বন এন্টারপ্রাইজেসের অফিস ঘরে বাবু এবং নাসিমকে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। সেখানে ঘটাং টাং শব্দ হচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার। নাসিম একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছে। সস্থা সিগারেট। উৎকট গন্ধ। দুজনকেই খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। চিন্তাগ্রস্ত হবার সংগত কারণ আছে। তারা একটা ভাল সাপ্লাইয়ের কাজ পেয়েছিল। মতিঝিলের এক বড় অফিসে কাগজ, পেনসিল, ফাইল, আইকা গাম সাপ্লাই। অফিসের একশ দশজন কর্মচারীর জন্যে সাবান, গামছা, গ্লাস, কুড়িটা। সেক্রেটারিয়েট টেবিল, চল্লিশটা বেতের চেয়ার। তিনটা দশ ফুট বাই বার ফুট কামার জন্যে জুট কাপেট। সবই দেয়া শুয়েছে। বিল পাস হচ্ছে না। আত্ব হবে, কাল হবে বলে তারা এক মাস পার করেছে। শেষব্বার বলে দিয়েছিল, বুধবার সকাল এগারটায় আসতে। আজ বুধবার। তারা দুজনই গিয়েছিল। বিল যার পাস করার কথা–রহমান সাহেব, তাদের দুঘণ্টা বসিয়ে রাখলেন। একটার সময় ডেকে পাঠালেন। শীতল গলায় বললেন–এখন লাঞ্চ টাইম। বেশি কথা বলতে পারব না। বিল তো আপনারা পাবেন না।

নাসিম হতভম্ব হয়ে বলল, কেন?

জিনিস ঠিকমত দেন নি। লো কোয়ালিটি জিনিস দিয়েছেন।

সব জিনিস তো স্যরি আপনাদের দেখিয়ে–আপনাদের এখোলে নিয়ে তারপর ডেলিভারি দিয়েছি।

তা দিয়েছেন, তবে যে জিনিস দেখিয়েছেন সেই জিনিস দেন নি। দিয়েছেন রদ্দি মাল।

বাবু বলল, স্যার আপনার কথা ঠিক না। যা দেখিয়েছি তাই দিয়েছি। বিশ্বাস করুন, কোন উনিশ-বিশ হয় নি।

আপনি বললে তো হবে না–মিষ্টির ব্যাপারে ময়রার কথা গ্রাহ্য না। আমাদের নিজস্ব টিম ইনকোয়ারি করেছে। তারা বলেছে–লো কোয়ালিটি।

তার মানে কি এই যে আমরা বিল পাব না?

না। সেক্রেটারিয়েট টেবিল আর চেয়ার রিজেক্টেড হয়েছে। যেগুলি দিয়েছেন ফেরত নেবেন, নতুন করে দেবেন। তারপর দেখা যাবে।

বাবু বলল, আমাদের এটা তো স্যার খুব ছোট ফার্ম। আমাদের অর্থবল নেই বললেই হয়…

আমাকে এসব বলে লাভ নেই। আমি আমার ডিসিশান জানিয়ে দিলাম। কাল ট্রাক নিয়ে এসে ফার্নিচার তুলে নিয়ে যাবেন। আমি আলসারের রোগী। আমাকে টাইমলি খেতে হয়। আপনারা এখন দয়া করে যান, আমি খেতে বসব।

আমরা স্যার বাইরে অপেক্ষা করি।

অপেক্ষা করে লাভ কিছু নেই। যা বলার বলে দিয়েছি।

আমাদের কিছু বলার ছিল স্যার।

আমার মনে হয় না আপনাদের কিছু বলার আছে। তারপরেও যদি কিছু বলার থাকে, আমার পি, একে বলুন।

বাবু এবং নাসিম মুখ শুকনো করে বের হয়ে এল। এই কাজটা এরা খুব আশা নিয়ে করেছিল। তারা যা চেয়েছে তাই দিয়েছে। বড় কাজ, ঠিকমত করলে পরে আরো কাজ পাওয়া যাবে। দুজনই পরিশ্রমের চূড়ান্ত করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে সবই জলে গেছে। সমস্যাটা কি বোঝা যাচ্ছে না। ভদ্রলোক কি তাদের কাছ থেকে ঘুষ চাচ্ছেন? তাও তো মনে হচ্ছে না। কাজ দেবার সময় তিনি হাসিমুখে বলেছেন–আপনারা দুই ইয়াং ম্যান, ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে ব্যবসায় নেমেছেন দেখে ভাল লাগছে। আপনারা লোয়েস্ট টেণ্ডার দিয়েছেন। লোয়েস্ট টেণ্ডারে কাজ দিতে হবে এমন কোন কথা নেই। তবু আপনাদের দিচ্ছি। আমি চাই শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা বিজনেসে আসুক। আপনারা সৎভাবে কাজ করবেন, আমি আপনাদের ব্যাক করব। কেউ যদি টাকা-পয়সা চায়–চট করে দেবেন না। আমাকে প্রথমে জানাবেন।

নাসিম হাত কচলাতে কচলাতে বলেছে, আপনার কথা শুনে বড় ভাল লাগছে স্যার। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করার কথা যা বললেন–সেটা অর্ধেক সত্যি। বাবু এম. এ. পাস করেছে। আমার বিদ্যা স্যার আই. এ. পর্যন্ত। থার্ড ডিভিশন পেয়েছিলাম–ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারি নি। আপনি স্যার আমাদের উপর একটু দোয়া রাখবেন।

নাসিম এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলেছে, এবং গদগদ গলায় বলেছে–আপনি স্যার বলতে গেলে আমাদের ফাদারের মত। আমাদের দুজনেরই ফাদার। নেই।

ঠিক আছে। ঠিক আছে। তোমরা অনেস্টলি কাজ কর, আমি দেখব।

সেই একই ভদ্রলোক আজ উল্টো কথা কেন বলছেন বাবু বা নাসিম দুজনের কারো মাথাতেই তা আসছে না। এতদিন তুমি তুমি করে বলেছেন, আজ বলছেন আপনি করে। মানেটা কি?

সূর্যের চেয়ে বালি সব সময়ই বেশি গরম হয়। অফিসারের চেয়ে পি,এর দাপট থাকে বেশি। রহমান সাহেবের পি.এর বেলায় এই থিওরি খাটল না। ভদ্রলোক হাসি-খুশি। নিজেই এদের দুজনকে ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়ালেন।

নাসিম বলল, ব্যাপারটা কি ভাই সাহেব বলুন তো। আমরা কি ভুল করেছি?

ভুল কিছু করেন নি।

তাহলে? বিল না পেলে বিশ্বাস করুন ভাই আমার অফিসে যে সিলিং ফ্যান আছে ঐটাতে ঝুলতে হবে। বোনের গয়না বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করেছি। সে দিতে চায় নি। বলতে গেলে জোর করে নিয়েছি। দুলাভাই কিছু জানে না। জানতে পারলে বোনকে সেফটি পিন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁটিয়ে মারবে। সমস্যাটা কোথায় আপনি আমাকে বলুন তো।

হাজার পঞ্চাশেক টাকা জোগাড় করতে পারবেন?

হাজার পঞ্চাশেক টাকা তো আমাদের লাভ হবে না। সব খরচ টরচ বাদ দিয়ে তেতাল্লিশ হাজার টাকা লাভ হবে। এর মধ্যে সুদের টাকা দিতে হবে আঠাশ হাজার।

এইসব আমাকে শুনায়ে কোন লাভ নেই রে ভাই। পঞ্চাশ হাজার টাকা, জোগাড় করুন। ব্যবস্থা হবে।

বাবু হতভম্ভ গলায় বলল, কে নেবে এই টাকা?

আপনার তো সেটা দিয়ে দরকার নাই।

আমাদের রক্ত পানিকরা টাকা কে নেবে এটা জানা আমাদের দরকার নেই? কি বলছেন আপনি?

আপনারা এই লাইনে খুবই নতুন। টাকাটা কে নেবে বুঝতে পারছেন না কেন? আপনাদের সঙ্গে কে কথা বলছে–আমি। আমি কার লোক? রহমান সাহেবের লোক। কে আপনাদের আমার সঙ্গে কথা বলতে বলল? রহমান সাহেব বললেন। এখন কিছু বুঝতে পারছেন?

না, এখনো বুঝতে পারছি না।

কেউ এখানে টেডার দেয় না। কেন দেয় না বুঝতে পারছেন না। এখানে টেন্ডার দিয়ে কেউ লাভ করতে পারে না। সব ঠিকঠাক মত চলে–শেষটায় ধরা খায়। হা হা হা।

আপনি হাসছেন? হাসি আসছে আপনার?

আপনাদের দুজনের বেকুবি দেখে হাসছি।

নাসিম সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, টাকাটা দিতে হবে? সিস্টেমটা কি?

সিস্টেম খুব সোজা। একটা ঠিকানা দেব–ঐ ঠিকানায় একটা রঙ্গিন টিভি চব্বিশ ইঞ্চি সনি, আর একটা ন্যাশনাল কোম্পানির G-10 ভিসিআর দিয়ে আসবেন। স্যারের মেজো মেয়ের বাসা। যেদিন দিবেন তার পরের দিন বিলে সই হবে। দেব ঠিকানা?

দিন।

ঠিকানা ভদ্রলোকের পকেটে লেখাই ছিল। তিনি ঠিকানা বের করে দিতে দিতে বললেন–এর পরেও আপনাদের হাজার পঁচিশেক টাকা লাভ থাকবে। কথা ছিল সেগুন কাঠ দিয়ে সেক্রেটারিয়েট টেবিল বানাবেন। বানিয়েছেন কড়ই কাঠে। কড়ই কাঠের সিএফটি হল তিনশ দশ। আর সেগুন এগার শ।

বাবু বলল, কড়ই কাঠের টেবিল বানানো হয় নি। সেগুন কাঠ দেয়া হয়েছে। আমি নিজে কাঠ কিনে মিস্ত্রিকে দিয়েছি।

বিশ্বাস করলাম। কাঠ আপনি সেগুন ঠিকই কিনেছেন। মিস্ত্রি দিয়েছে কড়ই, রঙ করে দিয়েছে। আপনাদের একটা উপদেশ দেই। শুনে রাখেন–এই লাইনে আপনাদের কিছু হবে না। অন্য কিছু করুন।

অন্য কিছু কি করব?

আপনারাই চিন্তাভাবনা করে বের করুন। আপনাদের বয়স কম, চিন্তাশক্তি বেশি। চা খাবেন আরেক কাপ? খান। গরম গরম সিঙারা ভাজা হয়েছে। সিঙারা খেতে পারেন। বলব সিঙারার কথা?

না থাক। অনেক মেহেরবানী করেছেন। আর না। আমরা এখন উঠব।

তারা ফিরে এসেছে অফিসে। দুজন চুপচাপ বসে আছে। অসহ্য গরম। মাথার উপর ফ্যান আছে। ফ্যান ছাড়ার কথা কারোরই মনে আসে নি। বাবু বলল, কি করবি নাসিম?

জানি না। বিষটি খাওয়া যায়। ঐ লাইনেই চিন্তা করছি।

রহমান সাহেবের মেয়েটার সঙ্গে দেখা করলে কেমন হয়?

খালি হাতে দেখা করবি?

হুঁ। এ ছাড়া উপায় কি? দেখা করে আমাদের অবস্থাটা বুঝিয়ে বলব।

এটা মন্দ না। প্রয়োজন দেখলে আমি পা জড়িয়ে ধরব। বিষ খাওয়ার চেয়ে পায়ে ধরা সহজ। বড়লোকের মেয়ে। পা মাখনের মত নরম হবার কথা। ধরলে আরাম লাগবে।

নাসিম নড়েচড়ে বসল। বাবু বলল, সত্যি যাওয়ার কথা ভাবছিস?

হুঁ। তবে একেবারে খালি হাতে যাব না। বিশাল এক কাতলা মাছ কিনব। বাজারের সবচে বড় মাছটা। প্রথমে মাছটা দেব। মেয়েরা কেন জানি বড় মাছ দেখলে খুশি হয়। মাছটা দেখে খুশি হবে। খুশি খুশি অবস্থায় আসল ঘটনা বলে পায়ে পড়ে যাওয়া। চল যাই।

এখন?

হ্যাঁ এখন। মাছ কিনব। ঐ বাসায় তোর যাবার দরকার নেই। আমি একাই যাব। পায়ে ধরা তোকে দিয়ে হবে না। ঐটা হচ্ছে আমার লাইন। তুই থাকলে আমার জন্যেও সমস্যা। ঠিকমত পায়ে ধরতে পারব না।

মাছ কিনবি যে টাকা আছে?

না, জোগড়ি করব।

মাছ নিয়ে যাবি কখন?

সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় যাব। সন্ধ্যাবেলা মেয়েদের মন একটু দুর্বল থাকে।

মেয়েদের মনের এতসব খবর তুই জানলি কিভাবে?

নাসিম হোহো করে অনেকক্ষণ ধরে হাসল। বাবু তাকিয়ে আছে নাসিমের দিকে। নাসিমের জন্যেই তার খারাপ লাগছে। ছোটখাট মানুষ। খুব ঘামছে। শব্দ করে হাসছে ঠিকই কিন্তু হাসিতে কোন প্রাণ নেই। নাসিম বলল, তুই বাসায় থাকিস। কি অবস্থা রাতে গিয়ে রিপোর্ট করব।

 

রাত আটটার দিকে প্রায় একমণ ওজনের এক কাতল মাছ নিয়ে নাসিম বাবুদের বাসায় উপস্থিত হল। রুবা চোখ কপালে তুলে বলল, এটা কি?

নাসিম কড়া গলায় বলল, ফাজলামি করিস না তো রুবা। ফাজলামি করলে চড় খাবি। এটা কি বললি কোন আন্দাজে? তুই মাছ চিনিস না?

চিনি। ছোট সাইজের মাছগুলি চিনি–এত বড় মাছ চিনি না। নাসিম ভাই এটা কি তিমি মাছের বাচ্চা? এত বড় মাছ কি জন্যে নাসিম ভাই?

খাবার জন্যে। বঁটি আন, মাছ কাটব। শুধু বঁটিতে হবে না–কুড়াল লাগবে। কুড়াল আছে?

কুড়াল থাকবে কেন? আমরা কি কাঠুরে?

কথাবার্তা শুনে সুরমা বের হয়ে এলেন। তিনি স্তম্ভিত হয়ে বললেন, এত বড় মাছ কি জন্যে?

নাসিম হাসিমুখে বলল, খাবার জন্য। অনেকদিন বড় মাছ খাই না। ভাবলাম যা থাকে কপালে আজ একটা বড় মাছ খাব।

তোমার পাগলামি কবে কমবে বল তো? তোমার কি বড় মাছ খাবার অবস্থা? নুন আনতে পান্তা ফুরায়…

নাসিম হাসতে হাসতে বলল, আমার অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। আমার নুনও নাই, পাত্তা নাই … তাই বলে এক-আধদিন একটা বড় মাছ খেতে পারব নী? বাবু কোথায়?

টিউশ্যানিতে গেছে।

ফিরবে কখন?

রুবা বলল, দশটার আগে কোনদিন ফেরে না। আজ সকাল সকাল ফিরবে। শরীর খারাপ।

ওর জন্যে অপেক্ষা করলে রান্নার দেরি হয়ে যাবে। কাটা শুরু করে দি। রুবা যা তো ছাই নিয়ে আয়। খালা আপনি আপনার রান্নার সমস্ত প্রতিভা ব্যয় করে মাছটা রান্না করুন তো দেখি।

সুরমা কঠিন গলায় বললেন–আমার শরীরের অবস্থা তো জানি। এই অবস্থায় আমি রাত দুপরে মাছ রাঁধতে বসতে পারব না।

আপনাকে কিছু করতে হবে না খালা। আপনি শুয়ে পড়ুন। রান্নাবান্না যা করার আমি আর রুবা মিলে করব। আমি একজন প্রথম শ্রেণীর বাবুর্চি। রুবা হাত লাগা–মাছের ল্যাজটা চেপে ধর।

মরে গেলেও আমি মাছের ল্যাজ চেপে ধরব না। হাত গন্ধ হয়ে যাবে। কাল আমার পিকনিক। গন্ধ হাত নিয়ে আমি পিকনিকে যাব?

তাহলে যা, চা বানিয়ে আন। খুব কড়া করে বানাবি।

নাসিম ভাই, তোমাকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন? কারণটা কি?।

দারুণ একটা ব্যাপার ঘটেছে। তুই বুঝবি না। চা বানাতে বললাম–বানিয়ে আন। চা খেয়ে অ্যাকশানে নেমে যাব। এই মাছ কাটতে মিনিমাম এক ঘণ্টা লাগবে।

সুরমা বিছানায় শুয়ে আছেন। এম্নিতেই তার শরীর ভাল না। তার চেয়েও বড় কথা, নাসিমকে তিনি সহ্য করতে পারেন না। তার ধারণা, নাসিমের পাল্লায় পড়ে বাবুর আজ এই অবস্থা। শিক্ষিত এম. এ. পাস ছেলে হকারদের মত এই অফিসে ঐ অফিসে ঘুরে বেড়াচ্ছে–কোন মানে হয়? শিক্ষিত ছেলে চাকরি করবে–দশটা পঁচটা অফিস করবে। তার জীবন থাকবে রুটিনশধ্য। এইসব কি? ছন্নচ্ছাড়া জীবন। যত বদ বুদ্ধি দিচ্ছে নাসিম ছোঁড়া। মাছ নিয়ে ঢং দেখাচ্ছে। মাছ রান্না করবে, খাবে, তারপর বসার ঘরে লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে থাকবে। যে ছেলে পরের বাড়িতে এমন নির্বিকারভাবে ঘুমায় তাকে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই।

নাসিম মাছ কাটছে। নাসিমের সামনে চায়ের কাপ হাতে রুবা বসে আছে। সে কৌতূহলী চোখে মাছ কাটা দেখছে। নাসিমের মুখ হাসি হাসি। রুবা অনেকদিন নাসিমকে এত আনন্দিত অবস্থায় দেখে নি।

নাসিমের আনন্দের কারণ আছে। তার কাজ হয়েছে। রহমান সাহেবের মেয়ে সব ঘটনা চুপ করে শুনেছে এবং নাসিমকে অবাক করে রাগে-দুঃখে কেঁদে ফেলেছে। নাসিম ভাবেও নি এই ব্যাপার হবে। মেয়েটি বলেছে–আপনি যদি মাছ এখানে রেখে যান, মাছ, আমি খবি না। রাস্তায় ফেলে দেব। বাবাকেও আপনাদের বিল প্রসঙ্গে কিছু বলব না। মাছ আপনি দয়া করে নিয়ে যান। আজ রাতেই আমি বাবাকে যা বলার বলব। বাবার যে এই অভ্যাস আছে আমি সন্দেহ করেছিলাম। কখনো বিশ্বাস করি নি।

 

নাসিম রুবার দিকে তাকিয়ে বলল, রুবা!

উঁ।

এই মাছটা পুকুরের না নদীর বল তো দেখি।

কি করে বলব? মাছের গায়ে তো লেখা নেই made in river কিংবা made in pond.

অবশ্যই লেখা আছে। সেই লেখা পড়ার চোখ থাকতে হয়। নদীর রুই মাছ হয় লম্বা। এদের স্রোতের বিরুদ্ধে চলতে হয়। লম্বা না হলে এদের চলাফেরা সমস্যা। পুকুরের মাছগুলি হয় মোটা, গোলগাল। তোকে ভাল জিনিস শিখিয়ে দিলাম।

থ্যাংকস। আরো কিছু শেখাও।

বল দেখি–এই মাছটা টাটকা না বাসি?

বিশ্রী গন্ধ আসছে। মনে হচ্ছে বাসি।

হল না। মাছের তেলটার দিকে তাকিয়ে দেখ। ধবধবে সাদা। এর মানে টাটকা মাছ। এক টুকরা মুখে দিবি, অমৃতের মত লাগবে।

নাসিম ভাই, কেন তুমি আজ এত খুশি?

খুশি হবার মত কারণ ঘটেছে। অসাধারণ একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হল। আমি আমার এই জীবনে এমন অসাধারণ মেয়ে দেখি নি।

রুবার মুখ কালো হয়ে গেল। সে নিজের অজান্তেই বড় ধরনের একটা ধাক্কা খেল। তার এই পরিবর্তন নাসিম ধরতে পারল না। ধরতে পারলে সেও চমকে উঠত।

বুঝলি রুবা, মেয়েটার বাপটাকে চিনি। হারামজাদা নাম্বার থ্রী। মানুষ সমাজের কলংক। কিন্তু মেয়েটা এত ভাল যে বাপের অপরাধও মেয়ের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা করা যায়।

নাম কি মেয়ের?

ভাল নাম মেহেরুন্নিসা। ডাকনাম বোধহয় তুহিন। তুহিন করে ঐ বাড়ির সবাই ডাকছিল।

আজই পরিচয় হল?

হুঁ।

অনেকক্ষণ গল্প করলে?

হুঁ। ভেবেছিলাম মিনিট পাঁচেক গল্প করব। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে প্রায় ঘণ্টা খানিক থাকলাম। চা খেলাম। কেক খেলাম। কেকটা অমৃতের মত। কিন্তু কিছু মানুষ আছে না, প্রথম দেখাতেই মনে হয়–আরে, এই মানুষটাকে তো অনেকদিন ধরেই চিনি। এই মেয়েও সে রকম।

আমার চেয়েও ভাল?

নাসিম হো-হো করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, তোর ধারণা তুই একটা দারুণ মেয়ে?

হ্যাঁ আমার তাই ধারণা।

মুখ এমন কালো করে ফেলেছিস কেন? ব্যাপার কি?

তোমার অসাধারণ একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। মুখ আলো হয়ে আছে। আমার তো আর কোন অসাধারণ পুরুষের সঙ্গে পরিচয় হয় নি আমার পরিচয় তোমার মত একজনের সঙ্গে মাকে সবাই ডাকে–গিট্টু। কাজেই আমার মুখ অন্ধকার।

ঘরে মসলাপাতি কি আছে দেখ। কি ফটফটি হয়েছিল। ফটফট করে কথা। সেই দিন এতটুকু প্যান্ট পরে খালি গায়ে ঘুরঘুর করতে দেখলাম।

রুবা কঠিন গলায় বলল–নাসিম ভাই, তুমি আমাকে কখনো খালি গায়ে ঘুরঘুর করতে দেখ নি।

আচ্ছা যা দেখিনি। তুই এত রাগছিস কেন?

তুমি আজেবাজে কথা বলবে, আমি রাগব না?

রুবা উঠে দাড়াল। নাসিম বলল, যাচ্ছিস কোথায়?

মসলা আছে কি-না দেখতে যাচ্ছি।

রুবা রান্নাঘরে গেল না। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সে কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কেন তার এত কান্না পাচ্ছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। নাসিম ভাই বলেছে তার একটা অসাধারণ মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তাতে তার নিজের এত খারাপ লাগছে কেন? ভাগ্যিস তার এই খারাপ লাগাটা অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে পেলে কি ভয়ংকর ব্যাপার হত!

রুবা কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলাল। চোখে মুখে পানি দিয়ে এসে দেখে নাসিম বঁটি দিয়ে হাত কেটে ফেলেছে। রক্ত বের হচ্ছে গলগল করে। নাসিম বলল, তোর আরোগ্য নিকেতন চট করে নিয়ে এসে হাতটা বেঁধে দে।

তুমি তো হাত একেবারে দু টুকরা করে ফেলেছ!

দু টুকরা করলেও কেন জানি ব্যথা পাচ্ছি না। একটা মজার জিনিস লক্ষ করেছিস রুবা, মাছের রক্ত আর মানুষের রক্ত এক রকম। এইখানে দেখ পাশাপাশি মাছের রক্ত আর মানুষের রক্ত। কোনটা কার বল তো?

রুবা কিছু বলল না। তার অষুধের বাক্স আনতে গেল। নাসিম কৌতূহলী চোখে মাছের এবং মানুষের রক্ত দেখছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ