ফরহাদ সাহেব ঢাকা চলে গেছেন। যাবার আগে সবার সঙ্গে খুব ভদ্র ব্যবহার করেছেন। নিজের কাজ কর্মের জন্যে ক্ষমা চেয়েছেন। সেলিম ভাইকে বইয়ের ভাষায়, কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছেন, ছবির ভুবনে তোমার আগমন সুন্দর হোক, শুভ হোক। এখানেই শেষ না, সেলিম ভাইকে পাশে নিয়ে ছবি তুলেছেন। ছবি তোলার সময় বাঁ হাত তুলে দিয়েছেন সেলিম ভাইয়ের কাঁধে। সেলিম ভাই বেচারার বিব্রত মুখ দেখার মত ছিল।

ইউনিটের গাড়ি তাকে ঢাকা পৌঁছে দেবার জন্যে যাচ্ছিল। তিনি তা নিলেন। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, এখানে কত কাজ, শুধু শুধু একটা গাড়ি আমি ঢাকা নিয়ে যাব কেন? বাসে উঠে চলে যাব। জনগণের সঙ্গে মেশাও হবে। মেশ তো হয় না। রাজনৈতিক নেতারা যেমন গণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন আমরা ছবির জগতের মানুষরাও তেমনি গণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। এটা ঠিক না। আমি ঠিক করেছি যখনই সুযোগ পাব— জনগণের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করব।

ফরহাদ সাহেব জনগণের সঙ্গে মেশার তেমন সুযোগ পেলেন না। সোহরাব চাচা ভাড়া করা মাইক্রোবাস এনে ফরহাদ সাহেবের কানে কানে কী যেন বললেন। ফরহাদ সাহেব হাসি মুখে মাইক্রোবাসে উঠে বসলেন। জনতার সঙ্গে মিশে যাবার কথা আর তার মনে রইল না। সোহরাব চাচা কী বলেন যে এমন মন্ত্রের মত কাজ করে? জোঁকের মুখে লবণ পড়ার অবস্থা হয়। আমি সোহরাব চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, মা শোন, মানুষও জেঁকের মতই। তাদেরও লবণ আছে। একেক মানুষের জন্যে একেক ধরনের লবণ। ফরহাদ সাহেবের জন্যে যে লবণ সেই লবণ কিন্তু অন্য কোন সাহেবের জন্যে কাজ করবে না।

আমি বললাম, আমাদের ডিরেক্টর সাহেবের জন্যে কী লবণ?

সোহরাব চাচা হাসলেন। আমি বললাম, আপনি জানেন না-কি জানেন না?

আমি জানি।

আমাকে বলবেন?

না।

ফরহাদ সাহেবের লবণটা কী তা বলবেন?

উহুঁ!

কোন মানুষের কী লবণ তা বের করা কি আপনার হবি?

হবি নারে মা, যে লাইনে কাজ করি এই লাইনে লবণ জানা থাকলে খুব সুবিধা হয়।

চাচা বলুনতো আমার লবণটা কী?

সোহরাব চাচা হাসলেন। হাসার ভঙ্গি দেখেই মনে হচ্ছে তিনি জানেন। আমি বিস্মিত হলাম। আমারো যে লবণ আছে আমি তা জানতাম না। সোহরাব চাচা কি আসলেই জানেন?

 

আমাদের শুটিং আপাতত বন্ধ।

ফিল্মের ভাষায় প্যাক আপ হয়ে গেছে। কখন বা কবে শুরু হবে কেউ বলতে পারছেন না। পাপিয়া ম্যাডাম হুট করে ঢাকা চলে গেছেন। তার মেয়ে সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় পা পিছলে পড়ে দাঁত ভেঙ্গে ফেলেছে। খবরটা যখন এল তখন তাঁর শট নেয়া হচ্ছে। আমি, পাপিয়া ম্যাডাম এবং মিজান সাহেব। দৃশ্যটা এ রকম— ডাকবাংলোর বাইরে আমরা তিনজন ফোল্ডিং চেয়ারে বসে আছি। দূরে গারো পাহাড় দেখা যাচ্ছে। আমার হাতে একটা পিরিচ। পিরিচে আচার। আমি আচার খেতে খেতে জামিল ভাইয়ের কথা শুনছি। আমার হাতে আচার থাকায় খুব সমস্যা হচ্ছে। কনটিনিউইটির সমস্যা। কখন মুখে আচার থাকবে, কখন হাতের আঙ্গুলে, লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে। জামিল ভাই (মিজান সাহেব) ভূতের গল্প করছেন। মূল চিত্রনাট্যে দৃশ্যটি রাতের। কিন্তু এখন করা হচ্ছে সন্ধ্যায়। সন্ধ্যায় দূরের গারো পাহাড় আবছা হলেও দেখা যায়।

জামিল ভাই হাত-টাত নেড়ে খুব মজা করে গল্প করছেন। আমি চোখ বড় বড় করে শুনছি। গল্পের খুব সিরিয়াস অবস্থায় হঠাৎ নিশাত আপা (পাপিয়া ম্যাডাম } উঠে দাঁড়াবেন এবং কাউকে কিছু না বলে ডাকবাংলোয় চলে যাবেন। জামিল ভাই বিস্মিত হয়ে বলবেন, দিলু ও এমন হুট করে চলে গেল কেন?

আমি বলব, মনে হয় গল্প শুনে ভয় পেয়েছে। জামিল ভাই আপনি বলতে থাকুন। আমি শুনছি। জামিল ভাই বললেন, আজ থাক আরেক দিন বলব। আমি আহ্লাদী গলায় বলব, না এখন বলতে হবে। জামিল ভাই মোটামুটি ক গলায় বলবেন, বিরক্ত করো নাতো। বলেই তিনি উঠে চলে যাবেন।

জামিল ভাইয়ের কঠিন আচরণে আমার চোখে পানি চলে আসবে। দৃশ্যটা শেষ হবে চোখের জলে।

পাপিয়া ম্যাডামের মেয়ের দাঁত ভাঙ্গার খবরটা দৃশ্যের শুরুতেই এল। পিয়া ম্যাডামের চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। তিনি বললেন, দৃশ্যটা শেষ হলে আমি ঢাকায় চলে যাব। ডিরেক্টর সাহেব বললেন, আচ্ছা। টেক শুরু হল। খুব সুন্দর অভিনয় করলেন পাপিয়া ম্যাডাম। মিজান সাহেবের অভিনয় আমার তত ভাল লাগল না। ডিরেক্টর সাহেব বললেন, মিজান তোমার অভিনয় ঠিক জমছে না। কারণটা কী?

মিজান সাহেব বললেন, আমিতো বুঝতে পারছি না।

টোন ডাউন করবে?

আপনি বললে করি।

তাহলে টোন ডাউন কর। তোমার গল্প শুনে মনে হচ্ছে তুমি ছোট ছোট বাচ্চাদের ভূতের গল্প বলছ–আসলে তোমার টার্গেট শ্রোতা হচ্ছে একজনই, নিশাত। তুমি গল্পটা বলছ দিলুর দিকে তাকিয়ে কিন্তু মন পড়ে আছে নিশাতের কাছে। নিশাতের কাছে গল্পটা কেমন লাগছে এটা নিয়েই তুমি কনসার্নড়।

টেক আবার শুরু হল। মিজান সাহেব আগের মতই অভিনয় করলেন তবে হাত নাড়াটা একটু কমল। সব শেষ করে আমরা রেস্ট হাউজে ফিরলাম সন্ধ্যা পার করে। পাপিয়া ম্যাডাম সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা রওনা হলেন। কবে ফিরবেন কাউকে কিছু বলে গেলেন না। আমাকে শুধু বললেন, তোমার জন্যে কি ঢাকা থেকে কিছু আনতে হবে?

আমি বললাম, না।

গল্পের বই? গল্পের বই কি আনব?

আনতে পারেন। সবচে ভাল হয় যদি আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে। আসেন।

ওকে আমি শুটিং স্পটে আনি না।

পাপিয়া মাডামের গাড়ি রওনা হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার কেন জানি মনে হল জাহেদার কথা ফলে যাবে। দুর্গাপুরে আর কখনো শুটিং হবে না। উনি ফিরে আসবেন না। আমরা দুচারদিন অপেক্ষা করে ঢাকায় ফিরে যাব।

মার শরীর খুবই খারাপ করেছে। নানান ধরনের অসুখ বিসুখ তাঁর হয়। একটা কমলে আরেকটা শুরু হয়। অসুখ ছাড়া অবস্থায় তিনি কখনো থাকেন না। যে সব অসুখ তার সারা বছরই থাকে সেগুলি হচ্ছে–

বুক ধড়ফড়
শ্বাস কষ্ট
আধকপালী মাথা ধরা
মাথা ঘোরা
বমি ভাব
বুক জ্বালা
কাশি
টনসিলের ব্যথা
জ্বর।

আজ তার পুরানো অসুখের কোনটা তাকে ধরে নি–তার পা ফুলে গেছে। তিনি বিছানা থেকে নামতেও পারছেন না। কাশবনের শুটিং দেখতে যাওয়ায় তাকে আট কিলোমিটারের মত হাঁটতে হয়েছে। আমার ধারণা এই হাঁটাই তার কাল হয়েছে। শারীরিক কষ্ট তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। অসুখ বিসুখের সময় কাউকে না কাউকে তার পাশে থাকতে হবে। পাশে থাকার এই অংশটা আমার কাছে অসহ্য লাগে। মা অনবরত কথা বলতে থাকেন। সেইসব কথাবার্তার বেশির ভাগই অর্থহীন। দুতিন মিনিট পর পর তিনি অস্থির হয়ে ডাকবেন,বকু, বকু ও বকু। ভাবটা এ রকম যেন ভয়ংকর কিছু ঘটে যাচ্ছে। আমি ছুটে যাব, তিনি বলবেন— মাথার নীচের বালিশটা ঠিক করে দেতো মা। বালিশ ঠিক করার এই কাজটা তিনি নিজেই পারেন–নিজে করবেন না। অন্য কাউকে দিয়ে করাবেন।

পাপিয়া ম্যাডাম চলে যাওয়ায় আমার কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আমি জোনাকি পোকার আলো জ্বলা দেখার জন্যে বারান্দায় বসে আছি এবং মজার একটা কাজ করার চেষ্টা করছি—জোনাকি পোকার আঁকে মোট কতগুলি জোনাকি পোকা আছে তা গোনার চেষ্টা করছি। কাজটা যত কঠিন মনে হচ্ছে। আসলে তত কঠিন না। ঝাকের জোনাকি পোকারা জায়গা বদল করে না। তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ওড়ে ঠিকই কিন্তু একজনের সঙ্গে অন্যজনের দূরত্ব ঠিকই রাখে। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম আলো জ্বলা-নেভা একেক জোনাকির একেক সময়ে হলেও যখন তারা স্থির হয়ে থাকে তখন আলো জুলা-নেভার মধ্যে এক ধরনের শৃঙখলা চলে আসে। সবাই এক সঙ্গে আলো জ্বালে এক সঙ্গে নেভায়।

বকু বকু বকু।

আমি বিরক্ত মুখে উঠে গেলাম। জোনাকি গোনা হল না। মা নিতান্ত অকারণে ডাকছেন। তাঁর মহা উদ্বিগ্ন গলার স্বরই বলে দিচ্ছে— অকারণ ডাকাডাকি।

বকু মা দেখতো আমার পায়ে পানি এসেছে কি-না। পানি আসা বুঝব কী করে?

পায়ে আঙ্গুল দিয়ে শক্ত করে চাপ দে। দেখবি গর্ত হয়ে যাবে। আঙ্গুল সরিয়ে দে। গর্ত যদি সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় তাহলে পানি আসে নি। আর যদি সময় বেশি নেয় তাহলে পানি এসেছে।

আমি টিপাটিপি করে বললাম, পানি আসে নি মা। মনে হয় বরফ এসেছে। গর্তই করতে পারছি না।

মা কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। কন্যার রসিকতা তার ভাল লাগছে না। আমি বললাম, মা যাই আমি জরুরি একটা কাজ করছি।

জরুরি কাজটা কী?

জোনাকি পোকা গুনছি।

এইটা তোর জরুরি কাজ?

হুঁ।

অসুস্থ মায়ের কাছে বসে, ভাল মন্দ দু একটা কথা বলা জরুরি না?

হুঁ।

আচ্ছা যাও বসলাম। তুমি ভালমন্দ কথা বল আমি শুনি।

পাপিয়া চলে গেছে?

হুঁ।

যাবার আগে দেখলাম গুজ গুজ করে তোকে কী সব বলছে। কী বলছে?

গোপন একটা কথা বলে গেছেন মা। তোমার না জানলেও চলবে।

যন্ত্রণা করিস না, কী বলেছে বল।

ম্যাডাম বললেন—বকুল ডিয়ার, আমি আমার কৃষ্ণকে তোমার হাতে আপাতত দিয়ে গেলাম। তুমি তাকে দেখে শুনে রাখবে। সঙ্গ দেবে।

আমি তোর মা না? আমার সঙ্গে অশ্লীল কথা বলতে তোর মুখে আটকায় না।

অশ্লীল কথাতো মা কিছু না। তাছাড়া তোমার কাছে অশ্লীল লাগলেও কিছু করার নেই। পাপিয়া ম্যাডাম আমাকে যাই বলেছেন আমি তাই তোমাকে বললাম। তুমি যদি শুনতে না চাইতে তাহলে আর অশ্লীল কথাগুলি তোমাকে শুনতে হত না।

পাপিয়া এ রকম কোন কথাই বলে নি। সে জিজ্ঞেস করছিল—তোর জন্যে গল্পের বই আনবে কি-না।

তাহলেতো তুমি জানই কী জিজ্ঞেস করেছিল–তারপরে জানতে চাচ্ছ কেন?

খুব দোষ করেছি। এখন কী করতে হবে? পা ধরতে হবে?

মা রাগে-দুঃখে কেঁদে ফেললেন। কাজেই হাসি মুখে আমি বসলাম তার পাশে। এখন মার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করা যায়। আদুরে ভঙ্গি করা যায়। তার গায়ে-মুখে নাক ঘষা যায়। আমি আদুরে গলায় বললাম, কেমন আছ মা?

যা ঢং করিস না।

ও আল্লা তোমার সঙ্গে ঢং করব নাতো কার সঙ্গে টং করব? সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে?

আবার ফাজলামি? ঐ বাঁদরটার নামও মুখে আনবি না।

আচ্ছা যাও মুখে আনব না। পা ব্যথা করছে? টিপে দেব?

বললাম না ঢং করবি না।

মার রাগ পড়ে গেছে। তার মন ভর্তি হাসি। সেই হাসি এখনো মুখ পর্যন্ত আসে নি তবে এসে যাবে।

বকু!

কি-কু?

উফ আবার ঢং। এত ঢং তোকে কে শিখিয়েছে?

বেশির ভাগই নিজে নিজে শিখেছি। কিছু শিখেছি পাপিয়া ম্যাডামের কাছ থেকে।

কী রকম বদ মেয়ে দেখলি?

পাপিয়া ম্যাডামের কথা বলছ?

আর কার কথা বলব? সামান্য চক্ষুলজ্জাও মেয়েটার নেই। মানুষের চোখে সাত পর্দা লজ্জা থাকে। তার এক পর্দাও নেই। তার মেয়ের কী না কী হয়েছে সব ফেলে-ফুলে ছুটে চলে গেছে।

নিজের মেয়ের বিপদে ছুটে যাবে না? তুমি ছুটে যেতে না?

এতদিন পর নিজের মেয়ে বলছে কেন? শুরুতে পত্রিকায় কত ইন্টার এ আমার মেয়ে না। পালক কন্যা। তখন সে ভয়ে অস্থির লোকজন যদি জানে মেয়ে হয়ে গেছে তখন নায়িকার ইমেজ নষ্ট হবে। লোকজন সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখবে না।

এই মেয়ে তাঁর নিজের না তিনি পত্রিকায় এমন ইন্টার দিয়েছিলেন?

অবশ্যই দিয়েছে। আমি নিজে পড়েছি। বুঝলি বকু ফিল্ম লাইন বড়ই জটিল লাইন।

তুমি এই জটিল লাইনে তোমার মেয়েকে ঢুকাচ্ছ কেন? এখনো কিন্তু সময় আছে।

কী সময় আছে?

তুমি তোমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও। ভাল একটা ছেলে দেখে বিয়ে দাও। চাকুরিজীবি স্বামী। দশটা পাঁচটা অফিস করবে। ভেড়ুয়া টাইপ। মাঝে মধ্যে লোভে পড়ে বন্ধুর সঙ্গে তাশ-টাশ খেলতে যাবে। তখন আমি খুব বকা ঝকা করব। ঈদের বোনাস যেদিন পাবে তার পরদিনই তাকে নিয়ে ঈদের শাড়ি কিনতে যাব কেনা কাটা শেষ হবার পর কোন একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুজন মিলে এক বাটি থাই স্যুপ খাব। ফুল কোর্স খাবার মত পয়সাতো আমাদের থাকবে না কাজেই শুধু স্যুপ।

তুই ভ্যার ভার করে এইসব কী বলছিস?

কেন তোমার কি শুনতে ভাল লাগছে না?

অসহ্য লাগছে।

কফি খাবে মা?

এখন কফি কোথায় পাবি?

ইউনিটকে বলব কফি দিতে। এক নম্বর নায়িকার অনুপস্থিতিতে আমিইতো এক নম্বর। খাবে কফি?

তুই কফির কথা বলবি তারপর ওরা দেবে না সেটাতো খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।

তুমি চুপ করে শুয়ে থাক, আমি কফি নিয়ে আসছি। তারপর আমরা মা-মেয়ে দুজন কফির কাপ হাতে পরচর্চা করব। পাপিয়া ম্যাডামকেতো ধরা হয়েছে, কফি খেতে খেতে আমরা ডিরেক্টর সাহেবের চরিত্র বিশ্লেষণ করব। উনাকে তুলোধুনা করে ছাড়ব।

বকুল, ফাজলামি ধরনের কথা তুই একদম বলবি না।

আচ্ছা যাও বলব না, তুমি ঝিম ধরে পড়ে থাক, আমি কফি নিয়ে আসছি।

চিনি কম দিতে বলবি, গাদাখানিক চিনি যেন না দেয়।

আমি মার ঘর থেকে বের হয়ে আবার কিছুক্ষণ জোনাকি গোনার চেষ্টা করলাম। গোনা যাচ্ছে না— যতবার গুনতে শুরু করি ততবারই ওরা গাছের আড়ালে চলে যায়। এরা কি কোনভাবে বুঝতে পারছে আমি এদের গুনতে চেষ্টা করছি? টেলিপ্যাথিক কোন যোগাযোগ? কফির কথা বলার জন্যে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছি সোহরাব চাচার সঙ্গে দেখা। তিনি মন খারাপ করে বসে আছেন। আমাকে দেখেই হাত ইশারা করলেন। আমি হাসি মুখে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, চাচা মন খারাপ কেন?

মন খারাপ না, ব্যথা উঠেছে।

ব্যথা উঠেছে মানে! কিসের ব্যথা উঠেছে?

আমার একটা কলিক ব্যথা আছে—ডান পেটে হয়। মাঝে মধ্যে হয়।

আলসার নাকি?

না-আলসার না, ডাক্তার দেখিয়েছি—তারা আলসার না এটাই শুধু বলে আর কিছু বলে না। তুমি রান্নাঘরে ঘুর ঘুর করছ কেন?

কফির সন্ধানে এসেছি চাচা-কফি কি পাওয়া যাবে?

অবশ্যই পাওয়া যাবে। কেন পাওয়া যাবে না!

তিন কাপ কফি লাগবে।

তিনজন কে?

মার জন্যে এক কাপ, আমার জন্যে এক কাপ এবং আমাদের ডিরেক্টর সাহেবের জন্যে এক কাপ।

স্যার কি কফি চেয়েছেন? তিনি তো এই সময় কফি খান না।

না উনি কফি চান নি তবু আমি ভাবছি এক কাপ কফি তাঁর কাছে নিয়ে বলব, আপনার জন্যে কফি এনেছি।

কেন?

উনি আমার খুব প্রশংসা করেছেন। আমার প্রশংসা মানে আমার অভিনয়ের প্রশংসা। যখন প্রশংসা করছিলেন তখন লজ্জায় কথা বলতে পারি নি। এখন লজ্জা একটু কমেছে। এখন ঠিক করেছি–কফির কাপটা উনার হাতে দিয়ে বলব

—থ্যাংক য়্যু।

তার কোন দরকার নেই। স্যারের সঙ্গে আমার যখন দেখা হবে তখন আমি বলে দেব।

কী বলে দেবেন?

বলব যে মিস রুমালী আপনার প্রশংসায় খুব খুশি হয়েছে?

আমি কতটা খুশি হয়েছি সেটাতো আপনি বলতে পারবেন না। কাজেই কফির কাপ নিয়ে আমাকেই যেতে হবে। তবে আপনি যদি মনে করেন উনার কাছে একা একা যাওয়া বিপদজনক তাহলে ভিন্ন কথা।

বিপদজনক হবে কেন?

আমারওতো সেটাই কথা, তবে উনার কাছে কফি নিয়ে যাচ্ছি শুনে আপনি যে ভাবে চমকে উঠলেন সেখান থেকে ধারণা হল— হয়ত উনার কাছে যাওয়া বিপদজনক। উনি হয়তোবা ঘাতক ট্রাক। আমার মত মেয়েদের একশ হাত দূরে থাকা দরকার।

সোহরাব চাচা শুকনো মুখে বললেন, তুমি অপেক্ষা কর। কফি বানানো হোক তুমি নিয়ে যাবে।

থ্যাংক য়্যু।

তোমার মার শরীরের অবস্থা কী?

অবস্থা বেশি ভাল না, মানুষের আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়, মার পা ফুলে বটগাছ হয়ে গেছে।

যাও মার কাছে গিয়ে বোস। কফি তৈরি হলে তোমাকে খবর দেব।

আমি মার কাছে বসব না। উঠানে হাঁটাহাঁটি করব। আপনি মার কফি তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেবেন।

আমি উঠোনে নেমে এলাম। জোনাকি পোকার ঝাকের দিকে এগুচ্ছি। হাতে একটা টর্চ লাইট থাকলে হত। ওদের গায়ে আলো ফেলে দেখতাম ওরা কী করে। সব অন্ধকারের পোকাই আলোকে ভয় করে। ওরা কী করবে— আলো নিয়ে যাদের চলা ফেরা তারা আলোকে ভয় করবে কেন?

 

ডিরেক্টর সাহেবের ঘরের দরজা খোলা। আমি দুকাপ কফি হাতে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ আগে খুব ছেলেমানুষী একটা কাজ করেছি—আই লাভ ইউ আই লাভ ইউ বলে উনার কফির কাপে ফু দিয়ে দিয়েছি। ভাবটা এ রকম যেন এই কফি খেলেই উনি বুঝতে পারবেন রুমালী নামের একটা মেয়ে তার জন্যে অস্থির হয়ে আছে। ঘরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছি না, আবার চলেও যেতে পারছি না হাতের কফি ঠান্ডা হচ্ছে। ঠান্ডা কফিতে চুমুক দিলে তার নিশ্চয়ই মেজাজ খারাপ হবে। আমি তার মেজাজ খারাপ করতে চাই না। ঘরের ভেতর গান হচ্ছে–ইংরেজি গান। সুরটা সুন্দর, কথাগুলি পরিষ্কার। এই গানটা তাঁর ঘরে আগেও বাজতে শুনেছি। নিশ্চয়ই তাঁর প্রিয় গান। গানটা গলায় তুলে নিতে পারলে ভাল হয়। তার আশে পাশে যখন থাকব তখন অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে দুলাইন গেয়ে ফেলব। তিনি চমকে বলবেন—আরে তুমি এই গান কোথায় শিখলে? আমি জবাব দেব না, মুখ টিপে হাসব। হাসার সময় আমার থুতনিটা ভেতরের দিকে রাখব। কারণ ক্যামেরাম্যান বলেছেন আমাকে সবচে সুন্দর দেখা যায় যখন আমার থুতনি ভেতরের দিকে থাকে। মুশকিল হচ্ছে ইংরেজি গানগুলি সহজে গলায় বসতে চায় না। মনে হয় গানগুলিরও নিজস্ব জীবন আছে। এরাও গাছের মত। এক মাটির গাছ অন্য মাটিতে বাঁচে না। এক দেশের গান অন্য দেশের মেয়ের গলায় বসে না। আমি কান পেতে আছি— গানের কথাগুলি ধরতে পেরেও পারছি না।

Down the way
Where the nights are gay
And Sun Shines daily on the mountain top.
I took a trip
On a sailing ship
And when I reached Jamaica I made a stop.
But I am sad to say
I am on my way
wont be back for many a day

আমি দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি চেয়ারে বসে। তাঁর হাতে কী একটা বই। মনে হচ্ছে বইটা খুব মন দিয়ে পড়ছিলেন। মাথা বই-এ ঝুঁকে আছে। তিনি মাথা তুলে আমাকে দেখে বললেন—এই যে বকুল। এসো। যেন তিনি জানতেন আমি কফি নিয়ে আসছি। কফির জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আমি জানি তিনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমার হাত থেকে কফির কাপ নেবেন। ঠান্ডা কফিতে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির স্বরে বললেন–Excellent কফি। মানুষটা সব সময় স্বাভাবিক, এইটাই তাঁর বিশেষত্ব। কিংবা কে জানে এটা হয়ত কোন বিশেষত্ব না। আমি মানুষটার উপর বিশেষত্ব আরোপ করতে চাইছি বলে এরকম ভাবছি।

তিনি হাত থেকে কফির কাপ নিয়ে বললেন, দেখেই মনে হচ্ছে কফিটা চমৎকার। তিনি আগ্রহের সঙ্গে চুমুক দিলেন এবং তৃপ্তির স্বরে বললেন, Excellent. তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আমিও কফির কাপে চুমুক দিলাম। মোটেই Excellent কিছু না। ঠান্ডা তিতকুটে একটা বস্তু।

বকুল তোমার খবর কী?

জ্বী, খবর ভাল।

তিনি হাত বাড়িয়ে ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করতে করতে বললেন, আমার মেজাজ যে কী রকম খারাপ সেটা কি বোঝা যাচ্ছে?

জ্বি না।

খুবই খারাপ। শুটিং পুরোপুরি বন্ধ করে বসে আছি। আবার কবে শুরু হবে সেটাও বুঝতে পারছি না। ফরহাদ আমাকে একটা চিঠি লিখে গেছে— সেই চিঠি পড়লে যে-কোন স্বাভাবিক মানুষের ব্রেইন ডিফেক্ট হবার কথা….।

আপনার হচ্ছে না? মানুষ হিসেবে আমি বোধ হয় খুব স্বাভাবিক না। ফরহাদের চিঠি একবার পড়েছি পড়ে ফাইলে রেখে দিয়েছি।

আমার চিঠিটা খুব পড়তে ইচ্ছা করছে। পড়তে চাইলেই তিনি আমাকে পড়তে দেবেন কি-না তা বুঝতে পারছি না। মানুষটাকে আমি এখনো তত ভাল ভাবে জানি না। আমি কেন তার ঘরে এসেছি তিনি কি তা জানেন? আমার অস্থিরতা কি তিনি বুঝতে পারছেন? তাকে কিছুই জানতে দেয়া যাবে না। কাজেই আমাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে অতি দ্রুত কোন একটা অজুহাত বের করতে হবে। তাঁর ঘরে আসার পেছনে বিশ্বাসযোগ্য কোন অজুহাত। কিচ্ছু মাথায় আসছে না। সবচে বড় সমস্যা হবে তিনি নিজে থেকে যদি জিজ্ঞেস করে ফেলেন-বকুল আমার কাছে কেন এসেছ? এটা জিজ্ঞেস করা মানেই হল তাঁর মনে খটকা লেগেছে। আর তখন যদি আমি কোন জবাব দিতে না পারি তখন সেই খটকা আরো বাড়বে।

বকুল!

জ্বি।

আমার কাছে কি কোন কাজে এসেছ না এমি গল্প করতে এসেছ?

আমি মাথা নিচু করে বললাম, আমাকে মা পাঠিয়েছে।

ও আচ্ছা।

মার ধারণা কফি নিয়ে আপনার কাছে যদি আসি আপনি খুব খুশি হবেন। আপনি খুশি হলে আমার জন্যে খুব সুবিধা হবে। আপনার পরের ছবিতেও হয়ত আমি সুযোগ পাব। সুযোগ সুবিধার ব্যাপারগুলি মা খুব ভাল বোঝেন।

তিনি হাসছেন। যাক, আমার কথাটা তাহলে তার বিশ্বাস হয়েছে। অবশি। আমি যা বলার বিশ্বাসযোগ্য ভাবেই বলেছি।

মাকে কি তুমি অপছন্দ কর?

না উনাকে খুবই পছন্দ করি। উনার কিছু কিছু বোকামি আমার কাছে অসহ্য লাগে।

কিছু কিছু বোকামিতো সবার মধ্যেই থাকবে। হান্ড্রেড পার্সেন্ট বুদ্ধিমান বলে কিছু নেই। সব বুদ্ধিতেই খাদ মেশানো থাকে। কারও হচ্ছে আঠারো ক্যারেট বুদ্ধি, কারো বাইশ ক্যারেট।

আমি যে বসে আছি আপনার কি বিরক্তি লাগছে?

না বিরক্তি লাগবে কেন?

লাগলেও কিচ্ছু করার নেই। মা বলে দিয়েছে আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে।

গল্প কর শুনি।

আমি গল্প করতে পারি না। আপনি গল্প করুন আমি শুনি। আপনার গল্প করতে ইচ্ছা না করলে গল্প করতে হবে না। আপনি আপনার কাজ করুন, বই পড়ুন। আমি কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে যাব–মাকে গিয়ে বলব, মা অনেক গল্প করেছি, উনাকে গানও শুনিয়েছি। গান শুনে উনি খুব খুশি হয়েছেন।

তুমি গান জান?

জ্বি, জানি।

তাহলে শোনাও একটা গান।

জ্বি না, আমি গান শুনাব না। আমি মোটামুটি ধরনের গান জানি। যে আমার গান শোনে সে খুশিও হয় না আবার বিরক্তও হয় না। কাজেই আমার শুনাতে ইচ্ছা করে না।

ও আচ্ছা তাহলে থাক। তিনি একটা সিগারেট ধরালেন। আমি আমার মিথ্যা বলার ক্ষমতা দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হলাম। একবার মিথ্যা বলা শুরু করলে সত্যি বলা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আমার বেলায় তাই হচ্ছে— আমি একের পর এক মিথ্যা বলে যাচ্ছি। আমার গান প্রসঙ্গে আমি যা বললাম তা পুরোপুরি মিথ্যা। গান আমি ভাল জানি–শুধু ভাল না, খুব ভাল। আমি জানি আমার গান শুনলেই তিনি বিস্ময়ে অভিভূত হবেন। গানকে আমি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাই না।

বকুল।

জ্বি।

চুপ করে আছ কেন? কথা বল।

কথা খুঁজে পাচ্ছি না।

পাপিয়া, পাপিয়ার সঙ্গে তোমার কেমন পরিচয়?

মোটামুটি পরিচয়। উনি আমাকে পছন্দ করেন কি-না আমি ঠিক বুঝতে পারি না।

তুমি পছন্দ কর?

না।

তুমি পছন্দ কর না কেন?

আমি জানি না। হিংসার কারণে হতে পারে।

তাকে হিংসা কর?

হুঁ।

কেন?

তিনি এত সুন্দর এই জন্যেই বোধ হয়। তাকে দেখলে আমার মোমবাতির কথা মনে হয়।

মোমবাতি কেন?

মোমবাতির মত ধবধবে সাদা শরীর। মুখটা জ্বলজ্বল করছে। ঠিক যেন মোমবাতির শিখা।

মোমবাতির শিখা যত জ্বলে মোমবাতি ততই কিন্তু ক্ষয়ে যেতে থাকে সেটা জান?

জানি। কিন্তু মানুষতো আসলে মোমবাতি না, সেই কারণে মানুষ ক্ষয় হয় না।

ভাল বলেছতো!

আপনি উনাকে খুব পছন্দ করেন?

হুঁ।

কেন, সুন্দর বলে?

সে যত-না সুন্দর, তার মন কিন্তু তারচেয়ে অনেক সুন্দর। যেমন ধর তার মেয়েটা ব্যথা পেয়েছে এই খবর শুনেই সে ছুটে চলে গেছে। মেয়েটা কিন্তু তার নিজের না।

নিজের না?

না নিজের না, সে রফিক নামের একটা ছেলেকে বিয়ে করল। রফিক তখন মেরীল্যান্ডের একটা কোম্পানীতে কাজ করে। ছুটি কাটাতে দেশে এসেছিল। একটা পার্টিতে পরিচয়। পরিচয় থেকে অতি দ্রুত বিয়ে। বিয়ের পর জানা গেল রফিক আমেরিকায় একটা ব্ল্যাক মেয়েকে বিয়ে করেছিল। তাদের একটি বাচ্চাও আছে। সেই বিয়ে টেকে নি। ডিভোর্স হয়ে গেছে। বাচ্চা মেয়েটিকে মা নেয় নি। বাবাও নিচ্ছে না। মেয়েটি দারুণ কষ্টে তার গ্রান্ডমার সংসারে আছে। মেয়েটিকে পাপিয়া নিজের কাছে নিয়ে এল। রফিকের সঙ্গেও তার বিয়ে টিকল না। রফিক তৃতীয় আরেকজনকে বিয়ে করল। রফিকের মেয়েটি রয়ে গেল পাপিয়ার কাছে। কী আদর যে পাপিয়া মেয়েটিকে করে তা তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না।

আর রফিক সাহেবের কাজ কি শুধু বিয়ে করে বেড়ানো?

ব্যাপারটা মোটামুটি সে রকমই দাঁড়াচ্ছে।

উনি কি খুব হ্যান্ডসাম—তাঁকে দেখামাত্রই কি মেয়েদের মাথা আউলা হয়ে যায়?

রফিক মোটেই হ্যান্ডসাম না। কাঠখোট্টা ধরনের চেহারা তবে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে মেয়েদের মনে একটা ঘোর অবশ্যই তৈরি হয়।

কেন?

আমি জানি না কেন? মেয়েরা বলতে পারে।

আপনার জানতে ইচ্ছা করে না!

না আমার জানতে ইচ্ছে করে না।

আমি এখন উঠি?

আচ্ছা যাও! আশা করি তোমার মা মোটামুটি খুশিই হবেন যে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়েছে।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। এবং কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই বললাম, আমি আপনার সঙ্গে সামান্য মিথ্যা কথা বলেছি। দয়া করে কিছু মনে করবেন না।

তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কী মিথ্যা কথা?

মা আমাকে আপনার কাছে পাঠান নি। আমি নিজেই এসেছি। আমার খুব একা একা লাগছিল–মন খারাপ লাগছিল। আমার মনে হচ্ছিল আপনার সঙ্গে কথা বললে মন খারাপ ভাব কমবে।

কমেছে?

জ্বি না, কমে নি।

তাহলে বস আরো কিছুক্ষণ।

না।

আমি উঠে চলে এলাম। দরজার ওপাশে এসে থমকে দাঁড়ালাম। আমার ধারণা ছিল আমার কাণ্ডকারখানায় উনি মোটামুটি স্তম্ভিত হয়ে যাবেন। দেখা গেল আমার ধারণা ঠিক না। আমি ঘর থেকে বেরুবার সঙ্গে তাঁর ঘরের ক্যাসেট প্লেয়ার চলতে শুরু করল। দরজার ভেতর দিয়ে এক পলকের জন্যে তাকালাম— তিনি গভীর মনযোগে বই পড়ছেন। কী এমন বই? উনার সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম তখন বইটার নাম আমি পড়েছি বইটার নামা Sula, লেখকের (না-কি লেখিকার?) নাম টনি মরিসন। বইটা ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেললে আমার ভাল লাগত! একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমি দরজার পাশে দাড়িয়ে থাকি–উনি এক সময় কিছুক্ষণের জন্যে বই রেখে বাথরুমে যাবেন বা অন্য কোথাও যাবেন এই ফাঁকে আমি বই ছিড়ে কুচি কুচি করে চলে আসব। উনি ফিরে এসে হতভম্ব গলায় বলবেন—একী? আমার পক্ষে তা করা সম্ভব না। আমরা এমন জগতে বাস করি যে জগতে যে কাজটা খুব করতে ইচ্ছে করে সেই কাজটা কখনো করা যায় না। অনন্ত নক্ষত্র বীথিতে এমন কোন গ্রহ কি আছে যে গ্রহের মানুষরা যা করতে চায় তাই করতে পারে?

আমি আবার উঠোনে চলে গেলাম। জোনাকি গোনা যাক। মার কী অবস্থা কে জানে? তিনি নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে পড়েছেন। আমার অতি আদরের ঝিনুক মা। যিনি তার ডানা খুলে রেখেছেন— আমি সুরুৎ করে ভেতরে ঢুকে যাব। ডালা যাবে বন্ধ হয়ে। আমি পরম নিশ্চিন্তে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ব। জগতের কোন সমস্যাই আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

আশ্চর্য একটাও জোনাকি পোকা নেই। বৃষ্টি হয় নি কিন্তু মাটির ভেতর থেকে ভেজা গন্ধ আসছে। এই গন্ধে শরীর ঝিম ঝিম করে।

ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করছে না। একা একা হাঁটতেও ইচ্ছা করছে না, আবার অন্য কারো সঙ্গে ঘুরতেও ইচ্ছা করছে না। এই অবস্থাটাকে কী বলে? একা থাকতে ইচ্ছা করে না, আবার দোকা থাকতেও ইচ্ছা করে না। আমি মনে মনে গুনগুন করছি।

Down the way
Where the nights are gay….

সুরটা সুন্দর, একবার শুরু করলে মাথায় চলতে থাকে—

I took a trip
on a sailing ship.

নিজের গান শুনে নিজেই মুগ্ধ হচ্ছি। নিজেকেই বলতে ইচ্ছা করছে— এই মেয়ে তোমার গলা এত মিষ্টি কেন? খবর্দার মুখ হা করে কখনো ঘুমুবে না। মুখ হা করে ঘুমুলে মুখের ভেতর দিয়ে পিঁপড়া ঢুকে তোমার গলা খেয়ে ফেলবে।

কেউ একজন আমার দিকে এগিয়ে আসছে। অন্ধকারে তার মুখ দেখতে পারছি না, কিন্তু হাঁটার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে উনি সেলিম ভাই। সেলিম ভাইয়ের সাহস ভালই বেড়েছে। একটা মেয়ে একা একা হাঁটছে তিনি কেমন তার কাছে চলে আসছেন। এই ভাবে ঘন ঘন আসতে থাকলে উনি বিরাট সমস্যায় পড়ে যাবেন

আরো ভাল ভাবে বললে বলতে হয়, যে সমস্যায় পড়েছেন তা আরো বাড়বে। দেখা যাবে সোমেশ্বরী নদীতে তিনিই ঝাপ দিলেন।

বকুল কেমন আছ?

ভাল।

এখানে হাঁটাহাটি করা ঠিক না ঘরে এসো।

হাঁটাহাটি করা ঠিক না কেন? ভুত আছে?

ভুত না, সাপ আছে। পাহাড়ি জায়গায় সাপ খুব ভয়ংকর হয়।

ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। আপনি কেমন আছেন সেলিম ভাই?

ভাল।

আপনার অভিনয়তো শুনেছি খুব সুন্দর হচ্ছে।

সুন্দর-টুন্দর কিছু না। স্যার যা করতে বলছেন–করছি।

যা করতে বলছেন তা করতে পারছেন এটাই হল অভিনয়।

আমার কারণে ফরহাদ সাহেবের সঙ্গে স্যারের এমন ঝামেলা হল এই জন্যও খারাপ লাগছে।

খারাপ লাগার কিছু নেই। গন্ডগোল হবার কথা ছিল হয়েছে। সবই কপালের লিখন। কপালের লেখা বদলানো যায় না। মওলানা সাহেব বলেছেন। মওলানা মন্তাজ মাস্টার।

তার সঙ্গে তোমার মনে হয় খুব খাতির?

আমার সঙ্গে সবারই খুব খাতির। মওলানা সাহেবের সঙ্গে আমার খাতিরটা খুব কাজে লাগছে।

কী রকম?

ধর্মের অনেক ব্যাপার তার কাছ থেকে শিখছি— যেমন ধরুন আমরা যখন বেহেশতে যাব তখন আমাদের বয়স কত থাকবে বলুনতো।

যে যে বয়সে মারা গেছে সেই বয়স।

আপনি যে কী বলেন—যে মহিলা নব্বই বছর বয়সে মারা গেছেন তিনি বুঝি বেহেশতে থুড়থুড়ি বুড়ি হয়ে লাঠি হাতে ঘুরবেন? বেহেশতে সব মেয়ের বয়স হবে মোল। আমার এখন যে বয়স তারচে এক বছর কম।

তোমার বয়স সতেরো?

আশ্চর্য আপনারতো খুব বুদ্ধি। চট করে আমার বয়স বের করে ফেললেন। আচ্ছা এখন বলুন দেখি বেহেশতে সব মেয়েদের বয়স যদি মোল হয় তাহলে ছেলেদের বয়স কত হবে?

পঁচিশ।

কিছুই হয় নি। ছেলেদের বয়স হবে চল্লিশ।

মওলানা সাহেব তোমাকে বলেছেন?

হ্যাঁ তার কথা কী আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?

বিশ্বাস হবে না কেন? উনি তো আর না জেনে বলছেন না। জেনেশুনেই বলছেন।

আচ্ছা সেলিম ভাই ইংরেজি গান আপনার কেমন লাগে।

ইংরেজি গানতো বেশি শুনি না।

বেশি শোনেন না?

বেশি মানে কী—একেবারেই শুনি না।

হিন্দি পছন্দ করেন?

হ্যাঁ করি। হিন্দিতে সুন্দর সুন্দর গান আছে।

সব ভাষাতেই সুন্দর সুন্দর গান আছে। আচ্ছা শুনুন আমি এখন আপনাকে একটা ইংরেজি গান শুনাব আপনি শুনে বলবেন, কেমন লাগল।

তুমি ইংরেজি গান জান?

শুনলেই বুঝবেন জানি কি-না। গানের কথাগুলি আগে শুনে নিন তাহলে বেশি ভাল লাগবে—ব্যাপারটা হচ্ছে কী একজন যুবক। না না যুবক না— মধ্যবয়স্ক মানুষ ধরুন চল্লিশ বছর বয়স। সে জাহাজে করে দূর দেশে রওনা হয়েছে। কিন্তু তার মন পড়ে রয়েছে নিজের ছোট্ট শহরে—সে তার খুব আদরের একজনকে ফেলে এসেছে Kingstone শহরে—

I left a little girl in Kingstone town.

 

আমি গাইতে শুরু করেছি। জায়গাটা অন্ধকার। আকাশে প্রচুর মেঘ জমেছে বলে নক্ষত্রের আলোও নেই। সেলিম ভাইয়ের মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি তিনি হতভম্ব হয়ে গেছেন। সম্ভাবনা খুব বেশি যে তিনি তাঁর জীবনের স্মরণীয় ঘটনার মধ্যে আজকের রাতের এই ঘটনা স্থান দেবেন। আর দেয়াইতো উচিত। অন্ধকার রাত। তার পাশাপাশি সতেরো বছরের একজন তরুণী হাঁটছে। তরুণীর চুলের গন্ধ এসে লাগছে তার নাকে। তরুণী গান করছে কিন্নর কণ্ঠে।

আমি গান শেষ করলাম। সেলিম ভাই গান প্রসঙ্গে কোন কথা না বলে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ঘরে চল, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে।

আমি বললাম, পড়ুক। আপনি বরং ঘরে চলে যান। আমি একা একা বৃষ্টিতে ভিজব।

সেলিম ভাই আগের চেয়েও ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, তুমি কি এই গানটা আরেকবার গাইবে?

আমি বললাম, না।

বৃষ্টি বেশ ভালই নেমেছে। কিছুক্ষণ থাকলে ভিজে চুপসে যেতে হবে। মা খুব রাগ করবেন। আমি ঘরের দিকে রওনা হলাম। সেলিম ভাই কিন্তু উঠোনেই রইলেন। কে জানে তিনি হয়ত একা একা বৃষ্টিতে ভিজে দেখবেন ব্যাপারটা কী?

মাকে একগাদা কৈফিয়ত দিতে হবে। কী বলব ঠিক করা আছে। যা বলব সব সত্যি বলব। কিন্তু সেই সত্যের মাঝখানে ধুলির কণার মত একদানা মিথ্যা থাকবে। সত্য দিয়ে সেই মিথ্যা ঢাকা বলে মিথ্যাটা কারোর চোখ পড়বে না। মা জানতে চাইবেন, কোথায় ছিলি এতক্ষণ?

আমি বলব, সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে?

তার সঙ্গে কী?

আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলব, আমি তাকে গান শুনাচ্ছিলাম মা। উনি খুব গান পাগল মানুষ। উনিতো আগেই খানিকটা পাগল ছিলেন, গান শুনিয়ে আমি তাকে আরো পাগল করে দিয়েছি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখ—একা একা বৃষ্টিতে ভিজছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ