রাতে লিলি মরার মতো ঘুমিয়েছে একবার শুধু ঘুম ভেঙেছে, তখন দেখে মা তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন। সে ঘুমঘুম গলায় ডাকল, মা! ফরিদা তৎক্ষণাৎ বললেন, কি গো মা।

কিছু না ঘুমাও। বলেই লিলি ঘুমিয়ে পড়ল। সেই ঘুম ভাঙল সকাল দশটায়। ঘরের ভেতর আলো, বিছানায় চনমনে রোদ। ঘুম ভাঙার পরেও অনেকক্ষণ সে বিছানায় শুয়ে রইল। এক ফাঁকে ঝুমু এসে উঁকি দিল। ঝুমুর ঠোঁটের ফোলা কমেনি–আরও মন হয় বেড়েছে। তার মুখ লালচে হয়ে আছে। কাল রাতে লিলি এটা লক্ষ করে নি।

তোর ঠোঁটের অবস্থা তো খুব খারাপ।

হুঁ।

ব্যথা করছে না?

করছে।

ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার তো।

ঝুমু সহজ গলায় বলল, বড় চাচা হোমিওপ্যাথি করতে বলেছেন। সামছুদ্দিন চাচা ওষুধ দিয়েছেন।

ইনজেকশন দেয়ার কথা যে ছিল দেয়া হচ্ছে না?

না। হোমিওপ্যাথি কাজ না করলে তখন দেয়া হবে।

এর মধ্যেই তো মনে হয় গ্যাংগ্রিন ফ্যাংগ্রিন হয়ে তুই মরে যাবি।

হুঁ।

লিলি বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা শরীরে নিয়ে সে কত স্বাভাবিকই না আছে। ঝুমু বলল, আপা তুমি চা খাবে? তোমার জন্য চা নিয়ে আসি?”

হাত-মুখ ধুইনি তো এখনও।

তুমি হাত-মুখ ধোও আমি চা নিয়ে আসছি।

হাত-মুখ ধুতে যাবার কোনো ইচ্ছা করছে না। বিছানায় শুয়ে আরও খানিকক্ষণ গড়াগড়ি করতে ইচ্ছা করছে। বারান্দা থেকে বাধার গলা শোনা যাচ্ছে খবরের কাগজ কোথায়? এখনও দেয় নাই? হারামজাদা হকারকে আমি খুন করে ফেলব।

বাবা আজ তাহলে অফিসে যান নি। লিলির সঙ্গে তাঁর এখনও দেখা হয় নি। লিলি জানে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ডাক পড়বে। কাল সারাদিন কোথায় ছিল, এত রাতে কোত্থেকে এসেছে, কে তাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে, অন্য একটা শাড়ি পরে সে বাসায় ফিরেছে, শাড়িটা কার? প্রশ্নের পর প্রশ্ন করা হবে।

লিলি ঠিক করেছে সব প্রশ্নের জবাব সে দেবে। শান্ত ভঙ্গিতেই দেবে। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে সে কথা বলতে পারে না। আজ বলবে।

বাবার সঙ্গে কথা বলার পর সে যাবে বড় চাচার ঘরে। বড় চাচাকে বলবে, ঝুমুর ঠোঁটের এই অবস্থা আর আপনি তাকে হোমিওপ্যাথি করাচ্ছেন। তাকে এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। ভালো কোনো ডাক্তার। বড় চাচা যদি বলেন, ডান দিকের জানালার পাল্লাটা একটু টেনে দে। তখন সে বলবে, চাচা পাল্লাটা তো আপনার হাতের কাছেই। আপনি নিজেই একটু টেনে নিন।

তারপর সে নিচে নামবে। রুমু ঝুমুর স্যার যদি ইতিমধ্যেই এসে থাকেন তাহলে তাকে বলবে, এই যে ভদ্রলোক শুনুন, সবার সামনে বিশ্রী ভঙ্গিতে নাকের লোম ছিঁড়বেন না। আবার কখনও যদি আপনাকে এই কাজ করতে দেখি তাহলে আপনার নাক আমি কেটে ফেলব।

ঝুমু চা নিয়ে এসেছে। লিলি বাসি মুখেই চায়ে চুমুক দিচ্ছে। চা-টা খেতে ভালো লাগছে। ঝুমু পাশে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে চা খাওয়া দেখছে। লিলি বলল, কিছু বলবি ঝুমু?

না।

কাল ফিরতে দেরি করায় তোরা খুব চিন্তা করছিলি?

আমি আর রুমু বাদে সবাই চিন্তা করছিল।

তোরা চিন্তা করিস নি?

না। তুমি যদি রাতে না ফিরতে তাহলে আজ সকালে আমি আর রুমু পালিয়ে যেতাম।

কোথায়?

ঝুমু কিছু বলল না, হাসতে লাগল। লিলি শঙ্কিত গলায় আবার বলল, কোথায় পালাতি?

ঝুমু হাসছে। মাটির দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে অনেক কথা বলে ফেলেছে। আর বোধহয় কিছু বলবে না। লিলিকে অবাক করে দিয়ে ঝুমু আবারও কথা বলল, তবে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ।

মা কাল তোমার জন্য খুব মার খেয়েছে।

মা মার খেয়েছে?”

মা তোমাকে বাঁচাবার জন্য বলেছিল সেই তোমাকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে বলেছে বলে তুমি গেছ। আর তাতেই বাবার মাথায় আগুন ধরে গেল। কিল চড় ঘুসি–ভয়ঙ্কর ব্যাপার! তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না।

তোরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলি?

হুঁ।

মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলি না?

না।

আশ্চর্য, তোরা চুপ করে দেখলি?

ঝুমু আবার হাসল।

লিলি তীব্র গলায় বলল, তুই হাসছিস?”

ঝুমু বলল, তখন একটা মজার কাণ্ড হলো, আমাদের মতির মা বুয়া মাছ কাটার বঁটি হাতে নিয়ে ছুটে গেল। চিৎকার করে বলল, আম্মারে ছাড়েন। না ছাড়লে বঁটি দিয়া কল্লা নামাইয়া ফেলমু। তখন বাবা মাকে ছেড়ে দিল।

অনেক কাণ্ড তাহলে হয়েছে?

হুঁ। আরও অনেক কাণ্ড হবে।

কী হবে?

তোমার বিয়ে হবে। এক সপ্তাহের মধ্যে হবে। বাবা আর বড় চাচা মিলে ঠিক করেছে।

কার সঙ্গে হবে?

সেটা পুরোপুরি ঠিক হয় নি। বাবার এক বন্ধুর ছেলে আছে। পুরনো ঢাকায় মোটর পার্টসের দোকান। আজ সন্ধ্যাবেলা সে আসবে। বড় চাচা তার ইন্টারভ্যু নেবেন।

লিলি বিস্ময় নিয়ে ঝুমুর কথা শুনছে। কথার বিষয়বস্তুর চেয়েও ঝুমুর কথা বলার উৎসাহ দেখেই সে বেশি অবাক হচ্ছে। লিলি বলল, তুই হঠাৎ এত কথা বলা শুরু করলি ব্যাপারটা কী? তুই একাই কথা বলা শুরু করেছিস না রুমুও শুরু করেছে?

ঝুমু আবারও হাসল।

লিলি বলল, রুমু কোথায়?

 স্যারের কাছে পড়ছে। আপা তোমার চা খাওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ।

তাহলে চলো, বাবা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তোমার সঙ্গে কথা বলার। জন্য বাবা আজ অফিসে যান নি।

আচ্ছা তুই যা আমি আসছি।

লিলি দাঁত মাজল, হাত-মুখ ধুল, চুল আঁচড়াল। কি মনে করে শাড়িও পাল্টাল। তার ঘর থেকে বাবার ঘরে যেতে হলে বড় চাচার ঘরের সামনে দিয়ে যেতে হয়। এই প্রথম বড় চাচার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় তিনি বললেন না–কে যায়, লিলি না? একটু শুনে যা তো।

নেয়ামত সাহেব খবরের কাগজ নামিয়ে রাখলেন, চশমা ভঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে বললেন, বোস। লিলি বসল এবং বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, চোখ নামিয়ে নিল না! নেয়ামত সাহেব সিগারেট ধরালেন। 

তুই কাল কোথায় গিয়েছিলি?

ইউনিভার্সিটিতে।

তারপর কোথায় গিয়েছিলি?

একটা বাসায় গিয়েছিলাম। কলাবাগানে।

তোর কোন বান্ধবীর বাড়িতে?

না।

তাহলে কার বাড়িতে?

হাসনাত সাহেব নামে একজন ভদ্রলোকের বাড়িতে।

উনি কী করেন?

উনি একজন পেইন্টার। ছবি আঁকেন।

ঐ বাড়িতে আর কে কে থাকে?

উনি একাই থাকেন। মাঝে মাঝে তার মেয়ে এসে থাকে।

তাঁর স্ত্রী কোথায়?

বোধহয় মারা গেছেন।

বোধহয় বলছিস কেন?

উনার মেয়েটা বলছিল মারা গেছেন। আমার তা মনে হয় নি। আমার মনে হয়েছে ভদ্রলোক ডিভোর্সড়!

তুই কি প্রায়ই ঐ বাড়িতে যাস?

আগে একবার গিয়েছিলাম।

তোর মা বলছিল অন্য কার একটা শাড়ি পরে তুই ফিরেছিস।

বৃষ্টিতে শাড়ি ভিজে গিয়েছিল সে জন্য বদলেছি।

নেয়ামত সাহেব চুপ করে আছেন। লিলি অবাক হয়ে লক্ষ করল বাবা এখন আর তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছেন না। চোখ নামিয়ে নিচ্ছেন। তাঁর হাতের সিগারেট অনেক আগেই নিভে গেছে। তিনি নেভা সিগারেটেই টান দিচ্ছেন। লিলি বলল, বাবা সিগারেট নিভে গেছে।

নেয়ামত সাহেব লিলির এই কথাতেও চমকালেন। সিগারেট ধরালেন না। নেভা সিগারেটে আবার টান দিলেন। লিলি বলল, বাবা আমি যাই।

নেয়ামত সাহেব হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। লিলি বাবার সামনে থেকে উঠে এলো। তিনি অদ্ভুত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

লিলির খিদে পেয়েছে। নাশতার জন্য নিচে নামতে তার ইচ্ছা করছে না। সে ছাদে উঠে গেল। ছোট চাচার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। সহজভাবে কিছুক্ষণ কথা বলবে। হাসি-তামাশা করবে।

জাহেদুর রহমান জুতা পলিশ করছিল। সে লিলির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, তোর জন্য কাল আমার যে যন্ত্রণা হয়েছে। রাত দুপুরে খাসি কিনতে গেছি আমিনবাজার। ঠেলে ঠুলে দুটিকে বেবিট্যাক্সিতে তুললাম। এরা সারাপথ কী চিৎকার যে করেছে! ভাবটা এ-রকম যেন আমি এদের চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি। পিঠে আদর করি, গলা চুলকে দেই–কিছুতেই কিছু হয় না, ভ্যা ভ্যা। সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে পুলিশ বক্সের কাছে পুলিশ এসে ধরল।

কেন?

আমারও প্রশ্ন, কেন? আমি তো ইন্ডিয়ান গরু স্মাগল করে আনি নি। আমি এনেছি খাঁটি বঙ্গদেশীয় ছাগল।

তারপর?

আমি যে নগদ পয়সায় ছাগল কিনেছি পুলিশ বিশ্বাস করে না। বলে রসিদ দেখান। আরে ছাগলের আবার রসিদ কি? এটা কি টিভি যে রসিদ নিয়ে আসব লাইসেন্স করাতে হবে?

শেষে কী করলে?

পান খাওয়ার জন্য পঞ্চাশটা টাকা ধরে দিলাম। আর মনে-মনে তোকে এক লক্ষ গালি দিলাম। কাল তুই কোথায় ছিলি? বান্ধবীর বাসায় লুকিয়ে ছিলি?

লিলি হাসল।

জাহেদুর রহমান বলল, আমিও ভাইজানকে তাই বললাম। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত, ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়ের দৌড় হলো বান্ধবীর বাড়ি পর্যন্ত। ভাইজান আমার কথা বিশ্বাস করল না–এমন হইচই।

তোমার আমেরিকা যাবার নতুন কিছু হয়েছে?

বৃহস্পতিবার আবার ইন্টারভ্যু দিচ্ছি। মরমন পাদ্রি কথা দিয়েছে সাহায্য করবে। কাকে নাকি বলে দেবে।

তুমি কি খ্রিস্টান হয়ে গেছ?”

এখনও হই নি। ব্যাটার নাকের সামনে মুলা ঝুলিয়ে রেখেছি। একবার খ্রিস্টান হয়ে গেলে তো আর পাত্তা দেবে না। ঠিক না?

হুঁ।

দেশ ছেড়ে দেবার এখন হাই টাইম। ভেরি হাই টাইম।

কেন?

খবর কিছু জানিস না।

না।

বড় ভাইজান ভোম মেরে বসে আছে সেটা দেখেও কিছু বুঝতে পারছিস না?

না।

আমাদের সৎ মা দি গ্রেট লেডি মোসাম্মত আফরোজা বেগম যার নামে আমাদের এই বাড়ি রহিমা কুটির তিনি তাঁর বাড়ি ফেরত চেয়েছেন।

তাই নাকি?

হা। মুখের কথায় চাওয়া না, উকিলের চিঠিফিঠি পাঠিয়ে বেড়াছেড়া। বড় ভাইজানের পালপিটিশন শুরু হয়ে গেছে। ক্রমাগত ঠাণ্ডা পানি খাচ্ছে আর বাথরুমে যাচ্ছে।

আমাদের এখন হবে কী?

হবে আবার কি? তোরা কমলাপুর রেল স্টেমনের প্ল্যাটফরমে শুয়ে থাকবি।

তুমি মনে হচ্ছে ব্যাপারটায় খুশি?

আমার অখুশি হবার কি আছে। আমি তো আর দেশে থাকছি না। তুইও থাকছিস না।

আমি যাব কোথায়?

তোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না? কে নাকি আজ সন্ধ্যায় তোক দেখতে আসবে। মেয়ে হয়ে জন্মানোর ডিসএ্যাডভানটেজ যেমন আছে, এ্যাডভানটেজও আছে। বিপদের সময় অন্যের গলা ধরে ঝুলে পড়ার সুযোগ আছে।

জাহেদুর রহমান প্রবল বেগে জুতা ব্রাশ করছে। বৃহস্পতিবারের ভিসা ইন্টারভ্যুর প্রস্তুতি।

.

সন্ধ্যাবেলা গোঁফওয়ালা এক ছেলে সত্যি সত্যি বাসায় এসে উপস্থিত। তার গা দিয়ে সেন্টের গন্ধ বেরুচ্ছে। বর্তমান কালের স্টাইলে শার্টের সামনে দুটি বোতাম খোলা। শরীরের তুলনায় তার মাথাটা ছোট এবং মনে হয় স্প্রিং বসানো। সারাক্ষণ এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

ফরিদা সেমাই রান্না করতে বসেছেন। মতির মাকে টাকা দিয়ে পাঠানো হয়েছে মিষ্টি আনতে।

লিলি এসে মার পাশে দাঁড়াল। সহজ গলায় বলল, মা ছেলেটাকে দেখেছ?

ফরিদা চোখ না তুলেই বললেন, হুঁ।

 ছেলেটাকে তোমার কেমন লাগছে মা?

ভালোই তো।

বেশ ভালো, না মোটামুটি ভালো?

বেশ ভালো। তবে চোখ দুটো ভালো না। রুমু ঝুমুর মাস্টারের মতো। শকুন শকুন চোখ।

তার জন্য চা নিয়ে কি আমাকে যেতে হবে?

হুঁ।

এই শাড়ি পরে যাব, না ভালো কোনো শাড়ি পরব?

সবুজ শাড়িটা পর। রুমুকে বল চুল বেণি করে দিতে।

আচ্ছা।

লিলি বলল, মা তোমার কাছে মনে হচ্ছে না, ছেলেটার মাথা শরীরের তুলনা

ছোট?

ফরিদা চুলায় ডেকচি বসাতে বসাতে বললেন, ভারী জামা-কাপড় পরেছে তে। এইজন্য মাথাটা ছোট লাগছে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরলে দেখবি মাথা ঠিকই লাগছে।

লিলি হাসছে। খিলখিল করে হাসছে। ফরিদা লিলির হাসির কারণ ঠিক ধরতে পারছেন না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ