ইমন তার বাবাকে বই পড়ে শোনাচ্ছে। বইটার নাম Fear at Midnight. ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প। ফিফথ গ্রেডের কিছু ছেলেমেয়ে মন্টানার জঙ্গলে সামার ক্যাম্প করতে যায়। সেখানে পৌঁছার পর শুরুটা তারা খুবই আনন্দে কাটায়। সমস্যা শুরু হয় মধ্যরাত থেকে। লেক থেকে উঠে আসে এক বুড়ো। বুড়োর চেহারায় মায়া। কথাবার্তায় মায়া। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ তার চোখ ধ্বক করে ওঠে। তখন চোখের মণিতে হালকা নীল আলো দেখা যায়।

ভূতের গল্প পাঠের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। টেবিলে চারটা বড় বড় মোমবাতি জ্বলছে। মোমবাতির আলো ছাড়া ঘরে কোনো আলো নেই। ফ্যান বন্ধ রাখা হয়েছে। ফ্যানের বাতাসে মোমবাতি নিভে যায়। তবে আজ গরম নেই। সন্ধ্যাবেলা তুমুল বৃষ্টি হওয়াতে আবহাওয়া ঠাণ্ডা।

ইমন খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছে। অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হওয়ায় তার নিজেরই খানিকটা ভয়-ভয় লাগছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির গ্লাসে পানি রাখা আছে। ইমন মাঝে-মাঝে পানির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। পানি খাবার সময়ে কিছুক্ষণ পাঠের বিরতি হয়। তখন পিতা-পুত্র গল্প করে।

এখন পানি পানের বিরতি। শওকত বলল, বুড়ো যে লোক লেকের পানি থেকে উঠে এলো, সে আসলে কে? মানুষ নিশ্চয়ই না?

ইমন বলল, মানুষ না।

সে কি ভ্যাম্পায়ার জাতীয় কিছু?

না। ভ্যাম্পায়াররা পানিতে থাকে না। তারা থাকে পুরনো অন্ধকার বাড়ির কফিনের ভেতর।

তাহলে বুড়োটা কী?

ইমন বলল, বুড়োটা কী আমি জানি। কিন্তু আগেই তোমাকে বলে দিলে মজা নষ্ট হয়ে যাবে।

শওকত বলল, তাহলে থাক। আমার নিজের ধারণা— সে পানির কোনো ভূত।

ইমন বলল, You are very close.

বুড়োটার একটা ছবি আঁকলে কেমন হয়?

খুব ভালো হয় বাবা।

জোছনা রাতে পানি থেকে উঠে আসছে আলখাল্লা পরা এক বুড়ো।

ইমন আগ্রহ নিয়ে বলল, কখন আঁকবে বাবা?

গল্পটা শেষ হোক।

ইমন বলল, বাকি গল্পটা আমি অন্য আরেকদিন পড়ব। আমার ছবি আঁকা দেখতে ইচ্ছা করছে।

শওকত বলল, ছবি আঁকা তো দেখতে পারবে না। কেউ তাকিয়ে থাকলে আমি ছবি আঁকতে পারি না।

তাহলে আমি তাকিয়ে থাকব না। আমি অন্য কিছু করব।

অন্য কিছুটা কী?

নকল পার্ল তৈরি করব।

কীভাবে?

এক বাটি ঠাণ্ডা পানি নিতে হবে। জ্বলন্ত মোমবাতি সেই পানির উপর এমনভাবে ধরতে হবে যেন গলানো মোম পানির উপর পড়ে। এক এক ফোঁটা মোম পড়বে আর জমে গিয়ে মুক্তার দানার মতো হয়ে যাবে।

বাহ্ ইন্টারেস্টিং তো!

আমাকে আর্টস এন্ড ক্রাফট ক্লাসে শিখিয়েছে।

আসো, তাহলে কাজ শুরু করা যাক। তুমি বানাবে মুক্তা, আমি বানাবো ভূত। তার আগে তুমি মার সঙ্গে কথা বলে এসো। সে নিশ্চয়ই তোমার টেলিফোনের জন্যে অপেক্ষা করে থাকে।

ইমন বাধ্য ছেলের মতো মাকে টেলিফোন করতে গেল। শওকত লক্ষ করল, টেলিফোন করার জন্যে সে বারান্দায় চলে গেছে। মাকে সে কখনো বাবার সামনে টেলিফোন করে না। মার জগতটা সে বাবার কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে। একইভাবে বাবার জগতটাও সে নিশ্চয় মার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। মাতা-পুত্রের কথাবার্তা আড়াল থেকে শোনার ক্ষীণ ইচ্ছা শওকতের হলো। ইচ্ছাটাকে সে পাত্তা দিল না। ছেলেকে ভোলানোর জন্যে ছবি আঁকতে হবে। লেকের মাঝ থেকে উঠে আসছে দুষ্ট বুড়ো। জোছনার ছবি। মেরিন ব্লু, ডার্ক আম্বার, আইভরি ব্ল্যাক, হোয়াইট। চারটা রঙ। অনেকদিন ছবি আঁকা হয় না। শওকতের মধ্যে টেনশন কাজ করতে শুরু করেছে। সাদা বোর্ডটা যেন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। সে যেন গম্ভীর গলায় বলছে— আমার গায়ে রঙ ভরাতে যাচ্ছ। খুব সাবধান! খুব সাবধান।

 

ইমন প্রথম কথা বলল, কেমন আছ মা?

রেবেকা বললেন, আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?

ভালো।

শুধু ভালো, না বেশ ভালো?

বেশ ভালো।

আজ দুপুরে কী দিয়ে খেয়েছ?

খিচুড়ি।

শুধু খিচুড়ি?

হ্যাঁ। বাবা আর আমি আমরা দুজনে মিলে বেঁধেছি।

তুমি কি রান্নাও শিখে যাচ্ছি নাকি?

হ্যাঁ। আমি চা বানাতেও পারি।

বলো কী?

চা বানানো যে এত সহজ আমি আগে জানতাম না।

আগে জানতে না–এমন অনেক কিছুই এখন জানবে। ভালো কথা, তোমার বাবার বাসায় কি কোনো কাজের মানুষ নেই?

না। সকালবেলা রহিমার মা বলে একজন মহিলা এসে ঘর ঝাঁট দেন। বাসন ধুয়ে দেন। তিনি এখন আসছেন না। তবে তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

রাতে কী খাবে?

রাতেও খিচুড়ি খাব। দুপুরে আমরা বেশি করে রান্না করেছি। অর্ধেক রেখে দিয়েছি রাতের জন্যে।

তুমি যদি চাও, আমি হোটেল সোনারগাঁ থেকে পিজা কিনে পাঠাতে পারি।

মা লাগবে না।

আমি যতদূর জানি পিজা তোমার খুবই পছন্দের খাবার।

খিচুড়িও আমার খুব পছন্দের খাবার মা।

তাহলে তো ভালোই। অ্যান্ডারসন তোমাকে একটা ফ্যাক্স পাঠিয়েছে। তোমাকে কি পড়ে শোনাব?

হ্যাঁ।

হ্যালো লিটল কাউবয়। হ্যাভিং ফান? এই দুই লাইন। তুমি যদি ফ্যাক্সের উত্তর দিতে চাও, আমাকে বলো, আমি উত্তর পাঠিয়ে দেব।

উত্তর দিতে চাই না।

কেন চাও না? আমি যতদূর জানি তুমি অ্যান্ডারসনকে খুব পছন্দ কর।

আমি তাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই, এই জন্যে উত্তর দিতে চাই না। এখন উত্তর দিলে সারপ্রাইজ হবে না।

কী সারপ্রাইজ?

সেটা আমি তোমাকে বলব না। মা শোন, বাবা এখন আমার জন্যে একটা ছবি আঁকছে।

ভালো। হোক, ছবি আঁকাআঁকি হোক। শুভরাত্রি ইমন।

শুভরাত্রি।

শওকত অতি দ্রুত ব্রাশ ঘসছে। অনভ্যাসে কি বিদ্যাস হয়েছে? কজির ফ্লেক্সিবিলিটি কমেছে? কজি সে-রকম ঘুরছে না। একজন পেইন্টারের জন্যে কালান্তক ব্যাধির নাম আর্থরাইটিস। আঙুল নড়বে না, কজি নড়বে না। সামান্য একটু নাড়ালেই তীব্র ব্যথায় ভুবন অন্ধকার হয়ে যাবে। তারপরেও তাঁকে আঁকতে হবে। একজন সঙ্গীত-সাধকের কালান্তক ব্যাধি বধিরতা। তিনি সঙ্গীত সৃষ্টি করবেন কিন্তু কিছু শুনতে পাবেন না। মোজার্টের জীবনে এই ব্যাপারটি ঘটেছিল। তারপরেও তিনি মহান সঙ্গীত তৈরি করেছেন। শওকতের এই সমস্যা নেই। আর্থরাইটিসে তার আঙুল অচল হয় নি, তারপরেও সব কেমন আটকে আটকে যাচ্ছে।

ইমন গভীর মনোযোগে মোমের মুক্তা বানাচ্ছে। সবগুলি মুক্তা এক সাইজের হলে ভালো হতো। তা হচ্ছে না। একটার সঙ্গে একটা লেগে যাচ্ছে। নিয়ম হচ্ছে, মোমের প্রতিটি ফোঁটা আলাদা আলাদা ফেলতে হবে। তা সে পারছে না। এক সঙ্গে দুটা-তিনটা ফোঁটা পড়ে যাচ্ছে। তার উচিত হাতে ধরে থাকা মোমবাতির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। তা সে পারছে না। মাঝে-মাঝেই ঘাড় ফিরিয়ে সে তার বাবাকে দেখছে। বাবার চেহারা এখন একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। মুখের চামড়া কঠিন। ভুরু কুঁচকানো। চেহারায় কেমন যেন রাগী রাগী ভাব। ছবি আঁকার সময় কি মানুষের চেহারা রাগী রাগী হয়ে যায়? ইমনের তা মনে হয় না। তাদের আর্টের টিচারের চেহারা কখনো রাগী রাগী হয় না। বরং উল্টোটা হয়, চেহারা কোমল হয়ে যায়। তিনি আবার ছবি আঁকার সময় মাথা দুলিয়ে গানও করেন—

Can you hear the drums Farando?
I remember another story nights like this
In the fire lights Farnando!

এই গানটা তাদের আর্ট টিচারের খুব পছন্দ। কারণ তাঁর নিজের নামও Farnando.

শওকত ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, মুক্তা বানানো কেমন হচ্ছে?

ইমন বলল, ভালো।

পিংক কালারের মোম কিনে আনব, তাহলে পিংক পার্ল বানাতে পারবে। তোমার কি ক্ষিধে লেগেছে?

না।

ক্ষিধে লাগলে বলবে, আমরা ডিনার করে নেব।

আচ্ছা। বাবা শোন, তোমাকে আমি যদি একটি ছবি দেই, সেই ছবি দেখে তুমি কি মানুষটাকে আঁকতে পারবে?

পারার তো কথা।

তাহলে তুমি একটা ছবি এঁকে দিও। ছবিতে মানুষটা সোফায় শুয়ে বই পড়ছে। কিন্তু চশমটা তার চোখে না। কপালে। উনি বই পড়ার সময় চশমাটা তার কপালে তুলে দিয়ে বই পড়েন।

মানুষটা কে?

মিস্টার অ্যান্ডারসন।

উনি কি তোমাকে খুব পছন্দ করেন?

হ্যাঁ। আমাকে ডাকেন লিটল কাউবয়।

কাউবয় ডাকেন কেন?

জানি না। বড়শি দিয়ে ট্রাউট মাছ ধরার ব্যাপারে তিনি অ্যাক্সপার্ট। একবার উনি একটা ট্রাউট মাছ ধরেছিলেন, সেটা আমার চেয়েও বড়।

বলো কী!

আমরা সেই ট্রাউট মাছটা দিয়ে কী করেছি শুনলে তুমি খুব মজা পাবে।

বলো শুনি।

আমরা করলাম কী, শুকনা কাঠ জোগাড় করে আগুন করলাম। তারপর মাছটাকে পোড়ালাম। খেতে গিয়ে দেখলাম, উনি লবণ আনতে ভুলে গেছেন। মাছ মুখে দিয়ে আমরা থুথু করে ফেলে দিলাম। উনি মাছটার উপর ভীষণ রেগে গেলেন।

মাছের উপর রেগে গেলেন কেন? মাছটা তো কোনো ভুল করে নি। ভুল উনি করেছেন। লবণ আনেন নি।

মিস্টার অ্যান্ডারসনের এরকমই স্বভাব। যে দোষী, তিনি তার উপর রাগ করেন না। অন্যের উপর রাগ করেন। মাছটার উপর তিনি ভয়ঙ্কর রেগে এফ ওয়ার্ড দিয়ে গালি দিলেন।

এফ ওয়ার্ডের গালিটা কী?

তিনি বললেন, Fuck you fish. Fuck you হলো এফ ওয়ার্ডের গালি। খুব খারাপ গালি। তুমি কি এই গালি আগে শুনেছ?

হ্যাঁ, শুনেছি।

এফ ওয়ার্ডের গালি ছাড়াও তিনি অন্য গালিও জানেন। যেমন SOB.

SOB আবার কেমন গালি?

SOB হলো Son of a bitch. বাবা, তোমার কি চা খেতে ইচ্ছা করছে? চা বানিয়ে আনব?

আনো। চিনি আধা-চামচ বেশি দেবে। রাতের চায়ে আমি চিনি বেশি খাই।

ইমন চা বানাতে গেল। শওকত তাকিয়ে থাকল ছবিটার দিকে। ছবি ভালো হয় নি। বুড়ো মানুষটাকে আলখাল্লা পরানোর কারণে তাকে লাগছে রবীন্দ্রনাথের মতো। অবচেতন মনে কোথাও হয়তো রবীন্দ্রনাথ ছিল। সেই রবীন্দ্রনাথ উঠে এসেছেন। তার অর্ধেক শরীর পানির নিচে। অর্ধেক উপরে। তিনি পিশাচের মতো চোখে বনভূমির দিকে তাকিয়ে আছেন। কী কুৎসিত!

ইমন চা নিয়ে এসে দেখে, তার বাবা কালো রঙ ঢেলে ছবি নষ্ট করছেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি অন্যরকম।

শওকত ছেলের দিকে তাকিয়ে আহত গলায় বলল, ছবিটা আঁকতে পারি নি। পরে এঁকে দেব। ঠিক আছে?

ইমন বলল, ঠিক আছে।

আজ রাতেই এঁকে রাখব। ঘুম থেকে উঠে তুমি ছবি দেখতে পাবে।

ইমন বলল, ঠিক আছে। তুমি চা খাও। সিগারেট এনে দেব?

দাও।

রাতে ইমনের ঘুম ভালো হলো না। যতবারই তার ঘুম ভাঙল, সে দেখল তার বাবা ছবি আঁকছেন। তার চোখ লাল। চোখে কেমন পাগল-পাগল দৃষ্টি। একবার তার ইচ্ছা করল বলে, বাবা, ছবি আঁকতে হবে না। এসো ঘুমিয়ে পড়ো। এই কথাটাও সে বলতে পারল না।

ইমনের ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। ঘুম ভেঙে সে দেখল, তার বাবা তার পাশে বিছানায় বসে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার খুব বড় কোনো অসুখ হয়েছে। গা থেকে অসুখ-অসুখ গন্ধও আসছে। শওকত ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা সরি। ছবিটা আমি আঁকতে পারি নি। আমি ছবি আঁকা ভুলে গেছি।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ