ডা. আবু করিম ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিনের প্রাক্তন শিক্ষক। ছাত্রজীবনে তিনি গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। চিকিৎসক কিংবা অধ্যাপক কোনোটাতেই তেমন সুবিধা করতে পারেন নি। তাঁর অনেক ছাত্র তাকে ডিঙিয়ে ফুল প্রফেসর হয়েছে। তিনি হতে পারেন নি। প্রাইভেট প্রাকটিস করতে গিয়েছেন, সেখানেও কিছু হয় নি। ডাক্তারদের চেম্বার থাকে রোগীতে ভর্তি। কয়েকজন অ্যাসিসটেন্ট রোগী সামলাতে হিমশিম খায়। তাঁর চেম্বার খালি। মাছিও উড়ে না। কারণ তার চেম্বার অতি পরিচ্ছন্ন চেম্বার। মাছিরা পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করে না।

ভালো বেতন দিয়ে তিনি একজন অ্যাসিসটেন্ট রেখেছিলেন। নাম্বার দেয়া প্লাস্টিকের কার্ডের ব্যবস্থা করেছিলেন। ওয়েটিং রুমে ৪২ ইঞ্চি ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি রেখেছিলেন। রোগীর নাম্বার ফ্ল্যাট স্ক্রিনে উঠবে তখন রোগী ঢুকবে। তার আগে না। প্লাস্টিক নাম্বার কার্ডে তিনি অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু নির্দেশও লিখেছিলেন। নমুনা—

রোগী নাম্বার ১৪

ক) TV screen-এ নাম্বার না দেখা পর্যন্ত শান্ত হয়ে অপেক্ষা করুন।

খ) আপনার রোগ নিয়ে পাশের রোগীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা থেকে বিরত থাকুন।

গ) পেছনের নাম্বার আগে আনার তদবির করবেন না।

ঘ) মোবাইল টেলিফোনে উচ্চস্বরে আলাপ করবেন না।

ঙ) আপনাদের সময় কাটানোর জন্যে অনেক ম্যাগাজিন রাখা আছে। ম্যাগাজিন পড়ুন। তবে দয়া করে বাড়িতে নিয়ে যাবেন না।

আবু করিমের অ্যাসিসটেন্ট তিন মাস কাজ করার পর অর্থাৎ তিন মাস চুপচাপ বসে থাকার পর এক সন্ধ্যায় চারটা থার্মোমিটার, প্রেসার মাপার যন্ত্র, কান দেখার যন্ত্র এবং পাঁচটা ওরস্যালাইনের প্যাকেট নিয়ে ভেগে চলে গেল। ডা. আবু করিম চেম্বার উঠিয়ে দিলেন।

এখন তিনি একা থাকেন। তার স্ত্রী (তিনিও ডাক্তারী শায়লা আলাদা থাকেন। তিনি বলেন, অর্ধ উন্মাদের সঙ্গে বাস করা সম্ভব না। ডাক্তার হিসেবে শায়লা অত্যন্ত সফল। তার চেম্বার সব সময় রোগীতে ভর্তি থাকে।

ডা. আবু করিমের এখন সময় কাটে টিভিতে রান্নার অনুষ্ঠান দেখে দেখে বিভিন্ন খাবার তৈরিতে। তিনি আচার বানানোতেও বিশেষ পারদর্শীতা লাভ করেছেন। তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবন নিম পাতার তিক্ত আচার। জাতীয় আচার প্রতিযোগিতায় তাঁর তৈরি নিম পাতার তিক্ত আচার পঞ্চম পুরস্কার পেয়েছে। সাজিনা গাছের ছালের আচার পেয়েছে অনারেবল মেনশান। বাণিজ্যিকভাবে তিনি এই দুই ধরনের আচার তৈরির বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন।

ডা. আবু করিমের একমাত্র বন্ধু সানাউল্লাহ। আবু করিম রোগী দেখা ছেড়ে দিয়েছেন, তবে সানাউল্লাহর ব্যাপারে অন্য কথা। সানাউল্লাহ শুধু যে তার রোগী তা-না, আচার টেস্টার। বন্ধুর আচার প্রতিভায় সানাউল্লাহ মুগ্ধ।

সকাল দশটার আগে কাউকে দেখতেই আবু করিম খুশি হন না। আজ সানাউল্লাহকে দেখে অতিব আনন্দ পেলেন। গত সাতদিনের চেষ্টায় নতুন একটি আচার তৈরি হয়েছে। আমার জগতের বিপ্লব বলা যেতে পারে। কারণ এই আচারের নাম আমিষ আচার। গরুর মাংসের নির্যাসের সঙ্গে কাচামরিচ, শুকনা মরিচ এবং নাগা মরিচের নির্যাস প্রথমে মেশানো হয়েছে। টকভাব আনার জন্যে দেয়া হয়েছে অ্যাসিটিক অ্যাসিড। জেলিভাব আনার জন্যে তার সঙ্গে মিশানো হয়েছে Agar Agar, প্রতিটি আচারের বোতলে একটি করে বিশ মিলিগ্রামের ভিটামিন B কমপ্লেক্স মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। পুষ্টিমান ঠিক রাখার ব্যবস্থা।

সানাউল্লাহ চায়ের চামচে এক চামচ আমিষ আচার খেয়ে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে থেকে বললেন, জিনিসটা মনে হচ্ছে বিষাক্ত।

আবু করিম বিরক্ত হয়ে বললেন, বিষাক্ত হবে কোন দুঃখে? তুমি চামচ ভর্তি করে সিরাপের মতো করে খাচ্ছ বলে এরকম লাগছে। চেটে চেটে খাও।

সানাউল্লাহ তাই করলেন এবং বললেন, মন্দ না।

আবু করিম বললেন, মন্দ না শব্দটা আমার সামনে দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করবে। মন্দ না হচ্ছে একটা নন কমিটেল টার্ম। লাইফে কমিট করতে হয়। বলবে মন্দ অথবা ভালো। মন্দ না কখনোই না।

সানাউল্লাহ বললেন, ভালো, তবে একটু ইয়ে।

ইয়ে মানে? স্পষ্ট করে বলো।

স্পষ্ট করে বলতে পারছি না। আরেক চামচ খেয়ে দেখি।

যত ইচ্ছা খাও। অতি উপকারী আচার। প্রোটিনের বিল্ডিং ব্লক অ্যামিনো অ্যাসিডে ভর্তি। এর সঙ্গে হয়েছে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স। আগার আগার দেয়াতে কোষ্টকাঠিন্যও কাজ করবে। নাগা মরিচ এবং কাচামরিচের রস ব্লান্ড থিনারের কাজ করবে, থ্রম্বোসিস হবে না।

সানাউল্লাহ মুগ্ধ হয়ে বললেন, দেখি আরেক চামচ। তিনি দুপুরের মধ্যে বোতল অর্ধেক নামিয়ে ফেললেন।

আবু করিম বললেন, আজ আমার মনটা বিশেষ খারাপ। তোমার আচার খাওয়া দেখে মন খারাপ ভাব সামান্য কমেছে।

মন খারাপ কেন?

আমার চোর অ্যাসিসটেন্টকে তোমার ভাবি তার চেম্বারে চাকরি দিয়েছে।

কাজটা ঠিক হয় নি।

গুন্ডা প্রকৃতির কারো সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে?

আছে। আমার খালাতো ভাই হামিদুর রহমান ওয়ার্ড কমিশনার।

তাকে দিয়ে আমার চোর অ্যাসিসটেন্টকে পাবলিকলি কানে ধরে উঠবোস করাতে পারবে? তোমার ভাবির সামনে করালে ভালো হয়।

সানাউল্লাহ বললেন, তার ঠিকানা জানি না। দেখি যোগাযোগ করতে পারি কি-না।

আবু করিম আমিষ আচারের সাফল্যে মুগ্ধ হলেন। সানাউল্লাহ বললেন, জাবিন কাল রাতে আমাকে বিশেষভাবে বলেছে থরো চেকআপ করতে।

আবু করিম বললেন, এখনই করছি, প্রেসার-সুগার সব মেপে দিচ্ছি।

সানাউল্লাহ বললেন, জ্বরের একটা ওষুধ দিও তো।

আবু করিম বললেন, তোমার জ্বর?

আমার না। ডমরুর জ্বর।

ডমরু কে?

সানাউল্লাহ বললেন, ডমরু হলো হমডুর ছোটবোন।

বয়স?

ঠিক বয়স বলতে পারব না। শিশু।

আবু করিম বললেন, শিশুদের আমি জ্বরের জন্যে এনালজেসিক দেবার পক্ষপাতি না। গা স্পঞ্জ করে জ্বর কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে কোল্ড শাওয়ার।

সানাউল্লাহ বললেন, তোমার এই আমিষ আচার শিশুরা কি খতে পারবে?

এখনো টেস্ট করা হয় নাই। তবে ঝাল বেশি, এটা একটা সমস্যা। শিশুদের জন্যে আলাদা একটা মিষ্টি ভার্সান করার পরিকল্পনা আছে। বাজারে অনেক কাচামরিচ পাওয়া যায় ঝালের বংশও নাই। তার নির্যাস ব্যবহার করা হবে। সঙ্গে মধু দেয়া হবে। মধুর Fructose শিশুরা পছন্দ করবে। চেটে চেটে খাবে।

সানাউল্লাহ হঠাৎ করে বললেন, তুমি কি ভূত বিশ্বাস কর?

আবু করিম ভুরু কুঁচকে বললেন, ভূতের কথা এল কী জন্যে?

এম্নি জিজ্ঞেস করলাম।

ভূত-ফুত বিশ্বাস করি না। ভূত হচ্ছে দুর্বল মস্তিষ্কের মানুষের কল্পনা।

সানাউল্লাহ বললেন, ঠিক বলেছ।

আবু করিম বললেন, ভূত প্রেত প্রসঙ্গ আমার সামনে তুলবে না। অযথা সময় নষ্ট।

সানাউল্লাহ বলল, অবশ্যই।

তুমি আচারের বোতলটা নিয়ে যাও। ভাতের সঙ্গে খেয়ে দেখ কী অবস্থা।

সানাউল্লাহ বন্ধুর কাছ থেকে আমিষ আচারের বোতল নিয়ে বাসায় ফিরলেন। জাবিন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোন করল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, বাবা, ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ।

ডাক্তার কী বললেন?

বললেন সব ঠিক আছে। ব্লাড় কলোস্টরেল টেস্ট করতে বলেছেন। কাল পরশু করিয়ে ফেলব।

হমডু ডমরুর বিষয়টা বলেছ?

বলেছি। ডমরুর জ্বরের কথা বললাম। উনি কোনো ওষুধ দিতে রাজি হন নি। তবে ওদের জন্যে এক বোতল আচার দিয়ে দিয়েছেন।

কী বললে, এক বোতল আচার দিয়ে দিয়েছেন?

হ্যাঁ। আমিষ আচার। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স সমৃদ্ধ।

বাবা, তুমি অবশ্যই ঘন ঘন করিম চাচার বাসায় যাবে না। এত বড় একজন ডাক্তার হয়ে যিনি শুধু আচার বানান তার মাথায় সমস্যা আচ্ছে।

সানাউল্লাহ হতাশ গলায় বলেন, শুধু আচার তো বা বানায় না। রান্না করেন। নতুন নতুন রেসিপি আবিষ্কার করেন। তাঁর আবিষার তিতা করলা দিয়ে গরুর মাংস অসাধারণ জিনিস। একবার যে এই জিনিস খাবে তার মুখে অন্য কিছু রুচবে না।

জাবিন বলল, করিম চাচাপ্রসঙ্গে কথা বলতে আর ভালো লাগছে না। বাবা শোন, তুমি তোমার ভূতের বাচ্চাকে টেলিফোন দাও। আমি কথা বলব।

এখন তো দেয়া যাবে না।

কেন দেয়া যাবে না? তারা তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারলে আমার সঙ্গেও কথা বলতে পারবে।

ওরা ঘুমাচ্ছে। এরা দিনমায় রাতে জেগে থাকে।

বাবা শোন, তোমার কথাবার্তা আমার কাছে খুবই এলোমেলো মনে হচ্ছে। আমি এক মাসের মধ্যে ঢাকায় এসে তোমার ব্যবস্থা করছি।

কাবেই এলোমেলো মনে হচ্ছে আমিএকমাসের মধ্যে ঢাকায় এসে তোমার ব্যবস্থা করছি।

সানাউল্লাহ আনন্দিত গলায় বললেন, মা চলে আয়। অনেকদিন তোকে দেখি না। কবে আসবি তারিখটা বল, আমি এয়ারপোর্টে থাকব।

জাবিন বলল, আমাকে একটা সত্যি কথা বলো তো বাবা। তুমি ঢাকায় আমাকে আনার জন্যে ভূতের গল্প ফেঁদেছ। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে এই মনে করে আমি ছুটে যেন চলে আসি। ঠিক বলছি না বাবা?

সানাউল্লাহ চুপ করে রইলেন।

জাবিন বলল, দেখছ আমার কত বুদ্ধি। আমাকে আনার জন্যে ভূতের গল্প ফাঁদার প্রয়োজন নেই বাবা। তোমার জামাই ছুটি পাচ্ছে না বলে আসতে পারছি না। ছুটি পেলেই চলে আসব। আমাকে আর ভূত-প্রেতের গল্প বলবে না। বাবা, ঠিক আছে?

হ্যাঁ ঠিক আছে।

বাবা, টেলিফোন রাখি?

আচ্ছা।

টেলিফোন রেখে সানাউল্লাহ ঘর তালাবন্ধ করে বের হলেন। কয়েকটা জিনিস কেনা দরকার।

হমডু ডমরুর জন্যে নরম পোশাক। কয়েক কৌটা মধু। বিভিন্ন রকমের ফলের জুসও কেনা যেতে পারে। মধু যেহেতু খায় ফলের রসও খাবার সম্বাবনা। নিউ মার্কেতে বইয়ের দোকানে যাওয়া দরকার। ভূত বিষয়ে বইপত্র যদি পাওয়া যায়।

ভূত-প্রেত বিষয়ক অনেক বই পাওয়া গেল। সবই গল্প উপন্যাস। যেমন— রাক্ষস খোক্কস। রক্তহিম ভূতের গল্প। বাঁশগাছের পেত্নী। সানাউল্লাহর দরকার শিক্ষামূলক বই, এইসব না। তিনি লাইব্রেরিয়ানকে বললেন, এর বাইরে কিছু

আছে?

লাইব্রেরিয়ান বললেন, এর বাইরে বলতে কী বুঝাচ্ছেন?

শিক্ষামূলক বই। যেমন, ভূতের খাদ্য। বা ভূতদের সামাজিক বিন্যাস। আমার আসলে প্রয়োজন ভূতদের খাদ্য বিষয়ক বই।

লাইব্রেরিয়াম অবাক হয়ে বললেন, ভূতের খাদ্য বিষয়ক বই চাচ্ছেন?

সানাউল্লাহ বললেন, জি। আমরা মানুষরা মূলত তিন ধরনের খাদ্য গ্রহণ করি আমিষ, শর্করা, স্নেহ। ভূতদের কী অবস্থা। আমার বাসায় দুটা ভূতের বাচ্চা আছে। ওদের কী খাওয়া বুঝতে পারছি না। সমস্যায় আছি।

আপনার বাসায় দুটা ভূতের বাচ্চা?

জি। ভাইবোন।

ও আচ্ছা।

ভাইটা বড়! নাম হমডু। ওদের পুষ্টিকর খাবার কী দেয়া যায় তাই নিয়ে চিন্তিত।

লাইব্রেরিয়ান বললেন, স্যার, আপনি বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুষ্টি বিজ্ঞানে চলে যান। তারা হয়তো বলতে পারবে।

সানাউল্লাহ বললেন, পুষ্টি বিজ্ঞানে যাবার ইচ্ছা আছে। তবে তারা আমাকে পাগল ভাবে কি-না কে জানে।

পাগল ভাবার সম্ভাবনা আছে। স্যার, চা খাবেন? একটু চা খান। এখানে ভালো সিঙ্গারা পাওয়া যায়। সিঙ্গারা আনিয়ে দেই।

সানাউল্লাহ লাইব্রেরিয়ানের ভুদ্রতায় মুগ্ধ হলেন। চা-সিঙ্গারা খেতে রাজি হলেন। এবং ভদ্রতার কারণেই তার দোকান থেকে একটা বই কিনলেন। ভূতের বই। নাম মধ্যরাতের হাসি! লাইব্রেরিয়ান বললেন, স্যার আমার নাম কাদের। এদিকে যখন আসবেন অবশ্যই আমার দোকানে আসবেন। চা-সিঙ্গারা খেয়ে যাবেন। আপনার বাসায় গিয়ে ভূতের বাচ্চা দেখারও শখ আছে। যদি অনুমতি দেন।

সানাউল্লাহ বললেন, এখন ওদেরকে লুকিয়ে রেখেছি। জানাজানি হলে লোকজন হামলে পড়বে। পত্রিকাওয়ালা, টিভি চ্যানেল। জীবন অস্থির করে ফেলবে।

ঠিক বলেছেন স্যার।

নিউ মার্কেট থেকে সানাউল্লাহ কিছু কেনাকাটা করলেন। হমডুর জন্যে লাল শার্ট, খাকি হাফপ্যান্ট। একজোড়া রাবারের নরম জুতা। ডমরুর জন্যে কিছু কেনা হলো না। তাকে তিনি এখনো চোখে দেখেন নি, তার সাইজ কী তাও জানেন না। কিছু খেলনা কিনলেন। ব্যাটারিতে চলে এমন গাড়ি। একটা মাছ, বোতাম টিপলেই লেজ নেড়ে এগুতে থাকে, পোঁ পোঁ শব্দ করে। বড় একটা গাঢ় হলুদ রঙের বল কিনলেন। ভূতের বাচ্চারা এইসব খেলনা পছন্দ করে কি-না তিনি জানেন না। তারপরেও কেনা থাকল। শিশু হচ্ছে শিশু। ভূতশিশু মানবশিশু আলাদা কিছু না বলেই তার ধারণা। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কারো সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সে তার এক বন্ধু আছেন। প্রফেসর। নাম ড. আইনুদ্দিন। তার সঙ্গে আলোচনা করা যায়।

ড. আইনুদ্দিন সিরিয়াস ধরনের মানুষ। যে-কোনো বিষয় নিয়ে সিরিয়াস কথাবার্তা বলতে পছন্দ করেন। ছাত্রমহলে তিনি গাইনুদ্দিন নামে পরিচিত। গাই নামক নিরীহ প্রাণী যেমন সারাদিন জাবর কাটে গাইনুদ্দিনও নাকি তাই করেন। বিজ্ঞানের জাবর কাটেন।

সানাউল্লাহ নিজের বাসায় না ফিরে আইনুদ্দিনের ফুলার রোডের বাসার দিকে রওনা হলেন। দুপুরের খাওয়া তার ওখানেই সারবেন। খেতে খেতে ভূত বিষয়ক আলোচনা করবেন। তাকে বাসায় না পাওয়া গেলেও সমস্যা নেই। আইনুদ্দিনের কাজের ছেলে রহমত তাকে ভালোই চেনে। আইনুদ্দিন এবং তার স্ত্রী রুবার ঝগড়া মিটমাট করার জন্যে তাকে অনেকবার এ বাড়িতে আসতে হয়েছে। তাদের ঝগড়া ধারাবাহিক নাটকের মতো হয়ে যাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে দুবার করে হচ্ছে। দুজনের বয়সের বিরাট ব্যবধান একটা কারণ হতে পারে।

আইনুদ্দিন বাসায় ছিলেন। সানাউল্লাহকে দেখে তিনি অতি বিরক্ত গলায় বললেন, তোমার সমস্যা কী? আইনুদ্দিনের এই বাক্য মুদ্রাদোষের মতো। যেকোনো মানুষের সঙ্গে দেখা হলেই তিনি বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করেন, সমস্যা কী?

সানাউল্লাহ বললেন, ভাবি বাসায় নেই?

না।

আবার ঝগড়া?

আইনুদ্দিন বললেন, ঝগড়া টগড়া কিছু না। ইদানিং লক্ষ করছি আমি যা-ই বলি সে বিরক্ত হয়। গতকাল রাতে ঘুমাতে যাবার সময় আমি তাকে বললাম, Photo electric eftect-এর জন্যে আইনস্টাইনকে নোবেল পুরস্কার দেয়া তাকে অপমান করার মতোই। রুবাকে বুঝানোর জন্যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একটা তুলনামূলক আলোচনায় গেলাম। তাকে বললাম রবীন্দ্রনাথকে যদি তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে শুধুমাত্র এই কবিতাটার জন্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হতো তাকে অপমান করা হতো। কথা শেষ করার আগেই তোমার ভাবি বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, বিদায়। আমি বললাম, বিদায় মানে কী? কাকে বিদায় বলছ? আইনস্টাইনকে না বরীন্দ্রনাথকে? তোমার ভাবি কোনো জবাব না দিয়ে পাশের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। সকালে উঠে দেখি চলে গেছে। টেলিফোন করি টেলিফোন ধরে না। তুমি এসেছ ভালো হয়েছে। তুমি আমার শ্বশুরবাড়িতে যাবে। তোমার ভাবির সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসবে।

সানাউল্লাহ বললেন, অবশ্যই নিয়ে আসব। দুপুরে তোমার এখানে খাব। রান্নাবান্না কি হয়েছে?

জানি না। রহমতকে জিজ্ঞেস কর। বাজারের টাকা নিতে এসেছিল, ধমক দিয়ে বিদায় করেছি। মনে হয় না সে কিছু বেঁধেছে।

 

রহমত রান্না করেছে। ভাত ডাল এবং শুকনা মরিচের ভর্তা। খাবার টেবিলে সানাউল্লাহ ভূত বিষয়ক আলাপ তুললেন।

তোমাদের সায়েন্স কী বলে? ভুত বলে কিছু আছে?

আইনুদ্দিন বললেন, সায়েন্স এই বিষয়ে কিছু বলে না। সায়েন্স হচ্ছে পরীক্ষা নির্ভর শাস্ত্র। ভূত বিষয়ে কোনো পরীক্ষা হয় নি।

হয় নি কেন?

প্রয়োজন হয় নি বলে পরীক্ষা হয় নি।

সানাউল্লাহ বললেন, তোমার কি মনে হয়? ভূতের অস্তিত্বের কোনো সম্ভাবনা কি আছে?

আইনুদ্দিন বললেন, এই বিষয়ে চিন্তা করি নি।

সানাউল্লাহ বললেন, ছোটবেলায় শুনেছি রাতে মিষ্টির দোকানে জিনরা উপস্থিত হয়। সব মিষ্টি খেয়ে শেষ করে। এটা কি সম্ভব?

আইনুদ্দিন বললেন, কোনো প্রাণী যদি খাদ্য গ্রহণ করে তাহলে অবশ্যই তাকে খাদ্যের বর্জ বের করে দিতে হবে। জিন মিষ্টি খেলে তাকে হাগু করতে হবে। কেউ কখনো জিনের গু দেখেছে? যেহেতু দেখে নাই সেহেতু জিন মিষ্টি খায় না। একে বলে ডিডাকটিভ লজিক।

সানাউল্লাহ বললেন, তোমার কথায় যুক্তি আছে। যাই হোক, তুমি কি ভূতপ্রেত বিষয়ক কিছু তথ্য আমাকে যোগাড় করে দিতে পারবে?

কী করবে?

সানাউল্লাহ বললেন, রিটায়ারমেন্টে চলে গেছি। কাজকর্ম নাই তো, সময় কাটানো।

সায়েন্সের কিছু সহজ বই দিয়ে দেই। পড়ে সময় কাটাও। ক্যালকুলাসের ইতিহাস বইটা দেব? ক্ষুদ্র সংখ্যার বিজ্ঞান। অসাধারণ জিনিস।

সানাউল্লাহ অনাগ্রহের সঙ্গে বললেন, দাও। আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। গুন্ডা প্রকৃতির কোনো ছাত্র কি তোমার আছে? মারামারিতে বিশেষ পারদর্শী এরকম কেউ?

কেন?

একজনকে সবার সামনে চড়-থাপ্পর দেয়া প্রয়োজন।

আইনুদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, তোমার কাছ থেকে এই ধরনের কথা শুনব কল্পনাও করি নি। আমি আমার ছাত্র ব্যবহার করব গুন্ডামির জন্যে? আমি কি পলিটিক্যাল লিডার। সরি বলো।

সানাউল্লাহ বললেন, সরি।

আইনুদ্দিন তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ঘেঁটে ক্যালকুলাসের ইতিহাস বইটা বের করলেন।

সানাউল্লাহ ক্যালকুলাসের ইতিহাস বই নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। আইনুদ্দিনের স্ত্রীকে আনার জন্যে তার যাবার কথা ছিল। আইনুদ্দিন কিছুতেই শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা বা টেলিফোন নাম্বার মনে করতে পারলেন না। কাজেই স্ত্রী ফেরত আনার প্রজেক্ট বাতিল হয়ে গেল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ