ঘুম আসছে না।

আমি চোখ বন্ধ করে হাত পা এলিয়ে পড়ে আছি। আমার গায়ে মার বিখ্যাত ভালবাসা কম্বল। বাইরের পৃথিবী হিম হয়ে আছে। বৃষ্টি হচ্ছে না, তবে আকাশে গুডগুড শব্দ হচ্ছে–হয়ত শেষ রাতের দিকে আবারো বৃষ্টি নামবে। ঘুমুবার জন্যে সুন্দর একটা রাত। ঘুম আসছে না। মা এর মধ্যে দুবার কপালে হাত রেখে জ্বর দেখলেন। চুলে বিলি কাটার মত করলেন। অকারণে কিছুক্ষণ কাশলেন। তার আসল উদ্দেশ্য আমাকে ঘুম থেকে তুলে গল্প করা। শুটিং কেমন হল, ঝড়ের সময় কোথায় ছিলাম এইসব খুঁটিনাটি। মা শ্রোতা হিসেবে খুব মনোযোগী। তার স্মৃতিশক্তিও ভাল। আমি যা বলব তিনি খুব মন দিয়ে শুনবেন। কিছুই ভুলবেন না। বেশ অনেকদিন পর তার যখন ধারণা হবে আমি প্রথমবার কী বলেছিলাম তা এখন আর মনে নেই তখন আবারো জানতে চাইবেন। একই গল্প আমি আবারো বলব। দুটি গল্পে যদি কোন মিল পাওয়া না যায় তখন অমিলের জায়গাগুলিতে জেরা করতে বসবেন। সেই জেরা থেকে বের হয়ে যাবে আমি মিথ্যা কিছু বলেছিলাম কি-না। গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করলে মা খুব ভাল করতেন। অপরাধীর মুখ থেকে সত্যি কথা তিনি অতি দ্রুত বের করে ফেলতে পারতেন।

বকু। ও বকু।

আমি জবাব দিলাম না। ঘুমে তলিয়ে গেছি এমন ভঙ্গিতে গাঢ় নিঃশ্বাস ফেললাম।

তুইতো জেগে আছিস। কথা বলছিস না কেন?

আমি চোখ মেলে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললাম, অসম্ভব টায়ার্ড লাগছে মা। চোখ মেলে রাখতে পারছি না।

তোদের শুটিং কেমন হল রে?

ভাল।

ঝড় কেমন দেখলি?

ভাল।

ঝড়ের সময় ভয় পেয়েছিলি?

হুঁ

ভয় পাওয়ারই কথা। আমারতো একেবারে আত্মা উড়ে গিয়েছিল।

মা আমাকে ঘুমুতে দাও। কথা বলো না। চুলে বিলি কাটবে না, সুড়সুড়ি লাগছে।

মা চুলে বিলি কাটা বন্ধ করলেন না, তবে কথা বন্ধ করলেন। এই কথা বন্ধও সাময়িক। তিনি আবারো শুরু করবেন। দম নিচ্ছেন।

বকু?

হুঁ।

তোরাতো চলে গেলি তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরাট এক পাজেরো জীপ এসে উপস্থিত। আমি ভাবলাম–পাপিয়া ফিরে এলো বুঝি। তাকিয়ে দেখি জীপের ভেতর একজন মহিলা বসে আছেন। তার কোলে পাঁচ ছ বছরের একটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। মহিলা কে বলত? দেখি তোর অনুমান?

আমি জবাব দিলাম না। মার সঙ্গে এই মুহূর্তে অনুমান অনুমান খেলা খেলতে ইচ্ছা করছে না। আমি কিছু সময় একা থাকতে চাই। নিজের জীবনটার উপর চোখ বুলিয়ে নিতে চাই। খুব সহজ সাদামাটা জীবন আমার না। নানান ধরনের জটিলতার জীবন। জীবনটা যদি লম্বা দড়ির মত হয় তাহলে আমার সেই দড়ির নানান জায়গায় গিঁট লেগে গেছে। কিছু গিট আপনাতেই লৈগে আছে, কিছু গিট আমি লাগাচ্ছি।

মা চাপা গলায় বললেন, মহিলার নাম নীরা। আমাদের মঈন ভাইয়ের স্ত্রী। আর মেয়েটার নাম কী জানিস? খুবই অদ্ভুত নাম— এন্টেনা। টিভির এন্টেনা থাকে। মানুষের নামও যে এন্টেনা হয় এই প্রথম শুনলাম। মঈন ভাইয়ের স্ত্রীকে দেখে আমি খুবই আপসেট হয়েছি। সাদা তেলাপোকার মত ফর্সা গা–আর খুব অহংকারী চেহারা। কপাল না কুঁচকে তাকাতে পারে না। ভুরু কুঁচকে থাকতে থাকতে কপালে দাগ পড়ে গেছে। উনার মেয়েটার চেহারা অবশ্যি সুইট আছে। বড় হলে থাকবে কি-না কে জানে। ছোটবেলায় যাদের চেহারা সুইট থাকে–বড় হলে তারা ঘোড়ামুখী হয়ে যায়।

আমি মার কথায় মনে মনে হাসলাম।

বোঝাই যাচ্ছে নীরা নামের মহিলা অসম্ভব রূপবতী। রূপবতী মহিলাদের প্রসঙ্গে মা বলবেন–চেহারা অহংকারী। দেমাগ ঝরে ঝরে পড়ছে, চোখের রঙ কটা। ভুরু কুঁচকানো।

বকু!

হুঁ।

মহিলার সঙ্গে আমিই আগ বাড়িয়ে কথা বললাম। এলেবেলে টাইপ কথা। শুটিং কী হচ্ছে না হচ্ছে এইসব।

ভাল করেছ। ক্ষমতাবান মানুষের স্ত্রীর সঙ্গে খাতির রাখা ভাল।

খাতির করার জন্যে বলি নি! কথা বলে উনাকে একটু বাজিয়ে নিলাম। কী বুঝলাম জানিস! কথা বলে বুঝলাম ভদ্রমহিলা খুব পাকা অভিনেত্রী। হাসি খুশি একটা ভাব মুখে ধরে রেখেছে। যেই আসছে তার সঙ্গেই হাসি মুখে কথা বলছে। বুড়ি বয়সে খুকি সাজার চেষ্টা।

যত অভিনয়ই করুক তোমার কাছেতো ধরা পড়ে গেছে।

তুই বাঁকা ধরনের কথা বলছিস কেন?

প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছেতো মা, এই জন্যেই আমার সোজা কথাগুলি বাঁকা হয়ে বের হচ্ছে। তুমি কি তোমার একটা পা আমার দিকে এগিয়ে দেবে?

কেন?

তোমার পা ধরব।

পা ধরবি কেন?

পা ধরে বলব আজকের রাতটার মত আমাকে ক্ষমা কর। ঘুমুতে দাও।

ভাত খাবি না?

না।

তুই শুয়ে থাক, আমি মুখে তুলে খাইয়ে দি।

তোমাকে মুখে তুলে খাওয়াতে হবে না মা। আমার বমি বমি লাগছে। সরে বোস, নয়তো তোমার গায়ে বমি করে দেব।

এক গ্লাস দুধ এনে দি। দুধ খা আর একটা কলা খা।

আমিতো কালসাপ না যে আমাকে দুধ কলা দিয়ে পুষতে হবে। তুমি যথেষ্ট বিরক্ত করেছে দয়া করে আর বিরক্ত করো না।

আচ্ছা ঘুমো। মাঝখানে শুয়ে আছিস কেন? সাইড করে ঘুমো— আমার জন্যে জায়গা রাখ।

তুমি অন্য বিছানায় ঘুমাও মা। আজ আমি একা শোব। তোমার সঙ্গে ঘুমুতে ইচ্ছা করছে না।

আমার সঙ্গে ঘুমুতে অসুবিধা কী?

তুমি ঘুমের মধ্যে খুব নড়াচড়া কর। বিড় বিড় করে কথা বল। আমার অসুবিধা হয়। তাছাড়া তোমার গায়ে রসুনের গন্ধ।

মা কথা বললেন না, বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। আমি তাঁর খুব দুর্বল একটা জায়গায় ঘা দিয়েছি। আঘাত সামলাতে তাঁর সময় লাগবে। তিনি আজ আলাদা বিছানায় ঘুমুবেন। এবং আমি নিশ্চিত বাকি রাতটা আমাকে বিরক্ত করবেন না।

মার গায়ে রসুনের গন্ধ এই কথাটা বাবা শেষের দিকে বলতে শুরু করেছিলেন। মার ঘর এবং আমার ঘর ছিল পাশাপাশি। ঐ ঘরে একটু চড়া গলায় কোন কথা হলেই আমি শুনতে পেতাম। বাবা কখনোই চড়া গলায় কোন কথা বলতেন না, তবে অল্পতেই মার গলা চড়ে যেত। মা কী বলছেন সেখান থেকেই বাবার জবাব কী হচ্ছে বোঝা যেত। এক রাতে শুনি মা চড়া গলায়, এবং একই সঙ্গে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলছেন— কী বললে, আমার গায়ে রসুনের গন্ধ? বাবা কী একটা জবাব দিলেন। সেই জবাব শোনা গেল না। মার . পরবর্তী কথা শোনা গেল–আমার গায়ে রসুনের গন্ধ বলে আমি তোমার সঙ্গে ঘুমুতে পারব না? আমার স্বামী থাকবে এক ঘরে, আমি থাকব আরেক ঘরে? আর রসুনের গন্ধটা তুমি পাচ্ছ কীভাবে? আমি কী ক্ষেতে রসুন বুনে এসেছি? মার ফুপিয়ে কান্নার শব্দ শোনা গেল। তার কিছুক্ষণ পর মা আমার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করলেন। আমি সদ্য ঘুম ভেঙ্গে উঠে এসেছি এমন ভাব করে দরজা খুলে বিরক্ত গলায় বললাম, রাত দুপুরে কী এমন দরজা ধাক্কাধাক্কি শুরু করেছ। মা ধরা গলায় বললেন–বকু ভাল মত শুকে দেখতো–আমার গায়ে কি কোন গন্ধ পাস? কোন বাজে টাইপ গন্ধ?

আমি অনেক শুকে টুকে বললাম, হুঁ পাচ্ছি। বেশ বাজে ধরনের একটা গন্ধ পাচ্ছি মা।

বাজে ধরনের গন্ধ মানে কী?

রসুন রসুন টাইপ।

সত্যি পাচ্ছিস?

হুঁ।

মা তখনই সাবান নিয়ে গোসলখানায় ঢুকলেন। গোসল করে গায়ে একগাদা সেন্ট মেখে ঘুমুতে এলেন। আমাকে বললেন, বকু এখনো গন্ধ পাচ্ছিস? আমি বললাম, এখন সেন্টের পচা গন্ধ পাচ্ছি। এরচে রসুনের গন্ধ ভাল ছিল। মাথা ধরে গেছে। তুমি আরেকবার গোসল করে আস। তুমি পাশে শুলে আমি ঘুমুতে পারব না। মা রাগ করে চাদর পেতে মেঝেতে ঘুমুতে গেলেন।

আমি কী মার চেয়ে বাবাকে বেশি পছন্দ করি? এই প্রশ্নটা নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি। এবং এক সময় এই সিদ্ধান্তে পৌছাই যে বাবার প্রতি তীব্র ঘৃণা ছাড়া আমার মনে কিছুই নেই। এটাও খুব আশ্চর্য ব্যাপার। একটা বড় ধরনের ভুলের জন্যে মানুষের সারা জীবনের সঞ্চিত শুদ্ধ কাজগুলিও ভুল হয়ে যায়।

আজ আমি যে ভুল করেছি তার জন্যে আমারও সারাজীবনের শুদ্ধ কাজগুলি কি ভুল হয়ে গেছে? না নিজের কথা আমি এখন ভাবব না। এখন নিজেকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। বরং বাবাকে নিয়ে ভাবি। আমার বাবা, সৈয়দ আনোয়ারের অনেক গুণ ছিল, এখনো নিশ্চয়ই আছে। তিনি শান্ত, ভদ্র, বিনয়ী, হাসি খুশি মানুষ। চোখে পড়ার মত বিশেষ কোন গুণ নেই। যাদের বিশেষ কোন গুণ থাকে না, তাদের বিশেষ কোন দোষও থাকে না। তার কোন দোষ ছিল না। তিনি গল্প বলতে পারতেন না, তবে গল্প শুনতে পছন্দ করতেন। আমি আমার স্কুলের সব গল্প বাবাকে বলতাম। অতি সাধারণ গল্প শুনেও তিনি মুগ্ধ ও বিস্মিত হতেন। তাঁর মুগ্ধতা ও বিস্ময় বোধে কোন খাদ ছিল না। অবাক হয়ে তিনি আমার গল্প শুনছেন, এই দৃশ্য এখনো আমার চোখে লেগে আছে।

বাবা শোন আজ কী হয়েছে আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে নাম দিলরুবা, সে পা পিছলে ধপাস করে পড়ে গিয়েছে।

বলিস কী?

মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত পড়ছিল।

তারপর?

মিস দৌড়ে এসেছেন। দিলরুবার বাবা মাকে খবর দিয়েছেন। তার মা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। এসেই মিসের সাথে কী চিৎকার কী চেঁচামেচি।

মিসের দোষ কী? তিনিতো আর ধাক্কা দিয়ে ফেলেন নি।

তবু উনি ভেবেছেন মিসের দোষ। মিসকে অনেক বকাঝকা করে দিলরুবাকে নিয়ে চলে গেছেন। উনি বলেছেন দিলরুবাকে আর এই স্কুলে রাখবেন না।

আমার মনে হয় এই স্কুলেই রাখবে।

আমারো তাই মনে হয়।

স্কুলের এই তুচ্ছ গল্প আমি মাকেও বললাম। মা গল্প শুনে বলেছেন— মিসেরইতো দোষ। সে দেখবে না মেয়েগুলি কী করছে না করছে? মিস গুলি কী করে আমিতো জানি। ক্লাসে এসে ঘুমায়। মাসের শেষে বেতন নিয়ে হাসি মুখে বাসায় যায়।

দিলরুবার প্রসঙ্গে পরবর্তীতে মা আর কিছুই জিজ্ঞাস করেন নি। কিন্তু বাবা ঠিকই পরের দিন জিজ্ঞেস করলেন, রুমালী দিলরুবা কি ক্লাসে এসেছিল? আমি বললাম, না বাবা। বাবা চিন্তিত গলায় বললেন, তাহলেতো সমস্যা। সত্যি সত্যি কি স্কুল বদলে দেবে?

বোধ হয়।

আরো দুএকটা দিন দেখা যাক।

তিন দিনের দিন কপালে ব্যান্ডেজ নিয়ে দিলরুবা ক্লাসে এল। আমি বাবাকে খবর দিতেই তিনি খুবই নিশ্চিন্ত হলেন বলে মনে হল। মনে হল তার বুক থেকে পাষাণ নেমে গেছে।

আমাকে স্কুল থেকে আনা নেয়ার কাজ মা-ই সব সময় করতেন। হঠাৎ হঠাৎ বাবা এসে উপস্থিত হতেন। সেদিন আমার আনন্দের কোন সীমা থাকত না। বাবার সঙ্গে স্কুল থেকে ফেরা, আমার জীবনের আনন্দময় ঘটনাগুলোর একটি। রিকশা করে ফিরছি হঠাৎ দেখা গেল এক জায়গায় কিছু লোক জটলা পাকিয়ে আছে। আমি বললাম—এখানে কী হচ্ছে বাবা?

বাবা সঙ্গে সঙ্গে রিকশা থামিয়ে আমাকে নিয়ে যাবেন জটলার কাছে। দুহাতে উঁচু করে তুলে ধরবেন যাতে কী হচ্ছে আমি দেখতে পাই।

হয়ত রিকশার পাশ দিয়ে আইসক্রীমের গাড়ি যাচ্ছে, বাবা বলবেন, আমার কেন জানি আইসক্রীম খেতে ইচ্ছা করছে। কী করা যায় মা?

আইসক্রীম খাও।

আমি একা একা খাব তুই বসে বসে দেখবি এটা কেমন কথা!

কিচ্ছু হবে না বাবা––তুমি খাও।

একটা কাজ করলে কেমন হয়–আমার আইসক্রীম থেকে তুই দুএক কামড় দে।

আচ্ছা।

বাড়িতে আইসক্রীম খাওয়া আমার জন্যে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। আমার ঠান্ডার দোষ আছে। আইসক্রীম খেলেই আমার টনসিল ফুলে যায়।

আইসক্রীম কেনা হয়। বাবা একটা কামড় দিয়েই বলেন, একী খেতে এমন বিশ্রী কেন? টাকাটা মনে হচ্ছে জলে গেল। রুমালী তুই খেয়ে দেখতো তোর কাছে কেমন লাগছে। আমি খেয়ে বলি, বাবা আমার কাছেতো খুব ভাল লাগছে।

তাহলে বরং তুই খেয়ে ফেল। নষ্ট করে লাভ কী? মাকে না বললেই হল।

আমি মহানন্দে আইসক্রীম খাই। আমাকে আইসক্রীম খাওয়ানোর বাবার এই ছেলেমানুষী কৌশল আমি চট করে ধরে ফেলি। আমার এত ভাল লাগে। এক একদিন আনন্দে চোখে পানি এসে যায়।

এখন আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কেন পড়ছে আমি জানি না। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়া রোগ হয়েছে। একা একা কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলেই আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ে।

আবার কি বৃষ্টি শুরু হল? শহরের বৃষ্টি এবং গ্রামের বৃষ্টিতে এক না। শহুরে বৃষ্টির ভেতর শহুরে ভাব আছে। যেন হিসেব কষা বৃষ্টি। গ্রামের বৃষ্টি লাগামছাড়া।

শহরের দালানকোঠা বৃষ্টির সঙ্গে নাচে না। গ্রামের গাছপালা, ঝোপঝাড় বৃষ্টিতে নাচতে থাকে।

আমার জীবনের বড় বড় সব ঘটনার সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক আছে। যে দিন আমি মারা যাব সেদিনও নিশ্চয়ই খুব ঝড় বৃষ্টি হবে। আমার ডেডবডি নিয়ে মা পড়বেন বিরাট সমস্যায়। লোকজনকে কীভাবে খবর দেবেন? কে আসবে? কোন কবরখানায় কবর হবে? গোরখোদকদেরও হয়তো খবর দিয়ে পাওয়া যাবে না। তবে মা সব ম্যানেজ করে ফেলবেন। দেখা যাবে ঝড় বৃষ্টির কারণেও কিছু আটকাচ্ছে না।

আমার জীবনের সঙ্গে ঝড় বৃষ্টির সম্পর্কের একটা গল্প বলি। স্কুল ছুটি হয়েছে। আমরা ক্লাস থেকে বের হয়ে দেখি খুব বৃষ্টি। রাস্তায় পানি জমে গেছে। আমাদের খুব মজা হচ্ছে। আমরা ইচ্ছা করে বৃষ্টিতে ভিজছি। একজন মিস বকা দিতে এসে নিজেও খানিকক্ষণ ভিজলেন। আমি তেমন করে ভেজার সাহস পাচ্ছি না, কারণ মা আমাকে নিতে আসবেন। তিনি যদি দেখেন আমার গা ভেজা তাহলে সব মেয়েদের সামনেই চড় থাপ্পড় মারা শুরু করবেন। হঠাৎ অবাক হয়ে দেখি মা না, বাবা আমাকে নিতে এসেছেন। আমার আনন্দের কোন সীমা রইল না। বাবা বললেন, তোর মার শরীর খারাপ। সে আসতে পারল না।

আমি বললাম, ভালই হয়েছে আসতে পারে নি। বাবা আজ আমি সরাসরি বাসায় যাব না, তোমার সঙ্গে রিকশা করে বৃষ্টিতে ঘুরব। বাবা বললেন, আচ্ছা। তাঁর গলা কেমন যেন শুকনো অন্যমনস্ক শুনাল। যেন তিনি কী বলছেন নিজেই জানেন না এবং তাঁর মন ভাল নেই। আমি বললাম, বাবা তোমার কি শরীর খারাপ? বাবা বললেন, হুঁ।

কী হয়েছে, জ্বর?

এই বলে আমি তার হাতে হাত রাখলাম। না জ্বর না, শরীর ঠাণ্ডা।

তোমার ভাল না লাগলে চল বাসায় চলে যাই।

বৃষ্টিতে ঘুরতে মন্দ লাগছে না— চল খানিকক্ষণ ঘুরি। তবে শহরের বৃষ্টি হল ভুয়া বৃষ্টি। আসল বৃষ্টি দেখতে হলে গ্রামে যেতে হয়। আইসক্রীম খাবি?

না। বৃষ্টির মধ্যে আইসক্রীম খেলে লোকজন হাসবে।

তাহলে চল কোথাও বসে কফি খাই। এক্সপ্রেসো কফি। খাবি?

চল যাই।

বাবা আমাকে একটা কফি শপে নিয়ে গেলেন। কফি শপটা মনে হয় বাবার চেনা। ম্যানেজার হাসি মুখে বলল, ভাল আছেন? বাবা শুকনো গলায় বললেন, হুঁ।

এ কে?

বাবা বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আমার মেয়ে। এটা বলতে গিয়ে তিনি কেন বিব্রত বোধ করছেন তাও বুঝলাম না। কফি শপটা প্রায় ফাঁকা। বাবা কোণার দিকের একটা চেয়ারে আমাকে নিয়ে বসালেন। এখান থেকে রাস্তা দেখা যায়।

মা আর কিছু খাবি?

না।

এরা খুব ভাল বার্গার বানায়। একটা খেয়ে দেখ।

বাবা আমাকে বসিয়ে রেখে ম্যানেজারের কাছে চলে গেলেন। সেখান থেকে কোথায় জানি টেলিফোন করলেন। আমাকে বার্গার দিয়ে গেছে, সস দিয়ে গেছে। আমি বার্গার খেতে খেতে বাবাকে লক্ষ্য করছি। তার টেলিফোন শেষই হচ্ছে না। মগ ভর্তি কফি দিয়ে গেছে, এখন নিশ্চয়ই ঠাণ্ডা হচ্ছে।

এক সময় টেলিফোন শেষ হল। বাবা কফি শপের ঐ লোকটার কাছ থেকে চেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার সামনের চেয়ারে বসেই বললেন

রুমালী কী বলছি মন দিয়ে শোন।

বাবার সব কথাই আমি খুব মন দিয়ে শুনি। তারপরেও তিনি আমাকে মন দিয়ে কথা শুনতে বলছেন কেন? ভয়ংকর কিছু কি ঘটেছে? মা বেবীটেক্সী এক্সিডেন্ট করে এখন হাসপাতালে আছেন? ভয়ংকর অবস্থা? তাঁকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। রক্ত দেয়া হচ্ছে। বাবা এই খবরটা আমাকে দিতে পারছেন না বলে কফি খাওয়াতে নিয়ে এসেছেন? এতক্ষণ যে টেলিফোনে কথা হল তা নিশ্চয়ই হাসপাতালের কারোর সঙ্গে। তারাও ভাল কোন খবর দিতে পারে নি। হয়ত আরো খারাপ খবর দিয়েছে। নয়তো বাবার মুখ এমন শুকনো হয়ে যাবে কেন?

রুমালী!

হুঁ।

কফিটা কেমন, খেতে ভাল না?

হুঁ।

তবে চিনি খুব বেশি। এক্সপ্রেসো কফির এই নিয়ম। চিনি বেশি দিতে হয়।

হুঁ।

বাবা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন–রুমালী মা শোন, আমি একটা ভয়ংকর অন্যায় করে ফেলেছি। মানুষ যখন বড় ধরনের কোন অন্যায় করে তখন সে বুঝতে পারে না যে সে অন্যায় করছে। বুঝতে পারলে অন্যায়টা সে করতে পারত না। তখন তার কাছে অন্যায়টাকে ন্যায় মনে হয়। যখন সে অন্যায়টাকে অন্যায় বলে মনে করে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

আমি সহজ গলায় বললাম, তুমি কী অন্যায় করেছ?

বাবা প্রায় বিড়বিড় করে বললেন, আমি আমার অফিসের একজন কলিগকে বিয়ে করে ফেলেছি। তার নাম ইসমত আরা। ব্যাপারটা কীভাবে কীভাবে যেন ঘটে গেছে।

বিয়ে কবে করেছ?

প্রায় তিন মাসের মত হয়েছে। তোর মাকে এখনো কিছু বলি নি। কীভাবে বলব তাও বুঝতে পারছি না। তোকেই প্রথম বললাম।

আমি কি মাকে বলব?

না তোকে কিছু বলতে হবে না। যা বলার আমিই বলব। কীভাবে বলব সেটাই ভাবছি।

আমি খুব সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কফির মগে চুমুক দিচ্ছি। বাবার হয়তো ধারণা হল— তিনি কী বলছেন তা আমি বুঝতেই পারি নি। বুঝতে না পারারই কথা, আমার বয়স তখন মাত্র এগারো, ক্লাস ফাইভে উঠেছি।

বাসায় ফেরার পথে বাবা কী মনে করে জানি দশটাকা দিয়ে একগাদা কদম ফুল কিনলেন। কদম ফুলতো আর গোলাপ বা রজনীগন্ধার মত দামী ফুল না। সস্তা ধরনের ফুল। টোকাইরা নিজেদের খেলার জন্যে গাছ থেকে পেড়ে আনে। কেউ সেই ফুল কিনতে চাইলে তারা যেমন বিস্মিত হয়, তেমনি আনন্দিতও হয়। দুটা ফুল চাইলে দশটা দিয়ে দেয়।

মা কদমফুল দেখে খুবই আনন্দিত হলেন তবে চোখে মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে বললেন, কী যে তোমার কাণ্ড। গন্ধ নেই, কিছু নেই এক গাদা ফুল নিয়ে এলে। জঞ্জাল দিয়ে ঘর ভরতি। কোন মানে হয়? তাও যদি ঘরে কোন ফুলদানী থাকত। এই ফুল আমি রাখব কোথায়, বালতিতে?

মা সেই জঞ্জাল গভীর আনন্দের সঙ্গে সাজিয়ে রাখলেন। এক ফাঁকে নিচু গলায় আমাকে বললেন, তোর বাবার এই এক বিশ্রী স্বভাব। ভাল ফুলটুল কিছু দেখলেই আমার জন্যে নিয়ে আসবে। আমি কি দেবী না-কি যে আমাকে ফুল দিয়ে অর্চনা করতে হবে?

ভালবেসে করে। আমি কখনো প্রশ্রয় দেই না। ভাব দেখাই যে রাগ করেছি। মা আনন্দের হাসি হাসছেন। তিনি জানতেও পারছেন না যে তার জীবনে ভয়াবহ ধ্বস নেমে গেছে বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল তার জন্যে কেউ আর কোন দিন আনবে না।

মা ব্যাপারটা জানতে পারেন আমার জানার দুমাস পর। এই দুমাসে আমি মাকে কিছুই বলি নি। বাবাকেও না। আমি আমার নিজের মনে ক্লাস করেছি, গল্পের বই পড়েছি, ডাইরি লিখেছি। কে জানে আমি হয়ত খুব অদ্ভুত একটা মেয়ে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ