মেজাজ খারাপ করার মত পরপর কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেছে।

জাফর সাহেবের প্রেসারের সমস্যা আছে। মেজাজ খারাপ হলে প্রেসার দ্রুত ওঠানামা করে। চট করে মাথা ধরে যায়। ঘাড় ব্যথা করতে থাকে এবং মুখে থুথু জমতে থাকে–এর কোনটিই ভাল লক্ষণ নয়। পঞ্চাশ পার হবার পর লক্ষণ বিচার করে চলতে হয়। তাঁর বয়স পাঁচপঞ্চাশ। তিনি লক্ষণ বিচার করে চলার মনে প্রাণে চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন কিছুতেই যেন মেজাজ না বিগড়ে যায়। এটা প্রায় কখনোই সম্ভব হয় না।

অফিস থেকে ফেরার পর তিনটা ঘটনা ঘটল মেজাজ খারাপ করার মত। ইলেকট্রিসিটি না থাকায় লিফট বন্ধ ছিল। আটতলা পর্যন্ত হেঁটে উঠার পর কারেন্ট চলে এল। লিফট ওঠা নামা শুরু করল।

পত্রিকা চেয়েছিলেন, সকাল বেলা তাড়াহুড়ায় ভালমত পড়া হয়নি। তাঁকে ভেতরের একটা পাতা দেয়া হল, বাইরের পাতাটা না-কি পাওয়া যাচ্ছে না।

এক কাপ চা চাইলেন, তিথি এক কাপ চা দিয়ে গেল। চুমুক দিতে গিয়ে দেখেন সর ভাসছে। তিনি বললেন, সর ভাসছে কেন?

তিথি বলল, সর চায়ের চেয়ে হালকা বলেই ভাসছে। যদি ভারী হত তাহলে ড়ুবে যেত। বলেই সে হেসে ফেলল! জাফর সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, রসিকতা করছিস কেন?

রসিকতা করছি না বাবা। একটা বৈজ্ঞানিক সত্য ব্যাখ্যা করলাম।

কঠিন ধমক দিতে গিয়েও জাফর সাহেব নিজেকে সামলে নিলেন। মেজাজ ঠিক রাখতে হবে। কিছুতেই মেজাজ খারাপ হতে দেয়া যাবে না। মেজাজের জন্যে শুধু তাঁর নিজেরই যে সমস্যা হচ্ছে তাই না, পারিবারিক সমস্যাও হচ্ছে। গত চারদিন ধরে এই ফ্ল্যাট বাড়িতে শুধু তিথি এবং তিনি আছেন। তাঁর স্ত্রী শায়লা ছোট দুই মেয়ে ইরা, মীরাকে নিয়ে পল্লবীতে তাঁর মায়ের বাসায় চলে গেছেন। যাবার আগে কঠিন গলায় বলেছেন, তুমি তোমার মেজাজ নিয়ে থাক। আমি চললাম।

জাফর সাহেব বলেছেন, যেতে ইচ্ছে হলে যাবে। তবে তুমি যদি মনে কর আমি তোমাকে সাধাসাধি করে নিয়ে আসব তাহলে বিরাট ভুল করবে। এ জীবনে অনেক সাধাসাধি করেছি। আর নয়। তোমার ব্যাপারে আমি হাত ধুয়ে ফেলেছি।

ছোট মেয়ে দুটিও যে মার সঙ্গে চলে যাবে তিনি ভাবেন নি। তিনি সারাজীবন শুনে এসেছেন মেয়েরা পিতৃভক্ত হয়। শুধু তাঁর বাড়িতেই উল্টো নিয়ম। দুই মেয়ে সুরসুর করে মার সঙ্গে চলে গেল। তাও যদি স্কুলে পড়া বাচ্চা মেয়ে হত একটা কথা ছিল। একটা আই এসসি. দিয়েছে, অন্যটা আই এ, পড়ে, সেকেন্ড ইয়ার। বড় মেয়ে তিথিও হয়ত চলে যেত। নেহায়েত হিউমেনিটেরিয়ান গ্রাউন্ডে যায় নি। ইরা মীরা খুব ভাল করে জানে তিনি এদের না দেখলে অস্থির বোধ করেন। সবাইকে এক সঙ্গে না নিয়ে বসলে খেতে পারেন না। মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যায়। কাকে কখন কি বলছেন খেয়াল থাকে না।

শায়লা চলে যাবার পরদিন কাজের মেয়ে রাশেদা তার টিনের ট্রাংক এবং পুটলা-পুটলি নিয়ে বিদেয় হয়ে গেল। যাবার সময় বলল, ভূল তুরুটি কিছু হইলে নিজ গুণে ক্ষমা দিবেন।

জাফর সাহেব বললেন, বেতন পাওনা আছে না? বেতন নিয়ে যাও।

আমার বেতনের দরকার নাই।

শেষ মুহূর্তে জাফর সাহেব আপোষের সুর বের করলেন। রাশেদা চলে গেলে ভয়াবহ সমস্যা হবে। তিথি সামান্য এক কাপ চা পর্যন্ত ঠিকমত বানাতে পারে না। রান্নার প্রশ্নই আসে না। ঢাকা শহরে ভাল কাজের লোক পাওয়া পরশ পাথর পাবার মত। জাফর সাহেব রাশেদার দিকে তাকিয়ে প্রায় মধুর গলায় বললেন, চলে যাচ্ছ কেন তাই তো বুঝলাম না। তোমাকে তেমন কিছু বলা হয়নি। রাশিদা বলল, আমি মিজাজের ধার ধারি না। যে বাড়িত আমারে ইংরেজি গাইল দেয় হেই বাড়িত কাম করি না।

ইংরেজি গালির ব্যাপারটা সত্য। জাফর সাহেব রাশেদাকে স্টুপিড ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার বলেছেন। এবং তিনি মনে করেন তাঁর জায়গায় অন্য যে কেউ এরচে কঠিন গালি দিত। তিনি অফিস থেকে এসে স্যান্ডেল চাইলেন। রাশেদা স্যান্ডেল দিল ঠিকই, কিন্তু দুটা দুপার্টির। তিনি কিছু বললেন না। চা চাইলেন। চা এনে দিল। চুমুক দিয়ে দেখেন মিষ্টি হয়নি। তিনি বললেন, রাশেদা, চিনি লাগবে। সে রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল, চিনি দেওয়া আছে, লাড়া দেন। নাড়া দিতে চামচ লাগবে। তিনি চামচ চাইলেন, রাশেদা একটা তরকারির চামচ নিয়ে উপস্থিত হল। চামচ দেখেই তাঁর মেজাজ খারাপ হল, তবু তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, এই চামচ চায়ের কাপে ঢুকবে?

রাশেদা চামচ উল্টে পেছনটা দিয়ে ডাল ঘেঁটার মত তাঁর চায়ের কাপ খুঁটে দিল। শুধু তখনি তিনি বললেন, স্টুপিড, ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার। অবশ্যি কঠিন গলায় বললেন। মিষ্টি করে কাউকে স্টুপিড বলা যায় না। সেই বলাটাই কাল হয়েছে।

জাফর সাহেব মেজাজ আয়ত্তে রাখার চেষ্টা অনেকদিন থেকেই করছেন। পারছেন না। সবাই সবকিছু পারে না, চেষ্টাও করে না। তিনি চেষ্টা করছেন। সেই চেষ্টা কারোর চোখে পড়ছে না। দুশ তেত্রিশ টাকা দিয়ে বই কিনে এনেছেন–Self control. সাতশ পৃষ্ঠার বই। সেখানে নেই, এমন জিনিস নেই। একটা অংশ আছে Yoga. সেই অংশে বলা হয়েছে–প্রতি রাতে শোবার আগে পাঁচ মিনিট শবাসন করলে নিজের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপিত হবে।

শবাসনের নিয়ম হল শক্ত মেঝেতে খালি গায়ে গায়ে কোন রকম কাপড়ই থাকতে পারবে না, অন্তর্বাসও নয়) শুয়ে থাকতে হবে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে ভাবতে হবে একজন মৃত মানুষ। তাঁর দেহটা একটা মৃত মানুষের দেহ। এই দেহের কোন অনুভূতি নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে এই দেহের কোন যোগ নেই।

পাঁচপঞ্চাশ বছর বয়সে নেংটো হয়ে মেঝেতে শুয়ে থাকার কল্পনাই ভয়াবহ। তিনি এই ভয়াবহ ব্যাপারটাও করলেন। দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে মেঝেতে শুয়ে রইলেন। পুরোপুরি নগ্ন হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না। তিনি কোমরে একটা টাওয়েল জড়িয়ে রাখলেন। লাভের মধ্যে লাভ এই হল, তাঁর ঠাণ্ডা লেগে গেল। কাশি, সর্দি। টনসিল ফুলে একাকার। ঠোক গিলতে পারেন না।

মানুষের কত সমস্যা থাকে। তাঁর একটিই সমস্যা। মেজাজ সমস্যা। কেউ তা সহজভাবে নিতে পারে না। মানুষের অসংখ্য সৎগুণের কিছু কিছু তাঁরও নিশ্চয়ই আছে। সেসব কেউ দেখবে না।

শায়লা বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। চারদিনে একবার টেলিফোন পর্যন্ত করেনি। মেয়ে দুটিও না। রাশেদা চলে গেছে জানার পর তার কি উচিত ছিল না বাসায় ফিরে

আসা?

এই যে তিথি সরভর্তি এক কাপ চা তাঁর হাতে দিল, চাপা হাসি হাসতে হাসতে বৈজ্ঞানিক সত্য ব্যাখ্যা করতে লাগল, তার কি উচিত ছিল না, বলা–বাবা, কাপটা আমার কাছে দাও। আমি আরেক কাপ বানিয়ে নিয়ে আসছি। এমন না যে সে পরীক্ষার চাপে ব্যতিব্যস্ত। তার এম.এসসি, ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। সে রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষার এই সময়টা সে তো রান্নাবান্না শেখার চেষ্টাও করতে পারে। একদিন বিয়ে হবে, নিজের সংসার শুরু করবে। এই যুগের মেয়েরা শুধু লেখাপড়া শিখবে, রান্নাবান্না শিখবে না? সামান্য এক কাপ চা-ও বানাতে পারবে না। তা তো হয় না। সরভর্তি চা হাতে নিয়ে জাফর সাহেব বসে রইলেন।

অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল বাজছে। রাশেদা নেই যে কলিংবেল শুনে দরজা খুলে দেবে। তিথি কি করছে? সে কি তার নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে? তাঁর ইচ্ছা করছে কড়া গলায় ডাকেন–তিথি!

ডাকার আগেই তিথি উপস্থিত হল। হাতে চায়ের কাপ।

বাবা, নাও–এবার চায়ে কোন সর নেই হেঁকে এনেছি।

জাফর সাহেব যন্ত্রের মত চায়ের কাপ নিতে নিতে বললেন, কলিংবেল বাজছে।

দরজা খোলা হয়েছে, বাবা।

কে এসেছে?

অচেনা একজন। যে এসেছে সে ড্রয়িং রুমে বসেছে।

জাফর সাহেব চায়ের কাপ হাতে উঠতে গেলেন। তিথি হাত ধরে বাবাকে বসিয়ে দিল। নরম গলায় বলল, চা শেষ করে তারপর যাবে। তার আগে না।

কেন?

যে এসেছে, আমার ধারণা, তাকে দেখে তোমার মেজাজ আরো খারাপ হবে। মাঝখান থেকে তোমার চা খাওয়া হবে না। চায়ে কি চিনি হয়েছে?

হুঁ।

চায়ের টেম্পারেচর ঠিক আছে? বেশি ঠাণ্ডা কিংবা বেশি গরম হয়নি তো?

না। ঠিকই আছে।

তিথি বাবার সামনে মোড়া পেতে বসল। জাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন, মেয়েকে কেমন জানি অচেনা অচেনা লাগছে। চুল টুল কেটেছে, কিংবা কোন একটা কায়দা করেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মেয়েদের চুল কাটার দোকান হওয়ায় এই এক বিপদ হয়েছে। নাপিতের কাছে ছেলেরা যাবে। মেয়েরা কেন যাবে? কি হচ্ছে দেশটার?

জাফর সাহেব বললেন, তোকে এমন লাগছে কেন?

কেমন লাগছে?

কি রকম যেন লাগছে! চুল কেটেছিস?

না, কানে দুল পরেছি।

জাফর সাহেব মেয়ের কানের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। হাতের চুড়ির চেয়ে বড় দুটা রিং, মাঝারি সাইজের হাতীর কানের জন্যে মানানসই হত মানুষের কানের জন্যে না। সুস্থ মাথার কেউ এই দুল কানে পরে? এই ফ্যাশনি কবে চালু হল?

সুন্দর লাগছে না, বাবা?

জাফর সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, এগুলির নাম কি?

আলাদা কোন নাম নেই। আমি নাম দিয়েছি পাংকু রিং, পাংকু মেয়েদের রিং।

পাংকু মেয়ে মানে কি?

তুমি বুঝবে না। তোমার চা খাওয়া কি শেষ হয়েছে?

হ্যাঁ।

তাহলে তুমি বসার ঘরে যাও। যে বসে আছে তাকে দ্রুত বিদেয় করে আস। তবে ফর গডস সেক, রাগারাগি করবে না।

রাগারাগি করব কেন?

রাগারাগি করবে কারণ ভদ্রলোক কাদামাখা জুতা পায়ে কার্পেটে হাঁটাহাঁটি করছেন। তোমার কাছে হয়ত অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু তাঁর হাতে চারটা মুরগি। মুরগিগুলি তিনি কার্পেটে শুইয়ে রেখেছেন। আমার মনে হয় তারা ইতিমধ্যে কার্পেট নোংরা করে ফেলেছে। কারণ মুরগিগুলিতো আর জানে না আমরা নতুন কার্পেট কিনেছি।

ঠাট্টা করছিস?

মোটেই ঠাট্টা করছি না। সত্যি কথা বলছি। তোমার যা মেজাজ, ঠাট্টা করে বিপদে পড়তে চাই না।

সত্যি কার্পেটে মুরগি শুইয়ে রেখেছে?

হ্যাঁ।

তুই বলতে পারলি না যে কার্পেট মুরগির বিছানা না?

আমি বলতে পারিনি, কারণ আমি অতি ভদ্র একজন তরুণী। কাউকে অপ্রস্তুত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া ভদ্রলোক কেমন মুখ কাচুমাচু করে বসে আছে, দেখে মায়াই লাগলো।

জাফর সাহেব গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালেন। তিথি বলল, প্লীজ বাবা, মেজাজ খারাপ করবে না। গ্রাম থেকে এসেছে, বোকাসোকা মানুষ …।

তিথি মিথ্যা বলেনি। সত্যি সত্যি কার্পেটের এক কোণায় চারটা মুরগি, দড়ি দিয়ে পা বাঁধা। তারা ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রয়িং রুমের সৌন্দর্য দেখছে। ধুলোমাখা জুতো পায়ে রোগী ধরনের একটা ছেলে বসে আছে। কার্পেট মাত্র গত সপ্তাহে কেন। হয়েছে। জুট কার্পেট না কিনে তিনি প্রায় চারগুণ দাম দিয়ে সিনথেটিক শ্যাগ কার্পেট কিনেছেন। সেখানে কেউ যদি কাদা মাখা জুতা পায়ে সোফায় বসে থাকে, কেমন লাগে?

জাফর সাহেব রুক্ষ গলায় বললেন, কি ব্যাপার?

ছেলেটা লাফ দিয়ে ওঠে দাঁড়ালো। গায়ে খয়েরী রঙের চাদর। গলায় টকটকে লাল রঙের মাফলার। চোখে সানগ্লাস থাকলে ষোলকলা পূর্ণ হত। বুক পকেটে আছে নিশ্চয়ই। এদের আর কিছু থাকুক না থাকুক–সানগ্লাস থাকে।

জাফর সাহেবের অনুমান মিথ্যা হল না। সে পা ছুঁয়ে সালাম করবার জন্য নিচু হতেই বুক পকেট থেকে একগাদা ভাংতি পয়সা, চাবীর রিং এবং একটা সানগ্লাস পড়ে গেল। জাফর সাহেব থমথমে গলায় বললেন, তুমি কে?

আমার নাম জামান। নুরুজ্জামান।

ভাল কথা। ব্যাপারটা কি? মুরগি তুমি এনেছ?

জি। আমার বাড়ি অতিথপুর, ঢাকায় একটা কাজে আসছি–আপনার আব্বা মুরগী দিয়ে দিলেন। বললেন, নিয়ে যাও।

নুরুজ্জামান দাঁত বের করে হাসছে। পান খাওয়া লাল দাঁত। জাফর সাহেবের ইচ্ছা হচ্ছে ধমক দিয়ে ছোকড়ার হাসি বন্ধ করেন।

এত দূর থেকে মুরগি আনার দরকার কি? ঢাকায় কি মুরগি পাওয়া যায় না?

উনি আপনাকে একটা চিঠিও দিয়েছেন।

দেখি চিঠি।

জাফর সাহেব চিঠি নিলেন। তাঁর মেজাজ আরো খারাপ হল। চিঠি একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। খামে বন্ধ করে যার চিঠি তাঁর কাছে দিতে হয়। এই সামান্য ব্যাপারও তাঁর বাবার মাথায় এখন ঢুকছে না। কারণটা কি? মস্তিষ্ক বিকৃতি শুরু হল না-কি? জাফর সাহেব ভুরু কুঁচকে অতি দ্রুত চিঠির উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে গেলেন–

বাবা জাফর,

দোয়া নিও। নুরুজ্জামানের সঙ্গে কয়েকটা মুরগি এবং কিছু ডিম পাঠালাম। ঢাকায় নুরুজ্জামানের কিছু কাজ আছে। তাকে সাহায্য করবে। সে কয়েকদিন থাকবে। তোমার বাসাতেই রাখার ব্যবস্থা কর। দরিদ্র ছেলে, ঢাকায় আত্মীয়স্বজনও নেই।

বৌমার চিঠিতে জানলাম তোমার প্রেসারের সমস্যা হয়েছে। আধুনিক জীবনযাপনের এই হল ফুল। পাখির মত আহার করবে, গাড়ি করে আফিসে গিয়ে কিছু কাগজপত্র সই করে ফিরে আসবে। খানিকক্ষণ টিভি দেখে স্লীপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে প্রেসার তো হবেই। আমার এত বয়স হল, এখনো তো এ জাতীয় কোন সমস্যা হয়নি। শুনলাম, আজকাল তুমি অল্পতেই হৈচৈ চেঁচামেচি কর, এটাও তে ভাল কথা না।…

চিঠি আর পড়তে ইচ্ছা করছে না। চিঠি মানে উপদেশ। পাঁচপঞ্চাশ বছরের ছেলেকে এত উপদেশ দেয়া যায় না, এটা উনাকে কে বুঝিয়ে দেবে? জাফর সাহেব নুরুজ্জামানের দিকে তাকালেন।

সে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ধপ করে সোফায় বসে পড়েনি। যাক এইটুকু ভদ্রতা তাহলে আছে! নুরুজ্জামান হড়বড় করে বলল, ১৮টা ডিম দিয়েছিলেন এখন সতেরোটা আছে। একটা ভেঙ্গে গেছে।

জাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন সোফার এক কোনায় ডিমের পুটলি। ভাঙ্গা ডিম থেকে হলুদ রস বের হয়ে সোফায় নিশ্চয়ই লেগেছে।

ঢাকায় কত দিন থাকবে?

কিছুদিন থাকতে হবে, স্যার।

কিছুদিন মানে কত দিন? বি স্পেসিফিক।

চার পাঁচ দিন।

এটা হচ্ছে ফ্ল্যাট বাড়ি। আমার স্ত্রী বর্তমানে বাসায় নেই, কাজের লোকও নেই–এখানে থাকলে তোমার সমস্যা হবে …।

নুরুজ্জামান হাসিমুখে বলল, আমার কোন অসুবিধা হবে না। প্রয়োজনে কার্পেটে শুয়ে থাকব। নরম কার্পেট।

এই কার্পেট শোয়ার জন্যে না। ভাল কথা–জুতা পরে এই কার্পেটে উঠবে। তুমি কর কি?

আমি অতিথপুর গার্লস হাইস্কুলের হেড মাস্টার।

জাফর সাহেব বিস্মিত হলেন–একুশ-বাইশের মত বয়স বলে মনে হচ্ছে এই ছেলে হেড মাস্টার। তার মানে কি? তিনি বললেন, অতিথপুরে মেয়েদের হাইস্কুল আছে নাকি?

এখনো কুল হয় নাই। শুধু জমি পাওয়া গেছে। মেয়েদের স্কুলের জন্যে একজন পঞ্চাশ ডেসিমেল জমি দান করেছে। সবাই আমাকে ধরল–তুমি জোগাড় যন্ত্র করে স্কুল দাড়া করায়ে দাও … এই জন্যেই ঢাকায় আসছি।

বুঝলাম না। ঢাকায় এসে কি হবে?

স্কুলের স্যাংশন লাগবে। স্কুল ঘর তোলার জন্যে সাহায্য যদি কিছু পাওয়া যায়। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে একটু দেখা করব।

জাফর সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি যে ভাবে কথা বলছ তাতে মনে হয়। শিক্ষামন্ত্রী তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছেন।

আপনি একটু চেষ্টা চরিত্র করলে ……।

আমি চেষ্টা করলেও কিছু হবে না। শিক্ষামন্ত্রী কোন বাড়ির কাছের ব্যাপার না। মন্ত্রীদের কোন দায় পড়েনি অতিথপুরের নুরুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করার। তাদের আরো কাজ আছে। বুঝতে পেরেছ?

জি স্যার।

আমার মনে হয় তোমার যা করা উচিত তা হল স্থানীয় এম.পি.-র সঙ্গে যোগাযোগ করা। মন্ত্রী অনেক বড় ব্যাপার।

তবু আসলাম যখন একটু চেষ্টা করে দেখি।

জাফর সাহেব বললেন, তোমার পড়াশোনা কতদূর?

বি.এ. পাশ করেছি। গৌরীপুর কলেজ। এম.এ. পাশ করার ইচ্ছা ছিল, টাকাপয়সা জোগাড় করতে পারলাম না। মানুষের সব ইচ্ছা তো আর …

নুরুজ্জামান কথা শেষ করল না। সোফায় বসে জুতা খুলতে লাগল। জুতা জোড়া রেখে এল কার্পেটের বাইরে। অর্থাৎ এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে সে এখানে কিছুদিন থাকবে। টকটকে লাল রঙের মোজা দেখা যাচ্ছে। কোন সুস্থ মাথার লোক এরকম মোজা পরে? নতুন মোজা। এক কোনায় এখনো লেবেল লাগানো। লেবেল খুলেনি। কিংবা কে জানে এরা হয়ত লেবেল খুলে না।

সে এখন হ্যান্ডব্যাগের চেইন খুলছে। জাফর সাহেব মনে মনে বললেন, গাধা! বসার ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। গাধাটা এখন নিশ্চয় লুঙ্গি বের করে পরে ফেলবে। সোফার টেবিলে পা তুলে নখ কাটবে। পকেটের ভাংতি পয়সার সঙ্গে একটা নেল কাটারও কার্পেটে পড়েছে। এই জাতীয় লোকজন কোন কাজকর্ম না থাকলে বসে বসে নখ কাটে। সেই কাটা নখ এসট্রেতে জমা করে রাখে।

 

তিথি বলল, কি হল বাবা? মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে। ভদ্রলোক কিছুদিন এখানে থাকবেন তাই না?

হুঁ।

গেষ্ট রুম দেখিয়ে দেব?

দেখিয়ে দে।

রাতে ভাত খাবে?

খাবে তো বটেই।

দুজনের মত ভাত আছে। আবার চড়াতে হবে।

জাফর সাহেব বললেন, আমি ভাত খাব না। ঐ গাধাটাকে খাইয়ে দে।

গাধা বলছ কেন?

শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। স্কুল স্যাংশান করিয়ে সে গ্রামে মেয়েদের হাইস্কুল দেবে। সেই না-কি হাইস্কুলের হেড মাস্টার।

তুমি বেশি রেগে যাচ্ছ, বাবা। এসো তুমি তোমার ঘরে শুয়ে থাক। শুয়ে শুয়ে তোমার Self control বইটা পড়।

তোর মা টেলিফোন করেছিল?

না। আমি টেলিফোন করব?

কোন দরকার নেই। লেট দেম গো টু হেল। তোর মার ব্যাপারে আমি হাত ধুয়ে ফেলেছি।

আমার কি মনে হয় জান বাবা? আমার মনে হয় তোমারই উচিত মাকে টেলিফোন করা। রাগারাগি তুমি করেছ, মা করেনি।

টেলিফোন করে কি বলব–আই এ্যাম সরি?

কিচ্ছু বলতে হবে না। টেলিফোন করলেই মার রাগ পড়ে যাবে। তারপর যখন শুনবে–রাশেদা চলে গেছে। বাসায় একজন অতিথি–তখন সব সামলাবার। জন্যে নিজেই আসবেন। করব টেলিফোন?

জাফর সাহেব কিছু বললেন না। তিথি টেলিফোন সেট বাবার সামনে থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। মার সঙ্গে কথা বলার সময় যেন বাবা শুনতে না পান। শায়লা টেলিফোন ধরলেন। তিথি বলল, কেমন আছ মা?

শায়লা ভারী গলায় বললেন, ভাল।

রাগ কমেছে?

রাগ কমাকমির এর মধ্যে কি আছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি যখন পুরোপুরিই এসেছি। তুই কি ভেবেছিস সুরসুর করে ফিরে আসব? তুই ভেবেছিস কি? তোর বাবা এক মাইল দূর থেকে ক্রলিং করে এসে আমার পায়ে ধরলেও লাভ হবেনা।

তোমার রাগ তো কমে নি মা, বরং বেড়েছে। এদিকে বাবা পুরোপুরি ঠাণ্ডা। মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তোমার সঙ্গে কমপ্ৰমাইজে আসতে চান। আমাকে বললেন, তোর মাকে টেলিফোন কর। আমি নিজের ইচ্ছেয় টেলিফোন করিনি, মা। বাবা করালো।

তুই তোর বাবাকে বল, আমি কোনদিনও তার ঐ সাধের ফ্ল্যাট বাড়িতে ঢুকবো না। কতবড় সাহস, আমার মেয়েদের সামনে আমাকে বলে ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার।

ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার বলা বাবার মুদ্রাদোষ। রাশেদাকেও বাবা ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার বলেছেন। এবং রাশেদাও বিদেয় হয়ে গেছে। মা আমরা দারুণ বিপদে পড়েছি। এদিকে গোদের উপর ক্যানসারের মত অতিথপুর থেকে এক অতিথি এসে উপস্থিত। উনার হবি হচ্ছে মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলা। উনি জানিয়েছেন ঢাকার সব মন্ত্রী এবং প্রতিমস্ত্রীর সঙ্গে কথা না বলে উনি বিদেয় হবেন না।

চুপ কর। খামাখা বক বক করিস না। শুধু শুধু এত কথা বলিস কেন?

বাবার সঙ্গে সত্যি কথা বলবে না, মা?

না।

মা, একটা কথা বলি, শোন। তুমি কি একটু ওভার রিএক্ট করছ না? তুমি পঁচিশ বছর ধরে বাবার সঙ্গে আছ, তুমি তো জান চট করে রেগে যাওয়া বাবার স্বভাব। রেগে যায়, আবার রাগ চলেও যায়। কখনো রাগ পুষে রাখে না। রাগ পুষে রাখার ব্যাপারটা কর তুমি।

তুই আমাকে উপদেশ দিচ্ছিস?

উপদেশ দিচ্ছি না, মা। আর উপদেশ দিলেও তুমি সেই উপদেশ শোনার পাত্র। বাবা তোমাকে ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার কলাতে তুমি বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেলে–বাবা তো কোন কারণ ছাড়া হঠাৎ রেগে গিয়ে তোমাকে ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার বলেনি … সব মিলিয়ে বিচার করে দেখ নিশ্চয়ই তুমি এমন কিছু করেছ যেখান থেকে বাবার ধারণা হয়েছে …

তুই আমাকে বিচার করা শেখাচ্ছিস! তোর এতবড় সাহস! তুই আমাকে…

এত চেঁচাচ্ছ কেন, মা? আমি তো চেঁচাচ্ছি না। ঠিক আছে মা, তুমি বেশি রেগে যাচ্ছ। আমি রাখি, পরে কথা বলব।

খবর্দার! টেলিফোন রাখবি না। টেলিফোন ধরে থাক।

আচ্ছা মা, টেলিফোন ধরে আছি। বল কি বলবে। শান্তভাবে বল, মা। মামারা কি মনে করবে!

তিথি টেলিফোন ধরে রইল। শায়লা বললেন, খবর্দার, কোনদিন তুই আমার সঙ্গে কথা বলবি না। কোনদিন না।

আচ্ছা বলব না।

আর তুই তোর বাবাকে বলবি তাকে আমি শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব। কত ধানে কত চাল বুঝিয়ে দেব। মাথা কামিয়ে তাকে আমার সামনে আসতে হবে। কতবড় সাহস আমাকে চাকর বাকরের সামনে অপমান করে। আমাকে স্টুপিড বলে। ষ্টুপিড পানিতে গুলে তাকে খাইয়ে দেব।

শায়লা ঘটাং করে টেলিফোন রাখলেন।

তিথি বাবার ঘরে ঢুকল। জাফর সাহেব বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। হাতে সত্যি সত্যি Self control-এর বই। তিথিকে ঢুকতে দেখেই আগ্রহ নিয়ে বললেন, কথা হয়েছে তোর মার সঙ্গে?

হ্যাঁ হয়েছে।

কি বলল?

তিথি ইতস্তত করে বলল, তেমন কিছু বলেনি। তবে মনে হয় তাঁর নিজের আচার-আচরণে খানিকটা লজ্জিত। এখন লজ্জায় পড়ে টেলিফোনও করতে পারছে না। ফিরেও আসতে পারছে না। তুমি বরং কাল নিজে গিয়ে নিয়ে এসো। প্রথমে হয়ত খানিকক্ষণ মিথ্যা রাগ দেখিয়ে চেঁচামেচি করবে। তুমি পাত্তা দিও না।

তিথি লক্ষ্য করল তার বাবার মুখ থেকে অন্ধকার অনেকখানি সরে গেছে। বাবার অনন্দিত মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া লাগছে। মা কেন যে এই মানুষটার উপর রাগ করে!

জাফর সাহেব ইতস্ততঃ করে বললেন, ইরা আর মীরা ওরা কি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিল?

হ্যাঁ বাবা, চাচ্ছিল। আমিই তোমাকে দেইনি। যার সঙ্গে কথা না বলে ওদের সঙ্গে কথা বললে–মা রেগে যাবে। তুমি যেমন ফট করে রেগে যাও, মাও তো সে রকম রাগে।

দ্যাটস টু। তুই যা, ঐ ছেলেটার ঘর দেখিয়ে দে।

তিথি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে রওনা হল।

 

নুরুজ্জামান লুঙ্গি পরে সোফার এক কোণায় চুপচাপ বসে আছে। তিথিকে দেখে আগের মত লাফ দিয়ে দাঁড়াল। তিথি বলল, আসুন, আপনাকে আপনার থাকার ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি। সরি, অনেকক্ষণ একা একা বসিয়ে রেখেছি।

নুরুজ্জামান মেয়েটির ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ একা একা বসিয়ে রেখেছি–কি সুন্দর করে কথাগুলি বলল। বলার কোন দরকার ছিল না। তাকে তো একা একাই বসিয়ে রাখবে। তার সঙ্গে গল্প করার কার এমন দায় পড়েছে।

নুরুজ্জামান বলল, ডিমগুলো কি করব। এখানে সতেরোটা ডিম আছে। আঠারোটা দিয়েছিলেন একটা ভেঙ্গে গেছে।

ডিমের ব্যবস্থা আমি করব আপনি আসুন।

নুরুজ্জামান উঠে এল।

এটা আপনার ঘর। সঙ্গে এটাচড় বাথরুম আছে। বাথরুমের একটা জিনিস আপনাকে দেখিয়ে দি। এটা গরম পানির, এটা ঠাণ্ডা পানির কল। গোসলের সময় ঠাণ্ডা-গরম দুরকম মিশিয়ে নেবেন। শুধু গরম পানির কল ছাড়লে কিন্তু বিপদে পড়বেন। খুব গরম পানি আসে। একেবারে বয়েলিং ওয়াটার। মশারি নেই। মশারির দরকারও নেই। নতলা পর্যন্ত মশা উঠতে পারে না। কাবার্ডে দুটা কম্বল আছে। জানালাটানালা বন্ধ থাকলে শীত আসে না। একটা কম্বলেও শীত মানার কথা, তারপরেও যদি শীত না মানে…। ভাত দিতে একটু দেরি হবে, আপনার কি খুব খিদে পেয়েছে?

নুরুজ্জামান বলল, জ্বি।

তাহলে আমি বরং এক কাপ চা আর বিসকিট দিয়ে যাই। আধঘণ্টার মধ্যে ভাত দিয়ে দেব?

জি আচ্ছা।

তিথি রান্নাঘরের দিক রওনা হল। তার মায়া লাগছে। খিদে লেগেছে কি-না জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ। কেউ বলে না। বলার নিয়ম নেই। সভ্য সমাজের নিয়ম হচ্ছে ভদ্রতা করে বলতে হয়, খিদে নেই।

খাবার ঘরের এক কোণায় চারটা মুরগি পায়ে দড়ি বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। এরা কোন শব্দ করছে না। সবকটা একসঙ্গে ঘাড় উঁচিয়ে তিথিকে দেখছে। তিথির মনে হল মুরগিগুলি খুব অবাক হচ্ছে–এতদিন তারা গ্রামের ঝোপেঝাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, আজ হঠাৎ নতলা ফ্ল্যাটে। তাদের পায়ের নিচে মাটি নেই আছে শ্যাগ কার্পেট।

তিথি প্লাস্টিকের একটা বাটিতে খানিকটা পানি এগিয়ে দিল। চারজনই ঝাপিয়ে পড়ল পানির বাটির উপর। আহা বেচারারা! তৃষ্ণায় নিশ্চয়ই এদের বুক ফেটে যাচ্ছিল। মুখ ফুটে বলতে পারছিল না। তিথি খানিকটা চাল এনে দিল। খুঁটে খুঁটে চাল খাচ্ছে। পা একসঙ্গে বাঁধা থাকায় আরাম করে খেতেও পারছে না। আহা বেচারারা! আহা।

 

নিন, চা নিন।

নুরুজ্জামান উঠে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল।

ঘরে বিসকিট নেই। এক স্লাইস রুটি মাখন লাগিয়ে এনেছি। চা খেয়ে একটা কাজ করে দেবেন?

নুরুজ্জামান বিস্মিত হয়ে বলল, কি কাজ?

মুরগিগুলির পায়ে দড়ি বাঁধা। দড়ি খুলে দেবেন। কাজের লোকের একটা ঘর আছে রান্নাঘরের পাশে। ঐখানে ছেড়ে রাখব। সারাদিন বাঁধা ছিল। খুব মায়া লাগছে।

নুরুজ্জামান বলল, জ্বি আচ্ছা।

তিথি একটুক্ষণ থেমে থেকে বলল, আপনি যখন দেশে ফিরে যাবেন তখন মুরগিগুলি সঙ্গে নিয়ে যাবেন। গ্রামে নিয়ে ছেড়ে দেবেন। পারবেন না?

জি পারব।

তিথি কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলল, ওরা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে দেখছিল। পানি দিলাম, এত আগ্রহ করে পানি খাচ্ছিল। মায়া পড়ে গেছে।

নুরুজ্জামান বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। কি অদ্ভুত কথা বলছে এই মেয়ে।

একটা মানুষকে একা একা খেতে দেয়া যায় না। আবার নিতান্ত অপরিচিত একজন মানুষকে ভাত বেড়ে দিয়ে বসে থাকা যায় না। তিথি টেবিলে ভাত বাড়ছে। জাফর সাহেব জানিয়েছেন তিনি রাতে ভাত খাবেন না। এক গ্লাস লেবুর সরবত খাবেন। ঘরে লেবু নেই। লেবু ছাড়া লেবুর সরবত বানাতে হবে। তিথির ধারণা তার বাবা লেবু নেই কেন এ নিয়েও খানিকক্ষণ হৈ চৈ করবেন। তার নিজেরও ক্ষিধে লেগেছে। লোকটির খাওয়া শেষ হবার পরই তার খাওয়ার প্রশ্ন আসে। সে কতক্ষণ ধরে খাবে কে জানে? গ্রামের মানুষ বেশি খায় কিন্তু সেই বেশি খাওয়াটা দ্রুত খায় না ধীরে ধীরে খায় তা তার জানা নেই।

নুরুজ্জামান ইতিমধ্যেই লুঙ্গী পরে মোটামুটি ঘরোয়া ভাব ধরে ফেলেছে। লুঙ্গী সাদা হলেও গায়ের গেঞ্জীটা গাঢ় নীল। চুলে তেল দেয়ায় মাথা চকচক করছে।

সে খুব সহজ ভঙ্গিতে টেবিলে খেতে বসল। তিথির দিকে তাকিয়ে বলল, কাটা চামচ দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস নাই।

তিথি বলল, আপনাকে কাটা চামচ দেয়া হয়নি হাত দিয়েই খাবেন।

হাত ধোয়ার পানি?

আসুন বেসিন দেখিয়ে দেই। বেসিনে হাত ধুয়ে নিন। হাত ধুয়ে খেতে শুরু করুন। আমি বাবাকে এক গ্লাস সরবত বানিয়ে দিয়ে আসি। একা একা খেতে আপনার অসুবিধা হবে নাতো?।

জি না। অসুবিধা কি?

নুরুজ্জামান তিথির ভদ্রতায় আরেকবার মুগ্ধ হল।

 

জাফর সাহেব ভুড়, কুঁচকে বললেন, লেবুর সরবত দিতে বললাম–লেবু কোথায়?

লেবু নেই বাবা। থাকবে না কেন? নিশ্চয়ই আছে। ভালমত খুঁজে দেখ।

খুঁজে যদি লেবু পাওয়াও যায়–তোমাকে দেয়া হবে না। রাতে লেবু খাওয়া। ঠিক না–পেটে এসিডিটি হয়। তোমার এই বয়সে পেটে এসিডিটি হওয়া ঠিক না। পেটে গ্যাস হবে। সেই গ্যাস ফুসফুসে চাপ দেবে। অক্সিজেন ফুসফুসে আসতে দেবে না–ফলে ব্রেইনে অক্সিজেনের অভাব হবে। মাথা ঘুরতে থাকবে–এক সময় দেখা যাবে পালস পাওয়া যাচ্ছে না।

জাফর সাহেব অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন–।

আমার কথা তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না বাবা?

হচ্ছে।

তাহলে এ ভাবে তাকিয়ে আছ কেন? সরবত খাও।

তিনি এক চুমুকে গ্রাস শেষ করলেন। তিথিকে গ্রাস ফিরিয়ে দিতে দিতে বললেন, গাধাটা খেয়েছে?

খেতে বসেছে।

তুই খেয়েছিস?

না। উনার খাওয়া হলেই খেতে বসব। অবশ্যি ক্ষিধে মরে গেছে। খেতে ইচ্ছাও করছে না। একা একা খেতে ভাল লাগে না।

তুই খেতে বসার সময় আমাকে ডাকবি। আমি বসব তোর সঙ্গে।

আমার সঙ্গে তোমার বসতে হবে না। তোমার ঘুম পেয়েছে তুমি ঘুমিয়ে পড়।

 

নুরুজ্জামান হাত গুটিয়ে বসে আছে। এখনো খেতে শুরু করে নি। তিথি অবাক হয়ে বলল, খাচ্ছেন না কেন?

নিমক নাই। নিমকের জন্যে বসে আছি।

তিথি রান্নাঘর থেকে লবনের বাটি এনে দিল। লবনকে নিমক বলার অর্থ তার কাছে পরিস্কার হচ্ছে না, পাতে খাবার লবনকে সম্মান দেখিয়ে নিমক বলা হয় কি? অনেকে যেমন দৈ বলে না। বলে দধি। বড় সাইজের রই মাছকে রুই মাছ বলে না, বলে রুহিত মাছ। তিথি টেবিলের অন্য প্রান্তে বসেছে। নুরুজ্জামানের নিমক খাওয়া বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে। খানিকটা লবণ প্লেটের এক কোনায় নিল। খানিকটা নিল তর্জুনির মাথায়। সেই নিমক জীবে ছুঁইয়ে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কি যেন বলল। কোন দোয়া হবে। একজন মানুষের সামনে চুপচাপ বসে থাকা যায় না। তিথি বলল, ঢাকায় কদিন থাকবেন?

মিনিষ্টার সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাত করব। তারপর একটু অন্য কাজও আছে।

আর কি কাজ?

একটু ঘুরাফিরা করব। ঢাকায় আগেও দুইবার এসেছি। ঘুরাফিরা করতে পারি নাই। দেখার জিনিসেরতো এই শহরে কোন অভাব নাই। এইবার ভাবছি—যতটা পারি দেখব। ডায়ানার একটা সন্তান হয়েছে। সেইটাও দেখে যাব।

আপনার কথা বুঝলাম না। কার সন্তান হয়েছে?

ডায়ানার।

ডায়ানাটা কে?

চিড়িয়াখানায় যে মেয়ে জলহস্তি আছে তার নাম ডায়ানা। খবরের কাগজে দেখেছি–ডায়ানার একটা পুত্র সন্তান হয়েছে। আগে একটা কন্যা হয়েছিল।

ও আচ্ছা। আপনি তাহলে চিড়িয়াখানা–শিশুপার্ক এই সব ঘুরে ঘুরে দেখবেন?

শিশুপার্ক দেখব না। গতবার দেখে গেছি। বড় ভাল লেগেছিল।

ভাল ভাল জিনিষতো বার বার দেখা যায়। তাও ঠিক।

খেতে পারছেনতো?

জি পারছি। পারব না কেন? গ্রাম দেশে এত পদ দিয়ে তো কখনো খাই না। দুইটা পদ থাকে। তরকারী–ডাল। কোনকোনদিন ভাজি আর ডাল।

ঢাকার কাজ কর্ম সারতে আপনার তাহলে কিছু সময় লাগবে?

জি লাগবে। আমাদের এলাকায় একজন লোক আছে টেলিভিশনে কাজ করে। উনার সাথেও একটু দেখা করব। উনার ঠিকানা আনতে আবার ভুলে গেছি। এই নিয়ে একটু দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত। তবে টেলিভিশনে গেলে নিশ্চয়ই উনার ঠিকানা পাব।

হ্যাঁ পাবেন।

উনি বলেছিলেন ঢাকায় আসলে যেন তার সঙ্গে দেখা করি। পারলে আমাকে একটা সুযোগ করে দিবেন বলেছিলেন।

তিথি বিস্মিত হয়ে বলল, কিসের সুযোগ?

নুরুজ্জামান সহজ গলায় বলল–আমি পাতার বাঁশি বাজাতে পারি। উনি শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। তখন ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন–বাচ্চু মিয়া ঢাকায় আসলে দেখা করবেন। আমার ডাক নাম বাচ্চু।

আপনি তাহলে একজন পাতাবাদক? ভাল ভাল।

একদিন শুনাবো আপনাকে। পাতা পাওয়া গেলে হয়। সব পাতায় আবার সুর। উঠে না। শহর বন্দর জায়গা পাতা পাওয়া মুশকিল। আশে পাশে অশ্বথ গাছ আছে?

জানি না আছে কি না।

আমগাছের পাতা দিয়েও হয়। খুব ভাল হয় না। দেখি অশ্বথের পাতা জোগাড় করব। আছে নিশ্চয়ই। এত বড় শহর থাকারতো কথা।

তিথি বলল, আপনাকে এত কষ্ট করার দরকার নেই। যদি গ্রামে কখনো যাই তখন শুনাবেন।

আর আপনারা কি কখনো গ্রামে যাবেন। আপনারা হয়েছেন শহরবাসী। শহরের নেশা একবার লেগে গেলে গ্রাম ভাল লাগে না। শহরের নেশা বড় খারাপ নেশা।

তিথি বলল, তাও ঠিক। তবে আমার গ্রাম খুব খারাপ লাগে না। একবার গিয়ে দাদাজানের সঙ্গে দুসপ্তাহ ছিলাম।

আমি জানি উনি আমাকে বলেছেন। উনি আমাকে খুব পেয়ার করেন। ও আচ্ছা ভুলেই গেছি উনি আপনাকে একটা পত্র দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন জরুরী। আমি নিয়ে আসি।

নুরুজ্জামান উঠতে গেল। তিথি বলল, খাওয়া শেষ করুন। তারপর দেবেন।

নুরুজ্জামান খাওয়া শেষ করল। খাওয়ার শেষ পর্বও দর্শণীয়। প্লেটে খানিকটা পানি ঢেলে সেই পানি দিয়ে প্লেট পরিষ্কার করে, সেই পানি ডালের মত চুমুক দিয়ে খাওয়া। রীতিমত গা গিনগিন করা ব্যাপার। তিথি তাকিয়ে আছে বলেই লজ্জিত গলায় বলল, নবী এ করিম এই ভাবে খেতেন। এতে আয়ু বৃদ্ধি হয়।

ও আচ্ছা। ঘরে কি পান আছে?

জ্বি না। মা পান খান। তিনি বাসায় নেইতো–তাই তার পানের সরঞ্জামও নেই। আচ্ছা আমি পানের ব্যবস্থা করছি।

কি ভাবে করবেন?

রিসিপসানে লোকজন আছে–এদের বললে ওরা পান এনে উপরে দিয়ে যাবে।

সামান্য পানের জন্যে আপনাকে নিচে নামার দরকার নাই।

আমাকে নিচে নামতে হবে না। আমি ইন্টারকমে বলে দেব।

 

তিথি কিছু খেতে পারল না। ভাতের গামলা ফ্যানের নিচে এতক্ষণ ছিল বলেই ভাত ঠাণ্ডা কড়কড়া হয়ে গেছে। চিবানো যায় না–এমন অবস্থা। তরকারীও কোনটিতে লবন, হয় নি। নুরুজ্জামান প্রচুর লবন কেন নিয়েছে তা এখন বোঝা যাচ্ছে। তিথির খুব ক্লান্তি লাগছে। অনেক কাজ বাকি। টেবিল থেকে থালাবাসন সরানো, পরিস্কার করা। রান্নাঘরও নোংরা হয়ে আছে। শোবার আগে সব ঝকঝকে না করে রাখলে ভাল ঘুম হয় না। ঘুমের মধ্যেও বার বার মনে হয় কি যেন বাকি থাকল। কি যেন বাকি থাকল।

সব কাজ শেষ করে এক পেয়ালা চা হাতে তিথি বারান্দায় এসে বসল। ঘুমুতে যাবার আগে এটি হচ্ছে তার শেষ রুটিন। ন তলার দক্ষিণমুখী বারান্দা। খুব হাওয়া। এক একবার মনে হয় বেতের চেয়ার সহ তাকে উল্টে ফেলে দিচ্ছে। আকাশের কাছাকাছি বাস করার অনেক সুবিধার একটি হচ্ছে–হাওয়ার সঙ্গে খেলার সুযোগ। আজ আবার জোছনা হয়েছে। বারান্দা চাদের আলোয় মাখামাখি। জোছনাটাও বেশ অদ্ভুত। মনে হচ্ছে শুধু বারান্দায় জোছনা হয়েছে। আর কোথাও নয়।

টেলিফোন বাজছে। ওঠে ধরতে ইচ্ছা করছে না। অনেক রাতে খুব আজে বাজে ধরনের কল আসে। আবার মারুফও মাঝ রাত ছাড়া টেলিফোন করে না। ষাট ভাগ সম্ভাবনা কুৎসিত মানসিকতার কোন মানুষ টেলিফোন করেছে। তিথি টেলিফোন ধরা মাত্র সে বলবে, আপা এত রাত পর্যন্ত জেগে আছেন কেন? কি করছেন? তারপরই শুরু করবে অশ্লীলতম কিছু কথা বার্তা।

আবার চল্লিশভাগ সম্ভাবনা হল–মারুফ টেলিফোন করেছে। টেলিফোন না ধরা মানে সেই সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করা। তিথি তা পারবে না। তিথি কেন কোন মেয়েই পারবে না। তিথি টেলিফোন ধরে ভয়ে ভয়ে বলল,

হ্যালো।

তিথি?

হুঁ।

তোমাদের টেলিফোন নষ্ট না-কি বলতো? সন্ধ্যাবেলা অনেকবার চেষ্টা করলাম।

সন্ধ্যাবেলা টেলিফোনের লাইন খোলা ছিল।

ও আচ্ছা। তুমি এখনো ঘুমাও নি?

না।

করছিলে কি?

বারান্দায় বসে জোছনা দেখছিলাম।

জোছনা আছে না-কি?

হুঁ।

তোমার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত।

কিছুটা ক্লান্ততো বটেই। অনেক কাজ করলাম। রান্না বান্না ঘর গোছানো।

তোমার মা এখনো আসেন নি?

উহুঁ।

তোমার মা-কি খুব রাগী মহিলা? তাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না।

মা মোটেই রাগী মহিলা না। তাঁর সব রাগ শুধু বাবার উপর। আর কারো উপর তার কোন রাগ নেই।

তোমার মার প্রসঙ্গে কথা তোলায় তুমি আবার রাগ করনিতো?

না। আমার সবচে ভাল গুন হল আমি কখনো রাগ করি না।

কারো উপর তোমার রাগ হয় না?

হয়। তবে আমার একটা টেকনিক আছে। ঐ টেকনিক ব্যবহার করে রাগটাকে অভিমানে নিয়ে যাই। তারপর খানিকক্ষণ কাদি। অভিমান দূর হয়ে যায়।

তুমি দেখি একেবারে বইয়ের ভাষায় কথা বলছ–সত্যি কি এরকম কর?

হ্যাঁ করি।

কি ভাবে কাঁদো? ভেউ ভেউ করে না নিঃশব্দ কান্না?

ছোট বেলায় ভেউ ভেউ করেই কঁদতাম। এখন নিঃশব্দে কঁদিতে চেষ্টা করি। পারি না। কি করি জান–বাথরুমে ঢুকে যাই। আমার একটা খুব নরম নীল রঙের তোয়ালে আছে ঐ তোয়ালেতে মুখ ঢেকে কাদি। যাতে কান্নার শব্দ কেউ শুনতে না পারে।

পানির ট্যাপ ছেড়ে রাখলেই হয়। পানি পড়ার শব্দে কান্নার শব্দ ঢাকা পড়ার Pati

তিথি হাসতে হাসতে বলল, আমার হচ্ছে নীল তোয়ালে টেকনিক। সবার টেকনিকতো এক রকম না।

তোমার কি ঘুম পাচ্ছে তিথি?

না।

সারারাত, কথা বলতে পারবে?

অন্য কারো সঙ্গে পারব না–তবে তোমার সঙ্গে পারব।

বেশ আজ তাহলে সারারাত কথা বলব। কত মানুষ কত ধরণের রেকর্ড করে। আমরা সারারাত ননষ্টপ কথা বলে রেকর্ড করব। রাজি আছ?

আছি।

বেশ তাহলে শুরু করা যাক–প্রথম বাক্যটি কি আমি বলব?

বল।

তুমি এত ভাল কেন তিথি?

তিথির চোখে পানি এসে গেল। টেলিফোনের এই এক সুবিধা কথা বলতে বলতে চোখে পানি এসে গেলেও ও পাশের মানুষটা বুঝতে পারবে না।

হ্যালো তিথি, হ্যালো–আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? হ্যালো…

তিথি বলল, শুনতে পাচ্ছি।

হ্যালো, হ্যালো তিথি–হ্যালো…

আমি তো তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি। পরিস্কার শুনতে পাচ্ছি।

তিথি তিথি…

ওপাশ থেকে অনেকক্ষণ হ্যালো হ্যালো শোনা গেল। টেলিফোনের খটখট শব্দ হল, তারপর পুরোপুরি নিঃশব্দ। নষ্ট টেলিফোন থেকে শোঁ শোঁ যে আওয়াজ হয় তাও হচ্ছে না।

তিথি আবারও বারান্দায় এল। এখন আর চাঁদটা দেখা যাচ্ছে না। আর্কিটেক্ট বাড়ি ডিজাইন করার সময় পূর্ব-পশ্চিম কত কিছু খেয়াল করেন। কোন দিকে রোদ আসবে, কোন দিকে আসবে না সব তাঁদের নখদর্পণে … কিন্তু চাঁদের আলো সম্পর্কে তারা কিছু ভাবেন না কেন? চাঁদটা কি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ না? এমন একটা বারান্দা কি তাঁরা বানাতে পারেন না যেখানে যতক্ষণ চাঁদ থাকবে ততক্ষণ চাঁদের আলো থাকবে?

তিথির হাই ওঠছে–বিছানায় যেতেও ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে, আজ রাতে তার ঘুম হবে না। তাকে জেগে থাকতে হবে। তিথি নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। বাথরুমে গা ধোল। শীত নেমে গেছে। পানি কনকনে ঠাণ্ডা। ইচ্ছা করলেই গরম পানি মিশিয়ে নিতে পারে। ইচ্ছা করছে না। শরীরে এক ধরনের যন্ত্রণা হচ্ছে। এই যন্ত্রণা দূর করতে ঠাণ্ডা পানি লাগবে।

বিছানায় শুতে গিয়ে তার মনে হল–দাদাজানের চিঠিটা পড়া হয়নি। খাবার ঘরের টেবিলে চিঠিটা পড়ে আছে। চিঠির যদি প্রাণ থাকত তাহলে সে নিশ্চয়ই বলত, এই যে তিথি, এখনও তুমি আমাকে পড়ছ না কেন? এত কিসের অবহেলা? তিথির গায়ে নাইটি। এমন একটা স্বচ্ছ পোশাকে কি খাবার ঘরে যাওয়া ঠিক হবে? যদি হুট করে ঐ লোকটা খাবার ঘরে ঢুকে পড়ে? এই পোশাকে তাকে দেখলে লোকটা কি ভাববে কে জানে? হয়ত তার ছোটখাট একটা স্ট্রোক হয়ে যাবে।

বসার ঘরে কেউ নেই। তিথি চিঠি নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে গেল। তিথির দাদাজান লিখেছেন–

তিথি সোনামণি,

বয়সের একটি পর্যায়ে মানুষ পরিত্যক্ত হয়। আমি সেই পর্যায়ে পৌহিয়াছি। আমার সঙ্গ এখন সবার বিরক্তি উৎপাদন করে। নিজের পুত্র কন্যারাও এখন আর আমার পত্রের জবাব দেয় না। তাহারা পত্র পাঠ করে কি-না সেই বিষয়েও আজ আমার সন্দেহ হয়। তোমার বাবাকে গত চার মাসে মোট ছয়টি পত্র দিয়াছি। সে একটিরও জবাব দেয় নাই।

তোমার কথা স্বতন্ত্র। গত চার মাসে তোমাকে আমি তিনটি পত্র দিয়াছি। তুমি তিনটিরই যে শুধু জবাব দিয়াছ তাই না–নিজ থেকেও একটি পত্র লিখিয়াছ? তোমার পত্রগুলি বার বার করিয়া পড়িয়াছি এবং বড়ই তৃপ্তি লাভ করিয়াছি।

তোমার পত্রপাঠে মনে হয়, তুমি তোমার জীবন নিয়া বড়ই চিন্তিত। এত চিন্তিত হইবার কিছু নাই। যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিবে। আল্লাহপাক মানুষকে সীমিত স্বাধীন সত্তা দিয়া পাঠাইয়াছেন। আমাদের কাজ করিতে হইবে এই সীমিত স্বাধীনতায়। মূল চাবিকাঠি তাঁহার হাতে। কাজেই এত চিন্তা করিয়া কি হইবে? যাহা হোক, আমি তোমাকে আধ্যাত্মবাদ শিখাইতে চাই না। সব কিছুরই একটা সময় আছে। আমি শুধু তোমাকে মন স্থির রাখিবার উপদেশ দিতেছি। মনকে কাঁটা কম্পাসের মত হইতে হইবে। কম্পাসের কাঁটা সাময়িকভাবে নাড়া খাইতে পারে তবে তাহার দিক কিন্তু ঠিকই থাকে।

এক্ষণে অন্য একটি বিষয়ের অবতারণা করিতেছি। নুরুজ্জামান ছেলেটিকে ভাল করিয়া লক্ষ্য কর। আমার অত্যন্ত পছন্দের ছেলে। তাহার কাজকর্ম নির্বোধের ন্যায়। তবে সে নির্বোধ নয়। তাহার মন কম্পাসের কাটার ন্যায় স্থির। এই সমাজে যাহা সচরাচর দেখা যায় না। তুমি গত চিঠিতে জানিতে চাহিয়াছিলে কোন ধরনের ছেলে তোমার বিবাহ করা উচিত। নুরুজ্জামান হচ্ছে সেই ধরনের ছেলে। আমার ধারণা, নুরুজ্জামানের মত কোন একজনের সঙ্গে তোমার বিবাহের ফল অত্যন্ত শুভ হইবে। আমি সরাসরি নুরুজ্জামানের কথাও বলিতে পারিতাম, বলিলাম না কারণ তোমাদের বাস্তবতা আমি জানি। আমার পত্রপাঠে রাগ করিও না বা বিরক্তও হইও না।

আমি যাহা ভাল বিবেচনা করিয়াছি তাহাই বলিয়াছি।…

বাকি চিঠি আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। তিথি চিঠিটা দলা পাকিয়ে কাবার্ডের দিকে ছুঁড়ে মারল। দাদাজানের বুদ্ধিশুদ্ধি কি পুরোপুরিই গেছে?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ