন মানুষের মত। বয়টার হাত থেকে বিরিয়ানীর প্যাকেট এবং সেভেন আপের বোতল নিয়ে পালিয়ে গেলে কেমন হয়?

 

পারুল বাথরুমে–তার গায়ে কোন কাপড় নেই। খয়েরি রঙের একটা টাওয়েল দড়ি থেকে ঝুলছে। ইচ্ছা করলেই এই টাওয়েলটা সে তার গায়ে ফেলে খানিকটা আব্রুর ভেতর নিজেকে রাখতে পারে। তা সে করছে না। ইচ্ছে করেই করছে না। নগ্ন শরীরে সে অপেক্ষা করছে–আসুক, কুকুরের সর্দারটা আসুক। মনের সাধ মিটিয়ে তাকে দেখুক। তারপর দেখা যাবে। কেউ আসছে না। এলেই সে টের পাবে। সে তার সমস্ত চেতনা জাগ্রত করে অপেক্ষা করছে। তার সামনে গামলা ভর্তি পানি। পানির গামলায় তার ছায়া পড়েছে। অন্ধকারের ছায়া অলোর ছায়ার চেয়ে আলাদা।

ভক করে তামাকের কড়া গন্ধ নাকে এসে লাগল। কি বিশ্রী, কি উৎকট গন্ধ। লোকটা এসে দাড়িয়েছে। পারুল নিজের মনে হাসল। গামলার পানি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিল। পানিতে তার ছায়াটা লজ্জাবতী গাছের পাতার মত কুকড়ে গেল। পারুল উঠে দাড়াল। সে এখন দরজা খুলে লোকটাকে ধরবে। তার আগে সে কি গানে টাওয়েলটা। জড়াবে না, যেমন আছে তেমনি বেরুবে? যেমন আছে তেমন বেরুলেও ক্ষতি নেই। কেউ দেখছে না–বাড়ির দেয়ালের ভেতর তিনটি ভয়ংকর কুকুর এবং কামরুল নামের লোকটি ছাড়া আর কেউ নেই। কুকুরের চোখে পোশাক নিশ্চয়ই কোন বড় ব্যাপার না। কুকুরের জগৎ হচ্ছে গন্ধের জগৎ। মানুষের গায়ের গন্ধটাই তার কাছে একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। আর কামরুল? সে তো তাকে দেখছেই। পারুল দরজা খুলে বের হল। আশ্চর্য! তার লজ্জা লাগছে না, অস্বস্তি লাগছে না–তার কাছে কেমন যেন ঘোরের মত মনে হচ্ছে। কিশোরী বয়সে একবার তার ১০৫ ডিগ্রী জ্বর উঠেছিল, সে সময় সে এক ঘোরের জগতে চলে গিয়েছিল। আশেপাশের সবাইকে তখন কেমন চকচকে লাগছিল যেন সবার গায়ে তেলমাখা। আলো পড়ে তেলমাখা শরীর চকচক ঝকঝক করছে–এখনো তেমন হচ্ছে। পারুল তীক্ষ্ণ ও তীব্র গলায় ডাকল, কামরুল, এই কামরুল।

কামরুল বাথরুমের পেছনে দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকে মুখ বের করল। পারুলের মনে হল বাথরুমের দেয়ালটা একটা কচ্ছপের খোলস। কামরুলের মাথাটা হচ্ছে কচ্ছপের মাথা। পারুল হেসে ফেলল। সেই হাসিতে কিছু বোধহয় ছিল, ভয় পেয়ে কামরুল দৌড় দিল। সে দৌড়ে বাগান পেরুচ্ছে। ছুটে যাচ্ছে তার নিজের খুপড়ির দিকে। পারুল ডাকল—মিকি, মাইক, ফিবো।

তিনটি কুকুরই বিদ্যুতের মত ছুটে এল। কামরুল তখনো ছুটছে, প্রাণপণে ছুটছে। পারুল কুকুর তিনটির দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বলল, তোরা দেখছিস কি? ঐ বদ লোকটাকে ধর। এক্ষুণি পর। এক্ষুণি। এক্ষুণি।

পারুল তর্জনী দিয়ে কামরুলের দিকে ইঙ্গিত করছে। তার মুখ দিয়ে হিস হিস জাতীয় শব্দ হচ্ছে।

তিনটি কুকুই কামরুলের দিকে ছুটছে। কামরুল দাঁড়িয়ে পড়েছে। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পেছন ফিরে সে দৃশ্যটা দেখল, তারপর ছুটে যেতে গিয়ে পা পিছলে মাটিতে পড়ে গেল। বাঘ যেমন শিকারের উপর ঝাঁপ দেয় অবিকল সেই ভঙ্গিতে ফিবো কামরুলের পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বাকি দুজন ওদের ঘিরে চক্রাকারে ঘুরছে।

পারুল দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল।

 

মাথা দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। পারুল তার মাথায় পানি ঢালছে। হিমশীতল পানি–গায়ে ঢালকেই গা জুড়িয়ে যায়। গামলার পানি শেষ হয়ে গেছে–এখন সে। চৌবাচ্চা থেকে পানি নিচ্ছে। চৌবাচ্চার পানি আরও ঠাণ্ডা। মনে হচ্ছে কেউ যেন। বরফের কুচি মিশিয়ে দিয়েছে। বরফের কুচি মেশানো এই হিমশীতল পানিতে গলা। পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছা করছে। পানির উপর শুয়ে থাকার কোন উপায় যদি থাকত। পাল চৌবাচ্চার ভেতর ঢুকে গেল।

 

বাড়ির প্রধান গেটটা বন্ধ। তাহের অনেকক্ষণ ধরেই কলিংবেল টিপছে। কেউ দরজা খুলছে না। তাহের প্রথমে ভেবেছিল, কলিংবেল কাজ করছে না–কলিংবেল টিপে সে কান পেতে রইল–এতে একটানা ক্রিইং শব্দ আসছে। গেটে মাঝে মাঝে সে ধাক্কা দিচ্ছে। কোন শব্দ নেই–। মাঝে মাঝে কুকুর তিনটার দ্রুত চলে যাবার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কুকুর তিনটা না থাকলে সে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে নেমে যেত। তার ভয়ংকর দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে। ছটা থেকে সে গেটে ধাক্কাধাক্কি করছে। এখন বাজছে, সাড়ে ছটা। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। পারুলের কোন বিপদ হয়নি তো! ভয়ংকর কোন বিপদ।

এখন তাহের আর কলিংবেল টিপছে না বা দরজাও পাকাচ্ছে না–ভীত গলায় ভাকছে, কামরুল। কামরুল মিয়া! এই কামরুল!

পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কে আসছে? কামরুল? তাহের বলল, কে কামরুল? ব্যাপার কি? কি হয়েছে?

কেউ জবাব দিল না। কিন্তু গেট খোলা হচ্ছে। তাহেরের বুকের ধ্বকধ্বকানি এখনও থামছে না। সে আবারও ডাকল, কামরুল! এই কামরুল!

আমি পারুল।

গেট খুলেছে। তাহের বিস্মিত গলায় বলল, কামরুল কোথায়?

আছে কোথাও।

প্রায় এক ঘণ্টা ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাছাড়া ঘরের ভেতর থেকে গেটের শব্দ শোনাও যায় না।

ভয় চলে যাওয়ায় তাহেরের এত শান্তি লাগছে! সারাদিন মে মাথাব্যথা ছিল হঠাৎ পাওয়া এই শান্তিতে তাও চলে গেছে। নিজেকে হালকা লাগছে।

তাহের বলল, সন্ধ্যাবেলা ঘুমের যে অভ্যাস করেছ–এটা ঠিক না। স্বাস্থ্যের জন্যে খুবই খারাপ।

পারুল জবাব দিচ্ছে না। আগে আগে যাচ্ছে, তাহের যাচ্ছে তার পেছনে পেছনে। তাহের বলল, কামরুল ব্যাটাকে তো দরকার।

কেন?

বাড়ি তার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতে হবে। আজই যেতে হবে।

কেন?

ম্যানেজার সাহেবের কাছে অবর গেছে আমি এই বাড়িতে সংসার পেতেছি। তিনি অর্ডার দিয়েছেন তোমাকে অন্য কোথাও রেখে আসতে। বলেছেন, সন্ধ্যাবেলা চেক করতে আসবেন। উনি আসার আগেই আমরা চলে যাব। দেরি করা যাবে না। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে।

কোথায় যাবে।

আজকের রাতটা আপাতত কোন হোটেলে কাটাই, তারপর… পারুল, তোমার কি শরীরটা খারাপ? তোমাকে কেমন যেন লাগছে।

পারুল ক্ষীণ স্বরে বলল, শরীর একটু খারাপ।

কতবার বলেছি সন্ধ্যাবেলা ঘুমুবে না। সন্ধ্যাবেলা ঘুমানো খুব বেড হেভিট। শরীরের বারোটা বেজে যায়।

 

তাহের বাথরুমে ঢুকে হাত-মুখ ধুচ্ছে। বাথরুমের দরজা খোলা। পারুল বাথরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাথরুমের বাল্ব নষ্ট বলে বাথরুমটা অন্ধকার। তাহের হাতে-মুখে শনি ঢালতে ঢালতে বলল–তুমি দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করো না। ব্যাগ দুটা চট করে গুছিয়ে নাও। ম্যানেজার ব্যাটা আসার আগেই কেটে পড়তে হবে।

কোন হোটেলে উঠবে, কিছু ঠিক করেছ?

উহুঁ। ওল্ড ঢাকার দিকে মোটামুটি সস্তায় ফ্যামিলি রুম পাওয়া যায়। আর একটা মাত্র রাত।

একটা রাত কাটিয়ে কোথায় যাবে?

এখনও ঠিক করিনি। গামছাটা দাও তো।

 

পারুল গামছা এনে দিল। খুব সহজ গলায় বলল, ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে।

তাহের অবাক হয়ে বলল, কি সমস্যা?

কুকুর তিনটা কামরুলকে মেরে ফেলেছে। ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফেলেছে।

তাহের বিরক্ত গলায় বলল, সব সময় রসিকতা ফাজলামি ভাল লাগে না। সব কিছুর সময়-অসময় আছে।

পারুল শীতল গলায় বলল, রসিকতা না। সত্যি। বারান্দায় এসে দাঁড়াও। বারান্দায়। দাঁড়ালেই দেখবে। বারান্দা থেকে দেখা যায়।

এইসব তুমি কি বলছ?

যা সত্যি তাই বলছি।

তাহেরের হাত থেকে মগ পড়ে গেল। এইসব সে কি শুনছে? স্বপ্ন দেখছে না তো? মাঝে মাঝে স্বপ্ন বাস্তবের মত হয়।

পারুল বলল, তুমি কি আগে চা খাবে না সরাসরি ভাত দেব?

তাহেবের মাথায় কিছু না। এই সময় কি করে একটা মেয়ে ভাত খাওয়ার কথা বলতে পারে। তাহের বলল, দাও, চা দাও। বলেই সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। আশ্চর্য! সে চা চেয়েছে, সহজভাবেই চেয়েছে। ভয়ংকর দুঃসময়ে মানুষ কি খুব স্বাভাবিক আচরণ করে? তাহেরের মুখ ধোয়া হয়ে গেছে, তারপরে সে অন্ধকার বাথরুমে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে পারুল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। নীরবতা ভঙ্গ করার জন্যেই তাহের আবারও বলল, ম্যানেজার সাহেব সন্ধ্যার পর আসবেন। কথাগুলি বলল নিজের কানে নিজের কথা শোনার জন্যে। ম্যানেজার সাহেব যে সন্ধ্যর পর আসবেন এটা তো সে আগেই বলেছে।

পারুল শান্তি গলায় বলল, আসুক। কুকুররা তাকেও খেয়ে ফেলবে।

কি বলছ তুমি!

যা ঘটবে তাই বলছি। এ বাড়ির গেটের ভেতর যেই ঢুকবে তাকেই কুকুররা খেয়ে ফেলবে। তোমাদের বড় সাহেব এলে তাকেও খাবে।

পারুল, তোমার তো পুরোপুরি মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

হুঁ।

ব্যাপারটা আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।

বিশ্বাস না হবার কিছু নেই। বারান্দায় এসে দাঁড়াও, আমি বাগানের বাতি জ্বেলে দিচ্ছি। সব দেখা যাবে। তবে না দেখাই ভাল। দেখলে তুমি চা-টা কিছু খেতে পারবে না। বমি করে ফেলবে। আস, বারান্দায় আস।

না থাক।

চা বানাচ্ছি–চা খেতে আস। সারারাত বাথরুমে দাঁড়িয়ে থাকবে?

তাহের বাথরুম থেকে বের হল। তার ডান পাটা পাথরের মত ভারি হয়ে আছে। প টেনে টেনে তাকে আসতে হচ্ছে। এটাও এক আশ্চর্য ব্যাপার। পা ভারি হলে পাই ভাবি হবে। একটা পা ভারি হয়েছে অন্যটা ঠিক আছে এটা কেমন কথা!

 

শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে স্টোভে। কেতলিতে পানি বিজ বিজ করে ফুটছে। চুলার আগুনের আঁচে কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে পারুলকে! কুকুর তিনটি এই সময় গ্রীলের কি দিয়ে মুখ বের করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আজ তা করছে না, তবে মাঝে মাঝে তাদের ক্রুদ্ধ চাপা হুংকার শোনা যাচ্ছে। তাহের নিচু গলায় ডাকল, পারুল!

হুঁ।

তোমার চাচার সঙ্গে আজ দেখা হয়েছে। উনার অফিসে গিয়েছিলাম।

পারুল তার দিকে চোখ তুলে তাকালো। তাহের ভেবে পেল না। এই সময়ে সে চাচার অফিসে যাবার গল্পটা কি করে বলছে। একটা মানুষ তাদের কাছ থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে মরে পড়ে আছে–আর সে চা খেতে খেতে গল্প করছে। মাথা তো পারুলের খারাপ হয়নি। মাথা তার খারাপ হয়েছে।

পারুল!

পারুল সঙ্গে সঙ্গে বলল, কি?

আমরা এখন কি করব?

চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে পারুল নরম গলায় বলল, তুমি কি করতে চাও?

পুলিশে খবর দেয়া দরকার। কুকুরে মেরে ফেলেছে–আমাদের তো কোন দোষ নেই। আমরা তো মারিনি।

কুকুর তো আর নিজ থেকে মারেনি। সে হচ্ছে কুকুরের সর্দার। কুকুর তাকে শুধু শুধু মারতে যাবে কেন? আমি বলেছি বলেই মেরেছে।

সে কি।

পারুল তার চায়ের কাপ তুলে নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, চা খাও। চা তো ঠাণ্ডা হচ্ছে।

চা ঠাণ্ডা হচ্ছে কি না তাহের জানে না, তার নিজের হাত-পা যে ঠাণ্ডা হয়ে আসছে তা সে বুঝতে পারছে। আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না যে পারুল ঠাট্টা করছে? মেয়ের মাঝে মাঝে বাজে ধরনের ঠাট্টা করে। মা-বাপ নেই টাইপ ঠাট্টা।

এ কি, কাপ হাতে নিয়ে বসে আছ কেন? ঠাণ্ডা হয়ে গেছে? ঠাণ্ডা হলে আবার গরম করে দেব।

তাহের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিল। ঠাণ্ডা-গরম কিছুই বোঝা গেল না। তাহের বিড় বিড় করে বলল, সন্ধ্যার পর ম্যানেজার সাহেব আসবেন।

পারুল বলল, উনি আসবেন না। কার দায় পড়েছে ঢাকার বাইরে এত দূর এসে খোঁজ নেবার? তিনি তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যে এইসব বলেছেন। যাতে তুমি ভয় পেয়ে সুর সুর করে চলে যাও।

উনি খুব কাজের। চলে আসবেন।

আসবেন না। আকাশের অবস্থা ভাল না–ঝড় বৃষ্টি হবে। এই রকম আবহাওয়ায় উত্তরখানের বিরান ভূমিতে কেউ আসবে না। তুমি অস্থির হয়ো না।

অস্থির হব না?

না। আর যদি এসেই পড়ে আমরা গেট খুলব না। সে তো আর দেয়াল টপকে ভেতরে আসবে না। আর যদি এসেই পড়ে তাহলে…

তাহলে কি?

আমার তিন বন্ধু আছে, ওরা মজা দেখাবে।

পারুল হাসছে। হাসতে হাসতে সে মুখে আঁচল দিল। মনে হচ্ছে গড়িয়ে পড়বে। তাহের বলল, এই পারুল, এই!

পারুলের হাসি থামছে না। খিলখিল করে সে হেসেই যাচ্ছে। তাহের পুরোপুরি নিশ্চিত হল পারুলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সুস্থ মানুষের হাসি না। কোন সুস্থ মানুষ এই অবস্থায় এমন ভঙ্গিতে হাসে না। বদ্ধ উন্মাদের লক্ষণ। উন্মাদ হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এত বড় বাড়িতে একটা ডেডবডি নিয়ে থাকলে যে কেউ উন্মাদ হয়ে যাবে।

পারুল, পারুল।

উঁ।

হাসি থামাও।

শুধু শুধু হাসি থামাব কেন? কেঁদে বুক ভাসাবার মত কিছু হয়নি। আমি হাসি থামাব না।

বলতে বলতেই পারুল হাসি বন্ধ করল। হাসি যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল ঠিক তেমনি হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। পারুল সহজ গলায় বলল, রাতে কি খাবে?

কি খাব মানে?

রাতে ভাত তো খাবে। উপোস নিশ্চয়ই দেবে না। তেমন কিছু রাঁধতে পারিনি। আলু ভেজে দি। কড়া করে আলু ভেজে দেব। ভাজা শুকনো মরিচ ডলে আলু ভাজা দিয়ে খেতে খুব মজা। ঘি থাকলে খুব ভাল হত। আলু ভাজার উপর এক চামচ গাওয়া ঘি দিয়ে দিলে খেতে চমৎকার হয়। এমন এক ঘ্রাণ বের হয় যে ঘ্রাণ দিয়েই এক থালা ভাত খাওয়া যায়।

এই সময় তুমি খাওয়ার কথা ভাবছ? অবশ্যই ভাবছি। কেন ভাবব না? মৃত্যুর সঙ্গে খিদের কোন সম্পর্ক নেই। দুটা আলাদা ব্যাপার। আমার মার বেলায় কি হয়েছে শোন–মা মরে গেল ভোররাতে। বাবা কাঁদতে কাঁদতে অস্থির। চিৎকার করে বিকট কান্না। সারাদিন বাবা কিছু খেল না। দুপুরে আমার বড় খালা তাকে খেতে বলেছে–বাবা দিয়েছে ধমক। রাত আটটার দিকে বাবা নিজেই খেতে চাইল। বাবা ভাত নিয়ে বসেছে–আমাকে দেখে বলল, খুকি, দেখ তো লেবু আছে কি না। আর একটা পেঁয়াজ কুচি কুচি করে কেটে দিতে বল।

তাহের তাকিয়ে আছে। পারুল গল্প শেষ করে বলল, এই যে গল্পটা বললাম, তার সারমর্ম হচ্ছে–একটু দূরে একটা মানুষ মরে পড়ে আছে–তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা যথাসময়ে খাওয়া-দাওয়া করব। আরাম করে মুতে যাব। এবং যাতে তোমার যদি অন্য কোন আন্সার থাকে,

পারুল, চুপ করতো।

পারুলের ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে। কে জানে, সে হয়ত আবার হাসতে শুরু করবে। পাগলের হাসি একবার শুরু হলে শেষ হতে চায় না।

 

পারুলের কথাই বোধহয় ঠিক। ক্ষুধার্ত মানুষ মৃত্যু-টৃত্যু নিয়ে ভাবে না। তারা খেতে বসে যায়। রাত দশটার দিকে তাহের খেতে বসল। অনেক ভাত খেয়ে ফেলল। আরো থাকলে আরো খেত। পাতিলে আর ভাত ছিল না। পারুল বলল, তোমার বোধহয় পেট ভরল না।

ভরেছে। পেট ভরেছে। শরীরের খিদে মিটছে–চোখের খিদায় ভাত চেয়েছি।

চট করে একটা পরোটা ভেজে দেব, খাবে?

কি যন্ত্রণা। বললাম না পেট ভরেছে।

তাহের বারান্দায় মোড়ায় বসে সিগারেট টানছে। পারুল থালা বাসন মাজামাজি করছে। তাহের এই মুহূর্তে ভাবতে চাচ্ছে না যে তাদের কাছ থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে একটা মানুষ মরে পড়ে আছে। আর ভাবতে ইচ্ছা করছে না। ঝুম ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। শীত শীত লাগছে। এক ঘুমে রাতটা কার করে দিয়ে–সকাল বেলা ভেবে-চিন্তে একটা পথ বের করতে হবে। পথ আর কি–পুলিশকে গিয়ে বলা–কুকর বাড়ির দারোয়ানকে মেরে ফেলেছে।

থানার ওসি জিজ্ঞেস করবেন–কখন মেরেছে? তখন একটু ঘুরিয়ে বলতে হবে–কখন মেরেছে সেটা স্যার বলতে পারি না। আমরা দেখেছি সকালে। দেখেই আপনাকে খবর দিয়েছি।

কুকুর মানুষ মেরে ফেলল, আপনারা কিছুই বলতে পারলেন না?

স্যার, এগুলি ভয়ংকর কুকর। আগেও একটা মানুষ মেরেছে।

বলেন কি?

খাঁটি কথা স্যার। এক বিন্দু বাড়িয়ে বলছি না। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন। আমরা স্যার, কুকুরের ভয়ে রাতে ভালমত ঘুমুতেও পারি না।

আমরা বলছেন কেন? আমরা মানে কি? আর কে?

স্যার, আমার স্ত্রী।

আপনার স্ত্রীও কি ঐ বাড়িতে থাকে? তারও তো একটা জবানবন্দি নেয়া দরকার।

তাহের আগের সিগারেট ফেলে দিয়ে আরেকটা ধরাল। ভালমত চিন্তা করতে হবে। পারুলকে কিছুতেই পুলিশের কাছে নেয়া যাবে না। ওর মাথার ঠিক নেই। কি বলতে কি বলে বসবে। যা বলার পুলিশ তাই বিশ্বাস করবে। পুলিশ তো আর জানে না–অভাবে অনটনে পারুলের মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।

পারুল!

উঁ।

চা দাও, একটু চা খাব।

দাঁড়াও, হাতের কাজ সেরে নেই। তুমি তো চা খেতে চাও না, আজ দেখি একেবারে সেধে সেধে খেতে চাচ্ছ।

তাহের জবাব দিল না। সে অবাক হয়ে পারুলের থালা-বাসন ধোয়া দেখছে। কি সহজ ভঙ্গিতে সে থালা বাসন ধুচ্ছে–আবার গুন গুন করছে। মনে কোন রকম দুঃশ্চিন্তা নেই। না, পারুলকে কিছুতেই পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিতে দেয়া যাবে না। জবানবন্দি দিতে গেলেই উল্টাপাল্টা কিছু বলবে। যা করতে হবে তা হচ্ছে–খুব ভোরবেলা ওকে অন্য কোথাও দিয়ে আসতে হবে। তারপর যেতে হবে পুলিশের কাছে। পুলিশ যখন জিজ্ঞেস করবে–আপনি একাই এ বাড়িতে ছিলেন? তখন বলতে হবে কিছুদিন আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে ছিল–তারপর ম্যানেজার সাহেব আপত্তি করলেন–আমি ওকে নিয়ে গেলাম।

কোথায় নিয়ে গেলেন?

ওর বড় চাচার বাসায়।

সেটা কবে? তারিখ বলুন, সময় বলুন।

এই যে আবার প্যাঁচের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।

চা নাও।

তাহের আগ্রহ করে চা হাতে নিল। এখন নিজেকে হালকা লাগছে। সমস্যা সমাধানের পথ পাওয়া না গেলেও পাওয়া যাবে। কিছু মিথ্যা বলতে হবে। তবে খুব গুছিয়ে বলতে হবে। এমন মিথ্যা যেখানে ফাঁক থাকবে না।

চা-টা ভাল হয়েছে পারুল।

সরে বোস, বৃষ্টির ছাট লাগছে।

তাহের সরে বসল। পারুল বলল, ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। এতে একটা লাভ হল। রক্ত ধুয়ে মুছে চলে গেল। এখন বাকি শুধু ডেডবডি মাটিতে পুঁতে ফেলা।

তাহের এমন ভাব করল মেন কথা শুনতে পাচ্ছে না। কথা শুনলেই কথার পিঠে কথা বলতে হবে। পারুলের পাগলামী আরো বাড়বে। এই পাগলামীকে কোন অবস্থাতেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না।

পারুল চুক চুক করে চা খাচ্ছে। এরকম শব্দ করে সে তো কখনো খায় না। নাকি আগেও এরকম শব্দ করেই খেতো? সে লক্ষ্য করেনি। পারুল হালকা গলায় বলল, বৃষ্টি কমবে না। তোমাকে বৃষ্টির মধ্যেই কাজটা করতে হবে।

তাহের হতভম্ব গলায় বলল, কি কাজ?

গর্ত করতে হবে। বাগানে কোদাল আছে। বৃষ্টিতে ভিজে মাটি হয়েছে নরম। তোমাকে বেশি কষ্ট করতে হবে না।

তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?

মোটেই পাগল হইনি। গর্ত খুঁড়ে ডেডবড়ি চাপা না দিলে কুকুর ছিঁড়ে খুড়ে খাবে। সেটা ভাল হবে? কাল তুমি যখন ঘর থেকে বের হবে তখন দেখবে দরজার কাছে কামরুলের হাতের কব্জি পড়ে আছে। তখন কেমন লাগবে?

আমাদের পুরো ব্যাপারটা পুলিশকে জানাতে হবে। পুলিশ যা করার করবে। আমরা কিছুই করব না। রাতটা কোন মতে পার করে পুলিশের কাছে যাব।

পারুল শান্ত গলায় বলল, পুলিশ এসে আমাকে বেঁধে নিয়ে যাবে। হাজতে রাখবে। টর্চার করবে। আমার পেটে একটা বাচ্চা আছে, সেটা কি তার জন্যে ভাল হবে?

তোমাকে টর্চার করবে কেন? তুমি কি করেছ?

আমি কুকুর তিনটাকে দিয়ে ঐ লোকটাকে মারিয়েছি। লোকটা ছিল ভয়ংকর বদ–আমি তাকে কঠিন শাস্তি দিয়েছি।

চিন্তা-ভাবনায় তোমরা মাথা পুরোপুরি গুলিয়ে গেছে। তোমার যা দরকার তা হচ্ছে প্রচুর ঘুম, প্রচুর বিশ্রাম, নিরিবিলি।

পারুল সহজ গলায় বলল, প্রচুর ঘুম, প্রচুর বিশ্রাম এবং প্রচুর নিরিবিলির জন্যেই ডেডবডিটা কবর দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি বুঝতে পারছ না–আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি–পুলিশের ঝামেলায় এখন আমরা যেতে পারব না। পুলিশ যদি আমাদের কিছু না করে একটা জিনিশ করবে–বাড়ি থেকে বের করে দেবে। দেবে কিনা তুমি বল।

পুলিশ না দিলেও ম্যানেজার সাহেব বের করে দেবেন।

তখন আমি যাব কোথায়? এমন কোন জায়গা কি তোমার আছে যেখানে তুমি আমাকে নিয়ে তুলতে পার? গল্পে উপন্যাসে গাছতলায় সংসার পাতার কথা থাকে। আমরা তো গল্প-উপন্যাসের মানুষ না। ঠিক বলছি?

হুঁ।

আমাকে এখান থেকে বের করে দিলে আমি কোথায় থাকব? রেলস্টেশনের প্লাটফরমে? হ্যাঁ সেখানে থাকা যায়–একদিন, দুদিন, তিনদিন–ধরলাম সাত দিন–তারপর? আমি তো একা না–আমার ভেতর আরেকজন আছে। তার সমস্যা আমি দেখব না?

তাহেরের মাথা ঝিম ঝিম করছে। কি পরিষ্কার কথাবার্তা নিখুঁত যুক্তি। তাহের অভিভূত হয়ে গেল।

পারুল শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নিল। তাকে এখন একজন কিশোরীর মত লাগছে। সে আরো খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, ডেডবড়ি মাটির নিচে পুঁতে ফেললে আমরা অন্তত কিছুদিনের জন্যে নিরাপদে থাকতে পারব। সেই কিছুদিনও তো আমাদের কাছে অনেক দিন।

তাহের চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, না, কিছুদিনের জন্যেও নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারবে না। ম্যানেজার সাহেব এসে খোঁজ করবেন।

ম্যানেজার সাহেব কামরুলের খোঁজে আসবেন না। তিনি আমার খোঁজে আসবেন। আমাকে পাবেন না। নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি ফেরত যাবেন।

তোমাকে পাবেন না কেন?

আমাকে পাবেন না–কারণ আমি দোতলার সবচে কোণার ঘরটায় চলে যাব। ওখানেই থাকব। ম্যানেজার সাহেব জানেন দোতলায় ঐ ঘরগুলির চাবী আমার কাছে নেই।

আসলেই তো নেই।

আছে। সব চাবী আমি খুঁজে বের করেছি।

কিন্তু ম্যানেজার সাহেব খন আসবেন তখন তো দারোয়ানের খোঁজও করবেন।

করতে পারেন। তুমি বলবে সে দোকানে কিছু একটা কিনতে গেছে।

তাহের আর কি বলবে ভেবে পেল না। যুক্তি তার মাথায় ভাল আসে না। অন্যের যুক্তিই তার কাছে সব সময় শক্ত যুক্তি বলে মনে হয়। পারুল বলল–আদা দিয়ে আরেকটু চা করি?

না।

খাও না–ঠাণ্ডার মধ্যে ভাল লাগবে। চা খেয়ে বাগানে চলে যাও–গর্তটা গভীর করে করবে। ঘাসের চাপাড়াগুলি আগে খুব সাবধানে আলাদা করে নিও। পরে ঐ ঘাসের চাপড়াগুলি উপরে দিয়ে দেবে। বর্ষাকাল তো, দেখতে দেখতে সুন্দর ঘাস গজিয়ে যাবে।

তাহের আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমি কখনো এই কাজ করব না। বলতে গিয়ে তার গলা কেঁপে গোল। কপালে ঘাম জমল।

করবে না?

না।

আমার কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি করবে।

না পারুল, আমি করব না। তোমার জন্যে আমি অনেক কিছুই করব কিন্তু এই কাজটা করব না।

বেশ, তুমি না করলে আমিই করব। কষ্ট হবে–সময় বেশি লাগবে কিন্তু আমি করব।

তুমি নিজে কবর খুঁদবে?

হ্যাঁ। আমি যা বলি তা কিন্তু করি। তুমি অনেকবার তার প্রমাণ পেয়েছ। পাওনি?

তাহের জবাব দিল না। সে সিগারেট টেনে যাচ্ছে–পরপর তিনটি সিগারেট খাওয়ার জন্যেই হয়ত শরীর কেমন কেমন করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। পারুল বলল, তুমি শুধু শুধু জেগে থেকো না। শুয়ে পড়। বিছানায় যাবার আগে একটু শুধু কষ্ট করে যাও। ঐ কোনায় দেখ একটা বড় ডেগচি আছে। ডেগচি ভর্তি করে পানি চুলায় দিয়ে দাও।

পানি দিয়ে কি করবে?।

সব কাজ-টাজ শেষ করে, সারা গায়ে সাবান মেখে গরম পানি দিয়ে গোসল করব। গোসল না করলে শরীর ঘিন ঘিন করবে।

তাহের মূর্তির মত বসে রইল। পারুল হাসিমুখে বলল, মনে হচ্ছে পানিও এনে দেবে না। থাক, আমিই আনব। তুমি শুয়ে পড়। শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ। ভয়ের কিছু নেই।

তাহের মন্ত্রের মত বলল, তুমি সত্যি মাটি খুঁড়তে যাবে?

পারুল সহজ গলায় বলল, হুঁ।

তোমার যেতে হবে না। আমিই যাব। কুকুর তিনটা তো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ওরা বাঁধা আছে।

কে বাঁধল?

আমিই বাধলাম, আবার কে।

কোদল কোথায় আছে বললে?

পারুল আঙ্গুল তুলে দিক দেথল। তাহের উঠে দাঁড়াল। নাক জ্বালা করছে। নাক জ্বালা করছে কেন? সে অজ্ঞান টান হয়ে যাবে না তো? অজ্ঞান হবার আগে কি মানুষের নাক জ্বালা করে?

পারুল বলল, বৃষ্টি দেখি আরো জোরে নামল। তুমি এক কাজ কর–খালি গায়ে যাও। শার্ট গায়ে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠাণ্ডা লাগবে। ভেজা কাপড় থেকে ঠাণ্ডা বেশি লাগে। আমি কি আসব তোমার সঙ্গে? পাশে দাঁড়িয়ে থাকব?

না।

তাহের টলতে টলতে এগিয়ে যায়।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ