বাড়ির নাম আতর-বাড়ি।

ঢাকা শহরে অদ্ভুত অদ্ভুত নামের অনেক বাড়ি আছে। আতর-বাড়িকে কি সেই তালিকায় ফেলা যায়?

গাছপালায় ঘেরা বিশাল দোতলা বাড়ি। চারিদিকে উঁচু পাঁচিল বলে দিচ্ছে বাড়ির মালিকের প্রচুর পয়সা। ধনবান ব্যক্তিদের বাড়ির পাঁচিল উঁচু হয়। তাঁরা নিজেদের পাঁচিল দিয়ে আলাদা করে রাখতে পছন্দ করেন। তাদের বাড়ির গেট হয় নিচ্ছিদ্র লোহার। সেখানে কোন ফুটো-ফাটা থাকে না। ফুটোর ভেতর দিয়ে তাদের বাড়ির ভেতরের কোন কিছুই দেখার উপায় নেই।

শফিকুল করিম আতর-বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছা করলেই সে বাড়িতে ঢুকতে পারে। ঢুকছে না। সিগারেট ধরিয়েছে, কে জানে ভেতরে হয়তো সিগারেট খাওয়া যাবে না। এমন হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে বাড়ির মালিক মবিনুর রহমান সিগারেটের ধোঁয়া পছন্দ করেন না। অতি ধনবানরা একটা পর্যায়ে এসে ডাক্তারদের নিয়ম-কানুন মেনে চলেন। সিগারেট ছেড়ে দেন। নিরামিশি হয়ে যান। সকালে মর্নিং ওয়াক করেন। বাড়িতে ওয়াকার নামক যন্ত্র থাকে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হাঁটা। ধনবানদের জন্যে বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি।

একটা সিগারেট শেষ করতে শফিকুল করিমের দুই মিনিট বার সেকেন্ড লাগে। স্টপওয়াচ দিয়ে হিসাব করা। আজকে মনে হয় সময় বেশি লাগছে। টেনশনের সময় অন্য সবাই সিগারেট দ্রুত টানে। তার বেলায় উল্টোটা হয়— সে সিগারেট আস্তে টানে। সময় বেড়ে যায়। শফিকুল করিমের কাছে মনে হচ্ছে সে দশ-পনেরো মিনিট ধরেই সিগারেট টানছে, তারপরও অর্ধেকের বেশি শেষ হয়নি। মনে হয় তার টেনশন বেশি হচ্ছে। অথচ টেনশনের কোনোই কারণ নেই। মবিনুর রহমান তাকে চাকরি দিয়েছেন। আজ সে জয়েন করবে।

কি ধরনের চাকরি সে বুঝতে পারছে না। ওনার পিএ টাইপ কিছু? নাকি বাজার সর্দার? প্রতিদিন সকালে গাড়ি ভর্তি বাজার আনতে হবে। চাকরির শর্তে কিছুই বলা নেই। বেতনের অংকটা লেখা আছে মাসে বার হাজার এবং অন্যান্য সুবিধা। অন্যান্য সুবিধা কি কে জানে।

একেক কাজে একেক ধরনের সুবিধা পাওয়া যায়। পত্রিকা অফিসে যখন কাজ করত তখন অন্যান্য সুবিধার মধ্যে ছিল ফ্রি চা। বেতনের কোনো ঠিকঠিকানা নেই; কিন্তু যখন ইচ্ছা তখন চা খাওয়া। রঙ চা, দুধ চা, মাঝে মধ্যে মালাই চা বলে এক বস্তু। দুধের সর দিয়ে বানানো।

সে কিছুদিন ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেছে। সেখানের সুবিধা বিনা টিকিটে বিমান ভ্রমণ

এন্টার্কটিকা ট্রাভেলস-এর মালিক বজলুল আলম চাকরি দেয়ার সময় শফিকুল করিমের পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন—বিনা টিকেটে দেশ-বিদেশ ঘুরবেন। যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যাবেন। জাপান-ইউরোপ-আমেরিকা কোনো ব্যাপারই না। অফ সিজনে যাবেন, এয়ারলাইন্স ফ্রি বিজনেস ক্লাসের টিকেট দেবে। আত্মীয়স্বজন বিদেশ যাচ্ছে? টেলিফোন করে বলে দেবেন তাদের নরমাল ইকোনমি ক্লাস টিকেট হয়ে যাবে বিজনেস ক্লাস। পায়ের ওপর পা তুলে ভ্রমণ।

শফিকুল করিমের জীবনে একবারই ফ্রি টিকেট জুটেছিল। ঢাকা-কাঠমন্ডু ঢাকা। কাঠমন্ডু যাওয়া হয়নি, তার আগেই চাকরি চলে গেল। এন্টার্কটিকা ট্রাভেলস-এর মালিক বজলুল আলম তার পিঠে হাত রেখে বললেন, সরি ভাই। আপনাকে দিয়ে আমাদের পোযাচ্ছে না। আমাদের আরো স্মার্ট লোক দরকার। আপনি একটু স্লো আছেন।

বজলুল আলমের অভ্যাস ছিল পিঠে হাত রেখে কথা বলা। বস শ্রেণীর মানুষদের কথা বলার অনেক প্যাটার্ন আছে। কেউ কথা বলে পিঠে হাত রেখে। কেউ কথা বলে চোখের দিকে না তাকিয়ে (প্রাইড পত্রিকার সম্পাদক হাসনাইন খান) আবার কেউ কথাই বলে না। যেমন বেগম রোকেয়া গার্লস কলেজের প্রিন্সিপাল আব্দুল মুকিত খান। শফিকুল করিম সেই কলেজে এক বছর এগারো মাস কাজ করেছে। বেতন ভালো ছিল না তবে মাসের সাত তারিখের মধ্যেই পাওয়া যেত। দুই ঈদে বোনাস ছিল। হুট করে চাকরি চলে গেল। প্রিন্সিপাল আব্দুল মুকিত খান সাহেব কম্পিউটার টাইপ করা চিঠিতে জানালেন– কলেজ পরিচালনা পরিষদ আপনার বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি একশান নিয়েছে। শফিকুল করিম কি ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করেছে সেটা জানার জন্যে আধঘণ্টা প্রিন্সিপাল সাহেবের ঘরে বসে রইল। তিনি কোনো কথা বললেন না। এই আধঘণ্টা তিনি গভীর মনোযোগের সঙ্গে নাকের লোম ছিঁড়ে টেবিলের ওপর রাখা এ ফোর সাইজ কাগজে জমা করতে লাগলেন। যেন তিনি নাকের লোম দিয়ে মহৎ কোনো শিল্পকর্ম করছেন। শিল্প-সৃষ্টিতে তিনি নিমগ্ন। এই সময়ে কারো দিকে তাকানো যাবে না এবং কারোর কথার কোনো জবাব দেয়া যাবে না।

আতর-বাড়ির মালিক মবিনুর রহমান সাহেবের নিয়ম-কানুন কী কে জানে! নিয়ম-কানুন নিশ্চয়ই আছে। থাকতেই হবে। হয়তো কথা বলার সময় তাঁর মুখ দিয়ে থুথু বের হয়। এই থুথু হাসি মুখে গায়ে মাখতে হবে। শফিকুল করিম সিগারেট ফেলে দিয়ে গেটের কলিং বেল টিপল। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ বাড়ির গেটের কলিং বেল কাজ করে না। বেল টেপার পরপরই অনেকক্ষণ গেটে ধাক্কাধাক্কি করতে হয়। এই বাড়িরটা কাজ করছে। দুবার বেল টিপতেই গেট খুলে গেল। দারোয়ান গলা বের করে বলল, কারে চান?

দারোয়ানকে দেখে স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে। সে লুঙ্গির ওপর খাকি শার্ট পরেছে। তার মানে আতর-বাড়ি ঢিলাঢালা অবস্থায় চলে। নিয়ম-কানুন কঠিন না। কঠিন নিয়ম হলে খাকি শার্ট-প্যান্ট, বুট-জুতা সবই থাকত। মুখও হাসি হাসি থাকত। তাদের মুখ দেখে মনে হতো কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা যুদ্ধে রওনা হবে।

আমার নাম শফিকুল করিম। আমি মবিনুর রহমান সাহেবের নতুন পিএ। চাকরিতে জয়েন করতে এসেছি। স্যার আছেন না?

জি আছেন। উনি চব্বিশ ঘণ্টা বাড়িতেই থাকেন। দোতলায় চলে যান। উনি দোতলায় থাকেন। আমরা স্টাফরা থাকি একতলায়।

সিঁড়ি কোন দিকে?

সোজা যান। শেষ মাথা পর্যন্ত যাবেন। ডাইনে তাকাবেন–সিঁড়ি।

শফিকুল করিম অবাক হয়ে বলল, সোজাসুজি দোতলায় চলে যাব? নিচে কাউকে কিছু জানাতে হবে না?

ক্যাশিয়ার সোবাহান সাহেব আছেন। উনার সঙ্গে দেখা করেন।

উনি কোথায় বসেন?

অফিস ঘরে বসেন। উত্তর দিকে যান। হলুদ রঙের আলাদা একতলা যে দালান দেখতেছেন, ঐটাই অফিস। ক্যাশিয়ার সাব অফিসে আছেন। আচ্ছা ঠিক আছে স্যার, চলেন আপনারে দিয়া আসি।

অফিস ঘরের বারান্দায় মোটামুটি ভালো জটলা। মজার কিছু হচ্ছে। সবাই আগ্রহ নিয়ে দেখছে। তবে কারো মুখেই কোনো কথা নেই। সাপ খেলা নাকি? সাপ খেলার সময় দর্শকরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখে। তবে সাপ খেলা, বাঁদর খেলা এইসব নিম্নবিত্তের জিনিস। বড় মানুষরা বড় খেলা দেখেন। সাপ-খোপ দেখেন না। শফিকুল করিম বলল, ওখানে কী হচ্ছে?

দারোয়ান গলা নামিয়ে বলল, আমজাদ স্যারের শাস্তি হইতেছে।

শাস্তি হচ্ছে মানে কী? কী শাস্তি হচ্ছে?

কাছে গেলেই দেখবেন। কানে ধইরা উঠবোস।

সত্যি সত্যি একজন বয়স্ক চশমা পরা মানুষ কানে ধরে উঠবোস করছে। একজন কাগজ-কলম নিয়ে সামনে আছে। সে মনে হয় উঠবোসের হিসাব রাখছে। যিনি উঠবোস করছেন তাঁর পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে গেছে। যিনি হিসাব রাখছেন তিনি বললেন, আমজাদ সাহেব এখন কিছুক্ষণ রেস্ট নেন। পানি খান।

উঠবোস করা মানুষটা সবুজ রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসল। চেয়ারের সামনে স্ট্যান্ড ফ্যান। একজন এসে ফ্যানের মুখ ঘুরিয়ে দিল। আমজাদ নামের মানুষটা হাঁ করে ফ্যানের বাতাস মুখে নিচ্ছে। মানুষটা ফর্সা, এখন তাকে টকটকে লাল দেখাচ্ছে। তার হাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি গ্লাস হাতে বসে আছেন। গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন না।

কাগজ-কলম হাতে মানুষটা শফিকুল করিমের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, আপনের এইখানে কী? কী চান?

ক্যাশিয়ার সাহেবের সঙ্গে কথা বলব।

অফিসে যান। বারান্দায় ভিড় করছেন কেন? এখানে মজা দেখার কিছু নাই।

শফিকুল করিম অফিস ঘরে ঢুকল।

একটা আইবিএম পার্সোনাল কম্পিউটারের সামনে যে লোক বসে আছে সেই সম্ভবত সোবাহান সাহেব। ভগ্ন স্বাস্থের একজন মানুষ। চোখের নিচে কালি। গাল ভাঙা। খালা-খাবলাভাবে মাথার চুল উঠছে। বয়স খুব বেশি হবে না, তবে দেখাচ্ছে অনেক বেশি। গরমের মধ্যেও তিনি হলুদ রঙের কোট গায়ে দিয়ে আছেন।

ভদ্রলোকের গলার স্বর মেয়েদের মতে, তিনি শফিকুল করিমের দিকে তাকিয়ে প্রায় কিশোরীদের মতো গলায় বললেন, আপনার কী ব্যাপার?

আমার নাম শফিকুল করিম। আমি চাকরিতে জয়েন করতে এসেছি।

বুঝেছি। বসেন। কেমন আছেন?

ভালো।

স্যার আপনার কথা বলেছেন। কবে জয়েন করবেন সেটা বলেন নাই। আসছেন ভাল করেছেন। আজ দিন ভালো— বৃহস্পতিবার। চা খাবেন?

জি না। প্র

থম দেখা আপনার সঙ্গে। চা খান। আলাপ-পরিচয় হোক।

আপনার এইখানে কি সিগারেট খাওয়া যাবে?

যাবে। সিগারেট ধরান কোন সমস্যা নাই।

ক্যাশিয়ার সাহেব বিরক্ত মুখে বেল টিপতে লাগলেন। এই কাজটা মনে হয় তিনি পছন্দ করেন না। অনেকক্ষণ বেল টেপার পর একজন ঘরে ঢুকল। সোবাহান সাহেব রাগী গলায় বললেন, বেলের শব্দ কানে যায় না? সব বারান্দায় বসে আছ। রঙ্গ দেখ? রঙ্গ গুহ্য দ্বার দিয়ে চুকায়ে দেব গুহ্য দ্বার চিনো? যাও দুই কাপ চা আনো।

শফিকুল করিম ক্ষীণ গলায় বলল, বারান্দায় কী হচ্ছে?

কানে ধরে উঠবোস করানো হচ্ছে। আমাদের আগের ম্যানেজার। আমজাদ নাম। অপরাধ করেছিল, চাকরি চলে গেছে। স্যারের কাছে কেঁদে পড়েছে। স্যার বলেছেন পঞ্চাশ হাজার বার কানে ধরে উঠবোস করলে চাকরি ফেরত পাবে। তাই করছে।

কতবার বললেন?

পঞ্চাশ হাজার বার। ফিফটি থাউজেন্ড।

বলেন কী?

পারবে না। সাত দিন ধরে উঠবোস করছে, মাত্র চৌদ্দশ, না পনেরোশ, হয়েছে। বেশিক্ষণ করতে পারে না। পা ফুলে যায়। তার ওপর আছে হাঁপানি। আজকে উঠবোস করতে আসছে জ্বর নিয়ে। আমি বলেছিলাম আজকে অফ রাখতে।

শফিকুল করিম সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, এ রকম শাস্তি কি এখানে প্রায়ই হয়?

না । এখানে কোনো শাস্তি হয় না। চাকরি চলে যায়। উঠবোস যেটা করছে সেটা চাকরি ফেরত পাওয়ার জন্যে। খামখা পরিশ্রম করছে। পারবে না। আপনি কি চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবেন? বিসকিট, চানাচুর?

জি না।

রাতে কি থাকবেন না চলে যাবেন?

চাকরির শর্ত কী? রাতেও থাকতে হবে?

স্যার যে রকম বলেন সে রকম। তবে রাতে থাকেন বা না থাকেন এখানে আপনার জন্যে ঘর থাকবে। বিশ্রাম নিতে পারবেন। খাওয়া-দাওয়া আমাদের সঙ্গে করবেন। স্টাফদের রান্না আলাদা হয়। বাবুর্চির রান্না খুবই ভালো। মাছমাংস দুটাই থাকে। রাতে যদি রুটি খাওয়ার অভ্যাস থাকে, বাবুর্চিকে আগে বলে দিবেন। রুমালি রুটি করে দেবে, মসলিন কাপড়ের মতো পাতলা।

বাবুর্চির নাম কী?

যাকে চায়ের কথা বললাম, সে-ই বাবুর্চি, নাম ছগির। ঢাকা শহরে ছগিরের মতো বাবুর্চি আছে বলে মনে হয় না। তার খাসির মাংসের রেজালা তুলনাবিহীন। চাকরিতে যখন ঢুকেছেন তখন তার রান্না অবশাই খাবেন। আমার কথা যাচাই করে নিতে পারবেন।

এক কাপের জায়গায় শফিকুল করিম দুকাপ চা শেষ করল। দুকাপ চায়ের সঙ্গে তিনটা সিগারেট। সোবাহান মিয়া সারাক্ষণই কথা বলে যেতে থাকলেন। তার মনে হয় কথা বলার রোগ আছে।

আপনি যে এসেছেন সেই খবর আমি মোবাইল টেলিফোনে স্যারকে দিয়ে দিচ্ছি। আপনি দোতলার বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকবেন। খবরের কাগজ-টাগজ পড়বেন। স্যার যদি ম্যানেজার বলে ডাক দেন, তবেই ঘরে ঢুকবেন। না ডাকলে ঢুকবেন না।

আমার পোস্টটা কী? ম্যানেজারের পোস্ট?

এই রকমই কিছু ধরে নেন।

আমজাদ সাহেব যিনি উঠবোস করছেন, তিনি কি এই পোস্টেই ছিলেন?

হ্যাঁ। আপনি উনার জায়গাতেই এসেছেন।

আমজাদ সাহেবের শাস্তি শেষ হলে উনি চাকরি ফেরত পাবেন। তখন কি আমার চাকরি চলে যাবে?

মনে হয় চলে যাবে! স্যার কখনো প্রয়োজনের বেশি স্টাফ রাখেন না। আপনি লে যনি দোতলায়। আমি খবর দিয়ে দিচ্ছি। দুপুরে যখন খেতে আসবেন ঘরের চাবি নিয়ে যাবেন।

মবিনুর রহমান বসে আছেন তাঁর শোবার ঘরের একমাত্র চেয়ারটায়। এটা একটা রকিং চেয়ার। পা রাখার জন্যে ফুট-রেস্ট আছে। ফুট-রেস্টে পা রেখে চেয়ার যখন দোলানো হয়, তখন ফুট রেস্টটাও সমান তালে দোলে। আরামদায়ক ব্যবস্থা। তারপরেও তিনি কোনো আরাম পাচ্ছেন না। তিনি পিঠের পেছনে একটা বালিশ দিয়েছেন। বালিশটা দেয়ার পর পর তাঁর মনে হয়েছিল, এইবার আরাম হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, পিঠের পেছনে বালিশ দেয়াটা বোকামি হয়েছে। বোকামি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ঠিক করতে হয় না। বোকামিটাকে প্রবাহিত হতে দিতে হয়। তিনি তাই করছেন, বোকামিটাকে প্রবাহিত হতে দিচ্ছেন।

তিনি চেয়ারে দুলতে দুলতে তাকিয়ে আছেন টিভির দিকে। তাঁর ঘরের টিভিটা বিশাল। ডায়াগোনালি, পর্দার সাইজ ৬৪ ইঞ্চি। টিভির সঙ্গে দেয়া হ্যান্ডবুকে লেখা আছে— পর্দার ছবি সবচে ভালো দেখার জন্যে দর্শককে পর্দা থেকে বিশ ফুট দূরে বসতে হবে। তিনি গজফিতা দিয়ে মেপে তার রকিং চেয়ার ঠিক বিশ ফুট দূরে বসিয়েছেন। দোল খাওয়ার সময় চেয়ার একটু আগুপিছু হয়। কতটুকু আগুপিছু হয় সেটাও মাপিয়েছেন। ০৩ ফুট। কাজেই তাঁর পজিশন ২০৩ ফুট।

টিভিতে রান্নাবান্নার একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। ঝলমলে শাড়ি-গয়না পরা অতি রূপবতী এক তরুণী পিজা বানাচ্ছে। তরুণীকে সাহায্য করছে আরো দুজন তরুণী। তিনজনের সাজসজ্জা এ রকম যে দেখে মনে হচ্ছে তারা কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছে। কিছু দর্শকও উপস্থিত আছে। দর্শকরা শুধু যে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তা-না। মাঝে মাঝে তাদের মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যাচ্ছে। যেন এমন অপূর্ব দৃশ্য তারা তাদের মানব জীবনে কখনো দেখেনি। ভবিষ্যতে দেখবে এই সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

সুপ্রিয় দর্শকমণ্ডলী, পিজার জন্মভূমি ইতালি। তবে এই খাবার এখন সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি বাংলাদেশেও। ঢাকা শহরে কতগুলো পিজা আউটলেট আছে আপনারা কি জানেন? ক্যামেরা চলে গেল দর্শকের মুখে। দর্শকরা চিন্তিত হয়ে একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। একজন বলল, পঞ্চাশটি।

রাঁধুনী কপালে এসে পড়া চুলগুলো ঝাঁকি দিয়ে সরাতে সরাতে বলল, হয়নি। আর কেউ কি উত্তর দেবেন? যার উত্তর কাছাকাছি হবে তার জন্যে পুরস্কার আছে।

একশ।

তিনশ পঞ্চাশ।

এক হাজার।

তিনি টিভির ভ্যলুম একটু বাড়িয়ে দিলেন। ঢাকা শহরে কতগুলো পিজা আউটলেট আছে এটা জানা এই মুহূর্তে তার কাছে জরুরি বলে মনে হচ্ছে। তিনি ঠিক করলেন, এই ফাঁকে পিজা রান্নাটাও শিখে নেবেন। পিজা তাঁর কোনো পছন্দের খাবার না। তারপরেও নতুন একটা রান্না শিখে নিতে কোনো সমস্যা নেই। ইংরেজিতে একটা কথা আছে— Even an old dog can learn few new tricks.

মবিনুর রহমানের বয়স সাতান্ন। মাঝারি আকৃতির ছোটখাটো মানুষ। চেহারায় বয়সের ছাপ তেমন ভাবে না পড়লেও মাথার চুল সবই সাদা। এই বয়সে মাথার চুল কমে যায়। কপাল বড় হয়। তাঁর বেলায় এই ঘটনা ঘটেনি। মাথা ভর্তি সাদা চুলের কারণে এবং গোঁফের কারণে তাকে অনেকটা আইনস্টাইনের মতো দেখায়। তিনি কপ দেন না। কলপের কোনো একটা ইনগ্রেডিয়েন্টে তাঁর এলার্জি আছে। দেশী-বিদেশী যে কলপই দেন, তার গায়ে চাকা চাকা বের হয়।

মাথার সাদা চুল তার পছন্দ না। বেশির ভাগ সময় তিনি মাথায় ক্যাপ পরে থাকেন। নানা ধরনের ক্যাপ তার আছে। এখন তিনি যে ক্যাপ পরে আছেন, সেটা আফগান মুজাহেদিন ক্যাপ। দেখতে অনেকটা কাগজের ঠোঙ্গার মতো। একটা ভঁজ দিয়ে মাথায় দিতে হয়। তার পরনে লুঙ্গি, গায়ে পাতলা ফতুয়া। তিনি টিভি পর্দা থেকে চোখ না সরিয়ে ডাকলেন, ম্যানেজার।

শফিকুল করিম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল। ঘরে ঢুকল না। দরজার ওপাশ থেকে ক্ষীণ গলায় বলল, স্যার ডেকেছেন?

তিনি বললেন, ভেতরে আসে। আমি যখন ডাকব আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়াবে। দূরে দাঁড়াবে না। তোমার নাম যেন কী?

শফিকুল করিম।

এত বড় নাম তো আমার মনে থাকবে না। ছোট নাম আছে? আমাকে শফিক ডাকতে পারেন। শফিক ছাড়া আর কিছু? শফিক ডাকতে পারব না। শফিক নামে আমার একজন কর্মচারী ছিল, বিরাট বদ। শফিক বলে ডাকলে তার কথা মনে পড়বে। আর কোনো নাম?

বাবুল ডাকতে পারেন। আমার বাবা আমাকে বাবুল ডাকেন।

নতুন নামে অভ্যস্ত হতে আমার সময় লাগে। যতদিন অভ্যস্ত না হব ম্যানেজার ডাকব। তোমার কোনো অসুবিধা নেই তো?

না স্যার।

কয়টা বাজে?

দশটা পঁচিশ।

এটা আমার একটা বদভ্যাস সময় জিজ্ঞেস করা। প্রায়ই সময় জিজ্ঞেস করব। তুমি বিরক্ত হয়ো না।

বিরক্ত হব না স্যার।

আকাশ খুব মেঘলা না?

জি স্যার।

ঠিক আছে, এখন যাও। বারান্দায় বসে থাকো। বৃষ্টি নামলে আমাকে খবর দিও। শোবার ঘর থেকে বৃষ্টি হচ্ছে কি হচ্ছে না এটা বোঝা যায় না।

জি আচ্ছা স্যার।

তোমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রেসিপির মূল জায়গাটা মিস করেছি। টিভিতে পিজা রান্না শিখাচ্ছিল। তুমি রান্না-বান্না কিছু জানো?

না।

কোনো দিন রাঁধোনি? ভাত-ডাল-ডিম ভাজি?

জি না।

বলো কী! জীবনে কখনো রাঁধেনি এমন পুরুষ মানুষ পাওয়া তো অসম্ভব ব্যাপার। ছোটখাটো রান্না আমি নিজেও পারি। ডালটা তো খুব ভালো পারি। ডাল রান্নার আসল কৌশল জানো?

না।

সিদ্ধ করা, আর কিছু না। যত সিদ্ধ করবে ভাল ততই ভালো হবে। নরমাল সিদ্ধের চেয়ে প্রেসার কুকারের সিদ্ধ ভালো হয়। সিদ্ধ হয়ে যাবার পরের অংশটার নাম বাগার। হাঁড়িতে কিছু তেল নেবে। সেখানে পেঁয়াজকুচি রসুন-কুচি দিয়ে দেবে। পেঁয়াজ এবং রসুনকুচি যখন ভাজা ভাজা হয়ে যাবে, তখন সিদ্ধ ডাল দিয়ে দেবে। পরিমাণ মতো লবণ দেবে। কাঁচামরিচের গন্ধের জন্যে ফালা-ফালা কয়েকটা কাঁচামরিচ দিতে পার। কেউ কেউ পাঁচফোড়ন দেয়। পাঁচফোড়ন দিলে ভালে হিন্দু হিন্দু গন্ধ হয়ে যায় বলে আমি দেই না। এখন মনে হচ্ছে না ডাল রান্নাটা খুব সহজ?

মনে হচ্ছে স্যার।

এক কাজ করো আগামীকাল তুমি ডাল রান্না করো। দেখি কেমন হয়। মানুষের সব ধরনের ট্রেনিং থাকতে হয়।

জি স্যার।

তোমার নাম বাবুল, তাই না?

জি।

এই দেখ তোমার নাম মনে আছে। তোমার নাম মনে রাখার জন্যে আমি সুন্দর একটা পদ্ধতি বের করেছি। এই পদ্ধতিকে বলে মেথড অব রাইম। মিল পদ্ধতি। মনে মনে তোমার নাম দিয়ে একটা ছড়া বানিয়ে কয়েকবার বলেছি। ছড়াটা মাথায় ঢুকে গেছে। ছড়াটা হচ্ছে—

বাবুল

হাবুল

কাবুল।

এই পদ্ধতিতে তুমি যে কোনো মানুষের নাম মনে রাখতে পারবে। তারিখ মনে রাখার জন্যেও একটা পদ্ধতি আছে। তোমাকে শিখিয়ে দেব। আমার কাছে একটা বইও আছে রিমেমবারিং নেমস অ্যান্ড ডেটস। পুরোটা পড়া হয়নি, কয়েক পাতা পড়েছিলাম। ইদানীং বই পড়ি না। আচ্ছা এখন যাও। অনেক কথা বলে ফেলেছি। বেশি কথা বলার অভ্যাস আগে ছিল না। ইদানীং হয়েছে। আমার বিছানার পাশে দেখ সিগারেটের প্যাকেট আছে, লাইটার আছে। আমাকে দিয়ে চলে যাও। আজ আর বৃষ্টিতে ভিজব না।

তুমি ম্যারিড?

জি স্যার।

বাচ্চা-কাচ্চা আছে?

একটা মেয়ে।

বয়স কত?

তিন বছর।

নাম কী?

নিশো।

নাম তো সুন্দর। নিশো। দাঁড়াও মনে রাখার ব্যবস্থা করি— নিশো, শিশু, যিশু। এই যে মাথায় নামটা ঢুকিয়ে দিলাম আর যাবে না। তোমার মেয়ের জন্যে আমার মাথার ভেতর একটা পার্মানেন্ট জায়গা হয়ে গেল।

শফিকুল করিম তাকিয়ে আছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। বুড়োকে কার্টুনের মতো লাগছে। কথাবার্তাও কার্টুনের মতো। এই কার্টুন বুড়ো কোটি কোটি টাকা বানিয়ে ফেলেছে— এটা বিশ্বাস করা কঠিন। বুড়োর গা দিয়ে আতরের গন্ধ বের হচ্ছে। আতর মেখেছে নাকি? বাড়ির নাম আতর বলেই গায়ে আতর মেখে বসে থাকতে হবে?

মবিনুর রহমান কিছুক্ষণ দুলুনি বন্ধ রেখেছিলেন। আবার শুরু করলেন। তিনি টিভির দিকে চোখ ফেরালেন। পিজা রান্না শেষ হয়ে গেছে। দর্শকরা পিজা খাচ্ছে। দর্শকদের খাওয়া দেখে তার নিজেরও ক্ষিদে লেগে গেল। অথচ কিছুক্ষণ আগেই তিনি দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিয়েছেন। আতপ চালের ভাত, মুরগির ঝোল মাংস, আরেকটা কি যেন আইটেম ছিল তার মনে পড়ছে না। মনে করার চেষ্টা করতে হবে। আজকাল কিছুই মনে থাকছে না। খুব খারাপ লক্ষণ। বিস্মৃতি রোগ। ডাল কি ছিল? অবশ্যই ছিল। ডালের বাইরেও কি যেন ছিল। সবজি জাতীয় কিছু? না-কি আলুর চপ?

বাবুর্চিকে ডেকে জেনে নেয়া যায়। এটা ঠিক হবে না। তাকেই বের করতে হবে।

 

শফিকুল করিম বারান্দায় বসে আছে। তাকে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে সে জানে না। এর মধ্যে যদি বাথরুম পায়, সে কী করবে? এক তলায় যাবে নাকি দোতলাতেও তার মতো কর্মচারীদের জন্যে কিছু ব্যবস্থা আছে? বারান্দায় বসে সিগারেট নিশ্চয়ই খাওয়া যাবে না। পানির পিপাসা হলে কী করবে? দোতলায় কেউ কি আছে যার কাছে পানি চাওয়া যাবে? তার কাজ কি বড় সাহেবের দৃষ্টির আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকা? চাকরি ছেড়ে চলে গেলে কেমন হয়? মীরাকে বলব চাকরিতে জয়েন করার পরপরই বড় সাহেব বললেন, তোমাকে দিয়ে আমার হবে না। তুমি চলে যাও। আমার ম্যানেজারের কাছ থেকে তিনদিনের বেতন নিয়ে যাও। আমি বেতন নেইনি।

মীরা খুবই মন খারাপ করবে তারপরেও কিছুই হয়নি এমন ভাব করে বলবে, তিনদিনের বেতন না নিয়ে ভালো করেছ। তুমি কি ফকির নাকি?

সে বলবে, এখন চলবে কীভাবে?

মীরা বলবে, এত দুশ্চিন্তা করবে না। একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই। তুমি তো মরুভূমিতে বসে নেই। তোমার টিউশনি আছে। কোচিং সেন্টারের পার্ট টাইম চাকরিটাও তো আছে।

দিনে আনি দিনে খাই চলতেই থাকবে?

চলুক। তুমি মুখ কালো করে থাকবে না। তোমার কালো মুখ দেখলে আমার খারাপ লাগে। চা বানিয়ে দিচ্ছি। চা খাও। তারপর চলো নিশোকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাই।

কোথায় বেড়াবে? রিকশা ভাড়া লাগবে না!

রাস্তায় হাঁটব। রাস্তায় হাঁটতে তো আর টাকা লাগবে না।

চলো হাঁটি।

চুপচাপ এক জায়গায় বসে থাকার সুবিধা হচ্ছে, মনে মনে অনেক গল্প তৈরি করা যায়। গল্পকে নানা দিকে নিয়ে যাওয়া যায়। শফিকুল করিম এখন রাস্তায় হাঁটার দৃশ্য কল্পনা করছে। নিশো মাঝখানে, তার দুই হাত বাবা-মাকে ধরে রাখতে হচ্ছে। বাবা-মা দুজনই যেন তার ভালোবাসা সমানভাবে পায় এই বিষয়ে সে খুব হুঁশিয়ার। রিকশায় করে গেলে সে কিছুক্ষণ বসে মার কোলে। কিছুক্ষণ বাবার কোলে। ভালোবাসা ভাগাভাগির ব্যাপারে তার হিসাব পরিষ্কার।

কে একজন দূর থেকে তাকে দেখছে। সাদা প্যান্ট সাদা শার্ট। মাথায় সাদা ক্যাপ। বাবুর্চি নাকি? ইংরেজি কায়দায় শেফ। শেফের পোশাক না পরে রাঁধতে পারে না এমন কেউ? তার এপ্রনের পকেটে কি থার্মোমিটার আছে? ডেগচিতে থার্মোমিটার দিয়ে টেম্পারেচার দেখে নিল। খাতায় নোট রাখল— বড় সাহেবের জন্যে ইলিশ মাছের ঝোল রান্না করা হয়েছে এই তাপমাত্রায়। বাবুর্চির সঙ্গে কথা বলা দরকার। তার সঙ্গেই ডাল রাঁধতে হবে। রান্না কি এই ফাঁকে সেরে নেবে? বাবুর্চির অবসর কখন সেটাও দেখতে হবে। বাবুর্চি যদি বলে বসে— এই পোশাকে তো রান্নাঘরে ঢুকতে পারবেন না। প্রপার ড্রেস লাগবে।

শফিকুল এগিয়ে গেল। বাবুর্চি এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। বাবুর্চি শ্রেণী সব সময় রান্নার হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে বলে মানুষের দিকে চোখ তুলে কম তাকায়। একদৃষ্টিতে তাকায় শুধু শিক্ষক শ্ৰেণী।

স্যার স্নামালিকুম। আমার নাম গনি। আব্দুল গনি।

শফিকুল করিম বলল, কেমন আছ গনি?

স্যার ভালো আছেন? অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে আছেন।

বারান্দাতেই আমার বসে থাকার কথা।

টিভি রুম সেখানে বসতে পারেন। লাইব্রেরি রুম আছে, সেখানেও বসতে পারেন। চা-নাস্তা কিছু লাগলে আমাকে বলবেন।

থ্যাংক ইউ।

গনি নামের বাবুর্চিকে ভালো লাগছে। নম্র ভঙ্গিতে কথা বলছে, বাড়ি মনে হয় যশোরের দিকে। ভাষা শুদ্ধ।

আব্দুল গনি।

জি স্যার।

বড় সাহেব আমাকে ডাল রান্না করতে বলেছেন। উনি রেসিপি দিয়ে দিয়েছেন।

আপনাকে কিছুই রান্না করতে হবে না। বড় স্যার কোনো কিছু মনে রাখতে পারেন না। আপনাকে একটা কথা বলে পাঁচ মিনিট পরেই ভুলে যাবেন।

তাই নাকি?

জি।

এত বড় বাড়িতে উনি একা থাকেন?

উনার সঙ্গে আমরা আছি। উনি একা। এতিমখানায় বড় হয়েছেন। বাবা-মা কে তাও জানেন না। টাকার পাহাড়ের ওপর বসে আছেন। খরচ কে করবে তার নাই ঠিক। চা বানিয়ে দেই খান?

দাও।

আপনার মনে হয় সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। লাইব্রেরি ঘরে বসে খান। স্যার লাইব্রেরি ঘরে কখনো আসেন না। উনি দিন-রাত নিজের ঘরেই থাকেন, মাঝে মধ্যে বারান্দায় এসে বসেন।

তুমি সাহেবের সঙ্গে কত দিন আছি?

প্রায় দশ বছর।

উনি মানুষ কেমন?

বড় মানুষদের যেসব আজেবাজে সমস্যা থাকে, তার এসব কিছুই নাই। অন্তত আমি দেখি নাই। মদ না, মেয়ে মানুষ না। ভালো-মন্দ খেতেও পছন্দ করেন না। খামখাই টাকা রোজগার করলেন। আপনাকে মনে হয় স্যার ডাকছেন। শুনে আসুন।

শফিকুল করিম অবাক হয়ে বলল, আমাকে কখন ডাকলেন? আমি তো কিছু শুনিনি।

আমি শুনেছি। আমার কান পরিষ্কার।

 

দরজা ঠেলে বড় সাহেবের ঘরে ঢুকল। বুড়ো এখনো আগের জায়গাতেই আছে। টিভি চলছে। তবে বুড়োর চোখ বন্ধ।

বাবুল।

জি স্যার?

কয়টা বাজে?

সাড়ে এগারোটা।

তার মানে তুমি প্রায় এক ঘণ্টা বারান্দায় বসেছিলে?

জি স্যার।

একজন যে কানে ধরে উঠবোস করছে এই দৃশ্য কি বারান্দা থেকে দেখা যায়?

স্যার আমি লক্ষ্য করিনি।

দেখা যাওয়ার কথা। এরা ঘটনাটা এমন জায়গায় করবে যেন আমি দোতলা থেকে দেখতে পারি।

শফিকুল করিম কিছু বলল না। কী বলবে সে? কী বললে বুড়ো খুশি হবে? চাকরি বজায় রাখতে হলে বুড়োকে খুশি রাখতে হবে। মাসে বার হাজার টাকা বিরাট ব্যাপার। কিস্তিতে সে ফ্রিজ কিনতে পারে। ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি নিশোর খুবই শখের ব্যাপার। তার চেয়েও বড় ব্যাপার বুড়ো বাবাকে সঙ্গে এনে রাখা। যে বাবা তাকে বাবুল নামে ডাকেন। মাঝে মাঝে শুধুই বাবু। ল বাদ পড়ে যায়। বাবা তাকে যে নামে ডাকেন, এই কার্টুন বুড়ো তাকে সেই নামে ডাকছে। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে! কার্টুনটাকে এই নাম বলা ঠিক হয়নি। বললেই হতো তার নাম শামসু বা ফজলু।

বাবুল!

জি স্যার।

দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোসো, তোমার সঙ্গে কথা বলি।

এই ঘরে দ্বিতীয় কোনো চেয়ার নেই। বসতে হলে মেঝেতে বসতে হবে। এটা বোধহয় নিয়ম। বড় সাহেব সিংহাসনে বসে থাকবেন। সভাসদরা মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসবে।

পঞ্চাশ হাজার বার কানে ধরে উঠবোসের শাস্তিটা তোমার কাছে কেমন লাগছে?

অন্য রকম লাগছে স্যার।

শাস্তির এই পদ্ধতি আমি শিখেছি বাবুপুরা এতিমখানায়। এতিমখানার প্রিন্সিপাল ছিলেন মুনশি ইদরিস। তিনি সব সময় গায়ে আতর মাখতেন। আতরের নাম মেশকে আম্বর। আমিও মাঝে মাঝে মাখি। কেউ কোনো অপরাধ করলেই মুনশি ইদরিস তাকে পশ্চিম দিকে ফিরে কানে ধরে উঠবোস করতে বলতেন। শান্তির মাত্রার ওপর কানে ধরে উঠবোসের সংখ্যা নির্ভর করত। এতিমখানার বাবুর্চিকে তিনি পঞ্চাশ হাজার বার কানে ধরে উঠবসের শাস্তি দিয়েছিলেন। সে চেষ্টা করেছিল। সাত হাজার বার পর্যন্ত করেছিল। ইন্টারেস্টিং না?

জি স্যার।

বাবুর্চি কি অপরাধ করেছিল জানতে চাইলে না?

শফিকুল করিম চুপ করে রইল। তার মনে হচ্ছে সে একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছে। বাবুর্চি কী করেছিল জানতে চাওয়া প্রয়োজন ছিল। বুড়ো গল্প করতে চাইছে। তাকে গল্প চালিয়ে যেতে হলে শ্রোতার কাছ থেকে কিছু শুনতে হবে। তার কাজ কী? বুড়োর গল্প শোনা?

বাবুল।

জি স্যার।

ঠিক আছে তুমি বারান্দায় থাকে। প্রয়োজন হলে তোমাকে ডাকব।

জি আচ্ছা।

শুধু যদি ঝুম বৃষ্টি নামে আমাকে খবর দেবে। পিট পিট বৃষ্টি হলে খবর দিতে হবে না।

জি আচ্ছা।

তোমার ডিউটি সকাল আটটা থেকে রাত আটটা। অসুবিধা আছে?

জি না। স্যার আমার কাজটা কি যদি বলেন।

বারান্দায় বসে থাকবে। বসে থাকাও কাজ। বেশ কঠিন কাজ। তবে তোমাকে আমি কাজ দেব। বিনা কাজে বেতন দেয়া আমার স্বভাব না। কাজটা তুমি পারবে কি পারবে না সেটা দেখারও ব্যাপার আছে। আমি তোমাকে পরীক্ষা করছি। ঠিক আছে তুমি এখন যাও।

শফিকুল করিম বারান্দায় বসে রইল। বড় সাহেব এর মধ্যে তাকে ডাকলেন। দুপুরে নিচে গেল খাবারের জন্যে। খেতে পারল না। দুকাপ চা তিনটা সিগারেট টেনে আবারও বারান্দায় এসে বসে থাকল। বড় সাহেব তার পরীক্ষা নিচ্ছেন। এটা কী রকম পরীক্ষা? সে বারান্দায় বসে আছে। পরীক্ষক ঘরে বসে টিভি দেখছেন। রাত সাড়ে আটটায় বাবুর্চি গনি এসে বলল, এখন চলে যান। স্যার চলে যেতে বলেছেন।

 

শফিক বাসায় ফিরল একটা ইলিশ মাছ নিয়ে। রাত নটার পর নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে হঠাৎ হঠাৎ মাছ খুব সস্তা হয়ে যায়। শফিকের হাতের মাঝারি সাইজের ইলিশটার দাম নিয়েছে মাত্র একশ টাকা। মাছটার পেটে ডিম আছে। খেতে তেমন স্বাদ হবে না। তবে ইলিশ মাছের ডিম মীরার অতি পছন্দের খাবার। কোনো এক বিচিত্র কারণে মেয়েরা পুরুষদের মতো খাদ্য-রসিক হয় না। মীরাও হয়নি শুধু ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল হলে ভিন্ন কথা। এই সময় তার চোখ চকচক করে। মীরার কথা মনে করেই শফিককে সব সময় ডিমওয়ালা ইলিশ কিনতে হয়।

শফিকের হাত একেবারেই খালি। এই অবস্থায় একশ টাকা হুট করে খরচ করা যায় না। যে চাকরি শুরু করেছে তার ওপর ভরসাও করা যাচ্ছে না। বড় সাহেব তাকে পরীক্ষা করছেন। পরীক্ষায় পাস করতে হবে। পাশ করা যাবে কিনা তা সে জানে না। তারপরও মাছটা কিনে তার ভালো লাগছে। মাছ দেখে মীরা খুশি হবে। বাসায় অনেক দিন মাছ-মাংস যাচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিনের মেনু আলুভাজি, ডাল-ভাত। মাঝে মধ্যে নিশোর জন্যে একটা ডিম-ভাজি। গত পরশু নিশোর ডিম-ভাজির একটা অংশ মীরা শফিকের পাতে তুলে দিয়ে ভালো সমস্যা বাধিয়ে ছিল। শফিক খাওয়া বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে কঠিন গলায় বলল, এটা কেন করলে?

মীরা বলল, কী করলাম?

নিশোর ডিমের অর্ধেকটা আমার পাতে তুলে দিলে কেন?

তুমি খাবে এই জন্যে তুলে দিয়েছি। এমন তো না যে তুমি ডিম খাও না।

শফিক গভীর গলায় বলল, মীরা শোনো, তুমি এই কাজটা করেছ আমাকে অপমান করার জন্যে। আমাকে তুমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছ যে, আমি অপদার্থ শ্রেণীর একজন মানুষ। যে স্ত্রী-কন্যার জন্যে সামান্য খাবারও জোগাড় করতে পারে না।

মীরা বলল, শুধু শুধু চিৎকার করে না তো!

নিশোর স্বভাব হলো, মায়ের প্রতিটি কথা তার নকল করতে হবে। নিশো তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা শুধু শুধু চিক্কার করবে না।

মীরা বলল, শান্ত হয়ে ভাত খাও।

নিশো বলল, বাবা খুব শান্ত হয়ে ভাত খাও।

শফিক শান্ত হয়েই খাওয়া শেষ করল, একবার শুধু বলল, মীরা শোনো মেয়েরা সবচে আনন্দ কখন পায় জানো? সবচে আনন্দ পায় স্বামীকে অপমান করে। মেয়েদের কাছে এই আনন্দ Sexual প্লেজারের কাছাকাছি।

মীরা বলল, তথ্যটা জানা ছিল না। এখন জানলাম।

নিশো বলল, বাবা! মা এখন জেনেছে।

 

শফিক বাড়ির দরজায় ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি যেন অপেক্ষা করছিল। শফিক দরজায় ধাক্কা দিল সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাত হলো। একই সঙ্গে বৃষ্টি। হুড়মুড় টাইপ বৃষ্টি।

দরজা খুলে মীরা প্রথম কথা যেটা বলল সেটা হচ্ছে, এই তুমি তো গোসল করবে। বাথরুমে এক ফোঁটা পানি নেই। বৃষ্টিতে গোসল করে ফেল। করবে?

শফিক বলল, হুঁ।

মীরা বলল, তাহলে তাড়াতাড়ি করো। ঝুম বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকবে না।

নিশো ঘুমুচ্ছে।

হুঁ। তোমার জন্যে অনেকক্ষণ জেগেছিল। কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়েছে। ডেকে তুলব?

না।

মাছ কীভাবে রান্না করব? ভাজি করব না তরকারি?

দুটাই করো।

তরকারি কী দেব? ঘরে কচুমুখি আছে। মুখি তো আবার তুমি পছন্দ করো না।

পছন্দ করি না তা না, গলায় ধরে।

কোনো তরকারি না হয় না দিলাম। শুধু ঝোল থাক।

থাক।

শফিকের বাসায় বৃষ্টির পানিতে গোসলের ভালো ব্যবস্থা আছে। বারান্দার দক্ষিণ অংশে ছাদ থেকে গড়িয়ে আসা বৃষ্টি বড় ধারায় নেমে আসে। বাবুল গোসলে নেমেছে। গোসলের ফাঁকে ফাঁকে বাথরুমের প্লাস্টিকের বালতিগুলো পানিতে ভরে রাখছে। কাল সকালে মীরাকে পানি ভরতে হবে না।

মীরা মাছ কুটতে বারান্দায় এসেছে। মাছ কোটার চেয়ে সে বেশি আগ্রহ বোধ করছে স্বামীর সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে। মাছ এবং বঁটি নিয়ে সে বারান্দায় চলে এসেছে, সে বারান্দায় বসে মাছ কুটবে, স্বামীর সঙ্গে গল্প করবে। একটা ছোট্ট সমস্যা, বারান্দায় আলো নেই বললেই হয়। তবে ইলিশ মাছ কুটতে আলো লাগে না। মীরা বলল, পানি ঠাণ্ডা?

শফিক বলল, বরফ গলা পানি। দেখ না ঠাণ্ডায় কাঁপছি।

উঠে পড়ো।

ঠাণ্ডা খারাপ লাগছে না।

আজ তো প্রথম চাকরি করলে। বস কেমন?

ইঁদুর টাইপ।

মীরা অবাক হয়ে বলল, ইদুর টাইপ মানে?

ব্যাটাকে দেখে মনে হয় একটা সাদা ইঁদুর। লুঙ্গি-ফতুয়া পরে মাথায় ক্যাপ দিয়ে চেয়ারে বসে দুলছে। শালা বুড়া ভাম।

গালাগালি করছ কেন?

বকরবকর বকরবকর করেই যাচ্ছে। গা থেকে বের হচ্ছে বোটকা আতরের গন্ধ। একটা থাপ্পড় দিতে পারলে…

এ রকম করে কথা বলবে না। প্লিজ। তোমার মুনিব অন্নদাতা।

হেন বিষয় নাই যে সে কথা বলবে না।

একা থাকে, কথা বলার লোক নেই। তোমার কাজটা কী?

জানি না কাজ কি।

আজ সারাদিন কী করলে?

কিছুই করিনি। দোতলার বারান্দায় বসেছিলাম। মাঝে মধ্যে ডেকে জিজ্ঞেস করে, কয়টা বাজে? আরে ইঁদুর তোর হাতে ঘড়ি আছে না? তুই ঘড়িতে দেখ কয়টা বাজে।

একজন বয়স্ক মানুষ, তুই-তোকারি করছ কেন?

মাথারও মনে হয় ঠিক নাই। উল্টাপাল্টা কথা—আমার নাম মনে থাকে না এই জন্যে নাম দিয়ে ছড়া বানিয়েছে।

কী ছড়া?

বাবুল, হাবুল, কাবুল।

মীরা হাসতে হাসতে বলল, বানিয়ে বানিয়ে এইসব কী বলছ?

একটা কথাও বানানো না। বাবুল হাবুল কাবুল। ছড়াকার এসেছে?

মীরা হাসছে। হাসি বন্ধ করার চেষ্টা করছে। পারছে না। শফিক স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মুগ্ধ হয়ে গেল। মীরাকে মাঝে মাঝে খুবই সুন্দর লাগে। আজ লাগছে। আপন মনে হাসছে বলেই কি সুন্দর লাগছে? শফিক বলল, বুড়োর মুখটা ছোট কিন্তু বিশাল এক গোঁফ রেখে বসে আছে। মেথরদের মতো গোফ।

মীরা বলল, ওনার এত সমালোচনা করার দরকার নেই, তুমি উঠে পড়ো। ঠাণ্ডা লাগবে।

গায়ে সাবান দেব। সাবান এনে দাও। ঘরে সাবান আছে না?

আছে।

মীরা সাবান এনে দিল। বাবুলের সাবান মাখা হলো না। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। পানির ধারা স্রোত নেই। এখন টিপটিপ করে পানি পড়ছে। মীরা বলল, সাবান মাখতে চাইলে মাখ, বালতিতে পানি আছে তো?

শফিক বলল, পানি নষ্ট করব না। থাক।

মীরা বলল, তোমার বেতন কত ঠিক হয়েছে?

বেতন খারাপ না।

খারাপ নাটা কত বলল শুনি।

টুয়েলভ।

টুয়েলভ মানে কি বার হাজার? সত্যি?

ক্যাশিয়ার তো তাই বলল। আবার একটা মোবাইল টেলিফোনও নাকি দেবে। যাতে মোবাইলে যোগাযোগ থাকে। আমার লাইফ হেল করার বুদ্ধি। রাত তিনটার সময় টেলিফোন করে বলবে, বাবুল হাবুল কাবুল– কয়টা বাজে?

তুমি দেখি ওনাকে একেবারেই পছন্দ করছ না।

পছন্দটা করব কেন? আমার ইংরেজি সাহিত্যে একটা এমএ ডিগ্রি আছে। আমার চাকরিটা কী? একটা পয়সাওয়ালা ইঁদুরের প্রতিটি কথায় ইয়েস স্যার বলা। এই চাকরি তো আমি অবশ্যই করব না। চাকরি মানে তো শুধু টাকা না। এক ধরনের ফুলফিলমেন্ট থাকতে হবে। পারপাস থাকতে হবে। জব স্যাটিসফেকশন থাকতে হবে।

এ রকম চাকরি তো অনেক দিন ধরেই খুঁজলে, কিছু তো পাওনি।

তার মানে তো এই না যে কোনো দিনও পাব না।

যেদিন পাবে সেদিন এই চাকরি ছেড়ে দেবে।

অবশ্যই ছেড়ে দেব এবং ইঁদুরটার গায়ে এক বোতল পানি ঢেলে চলে আসব। আমি ঠাট্টা করছি না। ঐ কার্টুনের গায়ে আমি সত্যি পানি ঢালব।

মীরা বলল, কেন শুধু শুধু গালাগালি করছ। ঐ প্রসঙ্গটা বাদ দাও না।

শফিক বলল, তোমার রান্না সারতে মনে হয় দেরি হবে। আমাকে এক কাপ চা দিও। শরীর ঠাণ্ডা মেরে গেছে। চা-টা যেন কড়া হয়। তুমি পাতলা চা বানাও, খেতে ভাল লাগে না।

মীরা বলল, এখন চা খাওয়ার দরকার নেই। ক্ষিদে নষ্ট হবে। তুমি ঘড়ি ধরে বসে থাকো, আমি ঠিক কুড়ি মিনিটের মাথায় খাবার দেব।

শফিক বলল, চা দিতে বলেছি চা দাও। আমার ক্ষিদা নষ্ট হবে কি হবে না এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

মীরা বলল, মেজাজ খারাপ কেন?

শফিক বলল, মেজাজ ঠিক আছে। তুমিও দেখি বুড়োর মতো বেশি বেশি কথা বলছ। এত কথা বললে রান্নাটা করবে কখন?

 

শফিক খুবই তৃপ্তি করে খাচ্ছে। এত দ্রুত খাচ্ছে যে মীরার ভয় ভয় করছে। ভাত কম পড়ে যাবে না তো? এখন সে যদি বলে, আরেক চামচ ভাত দাও— ঝোল দিয়ে খাব। তাহলে মীরা ভালো বিপদে পড়বে। হাঁড়িতে কোনো ভাত নেই। তার নিজের প্রেষ্টে আছে। শফিক যে মানুষ মীরা যদি নিজের প্লেট থেকে ভাত তুলে দেয় সে খাবে না।

মীরা বলল, মাছটা ফ্রেশ ছিল।

শফিক বলল, রান্না খুব ভাল হয়েছে। তুমি একদিন আমাকে ইলিশ মাছ রান্না শিখিয়ে দিও।

তুমি রান্না শিখে কী করবে?

বুড়ো যে কোনো একদিন বলে বসতে পারে— বাবুল হাবুল কাবুল ইলিশ মাহু রান্না করো।

উনি খামখা তোমাকে ইলিশ মাছ রান্না করতে বলবেন কেন? তুমি দেখি ভদ্রলোককে মাথা থেকে দূরই করতে পারছ না। ওনাকে মাথা থেকে অফ করো তো।

শফিক বলল, আচ্ছা যাও অফ করলাম। নিশো খেয়েছে?

এক গাদা লিচু খেয়েছে। পেটে ক্ষিদা নেই।

লিচু? লিচু এলো কোত্থেকে?

মঞ্জু মামা এনেছিলেন। রাজশাহীর লিচু। তুমি খাবে? এনে দেই?

না।

খাও না। খুব মিষ্টি। পোকা নেই। তুমি তো এই সিজনে লিচু খাওনি।

বললাম তো খাব না।

তুমি না খেলে নাই। আমি খাব। এই শোনো আমি আর পাতের ভাত খেতে পারছি না ভাত নষ্ট হবে। তোমার প্লেটে তুলে দেই?

শফিক কথা না বলে প্লেটেই হাত ধুয়ে ফেলল। বোঝাই যাচ্ছে সে খুব রেগেছে। রাগের কারণ মীরা খানিকটা ধরতে পারছে।

মীরা বলল, পান খাবে? পান দেই?

পান কোথায় পেয়েছ?

মঞ্জু মামা পান খেতে চাইলেন। দোকান থেকে কয়েক খিলি পান আনাতে বললেন। তোমার জন্যে দুই খিলি রেখে দিয়েছি। তুমি তো মাঝে মধ্যে পান খাও।

শফিক সিগারেট ধরাল। সে কঠিন চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা বলল, এ রকম করে তাকিয়ে আছ কেন?

শফিক বলল, তুমি খাওয়া শেষ করো, তোমাকে একটা কথা বলব।

আমার খাওয়া শেষ। কি বলতে চাও বলো।

শফিক থমথমে গলায় বলল, তোমাকে আগেও বলেছি এখনো বলছি, মঞ্জু নামের এই লোকটি যেন বাসায় না আসে।

ওনাকে আমি মামা ডাকি।

মামা, আংকেল এইসব আমাকে শিখাবে না।

মীরা বলল, উনি যদি বেড়াতে আর্সেন আমি কী বলব? বলব বাসা থেকে বের হয়ে যান?

হ্যাঁ বলবে।

মীরা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অতি তুচ্ছ জিনিসকে বড় করার তোমার অস্বাভাবিক এক ক্ষমতা আছে। তুমি লেখক হলে ভালো হতো। তিলকে তাল করতে পারতে। মুখ ভেঁতা করে রাখবে না। পান খাও।

শফিক পান মুখে দিল। মীরা বলল, আমি কি মঞ্জু মামার আনা লিচুর কয়েকটা খেতে পারি? না-কি তাও খাওয়া যাবে না! অনুমতি দিলে খেতে পারি।

খাও।

আরেকটা কথা, আজ রাতে তোমার কি আর কিছু লাগবে? লাগলে এখনি বলো। বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। তারপর ডেকে তুলবে, এর চেয়ে আগেই ফয়সালা হয়ে যাওয়া ভালো। লাগবে কিছু?

হুঁ।

সাজতে হবে? না-কি যেমন আছি তেমন থাকলেই হবে? তোমার মধ্যে এই এক অদ্ভুত জিনিস দেখলাম— বিশেষ প্রয়োজনের আগে সাজতে হবে। বাতি তো থাকে নেভানো। তুমি তো আর সাজটা দেখছ না।

সব মানুষ তো এক রকম না। একজন মানুষ একেক রকম।

তা ঠিক।

শফিক দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরতে ধরাতে বলল, তোমার কথাবার্তায় গণ্ডগোল আছে। তুমি কী করে বললে, তোমার মধ্যে এই এক অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। তুমি তো একমাত্র আমাকেই দেখেছ। অন্য কারো সঙ্গে নিশ্চয়ই বিছানায় যাওনি।

আমি একটা কথার কথা বলেছি।

এরকম কথা কথা দয়া করে আমাকে বলবে না। তোমার মঞ্জু মামাকে বলতে পারো। আমাকে না।

মঞ্জু মামার কথা এখানে এলো কী জন্যে?

আমি এনেছি তাই এসেছে।

 

মীরা ঘরের কাজ শেষ করে সাজতে বসল। সিল্কের শাড়ি পরল। ঠোঁটে লিপস্টিক দিল। চোখে কাজল দিল। সে আয়নায় নিজেকে দেখছে। কী সুন্দর মায়া মায়া একটা মুখ! এ রকম মায়া মায়া চেহারার একজন তরুণীর সঙ্গে তার স্বামী খারাপ ব্যবহার কী করে করে তা মীরা বুঝতে পারছে না। তার মন খারাপ লাগছে।

শফিক খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। নিশো তার গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে ঘুমুচ্ছে। তবে তার ঘুমের ব্যাপারে কখনোই নিশ্চিত হওয়া যায় না। এই মেয়ে মাঝে মাঝে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। খুব অস্বস্তিকর সময়ে হঠাৎ উঠে বসে হতভম্ব গলায় বলে, বাবা তোমরা এসব কী করছ? তাদের একটা শোবার ঘর।

দুটা ঘর থাকলে ভাল হতো। একটা ঘরে থাকতে নিশো। নিশো তখন একা ঘুমাতো না। নিশোর সঙ্গে থাকতেন তার দাদু।

চাকরিটা যদি সত্যি সত্যি পার্মানেন্ট হয়ে যায়, তাহলে সে অবশ্যই দুই শোবার ঘরওয়ালা একটা বাসা ভাড়া করবে। বাবা-মা দুজনকেই এনে সঙ্গে রাখবে।

চায়ের কাপ হাতে মীরা ঘরে ঢুকেই বলল, তোমার মেয়ে কী ঘুমুচ্ছে?

শফিক বলল, হ্যাঁ।

আমার কিন্তু মনে হচ্ছে না। চোখ পিটপিট করছে।

শফিক কিছু বলল না, চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, চা-টা ভালো হয়েছে।

মীরা বলল, আমার সাজ কী তোমার পছন্দ হয়েছে?

হুঁ।

প্রথম যেদিন বেতন পাবে আমাকে সাজের কিছু জিনিস কিনে দিও। আমি আরো সুন্দর করে সাজব।

আচ্ছা দেব।

বাসাটা বদলাবে না?

বদলাবো। বাবা-মাকে সঙ্গে এনে রাখব।

আমি কি বাসা খোঁজা শুরু করব?

তুমি কোথায় খুঁজবে?

নিশোকে স্কুলে দিয়ে আমরা সব গার্জেনরা বাইরে বসে গল্প-গুজব করি। তাদের মাধ্যমে অনেক খবর পাওয়া যায়। তুমি যদি বলো আমি কাল থেকেই বাসা খোজা শুরু করব।

তাড়াহুড়া করার কিছু নেই। চাকরি টিকবে কিনা এখনো জানি না। বুড়ো বলল, সে আমাকে পরীক্ষা করে দেখছে। পরীক্ষায় পাস করতে পারলেই চাকরি টিকবে।

কী পরীক্ষা?

জানি না কি পরীক্ষা। মুমুতে আস, বাতি নেভাও।

মীরা সুইচ বোর্ডে হাত দেবার আগেই নিশো বলল, মা এখন নেভাবে না। আমি ঘুমাইনি।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ