বকু তুই রোদে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

আমি পাশ ফিরে মাকে দেখলাম। মা কোন ফাঁকে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বিড়ালের চেয়েও নিঃশব্দে হাঁটতে পারেন। আশে পাশে কেউ নেই, আমি হয়ত নিজের মনে গল্পের বই পড়ছি। এক সময় হঠাৎ দেখব মায়ের মাথাটা আমার ঘাড়ের পাশে। তিনি আমাকে চমকে দিয়ে বলবেন, কী পড়ছিস? আমি যদি বলি গল্পের বই মা বলবেন, আজে বাজে গল্প নাতো? দেখি বইটা। মা বইটা হাতে নেবেন। বই এর নাম পড়বেন। নামের মধ্যে প্রেম ভালবাসা জাতীয় কিছু থাকলে তার ভুরু কুঁচকে যাবে। আমি যে পাতাটা পড়ছি সেই পাতাটা পড়ে দেখবেন। এই হচ্ছে আমার মা–সাবিহা বেগম। বয়স আটত্রিশ। সেই বয়স তিনি নানান ভাবে কমানোর চেষ্টা করছেন। মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। সেই ভাঁজ দূর করার অনেক চেষ্টা চলছে। তিনি কোত্থেকে একটা বই জোগাড় করেছেন। নজিবুর রহমান নামের এক ভদ্রলোকের লেখা—যৌবন ধরে রাখুন। সেই বই-এ মুখের চামড়ার ভাঁজ দূর করার যে সব প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করা আছে তার কিছু কিছু প্রয়োগ করছেন। তেমন লাভ হচ্ছে না। আমার ধারণা খানিকটা ক্ষতি হচ্ছে। মার চোখ দুটা ভিতরে ঢুকে চেহারায় খানিকটা ইঁদুর ভাব চলে এসেছে।

এখন বাজছে সকাল নটা এর মধ্যেই মা গোসল করে ফেলেছেন। চোখে কাজল দিয়েছেন। ম্যাচ করে শাড়ি ব্লাউজ পরেছেন। হাতে একটা ভ্যানিটি ব্যাগও অছে। সেই ব্যাগের রঙও শাড়ির রঙের সঙ্গে মেলানো সবুজ। মা বললেন, কিরে বন্ধু রোদে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

মার গলায় প্রবল উৎকণ্ঠা—যেন রোদে দাঁড়ানোর কারণে আমার শরীরে কিছুক্ষণের মধ্যে ফোসকা পড়ে যাবে। অথচ আমি মোটেই রোদে দাঁড়িয়ে নেই। আমি দাড়িয়ে আছি বিশাল একটা শিমুল গাছের নীচে। শিমুল গাছে কোন পাতা নেই— শুধুই থোকা থোকা ফুল। এমন কড়া লাল রঙ যে–তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মনে হয় গাছে আগুন ধরে গেছে। এই যে আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমার মনে হচ্ছে আমার মাথার উপর আগুন জ্বলছে। দাঁড়িয়ে থাকতেই ভাল লাগছে! গাছে হেলান দিতে পারলে আরো ভাল হত— কিন্তু হেলান দেবার উপায় নেই–গাছ ভর্তি বড় বড় কাটা। আমি মার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম। এই মিষ্টি হাসি হচ্ছে নকল মিষ্টি! অভিনয়ের মিষ্টি হাসি। আমি যখন তখন এই হাসি হাসতে পারি। মা আবারো বললেন, কিরে কথা বলছি জবাব দিচ্ছিস না কেন?

আমি বললাম, মা তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।

মা এই প্রশংসাতেও উললেন না। প্রায় ধমকের গলায় বললেন–শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

কারণ আছে বলেই দাঁড়িয়ে আছি।

কারণটা কী?

কারণটাতো মা তোমাকে বলা যাবে না।

ফাজলামি করবি না।

আমাকে ডিরেক্টর সাহেব থাকতে বলেছেন।

সঙ্গে সঙ্গে মার মুখে তৃপ্তির হাসি দেখা গেল। মা খুশি : ডিরেক্টর সাহেব থাকতে বললেতো থাকতেই হবে। এই মুহূর্তে তিনিই সব কিছু আমাদের সম্রাট। সম্রাটের প্রতিটি কথা পালন করতে হবে। তাকে খুশি রাখতে হবে। মার এখন প্রধান কাজ হয়ে দাড়িয়েছে সম্রাটকে খুশি রাখা। তার আশেপাশে থাকা। সম্রাটের সস্তা ধরনের রসিকতায় হা হা হি হি করে হাসা আমাদের এই সম্রাটের ধারণা তিনি খুব রসিক মানুষ। ডিরেক্টর সাহেবের নাম মঈন খান। বয়স ঠিক কত এখনো জানি না— চল্লিশের উপরতো বটেই। রোগা পাতলা মানুষ। ভদ্রলোকের মধ্যে একটা বহুরূপী ব্যাপার আছে। একেক দিন তাকে একেক রকম দেখা যায়। আমার মনে হয় ব্যাপারটা ঘটে তার চশমার কারণে। ভদ্রলোকের অনেকগুলি চশমা। একেক দিন একেক রকমের চশমা পরেন। চশমার সঙ্গে মিলিয়ে চুল আচড়ানোর মধ্যেও কিছু একটা নিশ্চয়ই করেন। তাঁর চেহারা পাল্টে যায়। চেহারার সঙ্গে সঙ্গে ভাবভঙ্গি পাল্টে যায়। আজ তিনি সোনালী ফ্রেমের চশমা পরেছেন।

মা বললেন, মঈন ভাই তোকে এখানে থাকতে বলেছেন?

হ্যাঁ।

কেন?

কাজ দেখতে বলেছেন।

তাতো বটেই–কাজ না দেখলে কাজ শিখবি কীভাবে?

মা লম্বা লম্বা পা ফেলে ডিরেক্টর সাহেবের দিকে এগুচ্ছেন। আমি শংকিত বোধ করছি। কারণ ডিরেক্টর সাহেব আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন নি। শিমুল গাছটা দেখে আমার এত ভাল লেগেছে যে আমি ইচ্ছা করে এখানে এসে নড়য়েছি। শুটিং এর কাজ হচ্ছে রাস্তার ঐ পাশে। নদশ বছরের একটা মেয়ে এবং চার পাঁচ বছরের একটা ছেলেকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে সেই সকাল থেকে। মেয়েটার পরণে ফ্রক। ছেলেটা সম্পূর্ণ নগ্ন। শুধু তার কোমরে কালো সুতা বাঁধা। সুতার সঙ্গে তিনটা শাদা কড়ি।

যে দৃশ্যটা এখন নেয়া হবে সেই দৃশ্যটা এরকম—এই দুই ভাই-বোন পানিতে ঝাপাঝাপি করছিল। হঠাৎ দেখতে পেল শহুরে কিছু মানুষ চারটা গরুর গাড়িতে করে যাচ্ছে। শহুরে মানুষদের গায়ে ঝলমলে পোষাক, তারা আনন্দ করতে করতে যাচ্ছে। এই দেখেই দুই ভাই-বোন পানি থেকে উঠে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়াবে। কৌতূহলী চোখে গরুর গাড়ির ভেতরের মানুষগুলিকে দেখতে চেষ্টা করবে। গরুর গাড়ির ভেতরে সাব্বির নামের এক ভদ্রলোক ক্যামেরায় তাদের ছবি তুলতে যাবেন—ওমি মেয়েটা হেসে ফেলবে, আর ছেলেটা দু হাতে তার নেংটো ঢেকে ফেলবে।

খুব সহজ দৃশ্য। অন্য কেউ হলে ফট করে নিয়ে নিত। কিন্তু আমাদের ডিরেক্টর সাহেব এই দৃশ্যটাকে যথেষ্ট জটিল করে ফেলেছেন। রাস্তার পাশে ট্রলী পেতেছেন। দৃশ্যটা নেয়া হবে ট্রলীতে। রিফ্লেক্টর বোর্ড হাতে তিনজন লাইটম্যান দাঁড়িয়ে আছে। এরা একটু পরপর ধমক খাচ্ছে। ট্রলীও বোধ হয় ঠিকমত বসছে না— ক্যামেরা কাঁপছে। কোদাল দিয়ে রাস্তাটা সমান করে ট্রলী বসানো হয়েছে। তারপরেও বোধ হয় রাস্তা সমান হয় নি! ডিরেক্টর সাহেবের কাছ থেকে ক্যামেরাম্যানও ছোট্ট একটা ধমক খেলেন।

বাচ্চা দুটি পুকুর থেকে উঠে এসেছে বলে তাদের গা ভেজা থাকার কথা। রোদে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের গা শুকিয়ে যাচ্ছে। তখন তাদের মাথায় বালতি ভর্তি পানি ঢালা হচ্ছে। এই কাজটিতে এরা দুজনই খুব মজা পাচ্ছে। মনে হচ্ছে তাদের জীবনে এমন আনন্দময় মুহূর্ত আর আসে নি।

আমি লক্ষ্য করলাম মা ছুটতে ছুটতে যাচ্ছেন। আমি মার মুখ দেখতে পাচ্ছি না–কিন্তু আমি জানি তার মুখ ভর্তি হাসি।

আজকের পরিস্থিতি মোটেই ভাল না। এখনো ক্যামেরা ওপেন হয় নি। এই অবস্থায় মা গিয়ে কী না কী বলবে কে জানে! তাদের কথাবার্তা এরকম হতে পারে। মা বলবেন, মঈন ভাই আমাদের কাজ কেমন হচ্ছে? (আপনার কাজ কেমন হচ্ছে, না-জিজ্ঞেস করে মা বলবেন—–আমাদের কাজ কেমন হচ্ছে। মা প্রমাণ করতে চাইবেন যে উনার কাজটাকে মা নিজের কাজ ভাবছেন।)

মঈন সাহেব মার কথার জবাবে কোন কথা বলবেন না, একটু হয়ত হাসবেন। মেজাজ ভাল থাকলে অবশ্যি মার সঙ্গে রসিকতা করে কিছু বলবেন। আজ মেজাজ ভাল নেই। মা তা ধরতে পারবেন না। কারণ মা অন্যের মেজাজ মর্জি কিচ্ছু বুঝতে পারেন না। নিজের মনে ছড়বড় করে কথা বলে যান।

আমার ধারণা মা এক পর্যায়ে বলবেন—মঈন ভাই, আমার মেয়ে আপনাকে কী চোখে যে দেখে–আপনি যা বলেন তাই তার কাছে একমাত্র সত্য? আপনি তাকে কাজ দেখতে বলেছেন–ঐ দেখুন সে রোদে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি তাকে ছায়ায় দাঁড়াতে বলুনতো। আপনি না বললে যাবে না। আশ্চর্য মেয়ে। কী সমস্যায় যে ভাই মেয়েটাকে নিয়ে আছি।

মঈন সাহেব তখন ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাবেন। কী হচ্ছে বুঝতে চেষ্টা করবেন। তিনি বলে ফেলতে পারেন–কই আপনার মেয়ের সঙ্গেতো আজ আমার কোন কথা হয় নি। তখন অবস্থাটা কী হবে! ডিরেক্টর সাহেবের কাছে মার ছুটে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে আমার কথা যাচাই করে নেয়া। মার স্বভাব হচ্ছে–যে যাই বলুক না যাচাই করে নেবেন।

মা কাউকেই বিশ্বাস করেন না। কোন ফেরেশতা এসে যদি মাকে বলে–আপা শুনুন, আপনার মেয়েকে দেখলাম একা একা রিকশায় করে নিউ মার্কেটে যাচ্ছে। মা সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, ও কী রঙের সালোয়ার পরেছে বলুনতো?

আমার খুব অস্বস্থি লাগছে। কী বিশ্রী ব্যাপার হল। ডিরেক্টর সাহেব যখন বিরক্ত গলায় বলবেন, কই আমিতো আপনার কন্যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলি নি। তখন কী হবে! তিনি হয়ত হাত উঁচিয়ে আমাকে ডাকবেন।

এত দূর থেকেও হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমার মা হেসে হেসে কী যেন বলছেন। মঈন সাহেব মায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন তার মুখে হাসি নেই, তবে বিরক্তিও নেই। শুধু পাপিয়া ম্যাডাম বিরক্ত মুখে তাকিয়ে আছেন। বেশির ভাগ সময়ই তিনি বিরক্ত হয়ে থাকেন।

পাপিয়া ম্যাডাম বসে আছেন মঈন সাহেবের পাশে। তাঁর হাতে বড় একটা গ্লাসে হলুদ রঙের কী একটা জিনিস। তিনি চুক চুক করে খাচ্ছেন। মার অকারণ হাসিতে সম্ভবত তার মাথা ধরে যাচ্ছে। পাপিয়া ম্যাডামের সব সময় মাথা ধরে থাকে।

পাপিয়া ম্যাডাম আমাদের এই ছবির নায়িকা। আমি এত সুন্দর মেয়ে আমার জীবনে দেখি নি। মোমের পুতুল বললেও কম বলা হবে। তার ঠোঁট সুন্দর, চোখ সুন্দর, নাক সুন্দর, দাঁত সুন্দর। লম্বা সিল্কি চুল যা দেখলেই হাত নিয়ে ছুঁতে ইচ্ছে করে। এবং কেঁচি দিয়ে এক গোছা চুল কেটে বাড়ির দেয়ালে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। তাকে দেখলে প্রথম যে কথাটা মনে হয় তা হচ্ছে——মানুষ এত সুন্দর হয় কী করে? হেলেন অব ট্রয় কিংবা ক্লিওপেট্রা এরা কি তার চেয়েও সুন্দর ছিল? মনে হয় না।

মা তর তর করে ছুটে আসছেন। তাঁর মুখ হাসি হাসি। মনে হচ্ছে জটিল কোন মিশন সম্পন্ন করে ফিরছেন। মিশনের ফলাফল তার পক্ষে।

বকু, তোকে বেলের সরবত দিয়েছে?

আমি কিছু বললাম না। মা হড়বড় করে বললেন, ইউনিটের সবাইকে বেলের সরবত দিয়েছে তোকে দিচ্ছে না কেন? তুইতো ফেলনা না, তুই এই ছবির দুই নম্বর নায়িকা।

মা চুপ করতো!

চুপ করব কেন? মঈন ভাইয়ের কানে আমি এক সময় কথাটা তুলব। সবাইকে সব কিছু সেধে সেধে দেয়া হয়–তোর বেলায় চেয়ে চেয়ে নিতে হয়। কেন তুই কি বন্যার জলে ভেসে এসেছিস? নাকি বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে আকাশ থেকে পড়েছিস?

উফ মা— চুপ কর।

সব সময় চুপ করে থাকলে হয় না। জায়গা মত কথা বলতে হয়। নিজের জিনিস আদায় করে নিতে হয়। বুদ্ধি খেলাতে হয়। তুই বুদ্ধি খেলাতে পারিস না। সবার মেয়ে হয় বুদ্ধিমতী, আর তুই হয়েছিস বোকামতী।

মা চলে যাচ্ছেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, তবে নিশ্চিত হতে পারলাম। মা সহজে কিছু ছেড়ে দেন না। বেলের সরবত প্রসঙ্গ এই খানেই চাপা পড়বে বলে মনে হয় না। যথাসময়ে ডিরেক্টর সাহেবের কানে উঠবে।

মার কথাগুলি মনে পড়ে এখন একটু হাসি পাচ্ছে— কেমন চোখ মুখ শক্ত করে বলছিলো–সব সময় চুপ করে থাকলে হয় না। জায়গা মত কথা বলতে হয়। নিজের জিনিস আদায় করে নিতে হয়। ভাবটা এ রকম যেন মা সব সময় নিজের জিনিস নিজে আদায় করে নিয়েছেন। আসলে তিনি কিছুই নিতে পারেন নি। বরং তার নিজের যা সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিতে হয়েছে।

আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন আমার বাবা আমাদেরকে ছেড়ে চলে যান। আমার বুদ্ধিমতী মা একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়েন। তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করেন নি–এরকম একটা ব্যাপার ঘটতে পারে। তিনি নানান ধরনের পাগলামী করার চেষ্টা করেন। গোলাপ গাছে স্প্রে করে দেয়ার যে বিষ ঘরে ছিল সেটা খাওয়ার চেষ্টা করেন, খানিকটা মুখে নিয়ে গু করে ফেলে দেন। এতেই তার মুখে ঘা-টা হয়ে একাকার। একবার পঞ্চাশটার মত ঘুমের অষুধ খান। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বমি হয়ে যাওয়ায় সেই অষুধে টানা আঠারো ঘন্টা ঘুম ছাড়া তার আর কিছুই হয় না। তারপর উঠে-পড়ে লাগেন, গুণ্ডা লাগিয়ে বাবাকে মারার ব্যবস্থা করবেন। সেই নিয়ে দিনরাত আমার সঙ্গে পরামর্শ— বুঝলি বকু এমন মারের ব্যবস্থা করব যে প্রাণে মরবে না তবে হাত পা ভেঙ্গে লুলা হয়ে বিছানায় পড়ে থাকবে। পিশাব পায়খানা বিছানায় করবে। আমাকে চিনে না? আমি তার বাপদাদা চৌদ্দগুষ্ঠির নাম ভুলিয়ে দেব। পাতলা পায়খানা করিয়ে ছাড়ব। কলসি ভর্তি ওরস্যালাইন খেয়েও কূল কিনারা পাবে না।

ভাড়াটে গুন্ডার পরিকল্পনা এক সময় বাতিল হয়— মা বিপুল উৎসাহে উকিলের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। দিনে উকিলের সঙ্গে কথা রাতে আমার সঙ্গে পরামর্শ বুঝলি বকু হুজুরকে আমি শ্রীঘরে নিয়ে ছাড়ব। আমার বিনা অনুমতিতে বিয়ে! সাত বৎসর শ্রীঘরে বসে ইট ভাঙ্গতে হবে। ইট ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে হাতে কড়া পড়ে যাবে। আমি সহজ জিনিস না। তুই শুধু দেখ— কী হয়।

শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। মা কাঁদতে কাঁদতে আগামসি লেনে তার বাবা-মার সঙ্গে থাকতে আসেন। আর আমার বাবা তার অফিস সেক্রেটারীকে বিয়ে করে ফেলেন। আমার ধারণা তাদের এখন বেশ সুখের সংসার। দুটা ছেলেমেয়ে আছে। বাবা থাকেন এলিফেন্ট রোড়ে একটা কেনা ফ্ল্যাটে। তাদের একটা মেরুন কালারের গাড়িও আছে। একদিন দেখি নতুন মা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। বাবা তার পাশে বসে হাসি হাসি মুখে কী যেন বলছেন। নতুন মার মুখেও হাসি। বাবা বেশ সুখেই আছেন। তবে মার ধারণা বাবা আছেন হাবিয়া দোজখে। কারণ যে মহিলাকে বিয়ে করেছেন—তিনি পর্বতের মত। বসলে উঠে দাঁড়াতে পারেন না। টেনে তুলতে হয়।

বুঝলি বকু, সারা গায়ে শুধু থলথলা চর্বি। পুতুল পুতুল দেখে তোর বাবা মজে গিয়ে বিয়ে করেছিল–সেই পুতুল এখন মৈনাক পর্বত। ট্রাকে তুললে ট্রাকের চাকার হাওয়া চলে যায় এই অবস্থা। আর মাগীর মেজাজ কী! সারাক্ষণ খ্যাক খ্যাক করে।

সবই মার বানানো কথা। মহিলা একটু মোটার দিকে। কিন্তু খুবই মায়াকাড়া চেহারা। মৃদুভাষি। কথা বলার সময় ঠোঁট টিপে টিপে হাসেন— দেখতে ভাল লাগে। আমার সঙ্গে তাঁর এই পর্যন্ত তিনবার দেখা হয়েছে। তিনবারই তিনি খুব ভদ্র ব্যবহার করেছেন। আমাদের এই দেখা হবার খবর জানেন না। খবর জানলে আবারো গোলাপ ফুলে দেয়ার কীটনাশক অষুধ খেয়ে ফেলতেন।

তবে এখন আর আমাদের গোলাপ গাছ নেই। এবং গাছে দেয়ার অষুধও নেই। নাজানের দোতলা বাড়ির একটা অংশে আমরা থাকি। দোতলার অর্ধেকটা এবং একতলার পুরোটা ভাড়া দেয়া হয়। এই ভাড়ার টাকায় আমাদের এবং আমার মামার সংসার চলে। মামার বয়স পঞ্চাশ-— এখনো বিয়ে করেন নি। আমার বুদ্ধি হবার পর থেকে শুনে আসছি তিনি বিয়ে করছেন। সব ঠিকঠাক। সেই বিয়ে এখনো হয় নি। এতে অবশ্যি আমার মা খুশি। কারণ বিয়ে কলেই দোতলার অর্ধেকটা আর ভাড়া দেয়া যাবে না। মামা সেখানে তাঁর সংসার পাতবেন। বাড়ি ভাড়া থেকে আয় অর্ধেক হয়ে যাবে। সংসারের খরচও যাবে বেড়ে। মামাকে তখন আর সামান্য হাত খরচ দিয়ে মানানো যাবে না। নিতেই মামা কিছুদিন পর পর গম্ভীর গলায় মাকে ডেকে বলেন–সাবিহা শোন তোর ভালর জন্যে বলছি। তোর মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। এখন দেখে নে একটা বিয়ে দিয়ে দে। তারপর তুই মেয়ে জামাইয়ের বাড়িতে উঠে যা। বরণ এই বাড়ি আমার। বাড়ি ভেঙ্গে আমি ফ্লাট বানাব। এক তলায় দোকান, উপরে ফ্লাট। মুফতে অনেক দিন থেকে গেলি। তোর কাছে থেকে এক পয়সা ড়ি ভাড়া নেই নি। আর কত? সারাজীবন তোদের পালব এমন কথাতো না। মতো আর হাজি মোহাম্মদ মোহসিন না। আমি হলাম গিয়ে পাজি মোহাম্মদ কাসেম।

নানাজানের এই বাড়ি যে শুধু মামার একার তা না। মার অবশ্যই তাতে অংশ আছে। মা মামার সঙ্গে ঐ লাইনে কোন কথা বলেন না। মা কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন-ভাইজান এই বাড়ি অবশ্যই আপনার। আপনি যেদিন বলবেন সেদিনই চলে যাব। আজ বললে আজ যাব। বিপদের সময় আপনি যে আমাকে থাকতে দিয়েছেন এই যথেষ্ট। আমার আর আমার মেয়ের চামড়া দিয়ে জুতা। নালেও আপনার ঋণ শোধ হবে না ভাইজান। ……

বলতে বলতে মার গলা ধরে যেত, তিনি বাক্য শেষ করতে না পেরে কেঁদে অস্থির হতেন। এতেই আমার কাসেম মামা বিচলিত হয়ে বলতেন—আরে কী শুরু করলি? তোদের আমি ফেলে দেব নাকি? আমার একটা বিচার আছে না? আমিতো নর-পিশাচ না। আমি নর-মানব। আমি যতদিন থাকব তোরাও থাকবি। চোখ মুছ।

চোখ মোছার বদলে মা আরো ব্যাকুল হয়ে কেঁদে উঠতেন। মামা হতেন চেলিত আমি আমার মায়ের অভিনয় প্রতিভায় হতাম মুগ্ধ।

মা অবশ্যই বুদ্ধিমতী। বাবার চলে যাওয়াকে এক সময় তিনি সহজ ভাবে নিয়ে নিলেন এবং বাস্তব স্বীকার করে বাঁচার চেষ্টা চালালেন। বাবার কাছে কান্নাকাটি করে তিনি মাসিক একটা বরাদ্দের ব্যবস্থা করলেন। এ ছাড়াও প্রায়ই বকুলের শরীর খারাপ চিকিৎসা করাতে হবে, বকুলের কলেজে ভর্তি হবার খরচ, এইসব বলে বলে টাকা আদায় করতে লাগলেন। সেই টাকার একটা পয়সাও খরচ করলেন না। ব্যাংকে জমা করতে লাগলেন। বাড়ি ভাড়া বাবদ যে টাকা পেতেন তার পুরোটাও মা খরচ করতেন না। একটা অংশ ব্যাংকে জমা করতেন। ছোটাছুটি করার ব্যাপারে মা একজন এক্সপার্ট। নিজের জীবনের দুঃখের কাহিনী বলার ব্যাপারেও এক্সপার্ট। স্কুলে আমাকে কখনো বেতন দিতে হয় নি। ফ্রী শিপের জন্যে মা দরখাস্ত করতেন। যেখানে লেখা থাকত–

আমি স্বামী পরিত্যক্ত একজন মহিলা বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছি। আমার বর্তমানে কোন সহায় সম্বল নাই, আশ্রয় নাই। দুইবেলা অন্ন সংস্থানের পথ নাই। আমি তারপরও মানুষের মত বেঁচে থাকতে চাই। তার পরেও আমি আমার কন্যা মালিহা রুমালীকে (বকুল) সুশিক্ষিত করতে চাই। আমার এই কন্যা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে তৃতীয় স্থান দখল করেছিল। অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষায় সে মেধা তালিকায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে চতুর্থ হয়েছিল। আপনার দয়ার উপর আমি নির্ভর করছি। এই কঠিন জীবন সংগ্রামে আপনি আমাকে সাহায্য করুন। মালিহা রুমালীর বৃত্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের খবর পত্রিকায় ছাপা হয়। আপনার অবগতির জন্যে পেপার কার্টিং এর ফটোকপি পাঠাইলাম।

বিনীতা
মালিহা রুমালীর দুর্ভাগা মাতা
সাবিহা বেগম মুক্তা।

মার এই জাতীয় দরখাস্তে কাজ হত। তিনি নানান ধরনের মহিলা সমিতিতেও ঘুরতেন। এক মহিলা সমিতি তাঁকে পায়ে চালানো একটি সেলাই মেশিন দিয়েছিল। তিনি মেশিন বিক্রি করে সেই টাকাও ব্যাংকে জমা করে রেখেছিলেন। এক এনজিওর কাছ থেকে তিনি আমার জন্যে একটা বৃত্তিও জোগাড় করেন। মাসে পাঁচশ টাকা। এই টাকা নেবার জন্যে প্রতি মাসের তিন তারিখে আমাকে মার সঙ্গে এনজিওর অফিসে যেতে হত এবং দীর্ঘ সময় করুণ মুখ করে একটা ঘরে বসে গরমে ঘামতে হত। সেই ঘরে ফ্যান ছিল, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার বনবন করে ফ্যান ঘুরলেও সেই ফ্যানে কোন বাতাস হত না।

মার ভিক্ষাবৃত্তিমূলক কর্মকান্ড শুরুতে অসহ্য লাগলেও শেষে সয়ে গিয়েছিল। মানুষের দয়া এবং করুণা পাবার নিত্য নতুন কলাকৌশল মা আবিষ্কার করতেন–আমি সে সব দেখতাম, এবং অবাক হতাম। মার কারণেই আমি প্রথম টিভি নাটকে সুযোগ পেলাম। নাটকের প্রযোজকের বাসার ঠিকানা বের করে তিনি একদিন আমাকে নিয়ে তাঁর বাসায় উপস্থিত। প্রযোজকের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে তিনি নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলতে বলতে যে কান্না শুরু করলেন—সেই কান্নায় পাথর গলে প্রযোজকের স্ত্রীতো গলবেনই। ভদ্রমহিলাও চোখ মুছতে লাগলেন। সেই মহিলার কল্যাণে আমি জীবনে প্রথম ক্যামেরার সামনে নড়ালাম। নাটকের নাম স্বপ্ন সায়র। স্বপ্ন সায়র নাটকে আমার অভিনয় নিশ্চয়ই খুব ভাল হয়েছিল— কারণ আমার মাকে তারপর আর কখনো কোন প্রযোজকের বাসায় গিয়ে তাদের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে হয় নি। বছরের শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী হিসেবে আমি দুবার রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেলাম। আমাদের বসার ঘরে দুটা ছবি বড় করে বাঁধাই করা আছে। একটাতে আমি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেবের হাত থেকে পদক নিচ্ছি, অন্যটায় প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেবের হাত থেকে পদক নিচ্ছি। এরশাদ সাহেবের একটা হাত আমার মাথায় রাখা। মা আমাকে গান শেখার ব্যবস্থা করলেন, নাচ শেখার ব্যবস্থা করলেন, সবই বিনা পয়সায়। একজন স্বামী পরিত্যক্তা আশ্রয়হীনা মহিলার প্রতি দয়া বশতই গানের এবং নাচের টিচার রাজি হলেন।

 

সোহরাব চাচা আমার দিকে আসছেন। তার হাতে বড় একটা কাচের গ্লাস। সোহরাব চাচা হচ্ছেন কথাকলি ফিল্মসের প্রডাকশন ম্যানেজার। রোগা টিং টিং-এ একজন মানুষ। সব সময় হলুদ পাঞ্জাবি পরেন এবং ক্রমাগত পান খান। ভাত খাবার আগেও তাঁর মুখ ভর্তি পান থাকে। ভাতের নলা মাখার সময় থু করে পান ফেলে কুলি করে নেন। অসাধারণ একজন মানুষ। মাছির যেমন হাজার হাজার চোখ থাকে তারও তেমনি হাজার হাজার চোখ। চারপাশে কোথায় কী হচ্ছে তিনি সব জানেন। সমস্যা, তা যত জটিলই হোক— তাঁর কাছে সমাধান আছে। সমস্যার সমাধান তিনি এমন ভাবে করেন যে কেউ বুঝতেই পারে না—সমাধানটা তিনি করেছেন। রাগ বলে কোন বস্তু তার ভেতর নেই। চব্বিশ ঘন্টা কাজ করতে পারেন। তবে কাজের ফাঁকে গল্প করতেও খুব পছন্দ করেন। বিশেষ বিশেষ মানুষের সঙ্গে যে গল্প করেন তা না— সবার সঙ্গে গল্প। যার সঙ্গে গল্প করেন মনে হয় সেই তার প্রাণের বন্ধু, তিনি আমাকে ডাকেন রুমাল।

রুমালের খবর কী?

খবর ভাল। আপনি কেমন আছেন চাচা?

আমি খুবই ভাল আছি— এই নাও তোমার বেলের সরবত।

বেলের সরবততে আমি খাব না।

সেকি তোমার মা যে বলল তুমি বেলের সরবত খেতে চাচ্ছ?

চাচ্ছি না।

আচ্ছা না চাইলেও খেয়ে ফেল। জিনিসটা ভাল। আরেকটা কথা শোন—যদি কিছু খেতে ইচ্ছে করে আমাকে বলবে! পুরোদস্তুর নায়িকা যখন হবে তখন আর বলতে হবে না। আপনাতেই সব হয়ে যাবে।

চাচা আমি কি নায়িকা হতে পারব?

সেটা আমি বলতে পারব না। অভিনয় প্রতিভা কার কেমন তা জানি না, বুঝিও না। আমি হলাম যোগানদার। যার যা লাগবে—আমাকে বলবে আমি উপস্থিত করব।

আপনাকে যা আনতে বলা হবে নিয়ে আসবেন?

তুমি বললে আনব না। তবে ডিরেক্টর সাহেব বললে জোগাড় করব।

উনি যা বলবেন তাই এনে দেবেন?

এনে দেব। ফিল্ম লাইনের প্রডাকশন ম্যানেজার হতে হলে চাহিবা মাত্র উপস্থিত বিদ্যায় পারদর্শী হতে হয়। তবে শোন মিস রুমাল— উদ্ভট কিছু কোন ডিরেক্টর চায় না। ডিরেক্টরও জানে কী জোগাড় করা যাবে কী যাবে না।

মঈন সাহেবকে আপনি খুব পছন্দ করেন তাই না চাচা?

হ্যাঁ।

কেন করেন?

তুমি যে কারণে কর–আমিও সেই কারণে করি।

কই আমিতো পছন্দ করি না।

পছন্দ না করাই ভাল। বেলের সরবতটা কেমন লাগলগো মা?

ভাল।

রেসিপি লাগবে? রেসিপি লাগলে বল–আমি রেসিপি দিয়ে দিচ্ছি। কাগজে লেখা আছে। এই নাও।

আমি অবাক হয়ে দেখি সত্যি একটা কাগজে-বেলের সরবতের রেসিপি লেখা। সোহরাব চাচার হাত থেকে আমি কাগজটা নিলাম—

বেলের সরবত

পাকা বেল ১টি

ঠাণ্ডা পানি ৩ কাপ

দৈ ১/২ কাপ

চিনি ১ কাপ

গোলাপজল ১ টেবিল চামচ

১. বেলের আঠা ও বীচি ফেলে ১ কাপ পানিতে ভেজাতে হবে মোটা চালুনীতে ছেঁকে নিতে হবে।

২. চালবার পর ১ কাপ চিনি মেশাতে হবে।

৩. দৈ ফেটে মেশাতে হবে। গোলাপ জল এবং বরফের কুচি দিয়ে পরিবেশন করতে হবে। চিনির বদলে ক্যারামেল সিরাপ দেয়া যেতে পারে।

 

আমি বললাম, চাচা আপনি রেসিপি নিয়ে ঘুরছেন কেন?

সোহরাব চাচা গলার স্বর নিচু করে বললেন, পাপিয়া ম্যাডামের জন্যে। ম্যাডামের এই সরবত এত পছন্দ হয়েছে যে রেসিপি চেয়েছেন। রেসিপি যখন লিখতেই হচ্ছে কার্বন পেপার দিয়ে তিন কপি করে ফেললাম–ছোট নায়িকা হিসেবে তুমি এক কপি রেখে দাও।

থ্যাংক য়্যু।

সোহরাব চাচা চলে গেলেন। এতক্ষণে শুটিং শুরু হল। তিনটা টেক নেয়া হল। টেক মনে হয় ভাল হয়েছে। ডিরেক্টর সাহেবকে খুশি খুশি দেখাচ্ছে। তিনি সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিচ্ছেন। আনন্দের সময় তিনি ফস করে সিগারেট ধরান–লম্বা লম্বা কয়েকটা টান দিয়ে জ্বলন্ত সিগারেট দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেন। সেই সিগারেট কুড়িয়ে তুলে নেবার ব্যাপারে সমবেত জনতার মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ দেখা যায়। এখানেও তাই হচ্ছে।

মুখভর্তি চাপদাড়ির মওলানা ধরনের একজন মানুষ আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম।

ভদ্রলোকের কাধে চাদর। পাঞ্জাবি নেমে এসেছে পায়ের পাতা পর্যন্ত। পাঞ্জাবির উপর খোপখোপ প্রিন্টের চাদর গা থেকে আতরের গন্ধ ভেসে আসছে। ভদ্রলোকের দিকে ভাল মত তাকালে দেখা যাবে চোখে সুরমাও দিয়েছেন। আমি ভাল মত তাকালাম না। এই জাতীয় মানুষরা কঠিন প্রকৃতির হয়ে থাকেন। শুটিং নিয়ে অকারণ হৈ চৈ শুরু করে দিতে পারেন। হয়ত বলে বসবেন আজ জুম্মাবার—আজ এইসব কী হচ্ছে? ঢাকার আশে পাশের মানুষ শুটিং-এ অভ্যস্ত। জায়গাটা ঢাকা থেকে অনেক দূরে। ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনা। সেখান থেকে দুর্গাপুর। দুর্গাপুর থেকে আরো তিন কিলোমিটার। জায়গাটার নাম চন্ডিগড়। কে জানে হয়ত চন্ডিগড়ের মানুষরা খুব ধর্মভীরু।

এত জায়গা থাকতে চন্ডিগড়ে শুটিং হচ্ছে। কারণ চিত্রনাট্য এই ভাবে লেখা। ঢাকা থেকে গারো পাহাড়ের দেশ দুর্গাপুরে বেড়াতে এসেছে একটা পরিবার, রিটায়ার্ড পুলিশের বড় কর্তা এবং তাঁর দুই মেয়ে দিলশাদ ও নিশাত। ছুটি কাটানোর গল্প। তারা উঠল একটা ডাক বাংলোয় অনেক মজা করল। আমি হচ্ছি ছোট বোন দিলু।

মওলানা সাহেব বিনীত গলায় বললেন, আসসালামু আলায়কুম।

আমি খুবই অস্বস্থিতে পড়ে গেলাম। বয়স্ক কোন ভদ্রলোক আগ বাড়িয়ে সালাম দিলে খুব অস্বস্থি লাগে। আমি লজ্জিত গলায় বললাম, ওয়ালাইকুম সালাম।

শুটিং হচ্ছে নাকি মা?

জ্বি।

দাঁড়ায়ে যদি দেখি কোন অসুবিধা আছে?

জ্বি না।

কেউ কিছু বলবে নাতো?

জি না।

আপনি কি শুটিং এর মেয়ে?

জ্বি।

শুটিং এর কথা শুধু শুনেছি। দেখার সৌভাগ্য হয় নাই।

আজ দেখুন।

রাংতা লাগানো বোর্ডের মত জিনিসগুলি কী?

এদেরকে বলে রিফ্লেক্টর। আয়নার মত। গায়ের উপর আলো ফেলে।

বাহ্‌ চমৎকার। লাল সার্ট পরা ভদ্রলোক কে?

উনি মঈন খান এই ছবির পরিচালক। ছবিটা উনি বানাচ্ছেন।

আলহামদুলিল্লাহ। উনার সঙ্গে কি কথা বলা যাবে?

কেন যাবে না–অবশ্যই যাবে। তবে এখন কাজ করছেনতো এখন বিরক্ত ন করাই ভাল।

জি আচ্ছা। জ্বি আচ্ছা। বিরক্ত করব না। মঈন সাহেবের স্ত্রী মাশাল্লাহ দেখতে খুব সুন্দর।

উনি ডিরেক্টর সাহেবের স্ত্রী না। উনার নাম পাপিয়া —এই ছবির নায়িকা। খুব বড় অভিনেত্রী।

ভদ্রলোকের ভুরু কুঁচকে গেল। পাপিয়া ম্যাডাম যেভাবে বসেছেন তাতে যে কোন মানুষেরই ভুরু কুঁচকাবার কথা। দুটা চেয়ার গায়ে গায়ে লেগে আছে। পাপিয়া ম্যাডাম ভঁর বাঁ হাত পাশের চেয়ারের হাতলে তুলে দিয়েছেন। দূর থেকে মনে হয় তিনি ডিরেক্টর সাহেবের কাধে হাত রেখে বসে আছেন।

কড়া রোদ উঠেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ। সকালবেলা ঠান্ডা থাকে। কুয়াশা কুয়াশা ভাব থাকে। এগারোটার দিকে ঝাঁঝালো রোদ উঠে যায়। এমন রোদ যে চোখ জ্বালা করতে থাকে।

মা শুটিং কি শেষ হয়ে গেছে?

জ্বি না— আজ সারাদিনই শুটিং হবে।

ঐ যন্ত্রটা কী?

এর নাম ক্রেন ট্ৰলী। ক্যামেরা ক্রেন ট্রলীতে বসিয়ে উপুর নিচ করা হয়। আপনি দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুটিং দেখুন আমি চলে যাচ্ছি।

আমি চন্ডিগড় হাইস্কুলের শিক্ষক—ইসলামিয়াত পড়াই।

ও আচ্ছা। খুব ভাল।

আমিও চলে যাব—আজ জুম্মাবার নামাজ আছে। আমার নাম মেরাজ উল্লাহ্। লোকে অবশ্য মেরাজ মাস্টার ডাকে। আমি আরো কিছুক্ষণ দেখি— আযান হয় বারোটার সময়। বারোটা বাজতে এখনো দেরি আছে।

আপনার যতক্ষণ ইচ্ছা দেখুন।

মা আপনার নামটা জানা হয় নাই।

আমার নাম বকুল।

মাশাল্লাহ অতি সুন্দর নাম।

আমি জায়গা ছেড়ে চলে এলাম—মেরাজ মাস্টার সাহেব আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে গভীর আগ্রহে চারপাশের কর্মকান্ড দেখছেন। আজ আমার কোন সিকোয়েন্স হবে না। সাব্বিরের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করবেন তিনি এসে পৌছান নি, তাঁর গতকালই এসে পৌঁছানোর কথা। তাঁকে ছাড়া শুটিং শুরু করা যাচ্ছে না। ভদ্রলোক সবাইকে খুব বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন। তবে ডিরেক্টর সাহেবের মধ্যে এ নিয়ে কোন দুঃশ্চিন্তা লক্ষ্য করছি না। কোন কিছু নিয়েই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ না হবার ক্ষমতা এই মানুষটার আছে। কেমন গা এলিয়ে সিগারেট টানছেন যেন মনে হচ্ছে তিনিই রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছুটি কাটাতে স্বয়ং দুর্গাপুরের পাহাড়ে এসেছেন। ছুটি শুরু হয়েছে।

পাপিয়া ম্যাডামের দিকে চোখ পড়তেই দেখি তিনি হাত উঁচিয়ে আমাকে ডাকছেন। আমি চাপা অস্বস্তি নিয়ে এগুচ্ছি। এই মহিলার সামনে কেন জানি আমি কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারি না। পাপিয়া ম্যাডাম গলায় লাল পাথরের নেকলেস পরেছেন। শিমুল ফুলের মত পাথরগুলিও জ্বলছে। তার চোখে এখন সানগ্লাস। কিছুক্ষণ আগেও সানগ্লাস ছিল না। তাঁকেতো সারাক্ষণই লক্ষ্য করছি। কোন ফাঁকে সানগ্লাস পরে ফেললেন? পাপিয়া ম্যাডামের সামনে দাঁড়ানোর পর আমার প্রথম যে ইচ্ছাটা হল তা হচ্ছে আমি অবিকল উনার মত একটা লাল পাথর বসানো নেকলেস কিনব।

পাপিয়া ম্যাডাম শান্ত গলায় বললেন, বকুল তুমি ঐ মওলানার সঙ্গে গুটগুট করে কী কথা বলছিলে?।

কী হচ্ছে না হচ্ছে উনি জানতে চাচ্ছিলেন।

পাবলিকের সঙ্গে কোন রকম মেলামেশা করবে না। সে যদি কিছু জানতে চায়— ইউনিটের সঙ্গে কথা বলবে। তোমার কভু ফড় করে এত কথা বলার দরকার কী? আমি তোমার ভালর জন্যেই বলছি।

জ্বি আচ্ছা। তু

মি আমার উপর রাগ করছ নাতো?

জি না।

শো বিজনেসে যারা থাকে তাদের সবার উচিত মানুষজনের কাছ থেকে একটু দূরে থাকা। লোকজন আসবে নানান কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করবে। তুমি খোলা মনে উত্তর দেবে–তারপর সেগুলি ফুলিয়ে ফাপিয়ে অন্যদের বলবে। মওলানা সাহেবকে আমার খুব কনসপিকিউয়াস মনে হচ্ছে। মওলানা মানুষ তিনি থাকবেন মসজিদে, শুটিং স্পটে কেন?

মঈন সাহেব হাসি মুখে বললেন— মানুষের স্বাভাবিক কৌতূহল। বেচারা মওলানা বলে তার কৌতূহল থাকবে না?

পাপিয়া ম্যাডাম খুব ঝাঝের সঙ্গে বললেন, প্লীজ দয়া করে তুমি আল্লাদী ধরনের কথা বলবে না। মওলানাকে বেচারা বলছ কেন? বেচারার ডেফিনেশন কী?

মঈন সাহেব বেচারার ডেফিনেশন শুরু করলেন–আর আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবলাম ব্যাপারটা কী, পাপিয়া ম্যাডাম ইনাকে তুমি তুমি করে বলছেন কেন?

কে ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে যতবার কথা বলতে শুনেছি ততবারই আপনি বলতে শুনেছি। আজ হঠাৎ তুমি কেন?

পাপিয়া শোন, বেচারা মানে হচ্ছে নেই-চারা। বে হল নেই, কাজেই বে চারা—নেই চারা। চারা হল চারাগাছ। অর্থাৎ যার শিকর আছে। গাছ নেই মানে শিকড়ও নেই। কাজেই বেচারার অর্থ দাঁড়াচ্ছে–শিকড়হীন মানুষ।

পাপিয়া ম্যাডাম কঠিন গলায় বললেন, মঈন ভাই শুনুন। যা কিছু একটা জিক দাঁড়া করালেইতো হয় না। লজিক ব্যাপারটাকে আপনি খেলো করে লেছেন।

তাই কি?

হ্যাঁ তাই। আমি আপনার লজিক লজিক খেলা দেখতে দেখতে ক্লান্ত। এবার ক্ষান্ত দিন। অনেকতো হল।

তুমি দেখি সত্যি সত্যি রাগ করছ——শোন পাপিয়া আমি আসলে রসিকতা ছিলাম। তুমি মনে হচ্ছে আজকাল রসিকতাও নিতে পারছ না। তোমার কি রীর খারাপ?

হ্যাঁ আমার শরীর খারাপ।

পাপিয়া শোন, তুমি একটা কাজ কর— নার্ভ রিলাক্স করে এ জাতীয় দুটা ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে থাক। বিশ্রাম নাও। আজ তোমার কোন শট হবে না।

পাপিয়া ম্যাডাম সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। দুজনের কথা কাটাকাটির মধ্যে পড়ে আমি খুবই বিব্রত বোধ করছি। পাপিয়া ম্যাডাম এখন অবশ্যি ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে আপনি আপনি করেই কথা বলছেন। মনে হয় উনার শরীর আসলেই ভাল না। কখন আপনি বলছেন, কখন তুমি বলছেন বুঝতে পারছেন না। উনি দ্রুত পা ফেলে এগুচ্ছেন আমি যাচ্ছি তার পেছনে পেছনে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে উনি এখনই বলবেন— এই মেয়ে তুমি আমার পেছনে পেছনে অসছ কেন? আমি কেন উনার পেছনে পেছনে যাচ্ছি তাও বুঝতে পারছি না। রেগে যাওয়া মানুষের সঙ্গে থাকতে নেই। রেগে যাওয়া মানুষ তার রাগ চারদিকে হড়িয়ে দেয়। আমি জানি কিছুক্ষণের মধ্যেই উনার রাগের খানিকটা আমার উপর এসে পড়বে। বকুল।

জি।

তোমার মা তোমাকে বকু ডাকে কেন?

আদর করে ডাকেন। বকুল থেকে বকু।

এইসব আদর ভাল না। তুমি শো বিজনেসের মেয়ে। তোমার নাম লোকের মুখে মুখে ফিরবে—এইখানে বকু আবার কী? তা ছাড়া বকুল নামটাওতো ভাল। শো বিজনেসে নাম হবে ফ্লাওয়ারী। বকুল ফুলের নাম হলেও ফ্লাওয়ারী নাম। তোমার আর কোন নাম নেই?।

আমার ভাল নাম–মালিহা রুমালী।

রুমালী নামটাতো বেশ ইন্টারেস্টিং। তবে মালিহা না। মা দিয়ে যে সব নাম শুরু তার কোনটাই আমার ভাল লাগে না। সেইসব নামে মা মা গন্ধ থাকে। শো বিজনেসের মেয়ের নামে মা মা গন্ধ থাকা ঠিক না। রুমালী নামটা অবশ্যি ভাল।

রুমালী নাম আমার বাবা রেখেছিলেন।

ভাল কথা মনে করেছ। তোমার বাবা প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। কথাটা তোমার বাবা প্রসঙ্গে না–তোমার মা প্রসঙ্গে। তুমি বাবার কথা বলায় মনে পড়ল।

বলুন।

তোমার মা সবচে অপছন্দের কাজ যেটা করেন সেটা হচ্ছে দুঃখের কাদুনী শুরু করেন। তোমার মার কাছ থেকে এই পর্যন্ত তিনবার আমি শুনেছি–তোমার বাবা তোমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তোমরা কী ভয়ঙ্কর কষ্টের মধ্যে পড়েছিলে, খেয়ে না খেয়ে ছিলে। সবাইকে এইসব বলে বেড়ানোর অর্থ কী? এটাতো কোন আনন্দের ঘটনা না যে পৃথিবী শুদ্ধ সবাইকে জানাতে হবে? সহানুভূতি পাবার জন্যে বলা? সহানুভূতির দরকার কী? আর শোন রুমালী, মানুষ সহানুভূতির বস্তা খুলে বসে নি যে দুঃখের কঁদুনি শুনলেই সহানুভূতির বস্তা থেকে পাঁচ কেজি সহানুভূতি দিয়ে দেবে। সহানুভূতি হচ্ছে——খুবই ফাইনার ফিলিংস। একমাত্র মহাপুরুষদের মধ্যেই এই ফিলিংস আছে। বুঝতে পারছ কী বলছি?

জ্বি।

তুমি কি তোমার মাকে খুব পছন্দ কর?

জ্বি।

তোমাকে জরুরি একটা কথা বলি— কাউকে খুব বেশি পছন্দ করবে না। খুব বেশি পছন্দ করলে কী হয় জান?

জ্বি না।

খুব বেশি পছন্দ যাকে করবে সে তোমাকে গ্রাস করে ফেলবে। কখন যে গ্রাস করবে তুমি বুঝতেই পারবে না। মানুষের মধ্যে আছে ঝিনুক স্বভাব। ঝিনুক ক করে? মুখ খুলে হা করে থাকে। ধরা যাক তুমি কোন একটা ঝিনুককে খুব বেশি পছন্দ করে ফেললে–তুমি তখন করবে কী, তার পেটের ভেতর গিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়বে। ওন্নি ঝিনুক তার ডালা বন্ধ করে ফেলবে। সেই ডালা খুলে তুমি আর কখনো বের হতে পারবে না। চির জীবনের জন্যে ঝিনুকের ভেতর আটকা পড়ে যাবে। তুমি কি আমার কথায় রাগ করছ?

জ্বি না।

শোন রুমালী আমি কথা খুব কম বলি। আবার মাঝে মাঝে যখন মেজাজ খারাপ হয় তখন প্রচুর কথা বলি। প্রচুর কথা বলায় আমার নিজের লাভের মধ্যে লাভ এই হয়— যার সঙ্গে কথা বলি সে যায় রেগে।

আমি রাগি নি, রাগ করার মত কোন কথা আপনি বলেন নি।

এখন বলব–কথাটা হচ্ছে–তুমি আমার পেছনে পেছনে ঘুর ঘুর করবে। বড় জাহাজের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছোট্ট একটা নৌকা থাকে। জাহাজ যেখানে যায় নৌকা জাহাজের পেছনে পেছনে সেখানে যায়। এই নৌকাকে বলে গাধাবোট। আমি জাহাজ কি না জানি না, কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি— আমার সঙ্গে সব সময় চার পাঁচটা গাধাবোট থাকে। গাধাবোট আমার কাছে অসহ্য লাগে।

আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাপিয়া ম্যাডাম এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর শেষ কথাগুলিতে আমি কী রকম কষ্ট পেলাম তা দেখার জন্যেও একবার পেছনে ফিরলেন না। মজার ব্যাপার হল আমি একেবারেই কষ্ট পাই নি। বরং আমার একটু হাসি পাচ্ছে। কাউকে কষ্ট দেব এটা আগে ভাগে ঠিক করে কেউ যখন কিছু করে তখন আর কষ্ট লাগে না! আরেকটা ব্যাপার হতে পারে মার সঙ্গে থেকে থেকে আমার গায়ের চামড়াও হয়ত খানিকটা শক্ত হয়েছে।

বকুল শুনে যাও।

আমি পেছন ফিরলাম। ডিরেক্টর সাহেব আমাকে ডাকছেন। তিনি বেশ আয়েশ করে বসেছেন। পাপিয়া ম্যাডাম যে চেয়ারে বসেছিলেন সেই চেয়ারে পা তুলে দিয়েছেন। এতক্ষণ চোখে সানগ্লাস ছিল না, এখন চোখে সানগ্লাস। পাপিয়া ম্যাডামের ফেলে যাওয়া সানগ্লাসটাই তার চোখে। তার মুখ আকাশের দিকে ফেরানো। গা এলানো গা এলানো ভাব।

ক্রেন ট্রলীতে কোন একটা সমস্যা হচ্ছে। ট্রলী খোলা হচ্ছে। মনে হয় সমস্যা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত শুটিং শুরু হবে না।

আমি ডিরেক্টর সাহেবের পাশে এসে দাঁড়াতেই তিনি চেয়ার থেকে পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, বোস। আমি বসলাম।

তুমি কেমন আছ?

জি ভাল।

চন্ডিগড় জায়গাটা সুন্দর না?

জ্বি।

আমার কাছে তত সুন্দর লাগছে না। আমার মনে হচ্ছে আউটডোর বান্দরবানে ফেললে ভাল হত। তুমি বান্দরবানে কখনো গিয়েছ?

জ্বি না।

খুব সুন্দর। একটা পাহাড়ি নদী আছে। নদীর নাম–শংখ নদী। খুব সুন্দর।

ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে আমার ভাল লাগছে না। কারণ তিনি সানগ্লাস পরে আছেন। সানগ্লাস পরা মানুষ কোন দিকে তাকিয়ে আছে তা বোঝা যায় না বলে কথা বলে ভাল লাগে না। তা ছাড়া ডিরেক্টর সাহেবও আমার সঙ্গে দায়সারা ভাবে কথা বলছেন। এই মুহুর্তে তাঁর কিছু করার নেই বলেই কথা বলে সময় কাটানো। কথা বলার জন্যে তার সবসময় কাউকে না কাউকে দরকার। পাপিয়া ম্যাডাম নেই কাজেই আমাকে দরকার। আমি না থাকলে তিনি অন্য কাউকে ডেকে নিতেন। ফিল আপ দ্যা ব্ল্যাংক। শূন্যস্থান পূরণ।

বকুল!

জ্বি।

দেখি একটা প্রশ্নের জবাব দাও–তোমার বুদ্ধি কেমন পরীক্ষা করা যাক। ব্যাপারটা হচ্ছে কী–তিনটা পিঁপড়া সারি বেঁধে যাচ্ছে। একজনের পেছনে একজন। সবার প্রথম যে পিঁপড়াটা যাচ্ছে সে বলল, আমার পেছনে আছে দুটা পিঁপড়া। মাঝখানের পিঁপড়াটা বলল, আমার সামনে আছে একটা পিঁপড়া, পেছনে আছে একটা পিঁপড়া। মজার ব্যাপার হচ্ছে সবচে পেছনে যে পিঁপড়াটা যাচ্ছে সে বলল–আমার সামনে কোন পিঁপড়া নেই, আমার পেছনে আছে দুটা পিঁপড়া। সে এ রকম বলছে কেন?

আমি চুপ করে রইলাম। এই ধাঁধার উত্তর আমি জানি। এর উত্তর হচ্ছে–সবচে পেছনের পিঁপড়াটা চালবাজ এবং মিথ্যুক। সে মিথ্যা কথা বলছে। কেউ যদি ধাঁধা জিজ্ঞেস করে তার মনে মনে আশা থাকে ধাঁধার জবাব কেউ পারবে। যদি কেউ পেরে যায় তাহলে প্রশ্নকর্তার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি ডিরেক্টর সাহেবের মন খারাপ করতে চাইলাম না। আমি এমন ভাব করলাম যে, আঁধার জবাব আমার জানা নেই। আমি আকাশ পাতাল ভাবছি। ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছি না।

পারছ না?

পারব। আমার একটু সময় লাগবে।

কোন অসুবিধা নেই। সময় নাও। যত ইচ্ছা সময় নাও।

আচ্ছা পিঁপড়া তিনটা কি আসলেই একটার পর একটা যাচ্ছিল?

অবশ্যই।

এরা হঠাৎ উল্টো দিকে চলা শুরু করে নিতো?

না।

আমি পারছি না।

পারছ না? খুব সহজ, শেষের পিঁপড়াটা দারুণ মিথ্যুক। সে মিথ্যা কথা বলছিল। মানুষের মধ্যে যেমন মিথ্যুক আছে পিঁপড়াদের মধ্যেও আছে। হা হা হা।

ডিরেক্টর সাহেব উচ্চ স্বরে হাসতে লাগলেন। উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখে পানি এসে গেল। হঠাৎ করেই এসে গেল। উনি ভাবলেন—ধাঁধার জবাব দিতে না পারার কারণে লজ্জায় এবং অপমানে আমার চোখে পানি এসেছে। তিনি খুবই অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।

আরে বোকা মেয়ে কাঁদছ কেন? এটা একটা ফালতু ধরনের ধাঁধা। তোমাকে জিজ্ঞেস করাই ভুল হয়েছে। আচ্ছা যাও প্রতিজ্ঞা করছি—এই জীবনে তোমাকে আর ধাঁধা জিজ্ঞেস করব না। প্লীজ চোখ মোছ।

আমি উড়নায় চোখ মুছলাম।

যাও রেস্ট হাউসে চলে যাও। বিশ্রাম কর। গল্পের বই-টই পড়। আজ তোমার কোন কাজ হবে না। আর শোন মেয়ে একটা কথা বলি——কিছু না পারলেই কেঁদে ফেলতে হবে এটা ঠিক না। তুমি তোমার এক জীবনে দেখবে অনেক কিছুই পারছ না। প্রতিবারই যদি কাঁদতে থাক তাহলে তোমার জীবন যাবে কাঁদতে কাঁদতে। এটা ঠিক না।

আমি চলে যাচ্ছি। ডিরেক্টর সাহেব এখন যদি আমাকে দেখতেন——তাহলে অবাক হতেন। আমার চোখ শুকনা এবং ঠোঁটে হাসি। বিষাদের হাসি না, আনন্দের হাসি। হঠাৎ এত আনন্দ হচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না। আমার নিজের অনেক কিছুই আমি এখন বুঝতে পারি না। শিমুল গাছের নীচে আমি দীর্ঘসময় দাঁড়িয়েছিলাম। কেন দাঁড়িয়েছিলাম? শুটিং দেখার জন্যে? কাজ শেখার জন্যে?, তা না। আমি দাঁড়িয়েছিলাম যাতে ডিরেক্টর সাহেবকে দেখতে পাই। এই মানুষটাকে আমার এক মুহূর্তের জন্যে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে করে না। তাঁর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই আমার চোখে পানি আসে। এর মানেই বা কী? ভয়ংকর একটা ঘটনা আমার ভেতর ঘটে গেছে। কেন ঘটল, কীভাবে ঘটল, আমি জানি না। আমার জানতে ইচ্ছে করে না। এই ভদ্রলোক আজ যদি আমাকে ডেকে বলেন—বকুল শোন, তুমি একটা কাজ কর। আমি একটা মৃত্যু দৃশ্যের শট নেব। তুমি ঐ যে পাহাড়টা দেখা যায়–পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ঝাপ দিয়ে নীচে পড়।

আমি তখনই তা করব। কেন করব কী জন্যে করব তা আমি জানি না। কিন্তু আমি অবশ্যই করব। আমি আবার হাসলাম। আমি জানি হাসলে আমাকে খুব সুন্দর দেখায়। আমি কি কখনো আমার হাসি উনাকে দেখাতে পারব? না পারব না। কারণ আমি তাকে কিছু দেখাতে চাই না। আমি কাউকেই কিছু দেখাতে চাই না। নিজেকেও না। আমি নিজেকে নিজের কাছে আড়াল করে রাখতে চাই।

রোদ আরো বেড়েছে। চারদিক ঝকঝক করছে। গল্প উপন্যাসে মাটির গন্ধের কথা পড়েছি। এখন আমি মাটির গন্ধ পাচ্ছি। কড়া গন্ধ। এই গন্ধে ঝিম ধরানো ভাব থাকে। কিছু গন্ধ থাকে যা গায়ে মাখতে ইচ্ছা করে। মাটির গন্ধ হল সে রকম গন্ধ। ফুলের গন্ধ গায়ে মাখতে ইচ্ছা করে না। সুন্দর কোন কৌটায় জমিয়ে রাখতে ইচ্ছা করে।

আমি এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছি। আমার মা বোধ হয় এখনো জানেন না যে আমি রোদের মধ্যে হাঁটছি। জানতে পেলে ছুটে আসতেন। গ্রামে আমার এই প্রথম আসা। যা দেখছি তাই ভাল লাগছে। মুগ্ধ হয়ে একটা বরই গাছের সামনে দাঁড়ালাম। বরই গাছতো কতই দেখেছি। বরই গাছ দেখে কখনো মুগ্ধ হই নি। এই গাছ দেখে মুগ্ধ হচ্ছি কারণ পুরো গাছ সোনালী রঙের চাদর দিয়ে ঢাকা। খুব সরু সোনালী লতা গাছটাকে ঢেকে ফেলেছে। রোদের আলোয় ঝলমল করছে। ক্যামেরা সঙ্গে থাকলে ছবি তুলতাম। ক্যামেরা সঙ্গে নেই–মার ব্যাগে আছে। ছোট্ট ভিভিটার ক্যামেরা হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে রাখা যায়। ছোট্ট হলেও দামী–খুব ভাল ছবি ওঠে।

এই ক্যামেরাও মার উপার্জন। তিনি একদিন বাবার কাছে গিয়ে বললেন— পরশু তোমার মেয়ের জন্মদিন। সে ষোল বছরে পড়ল। এই মেয়েতো পথে ফেলে দেয়া মেয়ে। তার জন্মদিনে তুমি আসবে এটা আমরা ভাবি না—তোমাকে আসতেও বলব না। তোমার মেয়ে তোমার কাছে একটা উপহার চেয়েছে তাকে তুমি একটা দামী ক্যামেরা দেবে। অটোমেটিক ক্যামেরা। তোমার কাছেতো হয়ে মুখ ফুটে কোনদিন কিছু চায় নি,–এই প্রথম চাচ্ছে। তুমি কিনে এনে খবে আমি কাল এসে নিয়ে যাব। বায়তুল মোকাররমের দোকানে পাওয়া যায়, দেখে শুনে কিনবে— সেকেন্ড হ্যান্ড যেন না হয়। সিঙ্গাপুর মেড না, জাপান মেড।

বাবা ক্যামেরা কিনে দিলেন। মা ঝলমল মুখে ক্যামেরা নিয়ে এলেন।

আমি মাকে বললাম, ক্যামেরা ভিক্ষা চাইতে তোমার লজ্জা লাগল না মা?

মা বিস্মিত হয়ে বললেন, লজ্জা লাগবে কেন? তুই তার মেয়ে না? নাকি আমি অন্য মানুষের সঙ্গে শুয়ে শুয়ে তোকে পেটে এনেছি।

ছিঃ মা এইসব কী ধরনের কথা?

তুই যে ধরনের কথা বলিস তার উত্তরে এইসব কথাই বলতে হয়। আমাদের যা দরকার আমরা আদায় করে নেব। ছলে বলে কৌশলে যে ভাবে পরি আদায় করব।

এই ক্যামেরা আমি নেব না মা।

নিতে না চাইলে নিবি না। আমার কাছে থাকবে। তোর নাটক-টাটকের রেকর্ডিং যখন হবে তখন এই ক্যামেরায় আমি তোর ছবি তুলব।

এই ক্যামেরায় আমি কোনদিন আমার ছবি তুলতে দেব না।

না দিলে না দিবি।

মা খুব আনন্দিত। আমার কঠিন কথাতেও তার আনন্দের কোন কমতি হল। তিনি হাসি মুখে ক্যামেরা গুছিয়ে রাখলেন। বুঝতে পারছি জিনিসটা তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে। আমার যখন কোন রেকর্ডিং থাকে— মা হাসিমুখে ক্যামেরা নিয়ে উপস্থিত হন। আশে পাশে কে আছে না আছে কোন খেয়াল না করে বলেন–দেখি বকু, আমার দিকে তাকা। মুখটা হাসি হাসি কর। ওমা ঠোঁটটা আরেকটু ফাঁক কর— এত অল্প ফাঁক না। দেখি চুলগুলি সামনে এনে দে না। উঁহু ডান দিকে না, বাম দিকে। মুখটা একটু উঁচু কর। চোখে আলো পড়ছে না, চোখ অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। হয়েছে—এখন বল চীজ।

আমি বলি—চীজ।

মানুষ যদি ঝিনুকের মত হয় তাহলে আমি মায়ের ঝিনুকের ভেতর বসে আছি। মা ডালা বন্ধ করে রেখেছেন। ডালাবন্ধ ঝিনুকের ভেতরের গরমে আমার অসহ্য বোধ হলেও আমিতো জানি মা ভালবাসার রসে ডুবিয়ে ডুবিয়ে আমাকে মুক্তা বানানোর চেষ্টা করছেন। পরিপূর্ণ মুক্তা হবার পর ঝিনুক কী করে? ডালা খুলে মুক্তা উগরে ফেলে দেয়? না-কি চিরজীবন বুকের ভেতর ধরে রাখে?

কী দেখছেন?

আমি চমকে তাকিয়ে দেখি সেলিম ভাই। আমাকে প্রশ্নটা করে তিনি নিজেই যেন লজ্জায় মরে যাচ্ছেন। সেলিম ভাই আমাদের ইউনিটের সঙ্গে আছেন। তাঁর কাজটা কী এখনো জানি না। তিনি অভিনেতাদের কেউ না। কারণ তিনি শিল্পীদের সঙ্গে থাকেন না, বা শিল্পীদের সঙ্গে খেতেও বসেন না। তিনি থাকেন ইউনিটের লোকদের সঙ্গে। খাওয়া দাওয়াও তাদের সঙ্গে করেন। তবে ইউনিটের কোন কাজ করেন না। খুবই বিব্রত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ান। যেন সিনেমার দলের সঙ্গে ঢুকে পড়ে খুব লজ্জায় পড়েছেন। আমি সেলিম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললাম, বরই গাছটা কেমন সোনালী চাদর গায়ে দিয়ে জড়সড় হয়ে আছে তাই দেখছি। খুব সুন্দর না?

জ্বি সুন্দর। এই লতাটার নাম স্বর্ণলতা।

আপনি কি খুব গাছ গাছড়া চেনেন?

গ্রামের ছেলেতো—গাছ চিনব না কেন?

আপনি গ্রামের ছেলে?

জি। স্কুল কলেজ সবই গ্রামে। গ্রাম থেকেই বি.এ. পাস করেছি।

এখন কী করছেন?

কিছু করছি না। এম.এ. পড়ার শখ ছিল। টাকা পয়সা নেই। বি.এ. পরীক্ষার রেজাল্টও ভাল হয় নি। এই রেজাল্টে এম.এ. ক্লাসে ভর্তি হওয়াও সমস্যা।

আপনার রেজাল্ট কী?

সেকেন্ড ক্লাস তাও খুব নীচের দিকে। থার্ড ক্লাস হতে হতে হয় নি।

সিনেমার দলের সঙ্গে ঘুরছেন কেন?

আমি মঈন স্যারের কাছে গিয়েছিলাম একটা চাকরির জন্য। উনি বিখ্যাত মানুষ-উনার কত জানাশুনা, উনি একটু বলে দিলেই আমার একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। এই আশায় যাওয়া। উনি বললেন আমার সঙ্গে দুর্গাপুরে চল। চলে এসেছি।

ভাল করেছেন।

না, খুব ভাল করি নি। এক কাপড়ে চলে এসেছি।

এক কাপড়ে এলেন কেন?

স্যারকে চাকরির কথা বলতেই উনি বললেন, চল আমার সঙ্গে দুর্গাপুরে। আমি বললাম, জ্বি আচ্ছা। এই বলেই স্যার ঘর থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠলেন। উনি যে তখনই দুর্গাপুর যাচ্ছেন তাতো আমি জানি না। উনি জীপে উঠলেন, জীপের পেছনে ইউনিটের বাস। আমি বাসে উঠলাম।

দুর্গাপুরে পৌঁছে উনি আপনাকে কিছু বলেন নি?

জ্বি-না। আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে উনি বোধ হয় আমার কথা ভুলেই গেছেন। আমাকে হয়ত ইউনিটের কেউ ভাবছেন। আমি যে নিজ থেকে তাকে কিছু বলব সেই সাহসও আমার নেই। আমি উনাকে খুবই ভয় পাই।

সবাই ভয় পায়। আমিও ভয় পাই। আচ্ছা আপনিতো গাছ পালা খুব চেনেন। এই গাছগুলির নাম কী? সাদা সাদা ফুল।

এই গাছের নাম দলকলস। ফুলে খুব মধু হয়। বাচ্চারা ফুল ছিড়ে ছিড়ে মধু খায়।

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি। খেয়ে দেখুন।

সেলিম ভাই ফুল তুলে দিলেন। ঠোঁটে লাগিয়ে কীভাবে টানতে হয় দেখিয়ে দিলেন। আমি টান দিতেই সত্যি সত্যি মুখের ভেতর মধু চলে গেল। হালকা মিষ্টি মধু। আশ্চর্যতো।

আরো মধু খাবেন? ফুল তুলে দেব?

দিন।

সেলিম ভাই ফুল তুলছেন। আমি মুখে দিচ্ছি, টেনে টেনে মধু নিয়ে ফুল ফেলে দিচ্ছি আমার খুবই মজা লাগছে।

বকু! এই বকু!

আমি তাকিয়ে দেখি মা ছুটতে ছুটতে আসছেন। সেলিম ভাই এর সঙ্গে আমাকে দেখে মার নিশ্চয়ই আত্মা কেঁপে গেছে। তিনি যে ভাবে ছুটছেন তা দেখে যে কেউ বলবে এই মাত্র তিনি কোন ভয়াবহ দুঃসংবাদ শুনেছেন। আমার হঠাৎ কেন জানি ইচ্ছে হল মাকে আরো ঘাবড়ে দি। সেলিম ভাইকে কী বলব, সেলিম ভাই কিছু মনে করবেন না—আপনি ত্রিশ সেকেন্ডের জন্যে আমার হাতটা একটু ধরুন তো। হাতটা ধরবেন এবং হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবেন—আর কিছু লাগবে না। বললাম না, কারণ এই ঘটনায় মা যতটা না ঘাবড়াবেন তারচে বেশি ঘাবড়াবেন সেলিম ভাই।

থাক দরকার নেই। আমি মার দিকে তাকিয়ে আছি তিনি উন্মাদিনীর মতই ছুটে আসছেন। তিনি তাঁর ঝিনুক-কন্যাকে পেটের ভেতর ঢুকিয়ে ডালা বন্ধ করে দেবেন। অনেকক্ষণ ধরে মেয়ে ঝিনুকের বাইরে। আর সময় দেয়া যায় না।

আমি মার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। সেলিম ভাই বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। দলকলস গাছের নামটা বলার জন্যে তাকে একটা ধন্যবাদ দেয়া উচিত। ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করছে না।

মা ডাঙ্গায় তোলা মাছের মত খাবি খাওয়ার মত করছেন। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছেন। ছুটে আসার ধকল কাটাচ্ছেন। তার শরীরের অবস্থা যা ছোটাছুটি কমিয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু মা সহজ স্বাভাবিক ভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারেন না–তকে কিশোরী মেয়েদের মত ছুটে যেতে হবে এবং ফলস্বরূপ অনেকক্ষণ ধরে খাবি খেতে হবে।

বকু পানি খাব।

এইখানে পানি কোথায় পাবে? তুমি অলিম্পিকের দৌড় দিলে ব্যাপার কী মা? আচ্ছা থাক এখনি জবাব দিতে হবে না। তুমি সুস্থ হয়ে নাও। বসবে? ঘাসের উপর বসে পড়। শাড়ি নষ্ট হলে হবে।

মা ঘাসের উপর বসে পড়লেন। আমি অপেক্ষা করছি কখন তিনি স্বাভাবিক হবেন।

দারুণ এক ঘটনা বকু।

দারুণ ঘটনা শুনব, তোমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হোক।

ঘটনা শুনলাম, আমার কাছে তেমন দারুণ কিছু মনে হল না। চন্ডিগড় গ্রামে হাফিজ আলি বলে এক যুবক আছে তার স্ত্রীর না-কি অদ্ভুত ক্ষমতা। যাকে যা বলে তাই হয়। সবাই এই মেয়েকে খুব মানে। মা বৌটির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। দেখা করে সেখান থেকেই দৌড়তে দৌড়াতে আসছেন।

মা তোমার ধারণা বৌটার সত্যি সত্যি আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে?

অবশ্যই আছে।

তোমাকে দেখে সে কী ভবিষ্যত্বাণী করল? ফড়ফড় করে কি বলে দিল—একদিন আপনার কন্যা বাংলাদেশের এক নম্বর নায়িকা হবে? তার এসি লাগানো গাড়ি থাকবে। গুলশানে বাড়ি থাকবে। বাড়িতে সুইমিং পুল থাকবে। সেই সুইমিং পুলে তুমি তোমার মেয়েকে নিয়ে সাঁতার কাটবে।

সব কিছু নিয়ে ঠাট্টা করিস না বকু। বৌটার ক্ষমতা আসলেই অস্বাভাবিক। আমি ওদের বাড়িতে গেলাম। বৌটা দরজা ধরে দাঁড়াল।

দেখতে কেমন মা?

দেখতে খারাপ না। সুন্দরই আছে। বয়স কমতো। কম বয়সের যে সৌন্দর্য সেই সৌন্দর্য।

তোমাকে কী বলল?

আমাকে দেখেই বলল, আপনার স্বামী দূর দেশে থাকেন। চিন্তা করবেন না উনি ফিরে আসবেন।

ভূয়া কথা। তোমার স্বামী দূর দেশে থাকে না, ঢাকা শহরেই থাকে, এবং সেই স্বামী কখনো ফিরে আসবে না।

তুই সব জেনে ফেলেছিস এই ভাবটা দূর করতো। এই দুনিয়ার তুই কিছুই জানিস না।

যা জেনেছি তাই আমার জন্যে যথেষ্ট। আর জানতে চাই না।

তুই আমার সঙ্গে চলতো বকুল। বৌটার কাছে তোকে নিয়ে যাই। দেখি বৌটা তোকে দেখে কী বলে।

আমি এইসব বিশ্বাস করি না মা। আমি মরে গেলেও ঐ মহিলা পীরের কাছে যাব না।

পীর না। খুব সাধারণ মেয়ে তবে খুব ক্ষমতা কার মনের ভেতর কী আছে সব বলে দিতে পারে।

তাহলেতো আরো যাব না। আমার মনের ভেতর ভয়ংকর সব জিনিস আছে। এইসব জেনে ফেললে অসুবিধা আছে।

তোর মনের ভেতর কী আছে?

তোমাকেতো মা আমি বলব না। আর যদি মনের ভুলে কোনদিন বলে ফেলি তুমি গলা টিপে আমাকে মেরে ফেলবে। আমি এখনি মরতে চাই না। আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই : মা দেখ দেখ জীবন বাবুর চিল। আকাশে উড়ছে।

জীবন বাবুর চিল মানে?

কবি জীবনানন্দ দাশের চিল—সোনালী ডানার চিল। কী অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুরপাক খাচ্ছে দেখেছ মা?

তুই আমার সঙ্গে বৌটার কাছে যাবি না?

না। এবং আমার একটা উপদেশ শোন মা, তুমিও যেও না। আগে ভাগে ভবিষ্যৎ জানা খুবই ভয়ংকর ব্যাপার।

ভয়ংকর ব্যাপার কেন?

তুমি বাবার সঙ্গে সুন্দর কিছু সময় কাটিয়েছ না? তুমি যদি গোড়া থেকেই জানতে একদিন বাবা তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে তাহলে কি এত সুন্দর সময় কাটাতে পারতে?

তুই বেশি জ্ঞানী হয়ে যাচ্ছিস বকু। এত জ্ঞানী হওয়া ভাল না।

আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশে জীবনবাবুর চিল উড়ছে। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে চিলগুলি। হায় চিল, সোনালী ডানার চিল। এই ভিজে মেঘের দুপুরে……।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ