বাবার সেই তের বছরের বালিকা বধূই আমার মা। বাবার ভাগ্য প্ৰসন্ন ছিল, কারণ বাবার বিয়ের পরপরই দাদাজান মারা যান। দাদাজানের বিশাল সম্পত্তি তাঁর হাতে এসে পড়ে। ধানী জমি, ভাটি অঞ্চলের জমি, নেত্রকোণা শহরে দুটি বাড়ি, ময়মনসিংহ শহরে একটি বাড়ি, একটা রাইস মিল এবং ইটের ভাটা। আমার প্রতিভাবান বাবা পাঁচ বছরের মধ্যে একটা ভেলকি দেখিয়ে দিলেন। তিনটি পুত্র কন্যার জন্ম দিলেন এবং পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে ঢাকায় চলে এলেন।

বর্তমানে তিনি একটি ভাড়াবাড়িতে থাকেন। ডেলটা ইসুরেন্স কোম্পানির হেড ক্যাশিয়ার হিসেবে সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতন পান। বাড়িভাড়া হিসেবে পান সতের শ টাকা। মেডিক্যাল এলাউন্স এক শ। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা একেবারে জলে যায় নি। মাঝেমাঝেই খুব তেজী ভাষায় পত্র-পত্রিকায় চিঠিপত্র লেখেন। গত রোববারের আগের রোববারে ইত্তেফাকে তাঁর একটা চিঠি ছাপা হয়েছে। চিঠির বিষয়বস্তু হচ্ছে ঢাকা শহরে মশার উপদ্ৰব। কঠিন ভাষা। ভাগ্যিস মশারা পড়তে জানে না। জানলে এই চিঠি পড়েই তাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যেত।  বারান্দায় দাঁড়িয়েই আমার প্রতিভাবান বাবাকে একঝলক দেখা গেল। তিনি দরজা পর্যন্ত এসে ক্ষীণ গলায় পারুলকে কী সব বলে আবার বিছানায় চলে গেলেন।

পারুল আমার ছোট বোন। ভাই এবং বোনদের মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক থাকে। বলে শুনেছি। আমাদের তা নেই। পারতপক্ষে আমরা দুজন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলি না। সে আমাকে দেখলেই মুখ কুঁচকে ফেলে। কীটপতঙ্গ দেখলে আহলাদী মেয়েগুলো যেমন করে, অনেকটা সেরকম।

পারুল বাবার ঘর থেকে বের হয়ে থমকে দাঁড়াল। শুকনো গলায় বলল, একটা চিঠি এসেছে, টেবিলের উপর আছে। ভাব বাচ্যে কথা। তাও আমার দিকে না তাকিয়ে। যেন দেয়ালের সঙ্গে কথা বলছে। আমি বললাম, চিঠিটা কবে এসেছে?

গতকাল।

এখন দিচ্ছিস কেন?

দেবটা কখন? তুই ফিরেছিস রাত সাড়ে বারটায়। আমি রাত সাড়ে বারটা পর্যন্ত চিঠি কোলে নিয়ে বসে থাকব?

এমন বিশ্রীভাবে পারুল কথা বলল যে, আমার ইচ্ছা করল বালতি থেকে এক মগ পানি এনে ওর মুখে ঢেলে দিই। গলাটা সে এমন করেছে যে, কথাগুলো শোনাচ্ছে বাবার কাশির মতো। অথচ তার গলার স্বর বেশ ভালোই।

আমাদের এ-বাসায় পারুলের কারণেই কিছু যুবকের আনাগোনা আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় সে মিষ্টি একটা গলার স্বর বের করে। সব মেয়েদের স্টকেই বেশ কয়েকরকম গলার স্বর আছে বলে আমার ধারণা। একেক সময় এককটা বার করে। আমার এই বোনটাকে মোটামুটি চলনসই সুন্দরী বলা চলে। তবে সে যতটা না সুন্দর, তার নিজের ধারণা সে তার চেয়েও সুন্দর। এটাই হচ্ছে প্রধান সমস্যা। বিয়ের যেসব প্রস্তাব আসছে তার কোনোটাই তার মনে ধরছে না। ব্যাংকের ম্যানেজারের এক প্রস্তাব এসেছিল। ছেলে দেখতে ভালো। সামান্য বেঁটে, তবে তেমন কিছু না। কথাবার্তা অনেক দূর এগনোর পর পারুল বলল, আমি বারহাট্টার এক গ্রামে পড়ে থাকব। তাই তোমরা চাও? সারাটা জীবন কাটালাম ঢাকা শহরে।

আমার মা হাসিমুখে বললেন, গ্রামই তো ভালো, নিরিবিলি থাকবি! টাটকা শাকসবজি খাবি। পারুল ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমার টাটকা শাকসবজির দরকার নেই।

বাবা দরাজ গলায় বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, বাদ দাও। আরো দেখি?

তারপর একজন পাওয়া গেল ঢাকা শহরের। নওয়াবপুরে তার একটা ইলেকট্রিকের দোকান আছে। পুরনো ঢাকায় নিজেদের এজমালি বাড়ি। পারুল সব শুনে থমথমে গলায় বলল, শেষ পর্যন্ত আমি দোকানদার বিয়ে করব?

মা বললেন, দোকানদার খারাপ কিরে? দোকানদার তো ভালেই। স্বাধীন ব্যবসা। আমাদের রসুলুল্লাহ্ তো ব্যবসা করতেন।

পারুল রাগী গলায় বলল, তুমি যা বোঝ না তা নিয়ে কথা বলবে না তো মা! দেশে কি ডাক্তার-ইনজিনিয়ার নেই যে, আমাকে দোকানদার বিয়ে করতে হবে?

এরপর থেকে আমরা ডাক্তার এবং ইনজিনিয়ার খুঁজছি। আমরা মানে আমার বাবা। তিনি নিয়মিত আমাদের সব আত্মীয়কে চিঠি ছাড়ছেন। প্রতিটি চিঠির ভাষা ও বক্তব্য এক—পর সমাচার এই যে, আমরা কুশলে আছি। দীর্ঘদিন আপনার কোনো পত্রাদি না পাইয়া চিন্তাযুক্ত আছি। সত্বর পত্র মারফত চিন্তা দূর করিবেন। এখন আপনাদের নিকট আমার একটি আবদার। আমার কনিষ্ঠা কন্যাটিকে সুপাত্রে সমৰ্পণ করিতে চাই। আপনাদের সকলের সহযোগিতা ভিন্ন সম্ভব নহে। যেভাবেই হউক একটি পাত্রের সন্ধান দিবেন। পাত্র ডাক্তার বা ইনজিনিয়ার হইলে ভালো হয়। বাবার বেশিরভাগ চিঠিরই জবাব আসে না। তবে তাঁর ধৈর্য অপরিসীম। তিনি আবার লেখেন। কয়েকদিন পর আবার। প্রথম জীবনে তিনি রবার্ট ব্রুসের কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। শেষ বয়সে করেছেন। অধ্যবসায়ের চূড়ান্ত দেখাচ্ছেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ