তিনদিন হলো আইনুদ্দিন মহানন্দে সানাউল্লাহর বাড়িতে বাস করছেন। তাঁকে আলাদা একটা ঘর দেয়া হয়েছে। চেয়ার-টেবিল দেয়া হয়েছে। নীলক্ষেত থেকে বিশাল সাইজের কোলবালিশ কিনে আনা হয়েছে। দিনের মধ্যে কয়েকবার কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকা তার অভ্যাস। আইনুদ্দিনের রুটিন এরকম—

সকাল ছটা : ঘুম থেকে জেগে উঠেন। এক কাপ লিকার চা খেয়ে এবং Physics in trouble বইটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকেন। সকাল সাতটা; নাশতা খেয়েই লেখার টেবিলে। অংক কষার শুরু।

সকাল দশটা। : অংকে বিরতি। কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকা।

সকাল এগারোটা : আবার অংক শুরু।

দুপুর একটা : লাঞ্চ শেষ করে কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুম।

দুপুর তিনটা : কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকা।

সন্ধ্যা ছটা : অংক শুরু।

রাত এগারোটা : রাতের খাবার এবং এক ঘুমে রাত কাবার।

সানাউল্লাহর সঙ্গে তার কথাবার্তা হয় না বললেই ঠিক বলা হয়। রফিক এই মানুষটাকে দেখে মুগ্ধ। সে এসে সানাউল্লাহকে বলল, বিরাট পাগল আদমি স্যার।

সানাউল্লাহ বললেন, কী করে বুঝলি পাগল আদমি?

রফিক বলল, প্রথম রাইতেই বলেছি স্যার আমার নাম রফিক। কিছু যদি লাগে রফিক বইল্যা আওয়াজ দিলে দুইটা আসব। সকালবেলা জিগ্যাস করে— এই তোমার নাম কী? নাম বললাম। সইন্ধ্যাবেলা আবার জিগায়, এই তোমার নাম কী? দিনের মধ্যে কয়েকবার উনারে নাম বলতে হয়।

সানাউল্লাহ বললেন, অতিরিক্ত জ্ঞানের মানুষ তো, এইজন্যে এরকম।

রফিক বলল, খাওয়া খাদ্য নিয়াও উনার কোনো চিন্তা নাই। যা দিতেছি খাইয়া ফেলতেছে। লবণ ছাড়া একবার তরকারি রাইন্ধা দিলাম। আপনেরে আলাদা লবণ দিয়া দিছি। উনারে লবণের একটা দানাও দেই নাই। খাইয়া ফেলছে। কিছু বুঝে নাই।

এরকম আর করবি না। যত্ন করবি।

অবশ্যই যত্ন করব স্যার। জ্ঞানী মানুষের যত্ন না করলে কার যত্ন করব? মূখের যত্ন? বাপ-মা আমারে এইজন্যে পয়দা করে নাই।

সানাউল্লাহ ভেবেছিলেন হমডু-ডমরুর সঙ্গে আইনুদ্দিনের পরিচয় করিয়ে দেবেন। শেষে পরিকল্পনা বাদ দিয়েছেন। ভূতের বাচ্চা দেখে মানুষটা ঘাবড়ে যেতে পারে। জটিল অংক নিয়ে বসেছে। শেষে অংকে গণ্ডগোল হয়ে যাবে।

হমডু-ডমরুকে আইনুদ্দিনের কথা বলেছেন। তারাও আড়াল থেকে দেখে এসেছে। তারা আইনুদ্দিনের নাম দিয়েছে অংক চাচু।

সানাউল্লাহ এখন নিয়ম করে তাদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। যুক্তাক্ষর ছাড়া বাংলা শব্দ দুজনই পড়তে পারে! হমড়ু যোগ-বিয়োগ শিখে ফেলেছে। ডমরু মনে হচ্ছে অংকে একটু কাঁচা। লেখাপড়া সানাউল্লাহ খুব কায়দা করে শেখাচ্ছেন। রফিককেও সঙ্গে নিয়ে বসছেন। তিনজন একসঙ্গে শিখছে। কাজেই রফিক কিছু বুঝতে পারছে না। হমড়ু ডমরু রফিকের আশেপাশেই ঘুরঘুর করে কিন্তু রফিক তাদের দেখতে পায় না। অথচ তিনি নিজে স্পষ্ট দেখছেন। মাঝে মাঝে তার নিজের ক্ষীণ সন্দেহ হয়। হমডু ডমরু তাঁর মনের কল্পনা না তো? পরমুহূর্তেই এই চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দেন। মনের কল্পনা হলে রোজ যে ব্যাটারি কিনে আনছেন, সেই ব্যাটারিগুলি খাচ্ছে কে?

হমড়ু ডমরুর ওপর তার অস্বাভাবিক মায়া পড়ে গেছে। এখন তারা আর খাটের নিচে ঘুমায় না। সানাউল্লাহর সঙ্গে খাটেই ঘুমায়। সানাউল্লাহকে রাতে গল্প শুনাতে হয়। সানাউল্লাহ ঠাকুরমার ঝুলি বইটা কিনে এনেছেন। রোজ রাতে বই থেকে দশ পাতা পড়ে শুনাতে হয়। তিনি চেষ্টা করছেন দুই ভাইবোনের রাতে জেগে থাকার অভ্যাস দূর করতে। মানুষের সঙ্গে তারা যেহেতু বাস করছে তাদের মানুষের স্বভাব গ্রহণ করাই ভালো। ডমরু এখন রাতে ঘুমানো অভ্যাস করে ফেলছে। হমডু ঘুমাচ্ছে না, তবে হাইতোলা শুরু করেছে। মনে হয় কিছুদিন পর সে নিজেও ঘুমাতে শুরু করবে।

সানাউল্লাহ ভূত সমাজের জন্যে কিছু করতে চান। প্রাণী হিসেবে মানুষের অবস্থান ভূতের ওপরে। ওপরের অবস্থানের প্রাণী দুর্বলদের জন্যে কিছু করবে সেটাই স্বাভাবিক। ভূতদের জন্যে তিনি কী করবেন তা মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছেন—

ক, বাসস্থান সমস্যার সমাধান। যেসব গাছে ভূতরা থাকতে চায় সেইসব গাছ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে লাগানো। যেমন, শ্যাওড়া গাছ, তেঁতুল গাছ, বেল গাছ, বাঁশঝাড়। অনাথ ভূতশিশু কিংবা পিতামাতা পরিত্যক্ত ভূত শিশুদের জন্যে একটা এতিমখানা প্রতিষ্ঠা।

খ. ভূতদের আদমশুমারি অর্থাৎ ভূত শুমারি করা। যাতে বাংলাদেশে ভূতের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়।

গ. ভূত খাদ্য। ভূতরা ঠিকমতো খাদ্য খাচ্ছে কি-না সেটাও লক্ষ রাখতে হবে। খাদ্যের অভাবে এরা যেন কষ্ট না পায়।

ঘ. তাদের শিক্ষার দিকটাও দেখতে হবে। মানুষরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এতদূর এগিয়েছে, ভূতরা শিক্ষার অভাবে পিছিয়ে থাকবে, এটা কেমন কথা!

সানাউল্লাহ একদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। যেসব ভূত ঢাকা শহরে বাস করে, তাদের নগরের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের পূর্ণ অধিকার আছে। এই বিষয়টাই উনাকে বুঝিয়ে বলা।

চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ঢাকা শহরে আপনি শ্যাওড়া গাছ আর বাশ গাছ লাগাতে চান?

সানাউল্লাহ বললেন, জি জনাব। নিজ খরচে করব, এতে বাসস্থান সমস্যার আশু সমাধান হবে।

কার বাসস্থান?

ভূতদের বাসস্থান। তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তো হবে না। ওদের সুযোগ-সুবিধা আমাদের দেখতে হবে। তারা আমাদের মতোই ঢাকা শহরে বাস করছে। যদিও মিউনিসিপ্যালটি Tax দিচ্ছে না। প্রয়োজনে দিবে।

আপনি কি সত্যি সত্যি ভূতদের জন্যে শ্যাওড়া গাছ লাগাতে চাচ্ছেন?

জি জনাব। আমি পুরো বিষয়টা ব্যাখ্যা করে মেয়র সাহেবের কাছে একটা আর্জিনামা লিখে এনেছি।

আর্জিনামা রেখে যান, আমি মেয়র সাহেবের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করব।

সানাউল্লাহ বললেন, আপনার অশেষ মেহেরবানি। ভূত সমাজের পক্ষ থেকে আপনাকে জানাচ্ছি আমার কৃতজ্ঞতা।

চিফ ইঞ্জিনিয়ার বললেন, ভাই যদি কিছু মনে না করেন, আপনার কিন্তু ভালো চিকিৎসা দরকার।

সানাউল্লাহ বললেন, আমার মেয়ে জাবিনেরও তাই ধারণা। সে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনে অস্ট্রেলিয়ায় চিকিৎসা নেব। মেয়ে দেখবে।

মেয়ের কাছে থাকুন, ভালো থাকবেন। ভূতদের নিয়ে ভূতরা চিন্তা করুক। তাই না? আরেকটা কথা, ভূতদের প্রতি আপনার এত মমতা, আপনি নিজে কি কখনো ভূত দেখেছেন?

সানাউল্লাহ বললেন, ভূতের দুই বাচ্চা আমার সঙ্গেই থাকে। এরা ভাইবোন। বোনটা আমাকে বাবা ডাকে। এই তথ্যটা আপনাকে প্রথম জানালাম। আর কেউ জানে না। আমার মেয়ে জাবিনকেও বলি নি। একটা ভূতের বাচ্চা আমাকে বাবা ডাকছে— এটা জানলে সে মনে কষ্ট পেতে পারে।

চা খাবেন?

সানাউল্লাহ বললেন, চা খাব না ভাই। আপনি যে চা খাওয়াতে চেয়েছেন এটাই যথেষ্ট। অফিস-আদালতে এই কাজটা আজকাল কেউ করে না। সবাই আছে নিজের ধান্ধায়। সবাই দেখছে নিজের স্বার্থ। আমার মেয়ে আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। সে দেখছে নিজের স্বার্থ। সে একবারও চিন্তা করছে না ভূতের বাচ্চা দুটার কী হবে? এদের কার কাছে রেখে যাব?

চিফ ইঞ্জিনিয়ার বললেন, এদের আপনি সঙ্গে করে নিয়ে যান। ভূতের দুই বাচ্চার ভিসাও লাগবে না। টিকিটও লাগবে না।

সানাউল্লাহ আনন্দিত গলায় বললেন, অতি উত্তম প্রস্তাব দিয়েছেন ভাই সাহেব। আমার মাথায় বিষয়টা একবারও আসে নি। আপনার এখানে আসা আমার সার্থক হয়েছে।

যদি সময় পান অষ্ট্রেলিয়া যাবার আগে একবার আসবেন।

অবশ্যই আসব।

সবচেয়ে ভালো হয় আমার বাসায় যদি একবার আসেন। আপনার নিজের মুখ থেকে পোষা ভূতের গল্প শুনলে আমার ছেলেমেয়েরা মজা পাবে। ওরা আমার কাছে রোজ রাতে ভূতের গল্প শুনতে চায়। আমি কোনো ভূতের গল্প জানি না বলে বলতে পারি না।

কবে যেতে বলছেন?

দেরি করে লাভ কী! আজই চলে আসুন। আমি ধানমণ্ডিতে থাকি।

সানাউল্লাহ বললেন, ভাই, আজ তো যেতে পারব না। আজ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আত্মাকে আনা হবে। চক্রের মাধ্যমে আনা হবে। নরুন্দ সাহেব ব্যবস্থা করছেন। উনি থিয়সফিস্ট বিখ্যাত মিডিয়াম।

চিফ ইঞ্জিনিয়ার ড্রয়ার থেকে তার একটা কার্ড বের করে দিতে দিতে বললেন, কার্ডটা রেখে দিন। ঠিকানা লেখা আছে। যে-কোনো সন্ধ্যায় টেলিফোন করে বাসায় চলে আসবেন। আমার ছেলেমেয়েরা আপনার ভূতের বাচ্চার গল্প শুনবে। রবীন্দ্রনাথের আত্মার সঙ্গে দেখা হওয়ার গল্পও শুনবে।

 

নরুন্দ সাহেবের বাড়িতে ভৌতিক চক্র বসেছে। একটা গোল টেবিলের চারপাশে হাত ধরাধরি করে পাঁচজন বসা। সবার হাত টেবিলে রাখা। টেবিলের মাঝখানে একটা মোমবাতি জ্বলছে। এছাড়া ঘরে কোনো আলো নেই। নন্দের গলায় বেলিফুলের মালা। মোমবাতির নিচেও কিছু টাটকা বেলিফুল রাখা হয়েছে। বেলি ফুলের কোনো গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরের এক কোনায় ধূপ পোড়ানো হয়েছে। ঘরভর্তি ধুপের গন্ধ। নন্দ কথা বলা শুরু করলেন—

ভৌতিক চক্রে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম। এখানে যারা আছেন, তারা একাধিকবার চক্রে বসেছেন। আজ আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন নতুন সদস্য জনাব সানাউল্লাহ। তিনি একজন বিশিষ্ট গ্রন্থকার। তার সঙ্গে কথাবার্তা থেকে কিছুক্ষণ আগে জেনেছি তিনি যে গ্রন্থটি রচনা করছেন তার নাম দিনের শেষে ভূতের দেশে। এই নামটি কবিগুরুর গান থেকে ধার করা। আজ আমরা কবিগুরুকে চক্রে আহ্বান করব।

আপনারা সবাই চোখ বন্ধ করে এক মনে বলবেন, গুরুদেব আসুন। আমরা আপনার প্রতীক্ষায়। কেউ হাত ছাড়বেন না। আমরা হাতে হাত ধরে গেলি করে বসেছি। এই কারণে একটি চৌম্বক আবেশের তৈরি হয়েছে। যখন আবেশ জোরালো হবে তখন চৌম্বক ঝড় পরকালে ধাক্কা দেবে। কবিগুরু আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলে আসবেন।

সানাউল্লাহ আশ্চর্য হয়ে বললেন, উনাকে কি চোখের সামনে দেখব?

নরুন্দ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সানাউল্লাহর দিকে তাকালেন। নরুন্দের অ্যাসিসটেন্ট আসগর মিয়া নরুন্দের ডানদিকে বসেছেন। কাকলাসের মতো চেহারা। নাকের নিচে বিরাট গোঁফ। গোফটা এমন যে মনে হয় গাম দিয়ে লাগানো। কথা বললেই খুলে পড়ে যাবে। আসগর মিয়া বললেন, রবীন্দ্রনাথের আত্মা স্যারের উপর ভর করবে। তখন রবীন্দ্রনাথের হয়ে স্যরি কথা বলবেন। স্যারের উপর ভর করার একটাই কারণ— স্যারের মতো মিডিয়াম অতি দুর্লভ।

নরুন্দ বললেন, অতি উচ্চশ্রেণীর ভৌতিক চক্রে অবশ্যি চর্মচক্ষেও আত্মা দেখা যায়। আমার কয়েকবার সেই সৌভাগ্য হয়েছে। শেকসপিয়র সাহেবকে দেখেছি। তার সঙ্গে হ্যান্ডশেকও করেছি। সেই গল্প আরেকদিন করব। যাই হোক, আপনারা আহ্বান শুরু করুন। আত্মার অবির্ভাবের পর তাকে প্রশ্ন করতে পারেন। প্রশ্ন করবেন বিনয় এবং ভদ্রতার সঙ্গে। সবার চোখ বন্ধ। বলুন, গুরুদেব আসুন। আমরা আপনার প্রতীক্ষায়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নরুন্দর শরীর কাঁপতে লাগল। তিনি ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন। মাথা পেন্ডুলামের মতো দুলতে লাগল। আসগর মিয়া বললেন, গুরুদেব চলে এসেছেন। সবাই বলুন, সুস্বাগতম।

সবাই বলল, সুস্বাগতম।

নরুন্দ চোখ মেলে সবার দিকে তাকালেন এবং খানিকটা মেয়েলি গলায় বললেন, তোমরা ভালো আছ? বলেই তাকালেন সানাউল্লাহর দিকে।

সানাউল্লাহ ভীত গলায় বললেন, স্যার আমি ভালো আছি। অন্যদের কথা বলতে পারছি না। আপনি কেমন আছেন?

নরুন্দ (অর্থাৎ কবিগুরু) বললেন, আমি অনিত্য। জগৎ অনিত্য। আমি এই অনিত্যের মাঝেই নিত্যের অনুসন্ধানে ব্যস্ত আছি।

এখনো কি কবিতা রচনা করেন?

আমি যেখানে বাস করি সেখানে কাগজও নেই কলমও নেই। তারপরেও মনে মনে কাব্য রচনা করি। অবসরে নিজের লেখা পুরনো কবিতাগুলি আবৃত্তি করি–

শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির
লিখে রেখো, দুই ফোঁটা দিলেম শিশির।

সানাউল্লাহ বিঘ্নিত হয়ে বললেন, নিজের কবিতা ভুল করেছেন স্যার। দুই ফোঁটা শিশির হবে না স্যার। হবে একফোঁটা শিশির।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, মর্তে আমি একফোঁটা শিশিরের কথাই লিখেছিলাম। পরকালে এসে মনে হলো আমাকে এই কৃপণতা মানায় না। শিশির দুই ফোঁটা হওয়া উচিত। কাজেই কারেকশন করেছি।

কথা শেষ হবার আগেই নরুন্দ গো গো শব্দ করতে করতে ধড়াম করে টেবিলে পড়ে গেলেন। আসগর মিয়া বললেন, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। গুরুদেব চলে গেছেন। আজকের মতো চক্রের সমাপ্তি। সবাই যার যার বাড়িতে চলে যান। আমার স্যার অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তাকে মেডিকেলে নিতে হতে পারে।

 

সানাউল্লাহ বন্ধুকে নিয়ে রাতের খাওয়া খেতে বসেছেন। আইনুদ্দিনকে অত্যন্ত চিন্তিত মনে হচ্ছে। বেচারা অংক নিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রম করছেন বুঝাই যাচ্ছে। চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে।

সানাউল্লাহ বললেন, অঙ্ক কোন পর্যায়ে আছে? আইনুদ্দিন বললেন, একটা wave function দাড় করিয়ে ফেলেছি।

তাহলে তো মনে হয় অনেকদূর চলে গেছ।

আইনুদ্দিন চিন্তিত গলায় বললেন, তা না। জিনিস আরো জটিল হচ্ছে।

সানাউল্লাহ বললেন, রুবা ভাবি অস্থির হয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। তুমি যে আমার এখানে আছ তা জানাব?

ভুলেও না। এখানে আমি ভালো আছি। শুধু খাবারদাবারে মাঝে মধ্যে সামান্য সমস্যা হচ্ছে।

কী সমস্যা? তোমার কাজের ছেলে, ওর নাম যেন কী? রফিক।

আইনুদ্দিন বললেন, রফিক ছেলেটা রান্নাবান্নায় বিশেষ পারদর্শী বলে মনে হচ্ছে না। প্রায়ই লবণ ছাড়া তরকারি রাধছে। তুমি আলাভোলা মানুষ বলে বুঝতে পারছ না। একদিন সকালে আমাকে চিনির বদলে লবণ দিয়ে চা দিল।

ওকে কিছু বলো না কেন?

লজ্জা পাবে বলে কিছু বলি না। মানুষ হয়ে জন্মেছে, ভুল তো করবেই।

 

খাওয়াদাওয়া শেষ করে সানাউল্লাহ রাতে ঘুমুতে গেছেন। ঠাকুরমার ঝুলি থেকে হমড়ু-ডমরুকে গল্প পড়ে শোনাচ্ছেন।

ক্রমে ক্রমে রাজার ছেলেরা বড় হইয়া উঠিল। পেঁচা আর বানরও বড় হইল। পাঁচ রাজপুত্রের নাম হইল— হীরারাজপুত্র, মানিকরাজপুত্র, মোতিরাজপুত্র, শঙখরাজপুত্র আর কাঞ্চন রাজপুত্র।

পেঁচার নাম হইল ভুতুম
আর
বানরের নাম হইল বুদ্ধু।…

এই সময় জাৰিনের টেলিফোন। সে উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, টেলিফোন করে করে তোমাকে পাচ্ছি না। বাবা, কী করছ?

সানাউল্লাহ বললেন, গল্প পড়ে শুনাচ্ছিরে মা। তোকে যেমন শুনাতাম। ঠাকুরমার ঝুলি থেকে পড়ে শুনাচ্ছি।

কাকে পড়ে শোনাচ্ছি?

হমড়ু আর ডমরুকে।

জাবিন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কাকে?

মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে সানাউল্লাহ বললেন, নিজেকেই পড়ে শোনাচ্ছি। আর কল্পনা করছি তুই ঘুমঘুম চোখে পাশে আছিস।

জাবিন বলল, অদ্ভুত অদ্ভুত কথা তোমার সম্পর্কে শুনতে পাচ্ছি বাবা। মন অত্যন্ত খারাপ।

সানাউল্লাহ চিন্তিত গলায় বললেন, কী কথা শুনছিস?

জাবিন বলল, যারাই তোমার সঙ্গে মেশে তাদেরকেই তুমি পাগল বানিয়ে ছেড়ে দাও।

কাকে আবার পাগল বানালাম?

হামিদ মামাকে। উনি এখন রোজ সকালে নাশতার মতো একটা করে ব্যাটারি খান।

এটা তো জানতাম না।

আবু করিম চাচা তো মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একজন শুধু বাকি আছে। আইনুদ্দিন চাচা। বাবা, উনিও কি পাগল হয়ে গেছেন? ইন্টারনেটে দেখলাম তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কুবা চাচি তার সন্ধান চেয়ে সব পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। আমাকে তো তুমি কিছুই জানাচ্ছ না।

সানাউল্লাহ বললেন, আইনুদ্দিন ভালো আছে। আমার বাড়িতেই লুকিয়ে w!

বলো কী! কেন?

জটিল একটা অংক ধরেছে। তার বাসায় অংকের পরিবেশ নেই।

কী অংক?

ভূতের একটা অংক। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দিয়ে ভূত আছে কি নাই প্রমাণ হয়ে যাবে। সে ভূতের wave function তৈরি করে ফেলেছে।

জাবিন কাদো কাঁদো গলায় বলল, বাবা কী হচ্ছে।

সানাউল্লাহ বললেন, কিছু হচ্ছে না তো মা। সব নরমাল।

তুমি কি ভালো আছি?

সানাউল্লাহ বললেন, আমি খুবই ভালো আছি। এমনিতেই ভালো ছিলাম, কবিগুরুর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর আরো ভালো লাগছে।

কার সঙ্গে কথা বলেছ?

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরকালে বসে উনি এখন নিজের পুরনো কবিতা কারেকশন করছেন। ঐ যে কবিতাটা আছে না—

শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির
লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির

এখানে এক ফোঁটার জায়গায় এখন হবে দুফোঁটা। তোর কাছে সঞ্চয়িতা আছে না? কারেকশন করে ফেল।

জাবিন টেলিফোন রেখে দিল। ইন্টারনেট নিয়ে বসল। ঢাকায় আসার টিকিট কাটবে। আর দেরি করা যাচ্ছে না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ