জহির অনেকক্ষণ হলো বসে আছে। যে ঘরে তাকে বসানো হয়েছে সেটা বসার ঘর না। অতি বিত্তবানদের বসার ঘরে অনেক কায়দা-কানুন থাকে। ইন্টোরিয়ার ডেকোরেটরা কালার চার্ট দেখে ঘর সাজান। হট কালার, কোল্ড কালার, অনেক জটিলতা। এই ঘরে কোনো জটিলতা নেই।

বসার সোফা আছে। সোফার কভার ময়লা। একটা জায়গায় সেলাই খুলে গেছে। কিছু প্রাস্টিকের সস্তা চেয়ারও আছে। ঘরের মাঝখানে লম্বা একটা টেবিল। টেবিল থেকে বার্নিশের গন্ধ আসছে। মনে হচ্ছে টেবিলটা বার্নিশ করা হচ্ছে। বার্নিশমিস্ত্রী এখনও আসে নি। এলেই কাজ শুরু হবে।

দেয়ালে গত বৎসরের একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। অতি বিত্তবানদের ঘরে ক্যালেন্ডার থাকে না। এদের আছে কেন বুঝা যাচ্ছে না। কাছেই মনে হয় রান্নাঘর। ভাজাভুজির গন্ধ আসছে।

সোফা থাকা সত্ত্বেও জহিরকে বসানো হয়েছে প্লাস্টিকের চেয়ারে। জহিরের গালের খোচাখোচা দাড়ি— এর কারণ হতে পারে। যে পাঞ্জাবিটা তার গায়ে সেটা সে গত দুদিন ধরেই পরে আছে। পাঞ্জাবি থেকে ঘামের গন্ধ আসার কথা। প্যান্টটা অবশ্যি ইস্ত্রি করা। পায়ের স্যান্ডেলের অবস্থাও ভালো। তারপরেও জহিরের ধারণা তার চেহারায় সাহায্যপ্রার্থী ভাব কোনো-না-কোনোভাবে এসে গেছে। সাহায্যপ্রার্থীকে কেউ সোফায় বসায় না। তার জন্যে বেতের মোড়া খোজা হয়।

যে ভদ্রলোক জহিরকে বসিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেছেন তার আচার-আচরণ অবশ্যি ভালো। চেহারায় কোমলতা আছে। বিনয়ী কথাবার্তা। বড়লোকদের মাঝে মাঝে বিনয়ী হতে দেখা যায় কিন্তু বড়লোকদের বাড়ির কাজের লোকদের মধ্যে এই জিনিস নেই। জহির তাকে বলেছে স্যারকে আমার নামটা বলবেন। নাম বললেই চিনবেন। আমার নাম জহির। বলবেন আর্টিস্ট জহির।

ভদ্রলোক বললেন, (হাসি মুখে) আপনার কি কোনো কার্ড আছে?

আমার কোনো কার্ড নেই। স্যার আমাকে বলেছিলেন যে-কোনো একদিন চলে আসতে। এপয়েন্টমেন্ট লাগবে না। উনি আমার একটা ছবি কিনেছিলেন। আমি নতুন ছবি নিয়ে এসেছি।

স্যার খুবই জরুরি কিছু কাজ করছেন। ব্যাংকের কাজ। একটু দেরি হবে।

দেরি হলে সমস্যা নেই।

চা খাবেন?

চা খেতে পারি।

চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ভদ্রলোক উধাও হয়েছেন পনেরো মিনিট আগে।

চা এখনো আসে নি। জুহির সিগারেট ধরালো। তার আগে দেখে নিল সোফায় পাশের সাইড টেবিলে এসট্রে আছে। এসট্রেতে বেশ কিছু সিগারেটের শেষ অংশ। সে প্লাস্টিকের চেয়ার ছেড়ে সোফায় বসল। সিগারেট হাতে এসট্রের কাছাকাছি বসাই যুক্তিযুক্ত।

জহিরের হাতে রোল করা তিনটা ওয়াটার কালার। এর যে-কোনো একটা আজ দিনের মধ্যে বিক্রি করতে হবে। তিনটা ছবিই খাস্তা। জহির নিশ্চিত ভদ্রলোক এটা ধরতে পারবেন না। তিনটি ছবিতেই লোক-ভুলানো ব্যাপার আছে। ধবল বকের ছবি। গাঢ় রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডে বকপাখির ধবল রঙ তুলে আনা হয়েছে। দেখতে ভালো লাগে এই পর্যন্তই। মনে কোনো ছাপ পড়ে না। ছবিতে গল্প নেই। রঙের কারিগরি আছে। চোখকে ফাঁকি দেয়ার ব্যাপার আছে। এর বেশি কিছু না।

চা নিয়ে একজন ঢুকেছে। আলাদা প্লেটে সমুচা জাতীয় কিছু। বড় লোকদের বাড়ির চা সব সময় ঠাণ্ডা হয়। অভাজনদের জন্যে তারা হেলাফেলা করে চা বানায়। দুধ নিতে সময় নেয়, চিনি দিতে সময় নেয়, চামচ নাড়তে সময় নেয়। এর মধ্যে চা হয়ে যায় পানি। মুখে নিয়েই থু করে ফেলে দিতে ইচ্ছা করে।

ঠাণ্ডা চা মনে করে চুমুক দিয়ে জহিরের মুখ পুড়ে গেল। আগুন-গরম চা। তবে চা-টা হয়েছে ভালো। চায়ের পাতা যে দামি বুঝা যাচ্ছে। চমৎকার গন্ধ আসছে। হতে পারে সরাসরি বাগান থেকে আনা চা। এদের হয়তো কয়েকটা বাগান আছে। বনেদী ধনি।

বনেদী ধনিরা সহজে পয়সা বের করতে চায় না। নতুন যারা ধনি হচ্ছে তাদের খরচের হাত ভালো থাকে। নব্য ধনীরা তিনটা ছবিই কিনে ফেলবে। তাদের থাকে জমা করার নেশা। যা দেখবে তাই কিনে জমাবে। কি জমাচ্ছে তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই।

আসুন। স্যার ফ্রী হয়েছেন। চার তলায় যেতে হবে। স্যার চারতলায়। বসেন।

লিফট আছে না?

লিফট নেই।

এমন জমকালো চারতলা বাড়ি। লিফট নেই এটা কেমন কথা?

বাড়িটা স্যারের বাবার বানানো। উনি লিফট পছন্দ করেন না। একবার লিফটে চার ঘণ্টা আটকা পড়েছিলেন সেই থেকে উনার লিফট-ভীতি। উনি যে কয়টা বাড়ি বানিয়েছেন কোনোটার লিফট নেই।

আপনার স্যারের কি চায়ের বাগান আছে?

স্যারের চায়ের বাগান নেই। উনার বাবার আছে। পুরোটা না শেয়ারে। বাগান বিক্রি হয়ে যাবে। কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে।

আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?

আমি স্যারের এসিসটেন্ট, কাম ম্যানেজার।

আপনাকে তো অনেকবার উপর-নিচ করতে হয়।

জি। অবস্থা কাহিল। কি করব চাকরি।

আপনার নামটা জানা হলো না।

আমার নাম ফরিদ। ফরিদ হোসেন।

জহির বলল, আমার নাম তো আপনাকে একবার বলেছি। আবার কি বলব?

ফরিদ বলল, না বলতে হবে না। আপনার নাম আমার মনে আছে। জহির। আর্টিস্ট জহির। ছোটবেলায় আমি ভালো আর্ট করতে পারতাম। এখনও হাতী, বাঘ এইসব আঁকতে পারি।

ভেরি গুড।

আপনার উঠতে কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি। আমার অবস্থা চিন্তা করেন। দিনের মধ্যে সতেরো-আঠারো বার উঠা নামা করি। আপনাকে যেই স্যারের কাছে হাওলা করে দিব। স্যার সঙ্গে সঙ্গে বলবেন চা আন। আবার নিচে যাও।

উপরে চায়ের ব্যবস্থা নাই?

জি না। কিচেন এক তলায়। স্যার ধোয়ার গন্ধ সহ্য করতে পারেন না বলে উপরে কিচেন নেই। ঝামেলা আর কারোর না, আমার। একবার হিসাব করেছিলাম সারাদিনে আঠারো বার উঠা-নামা করেছি। ঐটাই আমার রেকর্ড।

আজ দিনে এখন পর্যন্ত কতবার উঠানামা করলেন।

আজকেরটার হিসাব নাই।

জহিরের মনে হলো ম্যানেজার ছেলেটা শুধু যে ভালো তা-না। বেশ ভালো।

 

শাহেদুর রহমান আনন্দিত গলায় বললেন, হ্যালো জহির। কেমন আছ?

স্যার ভালো আছি। তিনটা ছবি আপনার জন্য এনেছি। দেখেন পছন্দ হয় কি না।

ওয়াটার কালার?

জি, ওয়েল কালার করব কিভাবে? রঙই কিনতে পারি না, রং, বোর্ড।

রঙ কেনার টাকার টানাটানি হলে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাবে। নো প্রবলেম।

স্যার থ্যাংক ইউ। ছবিগুলি কি দেখাব?

আগে চা খেয়ে নেই। তারপর না ছবি। ফরিদ চা আন।

জহির ফরিদের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল, স্যার আমার চা না হলেও চলবে। চা খেয়ে এসেছি।

আরেকবার খাও। ফরিদ! দাঁড়িয়ে আছ কেন? চা দিতে বললাম না।

ফরিদ ছুটে বের হয়ে গেল।

শাহেদুর রহমানের তিনটা ছবিই পছন্দ হলো। জহির বলল, বক পাখি নিয়ে একটা সিরিজের মতো করেছি। বিভিন্ন সময়ে উড়ে যাওয়া বকের ছবি। সিরিজের নাম দিয়েছি উড়ে যায় বকপক্ষী।

নামও তো সুন্দর। তুমি তোমার এই সিরিজের কোনো ছবি আমাকে না দেখিয়ে বিক্রি করবে না।

অবশ্যই না।

তিনটা ছবির জন্যে তোমাকে কত দেব বল তো?

জুহির অতি দ্রুত চিন্তা করছে। দাম বেশি চেয়ে ফেললে এই শিল্পবোদ্ধা হয়তো বলে বসবে কিনব না। একবার একটা দাম বলে ফেললে দাম কমানোও যায় না। ছবিতে আর মাছ না যে দাম নিয়ে মুলামুলি চলবে। জহিরের আপাতত পনেরো হাজার টাকা হলেই চলবে। বাড়ি ভাড়ার চার হাজার, মুদির দোকানের দুই হাজার। ফজলুর কাছে ধার আছে চার হাজার, পুরোটা না দিলেও চলবে অর্ধেক তো দিতে হবে। ছোট বোন তার মেয়ে আর স্বামী নিয়ে খুলনা থেকে বেড়াতে এসেছে। তিন-চার দিন থাকবে। জন্মের পর ভাগ্নিকে জহির এই প্রথম দেখবে, তাকে একটা কিছু দিতে হবে। সোনার আংটি বা চেইন। সোনার ভরি এখন কত কে জানে।

শাহেদুর রহমান বললেন, কী ব্যাপার কিছু বলছ না কেন?

জহির বলল, স্যার আপনি যা দেবেন তাই আমি নেব।

ত্রিশ হাজার দিলে চলবে? পার পিস দশ?

স্যার আমি তো আগেই বলেছি। আপনি যা দেবেন আমি তা-ই নেব। আপনি যদি বলতেন, জহির আমি তোমাকে কিছুই দেব না। তুমি তিনটা ছবি রেখে যাও। আমি ছবি রেখে হাসিমুখে চলে যেতাম। আপনি মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করছেন না।

বিশ্বাস করছি। কেন বিশ্বাস করব না।

শাহেদুর রহমান আনন্দিত গলায় বললেন, আমার কাছে শুধু ছবি বিক্রি করলে হবে না। আমাকে তুমি ছবি আঁকা শেখাবে।

অবশ্যই স্যার।

সপ্তাহে তিন দিন তুমি আমাকে শেখাবে। তার জন্যে তোমাকে যথাযত সম্মানী দেয়া হবে।

সম্মানীর কথা বলে আপনি আমাকে লজ্জা দেবেন না। আপনাকে যদি ছবি আঁকা শেখাতে পারি সেটাই হবে আমার সম্মানী।

তুমি পোট্রেট করতে পার?

পারি।

আমার বাবার, আমার এবং আমার মেয়ে মৃন্ময়ী এই তিনজনের তিনটা পোট্রট করে দেবে। প্রথমে মৃন্ময়ীরটা কর। আমার মেয়ের সঙ্গে কি তোমার পরিচয় হয়েছে?

জি না।

খুবই শার্প মেয়ে। আমি চাই মনের শার্পনেসটা যেন ছাবিতে আসে।

চেষ্টার কোনো ত্রুটি হবে না স্যার।

 

চা চলে এসেছে। চার সঙ্গে সকালের সেই সমুচা। বাড়তি হিসেবে আছে কেক। বুঝাই যাচ্ছে দামী কেক। জহির কেক খেয়ে আরাম পাচ্ছে না। তার টেনশান একটাই— এই লোক পেমেন্টটা চেকে করবে না তো। চেকে করলে সাড়ে সর্বনাশ। একটা বেজে গেছে ব্যাংক বন্ধ। ঘরে আছে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট। চাল-ডাল সবই কিনতে হবে। বাড়িতে মেহমান। প্রায় চার বছর পর ছোট বোনের সঙ্গে দেখা।

শাহেদুর রহমান সাহেব চেকে পেমেন্ট করলেন। এই কাজটা যে উনি করবেন তার আগেই বুঝা উচিত ছিল। বড় লোকরা বাসায় নগদ টাকা রাখে না বললেই হয়। তাদের আছে ক্রেডিট কার্ড। একশ পাতার মোটা মোটা চেক বই।

জহির চারতলা থেকে এক তলায় নেমেছে। ফরিদ তার সঙ্গে আছে। জহির বুঝতে পারছে না ফরিদকে তার সমস্যার কথা খুলে বলবে কি বলবে না। সব মানুষ নিজের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত, অন্যের সমস্যা তারা বুঝতে পারে না।

ফরিদ সাহেব।

জি।

আমার ছোট্ট একটা প্রবলেম আপনি সমাধান করতে পারবেন কি-না বুঝতে পারছি না। আপনার চেহারা দেখে মনে হয় আপনি কাইন্ড হার্টেড লোক।

বলুন কি সমস্যা।

স্যার চেক দিয়েছেন। আমার দরকার নগদ টাকা।

চেক কাল ভাঙ্গাতে পারবেন। ক্রশ চেক তো না। বাংকে জমা দিলেই টাকা পেয়ে যাবেন।

জহির বলল, আজকের দিনটা কীভাবে পার করব? আমার ছোটবোন তার মেয়ে নিয়ে খুলনা থেকে বেড়াতে এসেছে। মেয়ের দুধ আর কি কি যেন কিনতে হবে লিস্ট দিয়ে দিয়েছে। বাড়িওয়ালার বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে তিন মাসের। আজ সন্ধ্যার মধ্যে কিছু-না-কিছু দিয়ে তাকে সামলাতে হবে। না হলে আত্মীয়স্বজনের সামনে অপমান করে ছাড়বে।

ফরিদ বলল, বুঝতে পারছি।

জহির বলল, বুঝতে পারছেন না। সমস্যা আপনাকে পুরোটা বলি নি। এখনও বাকি। ভাই কোনো ব্যবস্থা কি করা যায়?

আপাকে বলে দেখতে পারি। উনার কাছে কাশ থাকে।

আপা কে?

স্যারের মেয়ে মৃন্ময়ী।

আপনি কি গুছিয়ে বলতে পারবেন? না-কি আমি বলব? বরং একটা কাজ করন উনাকে বলুন জহির নামের একজন আর্টিস্ট কয়েক মিনিট কথা বলতে চায়। বলতে পারবেন না?

পারব।

জহির আবার আগের জায়গায় বসে আছে। সোফায় না, প্লাস্টিকের চেয়ারে। তার সিগারেট ধরাবার ইচ্ছা করছে ধরাচ্ছে না। সিগারেট ধরালে গায়ে সিগারেটের গন্ধ লেগে থাকবে। মেয়েরা প্রেমিকদের গায়ে সিগারেটের গন্ধ সহ্য করে অন্যদেরটা করে না। সে পকেট থেকে মীনার দেয়া লিস্ট বের করল। লিস্টে এত কিছু লেখা এই প্রথম দেখল :

দুধ–-নেসলে এক কৌটা

হট ওয়াটার ব্যাগ

ডায়াপার (তিন বছরের)

এক কেজি কাল রঙের মিষ্টি

(টুনটুনি কালো মিষ্টি ছাড়া খায় না)

অলিভ ওয়েল

বেবি শ্যাম্পু

ফরিদকে আসতে দেখা যাচ্ছে। তার পেছনে কোনো নারীমূতি নেই। মৃন্ময়ী নামের তরুণী মনে হয় অপরিচিত কারো সঙ্গে দেখা করেন না।

জহির সাহেব। আপার ঘরের দরজা বন্ধ। উনার সঙ্গে কথা বলতে পারি নাই।

দরজা নিশ্চয়ই খুলবে। খুলবে না?

জি। সারা দিন তো আর দরজা বন্ধ করে রাখবেন না।

তাহলে অপেক্ষা করি।

জি আচ্ছা! আপনার তো মনে হয় টাকার খুবই প্রয়োজন। আমার কাছে এক হাজার টাকা আছে। ইচ্ছা করলে নিতে পারেন।

আপার কাছ থেকে সুবিধা না হলে আপনার কাছ থেকে টাকাটা নিতে হবে। খালি হাতে আজ ফেরাই যাবে না। ভাই আপনি মাঝে মাঝে খোঁজ নেবেন আপা দরজা খুলেছে কি-না। উনার মেজাজ কেমন?

ভালো।

বুদ্ধি কেমন?

বুদ্ধিও ভালো।

আপনার স্যারের চেয়ে বেশি না কম?

বেশি। উনার বুদ্ধি স্যারের বাবার মতো। তবে স্যারের বাবা গরম মাথার মানুষ। আপা ঠাণ্ডা মাথার।

চেহারা কেমন? আর্টিস্ট মানুষ তো, চেহারা কেমন জানতে হয়। উনার পোট্রেট করতে হবে।

চেহারা খুবই সুন্দর। আমি আমার জীবনে এত রূপবতী মেয়ে দেখি নাই।

বলেন কি!

টেলিভিশনে দেখি বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা হয়। দুনিয়ার মেয়ে লাইন করে দাঁড়ায়। মৃন্ময়ী আপার কাছে এরা কিছুই না। এরা উনার নখের কাছেই আসতে পারবে না।

আপনি তো মনে হয় উনার প্রেমে পড়ে গেছেন।

আরে না। কী যে বলেন! ছিঃ!

ছিঃ! বলেন কেন? কত গল্প আছে বড় লোকের মেয়ে গাড়ির ড্রাইভারের প্রেমে পড়ে গৃহত্যাগ করেছে। আপনার পজিসন তো ড্রাইভারের চেয়ে উপরে। ভাই যান তো আরেক বার খোঁজ নিয়ে আসুন। দেখে আসুন বিশ্বসুন্দরী আপা দরজা খুলেছেন কি-না।

ফরিদ চলে গেল। জহির ঘড়ি দেখল। দুটা দশ। সে বাসায় দুপুরের কোনো খাবারের ব্যবস্থা করে আসে নি। চাল-ডাল অবশ্যি আছে। মীনা বুদ্ধি করে কিছু কি করে ফেলবে না? ডাল রাধল, ভাত ফুটালো, তার স্বামীকে দোকানে পাঠিয়ে এক হালি ডিম আনিয়ে নিল। কষানো ডিম, ডাল, ভাত। সহজ বাঙালি খাবার।

জহির মীনার স্বামীর নাম মনে করার চেষ্টা করছে। নামটা মনে পড়ছে না। দন্ত স দিয়ে নাম। সালাম না তো? সামছু কি? সাবের? স্বাধীন? সেলিম?

ছোট বোনের স্বামীর নাম ভুলে যাওয়া অপরাধের মধ্যে পড়ে। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ধারাও হয়তো আছে।

দন্ডবিধি এত : অপরাধ ছোট বোনের স্বামীর নাম বিস্মরণ।

শাস্তি : ৫০০ টাকা জরিমানা এবং দুই দিনের কারাবাস।

 

জহির আশায় আশায় আছে কোনো এক ফাঁকে নামটা মনে আসবে তখন সেই নামে ডাকা যাবে। নাম মনে আসছে না। মীনা তাকে ডাকে টিয়া। এই টিয়া কী করছ? বাবুকে ধর। এই টিয়া জানালার পর্দা টেনে দাও।

জহির বলেছিল, টিয়া টিয়া করছিস কেন? ওর নাম কি টিয়া?

মীনা উত্তরে বলল (অভিমানি গলা) ভাইয়া এটা আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। ও আমাকে ময়নাপাখি ডাকে। আমি উত্তরে টিয়াপাখি ডাকি।

জহির বলল, ও তোকে ময়না ডাকতে পারে তোর গায়ের রঙ কালো। তুই ওকে টিয়া ডাকবি কে? ওর গায়ের রঙ তো সবুজ না। তুই মর্ডান মেয়েদের। মতো স্বামীর নাম ধরে ডাকবি। দেখি আমার সামনে স্বামীকে একবার নাম ধরে ডাক।

মীনা রাগী গলায় বলল, ওকে সারাজীবন আমি টিয়া ছাড়া কিছু ডাকব না। আরেকটা কথা ভাইয়া তুমি চট করে বলে ফেললে আমার গায়ের রঙ কালো। আমি যদি কালো হই তাহলে ফর্সা কে? তুমিও তো একদিন বিয়ে করবে। দেখব তোমার বউয়ের গায়ের রঙ কি হয়।

জহির বলল, তুই কি কেঁদে ফেলবি না-কি?

তুমি উল্টা-পাল্টা কথা বলবে আমি কাঁদব না।

 

আপনি জহির।

জহির থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়াল। তাকে মনে মনে বলতেই হলো, কী। আশ্চর্য এই মেয়ে কে? যে পুরুষ প্রথম দর্শনেই এই মেয়ের প্রেমে পড়বে না, সে পুরুষই না।

ফরিদ সাহেব আমাকে আপনার সমস্যার কথা বলেছেন। এখানে ত্রিশ হাজার টাকা আছে।

জহির পকেট হাতড়ে চেকটা বের করে এগিয়ে দিল।

মৃন্ময়ী বলল, কি?

ত্রিশ হাজার টাকার চেকটা।

আমাকে চেক দিচ্ছেন কেন? আমি কি ব্যাংক?

ম্যাডাম সরি।

চেক ভাঙ্গিয়ে টাকা ফেরত দিলেই হবে।

কতটুকু উপকার যে আপনি আমার করেছেন সেটা আপনি বুঝতেও পারবেন। থ্যাংক য়্যু।

মৃনারী তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটে চাপা হাসি।

জহির বলল, ম্যাডাম আমি কাল সকালেই আপনার হাতে টাকাটা দিয়ে যাব।

মৃন্ময়ী বলল, আমার হাতেই দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ম্যানেজারকে দিলেই চলবে।

জহির বলল, আমি যার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি তার কাছেই দিতে চাই। আপনাকে আরেকবার থ্যাংক য়্যু।

ফরিদ জহিরকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল। গেটের কাছে এসে বলল, আপনাকে বলেছিলাম না? বিশ্বসুন্দরী। ভুল বলেছি?

জহির বলল, ভুল বলেন নাই।

ফরিদ বলল, অতিরিক্ত সুন্দরী হওয়া ঠিক না।

জহির বলল, ঠিক না কেন?

সারাক্ষণ মানুষে চোখে লাগায় নানান অসুখ-বিসুখ হয়।

উনার কি প্রায়ই অসুখ-বিসুখ হয়?

তা অবশ্য না।

জহির বলল, ভাই আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আপনি আমার বিরাট উপকার করেছেন। যদি কোনোদিন আমি আপনার কোনো উপকার করতে পারি আমাকে বলবেন। আর আপনার দাওয়াত। একদিন আমার বাড়িতে আসবেন। ডাল-ভাত খাবেন। আপনি কি এই বাড়িতেই থাকেন না আলাদা থাকেন?

এই বাড়িতেই থাকি। স্যারের সঙ্গে থাকি। স্যার যে ঘরে ঘুমান আমি তাঁর পাশের ঘরে ঘুমাই। উনার কখন কি প্রয়োজন হয়। উনার বোবায়-ধরা রোগ আছে। বোবায় ধরলে আমাকে দৌড়ে যেতে হয়। ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙাতে হয়।

উনার স্ত্রী উনার সঙ্গে ঘুমান না?

জি না। উনার স্ত্রীর নানান অসুখ-বিসুখ আছে। উনি আলাদা ঘুমান।

জহির বলল, আপনার কি সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে?

ফরিদ বলল, অভ্যাস নাই। তবে দিন একটা খাই।

জহির তাকিয়ে আছে, ফরিদ চিন্তিত মুখে সিগারেট টানছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়।

জহির বলল, কিছু বলবেন?

ফরিদ থতমত খেয়ে বলল, জি না! জি না! কিছু বলব না।

 

জহির ঘরে ফিরল বিকাল চারটায়। বেল দিতেই মীনা দরজা খুলল। গম্ভীর গলায় বলল, ভাইয়া ব্যাপারটা কী বল তো? তোমার কাছে বেড়াতে এসে আমরা কি কোনো পাপ করেছি?

পাপ করবি কেন?

কোনো খাবারের ব্যবস্থা নাই, কিছু না।

দুপুরে খাস নি।

কী খাব বল? টিয়া আবার ক্ষিধা সহ্য করতে পারে না। সে দুটা বার্গার কিনে এনেছে। দুজনে দুটা বার্গার খেলাম। টিয়া দুপুরে ভাত ছাড়া কিছু খায় না। ভাতের সঙ্গে তিন চারপদ তরকারি লাগে।

সরি! বিরাট একটা ঝামেলায় আটকা পড়েছিলাম। এক কাজ করি তেহারি নিয়ে আসি। তেহারি খাবি?

কিছু একটা আন। আমার মেয়ের জিনিস আনা হয়েছে?

শুধু দুধ এনেছি আর কালোজাম এনেছি।

বাকিগুলো আন নাই কেন?

নিয়ে আসব। নো প্রবলেম। এক গাদা রঙ কিনেছি। রাতে তোর মেয়ের ছবি এঁকে দিব।

মীনা বলল, শুধু ছবি দিয়ে পার পাবার চেষ্টা করবে না ভাইয়া। সোনার কিছু দিতে হবে। না হলে শ্বশুর বাড়িতে আমার মুখ থাকবে না। সবাই জিজ্ঞেস করবে মেয়ের একটা মাত্র মামা, সেই মামা কী দিলো?

জহির বলল, ঠিক আছে। ঠিক আছে।

মীনা বলল, তুমি টিয়ার হাতে কিছু টাকা দিয়ে রেখো। তোমার বাসায় বেড়াতে এসে সে নিজের টাকা খরচ করবে কেন? তুমি সম্বন্ধি না?

ও নিজের টাকা কখন খরচ করল?

বার্গার কিনে আনল না। টুনটুনিকে রোজ দুটা করে ডিমের কুসুম খাওয়াই। তাকে দিয়ে ডিম কিনালাম। তোমার ঘরে তো ডিমও নেই।

ঠিক আছে কিছু টাকা ধরিয়ে দেব।

তোমার দেখি মুখ শুকিয়ে গেল। তুমি এত কৃপণ হয়ে গেলে কীভাবে? শুধু তেহারী আনবে না ভাইয়া। তেহারীর সঙ্গে আলাদা মাংস আনবে।

যদি পাই আনব। টিয়া বাবু কোথায়?

ঘুমাচ্ছে। ভাইয়া শোন, তুমি টিয়াবাবু ডাকছ কেন? টিয়া আমার দেয়া নাম। একটা পার্সোনাল ব্যাপার। তুমি তাকে তার নামে ডাকবে। আর কখনও টিয়াবাবু বলবে না।

যা আর ডাকব না।

টুনটুনিকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। কোলে নিলে সে শান্ত হয়ে থাকবে। মামার সঙ্গে পরিচয় হোক।

মেয়ে কোলে নিয়ে ঘুরতে পারব না।

কেন পারবে না? মামা ভাগ্নিকে কোলে নিবে না।

কোলে নেবে, কিন্তু কোলে নিয়ে সারা ঢাকা শহর ঘুরবে না।

ভাইয়া তুমি বদলে গেছ এটা জান। তোমার মুখ দেখে পরিষ্কার বুঝা যায় তুমি আমাদের উপর খুবই বিরক্ত। আমরা কি হঠাৎ বেড়াতে এসে তোমার কোনো প্রবলেম করেছি।

 

তুই কথা বেশি বলিস এইটাই প্রবলেম। এ ছাড়া কোনো প্রবলেম নেই।

জহির তেহারির সন্ধানে বের হলো। টিয়াবাবুর আসল নাম এখনো মনে আসছে না। সালাম? না সালাম না? সালাহউদ্দিন? না সালাউদ্দিন না। সাগর? উঁহু! সাগরও না। দন্তস দিয়ে আর কী নাম আছে? নিউ মার্কেট থেকে নবজাতকের নতুন নাম জাতীয় কোনো বই কিনে আনলে কেমন হয়?

নিউ মার্কেটের কথায় মনে পড়ল ফজলুকে টাকা দিতে হবে। নিউ মার্কেটের কাঁচাবাজারে একটা ঘর নিয়ে ফজলু থাকে। তার হাত একেবারেই খালি। এর মধ্যে ধরেছে ইনফ্লুয়েনজায়। ডাক্তার দেখিয়েছে কি-না, কে জানে। তার যে স্বভাব! নিশ্চয়ই না খেয়ে বিছানায় পড়ে আছে।

তেহারি কিনতে সামান্য দেরি হলে ময়না এবং টিয়া মারা যাবে না। দুজনের পেটেই বার্গার আছে। বার্গার ভাতের মতো চট করে হজম হয়ে যায় না। অনেকক্ষণ পেটে থাকে।

ফজলুকে তার ষরে পাওয়া গেল না। পাশের ঘরের এক ছেলে বলল, উনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন?

জহির বলল, কোন হাসপাতাল? কত নাম্বার বেড।

কত নম্বর বেড জানি না। ঢাকা মেডিকেল।

অবস্থা খারাপ না-কি?

জি খারাপ।

জহির রিকশা নিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে রওনা হলো।

 

ফজলুকে সহজেই খুঁজে বের করা হলো। হাসপাতালে তার সীট এখনো হয়নি। বারান্দায় আপাতত শুইয়ে রাখা হয়েছে। পাশে স্ট্যান্ডে স্যালাইনের ব্যাগ ঝুলছে। স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। চেহারা হয়েছে কাকলাশের মত। চোখ ঢুকে গেছে। মুখ ভর্তি কালো কালো ছোপ।

জহির বলল, অবস্থা কী?

ফজলু বলল, এখন একটু ভালো। কাল তো মনে হচ্ছিল এই বুঝি গেলাম। আজরাইল হাত ধরে টানাটানিও করেছে।

তোর টাকা নিয়ে এসেছি।

কত এনেছিস?

যা নিয়েছিলাম সবটাই এনেছি। দরকার লাগলে আরও দেব। টাকা সঙ্গে আছে।

 

তোর কাছে রেখে দে। এখানে টাকা রাখব না। চুরি হয়ে যাবে। আব্দুল কাদের বলে এখানে একজন আছে। খুঁজে বের কর। তাকে পাঁচশ টাকা ঘুষ দে। ঘুষ দিলে সীটের ব্যবস্থা হবে।

আব্দুল কাদেরটা কে?

খুঁজে বের কর কে। ক্লিনিকেল সেকশানে। সবাই চেনে। এত কথা বলতে পারব না।

খাওয়া-দাওয়া কী করছিস?

খাওয়া-দাওয়া কিছুই করছি না। সালাইন দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে স্যালাইনটা আমার পোলাও-কোরমা। তোর কাছে কাগজ-কলম আছে?

কাগজ-কলম দিয়ে কী হবে?

মার ঠিকানা লিখে দেব। মাকে দুই হাজার টাকা পাঠিয়ে দিবি। আমার খবর কিছুই জানাবি না।

 

আব্দুল কাদেরকে খুঁজে বের করতে অনেক সময় লাগল। পাঁচশ টাকার বদলে তাকে দেয়া হলো পনেরশ টাকা। সে অন্য এক রোগীকে সীট থেকে নামিয়ে ফজলুকে সীটে তুলে দিল। গম্ভীর গলায় বলল, টাইট হইয়া শুইয়া থাকেন। কেউ কিছু বললে আমার নাম বলবেন। ক্লিয়ার?

সব ঝামেলা মিটিয়ে জহির বাসার দিকে রওনা হলো রাত এগারোটায়। তার হাতে দুই প্যাকেট কাচ্চি বিরিয়ানী। সে নিজে কিছু খাবে না। তার শরীর গুলাছে। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। হাসপাতালে গেলেই তার এই সমস্যা হয়।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ