মুবিনুর রহমান শফিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। একবারও চোখের দৃষ্টি সরাচ্ছেন না। মাঝে মাঝে সামান্য ঝুঁকে আসছেন আবার সরে যাচ্ছেন। রকিং চেয়ারে বসে থাকার সময় যা করেন তাই। অথচ তিনি এখন রকিং চেয়ারে বসে নেই। তিনি বসে আছেন তাঁর শোবার ঘরের মেঝের কার্পেটে। শফিক বসেছে তাঁর সামনে। এই ঘরে আজ সে প্রথম ঢুকল। বড় সাহেবের শোবার ঘর হিসেবে এই ঘরটা ছোট। বেশ ছোট। তারচে বড় কথা এখানে কোনো খাট নেই। আসবাবপত্র নেই। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট আছে। ঘরের এক কোনায় বালিশ, কোলবালিশ এবং কম্বল দেখা যাচ্ছে। বড় সাহেব সম্ভবত সেখানে ঘুমান। হয়তো তিনি খাটে ঘুমাতে পারেন না। হয়তো ডাক্তার বলে দিয়েছে মেঝেতে ঘুমুতে। কিংবা তিনি নিজেই হয়তো শখ করে মেঝেতে শুয়ে থাকেন। বড় মানুষরা বিচিত্র কর্মকাণ্ড করতে ভালোবাসেন।

বাবুল।

জি স্যার।

লায়লা তোমাকে দুপুরে ভাত খাইয়েছে?

জি স্যার।

মেনু কী ছিল বলো তো?

বেগুন ভাজি, মুরগির মাংসের ঝোল।

ডলি ছিল না?

ডাল ছিল স্যার।

ডালের কথাটা বাদ দিলে কেন? আমার কাছে যখন কোনো বিষয়ে রিপোের্ট করবে তখন কিছুই বাদ দেবে না। কী ডাল ছিল, মসুর ডাল না মুগ ডাল?

মুগ ডাল।

মুরগির ঝোলে কোনো তরকারি ছিল?

পেঁপে ছিল। আলুর মতো গোল করে কাটা পেঁপে।

ভালো মতো চিন্তা করে দেখো কোনো ডিটেল কি বাদ গেছে?

জি না স্যার।

সব বলা হয়েছে?

জি স্যার।

লেবু ছিল না?

ছিল স্যার।

লেবুর কথা তো বাদ দিলে। চিন্তা করে দেখো আর কিছু কি বাদ গেছে?

জি না স্যার।

একটা ব্যাপার বাদ দিয়ে গেছ। তোমার সঙ্গে তোমার বাবা ছিলেন। এই কথাটা বলোনি।

শফিক হকচকিয়ে গেল। সে তার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে এই তথ্য বড় সাহেব জানবেন সে ভাবেনি। তিনি কি রাগ করেছেন? তার মুখ দেখে সে রকম মনে হচ্ছে না। হাসি হাসি মুখ। চোখের দৃষ্টি যদিও তীক্ষ্ণ।

তোমার বাবা কি দুপুরের খাবার খেয়ে খুশি হয়েছিলেন?

জি স্যার। খুব খুশি হয়েছেন।

খাবারের আয়োজন তো তেমন কিছু না। তাহলে খুব খুশি কেন হলেন?

আমার বাবা অল্পতেই খুশি হন। তাছাড়া ম্যাডাম খুব যত্ন করেছেন।

খুব যত্ন করেছেন মানে কী? তোমরা যখন খাচ্ছিলে তখন পাখা দিয়ে বাতাস করছিল?

ম্যাডাম আন্তরিকভাবে গল্পগুজব করছিলেন। বাবার সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশাও করছিলেন। যেন আমরা তার খুবই পরিচিত।

কি ঠাট্টা-তামাশা করছিল একটু বলো তো শুনি।

আমি বলতে পারব না স্যার। যখন ঠাট্টা-তামাশা করছিলেন তখন আমি বারান্দায় ছিলাম।

বারান্দায় ছিলে কেন?

আমার সিগারেট খাবার অভ্যাস আছে, আমি সিগারেট খাবার জন্যে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম।

তুমি বারান্দায় ছিলে, তাহলে কী করে বুঝলে যে ঠাট্টা-তামাশা হচ্ছিল?

আমি ওনাদের হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

লায়লাও হাসছিল?

জি স্যার।

কি নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছিল এটা তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে না?

জানা যাবে।

সোবাহানকে বলো একটা গাড়ি পাঠিয়ে সে যেন তোমার বাবাকে আমার এখানে নিয়ে আসে। রাত নটার দিকে আনবে।

জি আচ্ছা স্যার।

তোমার কপাল ঘেমে গেছে। ঘর যথেষ্ট ঠাণ্ডা, তোমার কপাল ঘামছে কেন? শফিক জবাব দিতে পারল না। তার কি হার্ট এটাকের মতো হচ্ছে? হার্ট এটাকের সময় ঘাম হয়।

বড় সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, অচ্ছাি তুমি এখন যাও। আমজাদ আলির শাস্তি কোন পর্যায়ে আছে খোঁজ নাও।

শফিক দোতলা থেকে নিচে নেমে এলো।

 

আমজাদ আলি উঠবোস করছেন। হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। বুক ওঠানামা করছে। তার পরনের ছাই রঙের পাঞ্জাবির পুরোটাই ঘামে ভিজে জবজব করছে। আগে উঠবোস করার সময় স্ট্যান্ড ফ্যানে বাতাস দেয়া হতো। আজ বাতাস দেয়া হচ্ছে না। মনে হয় ফ্যান নষ্ট। আমজাদ আলির বয়সও মনে হয় কয়েক দিনে অনেক বেড়েছে। মুখের চামড়া ঝুলে পড়েছে। চোখের নিচে কালি।

শফিক তাঁর সামনে দাঁড়াতেই তিনি উঠবোস বন্ধ করে পাশের চেয়ারে বসলেন।

যে উঠবোসের হিসাব লিখছিল সে বলল, স্যার আরো করবেন না এই পর্যন্ত?

আমজাদ আলি বললেন, আজ আর পারব না। কত হয়েছে? টোটাল কত?

তিন হাজার ছয়শ একত্রিশ।

এত কম? এই জীবনে মনে হয় শেষ করতে পারব না।

বাসায় চলে যান। কয়েকটা দিন রেস্ট নেন। একসঙ্গে বেশি করা ঠিক হবে না।

আমজাদ আলি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ভাই দেখো তো একটু চা খাওয়াতে পারে কিনা।

তিনি হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মুখের হাঁ একবারও বন্ধ করছেন না। অফিসের বারান্দায় এখন কেউ নেই শুধু শফিক এবং আমজাদ আলি। আমজাদ আলি চেয়ারে গা ছেড়ে এলিয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে যে কোনো সময় গড়িয়ে নিচে পড়ে যাবেন। শফিক তাঁর সামনে রাখা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে। আমজাদ আলি বললেন, ভাই কিছু বলবেন?

শফিক বলল, জি না।

কত বড় বিপদে পড়েছি দেখেছেন ভাই সাহেব। নিঃশ্বাস ঠিকমতো নিতে পারছি না।

শফিক বলল, আপনি একটা কাজ করুন, ঘরের ভেতরে ফ্যানের নিচে বসুন।

এখন নড়তে পারব না। নড়ার ক্ষমতা নাই। পায়ের অবস্থা দেখেন। কি রকম ফুলেছে দেখেছেন। মনে হয় পানি এসে গেছে। আঙুল দিয়ে চাপ দিলে ডেবে যায়।

আমজাদ আলির চা চলে এসেছে। তিনি চায়ের কাপ হাতে নিয়েই বমি করতে শুরু করলেন। শফিক ছুটে গিয়ে তাঁকে ধরল। আমজাদ আলি বিড়বিড় করে বললেন, সরি আপনার কাপড় নষ্ট করে দিয়েছি।

 

আমজাদ সাহেবকে হাসপাতালে নিতে হলো। ডাক্তার দেখেশুনে বললেন, তেমন কিছু না। বাসায় নিয়ে যান, রোগী রেস্টে থাকুক। সাত দিন কমপ্লিট বেড রেস্ট।

শফিক বলল, চলুন আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি।

আমজাদ আলি বললেন, আমাকে বাসায় দিয়ে আসতে হবে না। আমি একটা ইয়েলো ক্যাব নিয়ে চলে যাব। আপনি অনেক কষ্ট করেছেন অরি না।

শফিক বলল, কষ্ট কিছু না আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।

সেটা জানিরে ভাই। স্যার আপনাকে ফুলটাইম গাড়ি দিয়েছেন। আপনি বিরাট ভাগ্যবান মানুষ। একদিন দুটা মিনিট সময় দিবেন আমি আমার কপালটা আপনার কপালে ঘষব।

যাবার পথে আমজাদ সাহেব গাড়ির পেছনের সিটে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে রইলেন। চলন্ত গাড়িতে তিনি মাথা তুলতে পারছেন না। মাথা ঘুরছে। একবার শুধু শফিককে ফিসফিস করে বললেন, কানে ধরে উঠবোসের ব্যাপারটা যেন কেউ না জানে। তাই আপনার পায়ে ধরি। শফিক বলল, কেউ জানবে না।

আমজাদ আলি বললেন, আমার ছোট মেয়েকে তো চিনবেন না। শায়লা নাম। তার বিরাট বুদ্ধি। প্যাচ খেলিয়ে বের করে ফেলবে।

বাসায় পা দিয়েই আমজাদ সাহেব পুরোপুরি সুস্থ। হাঁকাহাঁকি-ডাকাডাকি।

মা দেখ কাকে নিয়ে এসেছি। আমাদের নতুন কলিগ। চা-নাস্তার জোগাড় দেখ গো মা।

শফিককে চা-নাস্তা খেতে হলো। আমজাদ সাহেবের ছোট মেয়ে শায়লার দুটা গান শুনতে হলো। শায়লা রবীন্দ্র সংগীত শিখছে। আমজাদ আলির বাড়িতে যে অতিথিই আসুক শায়লার একটা গান শুনতে হয়। এখন পর্যন্ত সে একটা গানই পুরোপুরি তুলেছে— খোল খোল দ্বার, রাখিও না আর বাহিরে আমায় দাড়ায়ে।

আমজাদ আলি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার মেয়ের গলাটা আপনার কাছে কেমন লাগল?

শফিক বলল, খুবই সুন্দর গলা।

আজ তবলা ছাড়া শুনেছেন। তবলা দিয়ে শুনলে আরো ভালো লাগবে। আরেক দিন যদি আসেন তবলা দিয়ে শোনার ব্যবস্থা করব।

আসব আরেক দিন।

আমজাদ আলি মেয়ের দিকে তাকিয়ে অনিন্দিত গলায় বললেন, মাগো তোমার এই গান আরেকবার শুনাও। এইসব গান একবার শুনলে মন ভরে না।

শফিককে একই গান দ্বিতীয়বার শুনতে হলো।

শফিক বাসায় ফিরল রাত দশটায়। নিশো তখনো জেগে। সে শফিককে দেখে ঝাপ দিয়ে পড়ল। নিশো আনন্দিত এবং উত্তেজিত। তার গায়ে নতুন জামা। তার খুব পছন্দের সাজ ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়া। এটা তাকে কখনো করতে দেয়া হয় না। বিশেষ বিশেষ উৎসবে এই সুযোেগটা সে পায়। আজ পেয়েছে। সে ইচ্ছা মতো ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষেছে।

নিশো বলল, বাবা আজ বাসায় পোলাও রান্না হয়েছে।

হঠাৎ পোলাও কেন?

আজ মার জন্মদিন।

ও আচ্ছা তাই তো!

মীরার জন্মদিনের তারিখটা শফিকের কখনো মনে থাকে না। বড় সাহেবের মতো তার যদি কয়েকজন পার্সোনাল ম্যানেজার থাকত তাহলে একজনের ওপর দায়িত্ব থাকতো জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, মেয়ের জন্মদিন এইসব মনে করিয়ে দেয়ার। একজনের ওপরে দায়িত্ব থাকতো কি উৎসব বিবেচনা করে উপহার কিনে আনার। আরেক জন থাকতো ফুড ম্যানেজার। সে উপলক্ষ্য বিবেচনা করে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করবে।

মীরা সুন্দর করে সেজেছে। চোখে কাজল দিয়েছে। কাজল নামের কালো রঙ কি করে চোখ এত সুন্দর করে কে জানে। মেয়েরা উৎসব উপলক্ষে নতুন শাড়ি পরতে পছন্দ করে। বেচারি একটা পুরনো শাড়ি পরেছে। জন্মদিনের কথা শফিকের কিছুই মনে নেই। মনে থাকলে একটা সুতির শাড়ি সে অবশ্যই কিনত। একটা শাড়ি, কিছু ফুল।

মীরা বলল, গোসল করার আগে কি তোমাকে চা দেব? না গোসল করে চা খাবে?

আগে গোসল করব।

আমার জন্মদিনের কথা তুমি ভুলে গেছ তাই না?

না ভুলিনি।

কেন মিথ্যা কথা বলো। ভুলে গেছ সেটা স্বীকার করলেই হয়। আমার জন্মদিন এমন কোনো বিরাট ব্যাপার না যে তোমাকে মনে রাখতে হবে।

ঝগড়া শুরু করে দিলে?

ঝগড়া শুরু করব কেন? তুমি যে মিথ্যা কথা বলছ এটা শুধু ধরিয়ে দিলাম। তোমার যদি জন্মদিনটা মনে থাকত আর কিছু আনো না আনো কিছু ফুল আনতে।

ফুল আনলেই ভালোবাসা প্রমাণ হয়?

ফুল আনলে প্রমাণ হয় যে তারিখটা তোমার মনে আছে।

তোমার জন্ম তারিখটা খোদাই করে আমার কপালে লিখে দাও না কেন? যতবার আয়নার দিকে তাকাব ততবার জন্ম তারিখ মনে পড়বে।

এখন তুমি ঝগড়া শুরু করেছ। যাও গোসল করে আসো। আজকের দিনটা চিৎকার-চেঁচামেচি না করে পরে করো। প্লিজ হাতজোড় করছি।

শফিক গোসল করছে। মা-মেয়ে দুজনই বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে। আজ বৃষ্টি নেই, বৃষ্টির পানির ধারাস্রোত নেই; কিন্তু শফিক গোসলের সময় এমন ভাব করছে যেন তার মাথায় বৃষ্টির পানি পড়ছে। মীরা ব্যাপারটা আগ্রহ নিয়ে দেখছে। এই অদ্ভুত কাণ্ড শফিক আগেও কয়েকবার করেছে। কাজটা সে নিশ্চয়ই চিন্তা-ভাবনা করে করছে না। সে কি কোনো ঘোরের মধ্যে আছে?

নিশো বলল, বাবা আজ পোলাও-এর সঙ্গে কী রান্না হচ্ছে বলো তো?

শফিক বলল, জানি না।

আন্দাজু করে। (আন্দাজকে নিশো আন্দাজু বলে।)

আন্দাজু করতে পারছি না।

চেষ্টা করে।

চেষ্টা করতে পারছি না। বিরক্ত কোরো না তো নিশো।

মীরা বলল, আমার রাগটা তুমি মেয়ের ওপর দেখাচ্ছ কেন? তোমার সমস্যা কী?

শফিক কঠিন কিছু বলতে যাচ্ছিল, বলল না। নিজেকে সামলে নিল। এখন সে চোখ বন্ধ করে এমন ভাবে মাথা নাড়ছে যেন মাথার ওপর বৃষ্টির পানি পড়ছে। মীরা বলল, বৃষ্টির মধ্যে তুমি যখন গোসল করো তখন চা খেতে পছন্দ করো। এনে দেব এক কাপ চা?

দাও।

চা খেয়ে মেজাজ ঠাণ্ডা করো। প্লিজ।

মীরা চা আনতে গেল। নিশো বলল, বাবা এখন আন্দাজু করো পোলাও-এর সঙ্গে কী রান্না হয়েছে?

হরিণের মাংসের কাবাব। ময়ূরের রোস্ট।

হয়নি।

তাহলে মনে হয় হাতির মাংসের রেজালা, ঘোড়ার মাংসের কোরমা।

বাবা তুমি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ। ভালো হবে না বলছি। আমিও কিন্তু মার মতো রাগ করব।

 

শফিক হেসে ফেলল। মীরার ওপর যে রাগ তৈরি হয়েছিল এখন আর তা নেই। হেসে ফেলায় সব শেষ। এখন শফিকের ইচ্ছা করছে মীরাকে সত্যি কথাটা বলতে। সে এখন মীরাকে বলতে পারে তোমার জন্মদিনের তারিখটা আমি ভুলে গেছি এটা সত্যি তবে আমাদের অফিসের একজন কর্মচারীর হার্ট এটাকের মতো হয়েছিল এটাও সত্যি।

মীরা চা এনে দেখে বাবা-মেয়ে দুজনই খুব হাসাহাসি করছে। শফিক হতি দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে আর মেয়ে বলছে—বাবা ভালো হবে না বলছি। আমি কিন্তু খুব রাগ করছি। আমি কিন্তু ভয়ংকর রেগে যাচ্ছি।

 

জয়নাল সাহেব অবাক হয়ে তাঁর সামনে বসে থাকা মানুষটাকে দেখছেন। এই মানুষটা নাকি কোটিপতির ওপর কোটিপতি। তিনি তার জীবনে কোনো কোটিপতি দেখেননি। এক লক্ষ লিখতে একের পর পাঁচটা শূন্য দিতে হয়। এক কোটি লিখতে কয়টা শূন্য লাগে তিনি এই মুহূর্তে মনে করতে পারছেন না। নিযুতের পর হলো কোটি। নিযুত লিখতে ছয়টা শূন্য তার মানে সাতটা শূন্য। এক বিলিয়নে কয়টা শূন্য? যাক এইসব নিয়ে পরে চিন্তা করা যাবে এখন বরং কোটিপতি মানুষটাকে দেখা যাক।

মানুষটা চেয়ারে দুলছেন। বেশিক্ষণ দুলুনি দেখা যায় না। মাথা ঝিমঝিম করে। মানুষটা সিগারেট খাচ্ছে। নিশ্চয়ই খুবই দামি সিগারেট। তিনি নিজে সিগারেট খান না তবে দামি একটা সিগারেট খেয়ে দেখা যেতে পারে। তবে এই মানুষের সামনে খাওয়া যাবে না। বেয়াদবি হবে।

আপনি ডিকশনারি মুখস্থ করে ফেলেছেন?

জি জনাব।

আপনি যেখানেই যান হাতে ডিকশনারি থাকে?

জি জনাব।

বাস করেন একটা হোটেলে?

জি জনাব।

আপনি কি সুখে আছেন?

জি জনাব।

রাতের খাওয়া খেয়েছেন?

জি না।

আমার সঙ্গে রাতের খাওয়া খান অসুবিধা আছে?

জি না জনাব।

প্রতিটি বাক্য জনাব দিয়ে বলছেন কেন?

আপনি নিষেধ করলে বলব না।

আপনার স্মৃতিশক্তি কেমন?

স্মৃতিশক্তি ভালো না জনাব।

ভালো না বলছেন কেন? গোটা ডিকশনারি মুখস্থ করে ফেলেছেন।

আমার স্মৃতিশক্তি ভালো না জনাব। সব ক্ষমতা ডিকশনারি মুখস্থ করতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলেছি।

নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলেন সেটা মনে আছে?

জি জনাব মনে আছে।

লায়লার সঙ্গে দেখা হয়েছিল মনে আছে?

জি মনে আছে।

দুপুরে খেয়েছিলেন মনে আছে?

মনে আছে।

আইটেম কী কী ছিল মনে আছে?

আছে।

তাহলে তো অনেক কিছুই মনে আছে। এখন বলুন লায়লার সঙ্গে কি কি কথা হয়েছিল। কোনো কিছুই বাদ দেবেন না। আপনারা দুজন মিলে হাসাহাসিও করছিলেন বলে শুনেছি। কি নিয়ে হাসাহাসি করছিলেন সেটা আগে বলুন।

জয়নাল সাহেব বিস্মিত হয়ে তাকাচ্ছেন। তাঁর সামনে চেয়ারে বসে যে মানুষটা দোল খাচ্ছে তাকে এখন আর খুব স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে মানুষটার কোনো সমস্যা আছে। বড় কোনো সমস্যা।

মবিনুর রহমান বললেন, চুপ করে আছেন কেন, বলুন।

উনি তার মেয়ের নানা কর্মকাণ্ডের কথা বলতে বলতে হাসছিলেন।

উদাহরণ দিন। উদাহরণ না দিলে বুঝব না।

যেমন তাঁর মেয়েটা কেজি থেকে ক্লাস ওয়ানে উঠবে। উনি তার মেয়েকে স্কুলে যাবার জন্যে সাজিয়ে দিচ্ছেন। সাজাতে সাজাতে বললেন— মা আজ তুমি ক্লাস ওয়ানে উঠবে। মেয়েটা তখন গভীর হয়ে বলল, উঠব তো বুঝলাম, কিন্তু নামব কীভাবে?

মবিনুর রহমান বললেন, এই কথায় হাসির অংশ কোনটা? কই আমার তো হাসি আসছে না!

আমি ঠিকমতো বলতে পারিনি। এই জন্যে আপনার হাসি আসেনি।

মেয়েটার নাম কী?

নাম জানি না।

নাম জিজ্ঞেস করেননি?

জি না।

জিজ্ঞেস করেননি কী জন্যে?

জনাব আপনি যদি চান আমি জিজ্ঞেস করে জেনে আসব।

আপনাকে কিছুই জানতে হবে না। আপনি কি কখনো মানুষ খুন করেছেন? জি না জুনাব।

কাউকে খুন করার ইচ্ছা কখনো হয়েছে?

জি না।

জয়নাল সাহেব ভীত চোখে তাকিয়ে আছেন। মানুষটাকে দেখে তার কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে। শফিকের জন্যে তার মায়া লাগছে। এই মানুষটার সঙ্গে কাজ করা শফিকের জন্যে নিশ্চয়ই কোনো সহজ কাজ না। আহা বেচারা।

মবিনুর রহমান বললেন, মানুষ খুন না করতে পারেন; কিন্তু খুনের ইচ্ছা হওয়াটা তো স্বাভাবিক। আমার বাবা আমার চার বৎসর বয়সে আমাকে একটা এতিমখানায় দিয়ে চলে যান। আর তাঁর কোনো খোঁজ পাইনি। এই মানুষটার প্রতি আমার কি রাগ উঠবে না?

জয়নাল সাহেব ভয়ে ভয়ে বললেন, উনি হয়তো খুবই অভাবি মানুষ ছিলেন। অভাব মানুষের সব ভালো গুণ নষ্ট করে দেয়। আমিও অভাবের কারণে আমার স্ত্রীকে মেয়ের বাসায় ফেলে রেখে হোটেলে থাকি।

মবিনুর রহমানের মুখ হাসিহাসি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি মজা পাচ্ছেন। তিনি ডিকশনারি হাতে বসে থাকা লোকটার দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললেন, এখন আমি কি বলব একটু মন দিয়ে শুনবেন।

জয়নাল সাহেব ভীত গলায় বললেন, আপনার সব কথাই আমি মন দিয়ে শুনছি জনাব।

চার বছর বয়েসী বাচ্চার মনে কোনো স্মৃতি থাকে না; কিন্তু আমার বাবাকে নিয়ে কিছু স্মৃতি আছে। তার মধ্যে একটা হলো আমার বাবা আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন। ঘাড়ে ধরে পুকুরের পানিতে মাথা ড়ুবিয়ে রাখছেন। আমার নাক-মুখ দিয়ে পানি ঢুকে যাচ্ছে। এখন আপনি বলুন এই মানুষটাকে খুন করার ইচ্ছা হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক কিছু?

জয়নাল সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, জনাব খুবই পানির পিপাসা হয়েছে। এক গ্লাস পানি খাব।

বরফ দেয়া ঠাণ্ডা পানি?

জি জনাব বরফ দেয়া ঠাণ্ডা পানি।

জয়নাল সাহেবকে বিস্মিত করে দিয়ে এই মানুষটা নিজেই হাতে করে পানি নিয়ে এলেন। কোটিপতি একজন মানুষ। একের পর সাতটা শূন্য বসালে কোটি হয়। কোটির পরে কি আছে? বিলিয়নের পরে আছে ট্রিলিয়ন। কোটির পরে কি?

জয়নাল সাহেব।

জি।

আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?

সামান্য লাগছে। যদি ইজাজত দেন আমি হোটেলে চলে যাই।

ডিনার করবেন না?

জি না। শরীরটা ভালো না।

আচ্ছা ঠিক আছে যান। গাড়ি আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। আরেক দিন আপনাকে খবর দিয়ে অনিব।

আপনি যখন বলবেন চলে আসব।

আপনাকে সঙ্গে নিয়ে একটা দৃশ্য দেখব। তিন-চার বছর বয়েসী একটা বাচ্চা জোগাড় করব। বাচ্চার বাবাকে দিয়ে বাচ্চাটাকে শাস্তি দেয়াব। বাচ্চার বাবা সামান্য কিছু সময়ের জন্যে বাচ্চাকে ঘাড়ে ধরে চৌবাচ্চার পানিতে চুবিয়ে রাখবে। ইন্টারেস্টিং হবে না?

জয়নাল সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, জি জনাব।

আপনার সন্ধানে কি এই বয়সের কোনো ছেলে বা মেয়ে আছে?

জয়নাল সাহেব আবারো বিড়বিড় করলেন। কি বললেন কিছুই বুঝা গেল না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ