টগরকে ভর্তি করা হয়েছে একটা ক্লিনিকে।

ঝকঝকে তকতকে একটা বাড়ি। হাসপাতাল মনেই হয় না। রুগীটুগীও নেই। তিন নম্বর রুমে একটি মাত্র পেসেন্ট। সেও খুব হাসি খুশি। অল্প বয়সী একজন তরুণী। প্রথম মা হবে। সকালবেলা ব্যথা উঠেছিল, সবাই ব্যস্ত হয়ে নিয়ে এসেছে। ডাক্তার বললেন। ফলস পেইন। স্বামী ভদ্রলোক নার্ভাস প্রকৃতির। সে স্ত্রীকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে রাজি নয়। রাতটা এখানেই রাখতে চায়। সে পরিচিত অপরিচিত সবাইকে সিগারেট দিচ্ছে এবং স্ত্রীর ব্যথা উঠার ব্যাপারটি বলছে। তার মূল বক্তব্য হচ্ছে, দরকারের সময় কাউকে পাওয়া যায় না। তার নিজের গাড়ি আছে। আত্মীয়-স্বজনদেরও গাড়ি আছে কিন্তু তার স্ত্রীকে আনতে হল রিকশায়। এর নাম ভাগ্য।

ওসমান সাহেব পৌঁছলেন রাত এগারোটায়। ওয়েটিং রুমে অপলা বসে আছে। আর কাউকে দেখা গেল না। বারান্দার সোফায় এক বুড়ো ভদ্রলোক গা এলিয়ে পড়ে আছেন। অপলা বলল, দুলাভাই, আপনার এত দেরি হল কেন? ওসমান সাহেব সহজ স্বরে বললেন পিজিতে গিয়েছিলাম। তোমরা কোথায় আছ কেউ বলতে পারল না।

বুঝলেন কী করে আমরা এখানে?

তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম। রানুর খালার কাছ থেকে ঠিকানা আনলাম। টগর কেমন আছে?

ভাল আছে। ভয়ের কিছু নেই। ঘুমুচ্ছে। আপনি ভেতরে চলে যান। আপা সেখানে আছে। দুনম্বর রুম।

তার সঙ্গে আর কে আছে?

আর কেউ নেই। যান। আপনি ছেলেকে দেখে আসুন।

তিনি সিগারেট ধরালেন এবং বেশ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন অসুস্থ ছেলের জন্যে যে রকম আবেগ অনুভব করার কথা সে রকম তিনি করছেন না। কিংবা হয়ত এই ক্লিনিকটি মনের উপর চাপ ফেলতে পারছে না। হাসপাতাল যে রকম ফেলে।

ওসমান সাহেবের পানির তৃষ্ণা হচ্ছিল। এখানে পানি কোথায় পাওয়া যাবে কে জানে। অপল বিরক্ত স্বরে বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যান, আপা একা আছে।

তুমি এখানে বসে আছ কেন?

এমনি আমার ভাল লাগছে না।

অপলা অন্য দিকে মুখ ফেরাল। ঝগড়া-টগড়া কিছু হয়েছে। মেয়েরা অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে ঝগড়া করতে পারে।

এই ক্লিনিক বিত্তবানদের জন্যে। বেশ বড় বড় রুম। জানালায় সুন্দর পর্দা। প্রশস্ত বেডে ফোমের তোষক। ওসমান সাহেব দেখলেন টগর কোত হয়ে ঘুমুচ্ছে। তার মুখ অস্বাভাবিক বিবর্ণ। গায়ে ধবধবে সাদা একটা চাদর। সাদা চাদর সব সময় মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয। ওসমান সাহেব মনে মনে ঠিক করলেন রানুকে বলবেন চাদরটা বদলে দিতে।

রানু খুব ভয় পেয়েছে। সে বসে আছে টগরের মাথার পাশে। কিছুক্ষণ পরপরই টগরকে ছুঁয়ে দেখছে।

টগর বেঁচে আছে। এ ব্যাপারে সে যেন নিশ্চিত হতে চান। রানুর চোখের নিচে কালি পড়েছে। সে কাঁপছে অল্প অল্প। এতটা ভয় পাওয়ার মত সত্যি কী কিছু হয়েছে? টগর তো ঘুমুচ্ছে বেশ স্বাভাবিকভাবে। ওর ঘুমন্ত মুখে তেমন কোন যন্ত্রণা ছাপ নেই। কোথায় যেন পড়েছিলেন, শিশুদের মুখে শারীরিক কোন কষ্টের ছাপ পড়ে না। ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, ও কেমন আছে?

ভাল। ঘণ্টাখানেক আগে ঘুমিয়েছে।

গায়ে জ্বর আছে?

আছে।

তিনি টগরের কপালে হাত রাখতেই সে কেঁপে উঠল। যেন সে বুঝতে পারছে অপরিচিত কারোর স্পর্শ। এ হাত মায়ের হাত নয়।

বেশ জ্বর তো গায়ে।

হ্যাঁ। বারটার সময় আরেক ডোজ ওষুধ পড়বে।

ওসমান সাহেব ইতস্তত করে বললেন–ক্লিনিকের কাউকে বল সাদা চাদর বদলে একটা রঙিন চাদর দিতে।

কেন?

এমনি বলছি। কারণ নেই।

রানু কঁপা গলায় বলল— কারণ নিশ্চয়ই কিছু আছে। তুমি বল।

সাদা চাদর মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়।

রানু কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে টগরের গায়ের চাদর তুলে ফেলল। ওসমান সাহেব শান্ত স্বরে বললেন–এত ভয় পাচ্ছি কেন রানু? ভয়ের কিছু নেই।

তুমি বুঝলে কী করে ভয়ের কিছু নেই?

তিনি এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না। কিন্তু রানু তাকিয়ে আছে আগ্রহ নিয়ে। সে একটা জবাব চায়।

বল কী করে বুঝলে ভয়ের কিছু নেই?

আমার মন বলছে। দেখবে ও সকালের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠবে।

রানু বলল, বারটা বাজতে কত দেরি বল তো?

পনেরো মিনিট।

হল ঘরে একজন নার্স আছে তাকে খবর দাও। বারটার সময় ওষুধ দিতে হবে। আর শোন, তুমি কী আত্মীয়-স্বজন সবাইকে খবর দিয়েছ?

না। কাউকে কিছু বলিনি।

সবাইকে বল।

দরকার আছে কোনো?

আছে। নয়ত পরে সবাই রাগ করবে।

কথাটা মিথ্যা নয়। এদেশে অসুখ-বিসুখ সামাজিক ব্যাপার। যথা সময়ে সবাইকে জানাতে হবে। কেউ যেন বাদ না পড়ে। কাউকে খবর না দেযাব মানে হচ্ছে তাকে দাম দেযা হয়নি। তুচ্ছ করা হয়েছে।

ওসমান সাহেব ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। নার্সকে দেখা গেল ট্রেতে করে ওষুধপত্র সাজিয়ে আনছে। ক্লিনিকটি মনে হচ্ছে ভালই। ঘড়ি ধরে সব হচ্ছে। বারটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি আছে এখনো।

নার্স মেয়েটি মধ্য বয়সী। গায়ের রঙ শ্যামলা। কিন্তু ধবধবে সাদা শাড়ির জন্যে তাকে কালো দেখাচ্ছে। ভালই লাগছে। মেয়েটির মধ্যে মা মা ভাব আছে।

ওসমান সাহেব হাসিমুখে তাকালেন। মেয়েটি বিরক্ত গলায় বলল–এত মানুষ কেন এখানে? শুধু একজন থাকবেন। ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করেন। ক্লিনিকের নিযম-কানুন মানতে হবে তো।

মেয়েটির গলার স্বর পুরুষালি। কথা বলার ভঙ্গিটিও বাজে। ওসমান সাহেব ওয়েটিং রুমে চলে এলেন।

অপলা বেঁটে মত একটি লোকের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। লোকটির হাতে একটা জুলন্ত সিগারেট। সে হাত মুঠো করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে সিগারেট টানছে। ওসমান সাহেব এগিয়ে আসতেই সে হাসি মুখে বলল স্নামালিকুম স্যার, আবদুল মজিদ। আমার নাম। পিডিপিতে কাজ করি।

ভদ্রলোকের গলার স্বর এমন যেন দীর্ঘদিনের পরিচয় তাদের। ওসমান সাহেব অস্পষ্ট ভাবে হাসলেন।

আপনার কথা শুনলাম স্যার উনার কাছে। বিখ্যাত সাহিত্যিক। আপনাদের সাথে দেখা হওয়া ভাগ্যের কথা। সিগারেট নেন স্যার।

ওসমান সাহেব সিগারেট নিলেন। মজিদ দামী একটা লাইটার বিদ্যুৎগতিতে বের করল। হাসি মুখে বলল–আপনার নাম শুনেছি।

লেখা পড়ি নাই। আউট বই পড়ার আমার অভ্যাস নাই। আমি খুবই লজ্জিত।

লজ্জিত হবার কিছু নাই। পড়ার অভ্যাস অনেকের নাই। অনেকে সময়ও পায় না। আমার স্ত্রী অবশ্যি খুব পড়ে। রাত-দিন গল্পের বই নিয়ে আছে। আমাকে রাতে পড়ে শুনাতে চায়। যা মুসিবন্ত। সারাদিন পরিশ্রম করে রাতে একটু ঘুমোব। তা না গল্প শোন। অন্য মানুষের জীবনের বানানো গল্প শুনে কোন লাভ আছে স্যার বলেন?

না। লাভ আর কী।

এই তো আপনি স্বীকার করলেন। অনেস্টলি এডমিট করলেন। নিজে সাহিত্যিক হয়েও করলেন। আপনি স্যার গ্রেটম্যান।

অপলা হাসছে মুখ টিপে। ওসমান সাহেব অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। মজিদ ক্রমাগত কথা বলে যেতে লাগল–তার স্ত্রীর ব্যথা কীভাবে উঠিল, কত ঝামেলা করে আসতে হল এখানে। এসে দেখা গেল। ফলস পেইন। আসার সময় আত্মীয়-স্বজন কাউকেই খবর দেয়া হয়নি। এখান থেকে টেলিফোন করারও উপায় নেই। কারণ তার সব কিছু মনে থাকে। কিন্তু টেলিফোন নাম্বার মনে থাকে না। একটা কালো ডাইরিতে সব নাম্বার লেখা আছে কিন্তু তাড়াহুড়ার জন্যে সে ডাইরিটাই আনা হয়নি। অপলা বললো–আপনার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করুন। তাঁর নিশ্চয়ই মনে আছে। মেয়েদের এসব জিনিস খুব মনে থাকে।

মজিদ প্ৰায় লাফিয়ে উঠল–দ্যাটস রাইট। এক্ষুণি যাচ্ছি।

অপলা বলল, ভদ্রলোক মাথা ধরিয়ে দিয়েছেন। অবশ্যি খুবই সরল টাইপের মানুষ। তার জীবনের পুরা হিস্ট্রি আমাকে বলেছেন। আপনার উপন্যাসের জন্যে একটা চমৎকার ক্যারেকটার। ঠিক না দুলাভাই?

ওসমান সাহেব সহজ স্বরে বললেন, খুব কমন ক্যারেকটার। এ জাতীয় মানুষ প্রচুর আছে আমাদের চারপাশে। তাছাড়া এদের তুমি যতটা সরল মনে করছি ততটা না। এদের অনেকেই বোকার একটা মুখোশ পড়ে থাকে। এই মুখোশ দিয়ে প্রচুর মিথ্যা কথা বলে। সেগুলিকে তখন আর মিথ্যা বলে মনে হয় না।

অপলা তাকিয়ে রইল। ওসমান সাহেব বললেন, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছি না, তাই না?

বিশ্বাস করব না কেন? করছি।

না, করছ না। এই লোকটির কথাই ধর, সে যে মিথ্যা বলছে তা কী টের পেয়েছ?

সে আবার কী মিথ্যা বলল?

ঐ যে বলল আত্মীয়-স্বজনদের খবর দিতে পারিনি। এটা মিথ্যা। আমি এসে দেখি, এখানে একগাদা লোকজন। সে সবাইকে সিগারেট দিচ্ছে।

ঔপন্যাসিকরা খুব ভাল ডিটেকটিভ হতে পারে বোধ হয়। এরা সব কিছু খুব তলিয়ে দেখে। ঠিক না দুলাভাই?

ওসমান সাহেব একটু অস্বস্তি বোধ করলেন। তাঁর নিজের কাছেই মনে হল অপলাকে এত কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকে ইমপ্রেস করা। এই বালিকাটিকে মুগ্ধ করবার একটি গোপন ইচ্ছা! কী তার অবচেতন মনে বাসা বেঁধে আছে? কেন আছে?

অপলা!

জি।

এখানে টেলিফোন আছে?

অফিসে আছে। দুটাকা করে দিতে হয়। এরা ভাল বিজনেস শুরু করেছে। আমি কী আসব আপনার সঙ্গে?

এসো।

আপার সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। নার্সটা একগাদা কথা শুনিয়ে দিল। ইচ্ছা হচ্ছিল একটা চড় দেই।

দিলে না কেন?

অপলা অবাক হয়ে তাকাল। ওসমান সাহেবের গলার স্বরে কোন রসিকতা নেই। তিনি সত্যি সত্যি জানতে চান। অপলা মৃদু স্বরে বলল, আপনি লোকটি খুব অদ্ভুত।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

রাতে দেড়টায় টেলিফোন করা বিরক্তিকর ব্যাপার। বার বার রিং হবে কেউ ধরবে না। তারপর যখন ধরবে তখন ভয়ার্ত স্বর বের করবে–কী হয়েছে কী হয়েছে? কী হয়েছে ব্যাখ্যা করার পরও বুঝতে চাইবে না। আবার বলতে হবে। মধ্যরাতে সুসংবাদ দিয়ে কেউ ফোন করে না।

কিন্তু আশ্চৰ্য, রিং করা মাত্রই মিলি ধরল এবং সহজ স্বরে বলল–কাকে চাই?

মিলি নাকি?

হুঁ। কী ব্যাপার, ভাইয়া?

তুই এখনো ঘুমুসনি।

না, রাতে তো আমার ঘুম হয় না।

ঘুম হয় না। মানে?

হয় না মানে হয় না। মাঝে মাঝে ঘুমের ওষুধ খাই। তুমি এত রাতে কী জন্যে ফোন করেছ?

টগরের শরীরটা খারাপ। ডিপটেরিয়া। ওকে একটা ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।

মিলি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বল,এই কথাটা তুমি এত পরে বলেছ কেন? ঠিকানা কী বল, আমি এক্ষুণি আসছি।

আসার দরকার নেই, ও ভালই আছে।

তোমাকে ঠিকানা দিতে বলছি তুমি ঠিকানা দাও।

ওসমান সাহেব ঠিকানা দিলেন। তিনি নিশ্চিত জানেন মিলি আধা ঘণ্টার মধ্যে আসবে। এবং আসার আগে ঢাকা শহরে যত পরিচিত লোকজন আছে সবাইকে টেলিফোন করবে। টেলিফোনের ভাষাটা হবে এরকম–সর্বনাশ হয়ে গেছে –টগরের শরীর খুব খারাপ। এখন তখন অবস্থা। হাসপাতালো নিয়ে গেছে। এক্ষুণি আসুন।

অপলা বলল, মিলি আপ আসছে নাকি?

হ্যাঁ আসছে। মনে হচ্ছে বিরাট একটা দল নিয়ে আসবে। ও ঝামেলা ছাড়া কিছু করতে পারে না।

অপলা অল্প হাসল। ওসমান সাহেব বললেন, ক্ষিধে পেয়েছে, রাতের খাওয়া হয়নি। তোমরা কিছু খেয়েছ?

না।

বলুন।

যা ভাবা গেছে, টেলিফোন এনগেজড। মিলি নিশ্চিয়ই পাগলের মত চারিদিকে টেলিফোন করছে। ওসমান সাহেব বেশ শব্দ করেই হাসলেন। অপলা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, আপনাকে একটা কথা বলব দুলাভাই?

বল।

আগে কথা দিন রাগ করতে পারবেন না।

না। রাগ করব না।

এই যে টগর এরকম অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে এটা আপনাকে এফেক্ট করেনি। ঠিক না?

ওসমান সাহেব জবাব দিলেন না। অপলা বলল আপনি কী আমার ওপর রাগ করেছেন?

না, রাগ করিনি।

আমার ধারণা ছিল কবি-সাহিত্যিকদের অনুভুতি অনেক তীক্ষ্ণ। ধারণাটা বোধ হয়। সত্যি না।

একজনকে দিয়েই সবার বিচার করা ঠিক?

অপলা চুপ করে রইল। সে একটু লজ্জিত বোধ করেছে। মজিদ সাহেবকে সিগারেট হাতে হাসতে হাসতে আসতে দেখা গেল।

স্যার, আমার স্ত্রী আপনাকে চিনেছে। আপনার তিনটা বই সে পড়ছে। এর মধ্যে দু’টা খুব ভাল লেগেছে। নাম বলেছিল। এখন মনে নাই।

ওসমান সাহেব জবাব দিলেন না। পানির তৃষ্ণা অনেক বেড়েছে। কোথায় পানি পাওয়া যাবে কে জানে।

রাত দুটার দিকে রানু এসে বলল, টগরের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে অক্সিজেন দিতে হবে। রানু কাঁপছে থরথর করে। ওসমান এগিযে এসে তার হাত ধরলেন।

রানু কাঁদতে শুরু করল। এত ভয় পেয়েছে সে? ওসমান সাহেব বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। আশপাশে কেউ নেই। বারান্দার শেষ প্ৰান্তে মজিদ সাহেব দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি আড়ালে সরে গেলেন। এই ছোট্ট ভদ্রতাটি ওসমান সাহেবের বড় ভাল লাগল।

রানুর হাত থারথার করে কাঁপছে। ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, কোন ভয় নেই রানু। এরকম অভয়বাণী দেয়ার যোগ্যতা কী তার আছে? তিনি ডাক্তার নন। মহাপুরুষও নন। রানু যেমন ভয় পেয়েছে, তিনিও পেয়েছেন। তবু অভয় দেয়ার দায়িত্বটি তিনি নিলেন কেন? পুরুষ হিসেবে এই দায়িত্ব কী আপনাতেই এসেছে তার কাছে?

রানু চল টগরের কাছে যাই। মিলিরা এসে পড়বে।

টগর জেগে আছে কী ঘুমিয়ে আছে তা টের পাওয়া যাচ্ছে না। অক্সিজেনের নল তার নাকে স্কচ টেপ দিয়ে আটকানো। অল্প বয়সী ডাক্তারটি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। টগরের যে খুব কষ্ট হচ্ছে তা মনে হল না। সে বেশ স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

ওসমান সাহেব বললেন, কেমন দেখছেন? ডাক্তার ছেলেটি হাসিমুখে বলল,–ভাল, ভয়ের কিছু নেই। ব্রিদিংয়ের কষ্ট হচ্ছিল মনে করে অক্সিজেন দিয়েছি। আসলে অক্সিজেনের নল দেখলেই লোকজন ভয় পায়।

রানু শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। ডাক্তার ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে সহজ স্বরে বলল, তেমনি কিছু অসুবিধা হলে তো আমি স্যারকে ডেকে আনতাম। আনতাম না?

রানু কাঁপা গলায় বলল, আপনি আপনার স্যারকে ডেকে আনুন।

কোনোই প্রয়োজন নেই।

প্রয়োজন আছে, ডেকে আনুন।

বিশ্বাস করুন দরকার হলেই আমি তাকে ডাকব।

রানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, আপনি বুঝতে পারছেন না, এই ছেলেটি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। ওসমান সাহেব তাকালেন রানুর দিকে। তার চোখ ভেজা। দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটি কঠিন। শিশুটিকে রক্ষার জন্যে সে যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। চমৎকার একটি ছবি তো। তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তার কোনো উপন্যাসে এরকম কোনো ছবি আছে কী? তিনি মনে করতে পারলেন না। বাইরে গাড়ির হর্ণ দিচ্ছে। মিলিরা কী এসে পড়েছে? তিনি ঘর ছেড়ে বারান্দায় এলেন।

দু’টি গাড়ি ভর্তি করে একগাদা মানুষ এসেছে। মিলি যাকে যেখানে পেয়েছে ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে। বাবা এসেছেন। বাবার সেক্রেটারি সুন্দরী মেয়েটি পর্যন্ত এসেছে। ওসমান সাহেব বিরক্ত হবার বদলে খুশি হলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, এতগুলি মানুষ হঠাৎ চলে আসায় একটা উৎসবের ভাব চলে এসেছে।

তার মায়ের মৃত্যুর সময়ও এরকম হল। নানান জায়গা থেকে এত মানুষজন এল যে বাড়িটি হয়ে গেল বিয়ে বাড়ির মত। সবাই মায়ের ঘরে গিয়ে খানিকক্ষণ চোখ মুছে তারপর ছড়িয়ে পড়ে সারা বাড়িতে। সবাই চেষ্টা করে মুখের ভাব যথাসম্ভব করুণ রাখতে। সেটা বেশীক্ষণ সম্ভব হয় না। পুরনো দিনের মজার মজার সব ঘটনা মনে পড়ে যায় একেক জনের। খানিকক্ষণ হাসির পর আবার দারুণ গম্ভীর হয়ে যায় সবাই।

পরিষ্কার মনে আছে, পানি আনবার জন্যে রান্নাঘরে ঢুকে ওসমান সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলেন তিন-চারজন মাঝ-বয়সী মহিলাসুখী সুখী মুখে জমিয়ে গল্প করেছেন। চুলায় এক বিশাল কেতলিতে চায়ের পানি ফুটছে। টেবিলে সারি সারি চায়ের কাপ। ওসমান সাহেবকে দেখেই একজন মহিলা বললেন–চায়ের দেরি হবে। দুধ আনতে গেছে। দুধ নাই।

ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন, মিলির মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। সে বোধ হয় রাস্তায় আসতে আসতে কেঁদেছে। তার চোখ লাল। নাক ফুলে আছে। মিলি তাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, টগরের খবর কী?

ভালই।

কে যেন বলল অক্সিজেন দিচ্ছে।

তা দিচ্ছে।

তাহলে ভাল হয় কী ভাবে? এসব কী বলছি তুমি?

ওসমান সাহেব সিগারেট ধরালেন। মিলি বলল, আরে, তুমি কেমন মানুষ? এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

কোথায় যাব?

টগরের কাছে গিয়ে বস?

বসলে কী হবে?

বসলে কী হবে মানে? নিজের ছেলের এত বড় অসুখ আর তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে আরাম করে বিড়ি সিগারেট খাবে?

বলতে বলতে মিলি কেঁদে ফেলল। মেয়েরা এত সহজে কাদিতে পারে? মানিশ রায় বলে তার এক বন্ধু একবার বলেছিল মেয়েদের সব কিছুর মধ্যে একটা লোক দেখানোর ব্যাপার আছে।

কোনো মেয়ের যদি স্বামী মরে যায়। সে কাঁদবে কিন্তু এমনভাবে কাঁদবে যেন তাকে খারাপ না দেখা যায়। কাদার মধ্যেও সে একটু আর্ট খুঁজবে।

মিলি অবশ্যি আর্ট-ফার্ট খুঁজছে না। সে বিশ্ৰী একটা ভঙ্গি করেই কাঁদছে। ওসমান সাহেব বললেন, এত কাঁদছিস কেন?

কাঁদব না?

কাঁদার মত তো কিছু হয়নি? মিলি ফোঁফাতে ফোঁফাতে বলল, সব কিছুর মূলে হচ্ছে তুমি। তোমার মধ্যে মায়া বলে কিছু নেই।

মায়ার সঙ্গে ডিপথেরিয়ার কী সম্পর্ক? ডিপথেরিয়া একটা জীবাণুঘটিত অসুখ। খুব মায়া আছে এমন একজন বাবার ছেলেরও ডিপথেরিয়া হতে পারে। তুই যা… তোর ভাবীর কাছে যা। তবে এমন হাউমাউ করে কাঁদিস না।

মিলি তীব্র কণ্ঠে বলল, কেমন করে কাঁদতে হবে? তোমার উপন্যাসের নায়িকাদের মত? ফিচ ফিচ করে?

তিনি হেসে ফেললেন। স্বল্পবুদ্ধি মানুষেরা মাঝে মাঝে বেশ মজার কথা বলে।

মিলি ঘরের দিকে চলে গেল। তার মুখ থমথম করছে। রানুর কাছে গিয়ে সে দ্বিতীয় দফায় কেঁদেকেঁটে একটা ঝামেলা করবে। ওসমান সাহেব হাঁটতে হাটতে বারান্দার শেষ মাথায় চলে গেলেন। সিগারেটটা ড্যাম্প। টানতে কষ্ট হচ্ছে।

ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন, তার বাবা খুবই উৎসাহী ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছেন। কোনো রকম ঝামেলা উপস্থিত হলে বুড়োরাই বোধ হয় সবচেয়ে উৎসাহী হয়। তাদের উত্তেজনাহীন জীবনে সাময়িক উত্তেজনার বিষয়গুলি তারা উপভোগ করেন।

বাবাকে দেখা গেল গম্ভীর হয়ে কাকে হাত নেড়ে নেড়ে কী যেন বলছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন ধরাধরি করে ওয়েটিং রুম থেকে একটা সোফা বাইরে নিয়ে এল। তিনি রাজা-বাদশাদের মত মুখ করে বসলেন। এই লোকটি যে বাড়িতেই যান। সে বাড়িকেই মনে করেন নিজের বাড়ি। ওয়েটিং রুম থেকে সোফা টেনে বারান্দায় আনার কোনো দরকার ছিল না। ওয়েটিং রুমে দিব্যি বসা যেত। আর এমন যদি হয় যে তাকে বারান্দাতেই বসতে হবে তিনি বেতের চেয়ারে বসতে পারতেন। বেশ কয়েকটি বেতের চেয়ার আছে বারান্দায়। ওসমান সাহেব সিগারেট ফেলে দিয়ে বাবার কাছে এগিয়ে গেলেন। তিনি ধমকের স্বরে বললেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?

এখানেই ছিলাম।

ক্লিনিকে আনার বুদ্ধি দিল কে? ক্লিনিকে কোন চিকিৎসা হয়? টাকার শ্রাদ্ধ ছাড়া কিছুই হয় না। যত বেকুবী কাণ্ডকারখানা। আসল যে ডাক্তার সে ঘুমাচ্ছে। এক চেংড়া ছেলেকে দিয়ে রেখেছে। সে এ বি সি জানে না, ডাক্তারি জানবে কী?

ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, ডাক্তারি জানবে না কেন? মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে এসেছে।

পাস করলেই ডাক্তার হয়? হাজার হাজার ছেলে পুলে তো ল পাস করছে। ওরা পারে ওকালতী করতে? কোর্টে দাঁড়িয়ে একটা আগুমেন্ট করতে গেলেই তো প্যান্ট নষ্ট করে ফেলবে।

ওসমান সাহেব কিছু বললেন না। বাবার সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। হৈচৈ শুরু করলেন।

অপলা এসে বলল, চাচাজান আপনাকে ভেতরে ডাকে।

কে ডাকে?

রানু আপা। বড় ডাক্তার এসেছে।

ঘুম ভেঙেছে তাহলে। আমি ভেবেছিলাম ভোর দশটার আগে তাঁর নিদ্ৰা ভঙ্গ হবে না। ওসমান তুইও আয়।

না ঠিক আছে। আপনি একাই যান। একসঙ্গে এতগুলি মানুষের ভিড় করা ঠিক হবে না।

ওসমান সাহেব বাবার খালি করা সোফায় বসলেন। পানির তৃষ্ণা হচ্ছে এখানে পানি কোথায় পাওয়া যায় কে জানে। মোটা নার্সটাকে একটি ট্রে নিয়ে যেতে দেখা গেল। ওসমান সাহেব একবার ভাবলেন তাকে জিজ্ঞেস করবেন। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতে পাবলেন না। বাবা হলে কড়া গলায় বলতেন, এই যে মেয়ে, ঠাণ্ডা দেখে এক গ্লাস পানি আন। গ্লাস ধুয়ে আনবে। এই বলায় কোনো রকম জড়তা থাকত না। যেন নিজের বাড়িতেই কাউকে কিছু বলছেন। একটি মানুষেবা সঙ্গে অন্য একটি মানুষের এত তফাৎ।

ওসমান সাহেব দেখলেন বাবার সেক্রেটারি মেয়েটি ছোট ছোট পাযে এগিযে আসছে। মিলির কাছে এর কথা শুনেছেন। কিন্তু দেখা হল এই প্রথম। কী যেন নাম মেয়েটির? অত্যন্ত পরিচিত চেহারা। আগে কি দেখেছেন? কোথায দেখেছেন? টিভি বা সিনেমায অভিনয-টবিনযা করে নাকি? কবলেও তার দেখাব কথা নয়। টিভি-সিনেমা তিনি দেখেন না। মেয়েটির নাম কী বেবা? না রেখা? প্রথম অক্ষরটি কী ‘ব’ না অন্য কিছু?

স্নামালিকুম।

ওযালাইকুম সালাম।

ডাক্তার সাহেব এসে দেখেছেন। টগর ভাল আছে। অক্সিজেনের নল সব খুলে ফেলা হয়েছে।

তাই নাকি?

জি।

ক্রেস্টাপেন পেনেসিলিন দেয়া হচ্ছে, দশ লাখ ইউনিট কবে। এটিএসও দেযা হয়েছে। ভয়ের কিছুই নেই। সকালের মধ্যে সে মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠবে।

আপনি এতসব জানলেন কোথেকে?

মেয়েটি লজ্জিত স্বরে বলল, জিজ্ঞেস করে জেনেছি। আচ্ছা। আপনি কী আমাকে চিনতে পাবছেন?

পারব না কেন? আপনি আমার বাবার সেক্রেটারি। মিলি আমাকে বলেছে।

মিলি আমাকে ঠিক পছন্দ করে না।

ওসমান সাহেব কিছু বললেন না। মিলিকে ব্যস্তভাবে আসতে দেখা গেল। বীথি সবে গেল। মিলি বিরক্তস্বরে বলল, এ মেয়েটে এতক্ষণ ধবে কী গুজ গুজ করছিল?

তেমন কিছু না। কথা বলছিল।

অসুখ-বিসুখের মধ্যে তার এত কী কথা?

প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে ওসমান সাহেব বললেন, টগর কেমন আছে?

ভাল ঘুমাচ্ছে। তোমাদের জন্যে খাবাব নিয়ে এসেছি। এসো।

কী এনেছিস?

স্যান্ডউইচ বানিয়ে এনেছি। চট করে আর কী পাব?

তোর বর তোর সঙ্গে আসেনি?

ও ঘুমাচ্ছিল। জাগাইনি। টগরেব সঙ্গে ওর কী সম্পৰ্পক বল? টগবের অসুখ হলেই কী আর না হলেই বা কী?

তাই বলে কাউকে কিছু না বলে চলে আসবি?

হুঁ আসব। এসো, খেতে এসো।

রানু সহজভাবেই স্যান্ডউইচ মুখে দিচ্ছে। মিলি ফ্লাক্স ভর্তি কবে চা নিয়ে এসেছে। সেই চা ঢালা হচ্ছে। উৎসবের আমেজ চারদিকে। ওসমান সাহেব চায্যের পেয়ালা হাতে নিয়ে অপলাকে বললেন, মজিদ সাহেবকে ডেকে নিয়ে আসা। বেচারা একা ঘুরঘুর করছে।

রানুর চেহারা থেকে ভয়ের ভাবটা কেটে গেছে। সে হাসতে হাসতে পাশে বসে থাকা মোটা ভদ্রমহিলাকে কী যেন বলল। তিনিও হাসতে শুরু করলেন। এখানে যারা এসেছে। এদের অনেককেই ওসমান সাহেব চেনেন না। যেমন মোটা ভদ্রমহিলা। মুখ চেনা চেনা। পারিবাবিক উৎসবে ইনি নিশ্চয়ই আসেন। চোঁদ পনেরো বছরের চশমাপরা একটু ভাবুক ভাবুক ধরনের। ছেলেকে ও দেখা যাচ্ছে একে এর আগে কোনোদিন দেখেননি, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউ না নিশ্চয়ই।

অপলা এসে বলল, দুলাভাই, মজিদ সাহেব আপনাকে একটু বাইরে ডাকেন।

কেন?

জানি না কেন। আপনি একটু আসেন। ভদ্রলোক খুব আপসেট।

মজিদ সাহেব শুকনো মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ওসমান সাহেবকে দেখেই বললেন, কাণ্ড

দেখেছেন? এখন বলছে সিজারিয়ান করতে হবে। এতক্ষণ কিছু বলে নাই। হঠাৎ সিজারিয়ান।

তাই নাকি?

স্যার ওদের ওপর আমার ফেইথ চলে গেছে। ওর যদি সিজারিয়ান লাগেও আমি এখানে করাব না। মরে গেলেও না। আমি পিজিতে নিয়ে যাব। আপনি স্যার আমাকে একটু সাহায্য করেন।

ওসমান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কী সাহায্য?

আপনাকে স্যার একটু আসতে হবে আমার সাথে। আপনি সঙ্গে থাকলে বুকে হাতীর বল হয় স্যার।

তাকে অবাক করে দিয়ে মজিদ চোখ মুছতে লাগলেন। ওসমান সাহেব বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, এত নার্ভাস হচ্ছেন কেন।

নার্ভাস হচ্ছি কারণ ও বাঁচবে না।

কেমন করে বুঝলেন?

আমি বুঝতে পারছি।

মজিদ সাহেব শিশুদের মত ফুঁফিয়ে উঠলেন।

আমি যাব আপনার সঙ্গে। ভয়ের কিছু নেই। আমি আমার স্ত্রীকে বলে এক্ষুণি আসছি।

টগরের পাশে রানু বসে আছে। বুড়ো মত একজন ডাক্তার টগরের কপালে হাত দিয়ে তাপ পরীক্ষা করছেন। ওসমান সাহেব ভেতরে ঢুকতেই রানু বলল, ইনি ছেলের বাবা। খুব সম্ভব ছেলের বাবা প্রসঙ্গেই কথা হচ্ছিল। ডাক্তার সাহেব বললেন–আপনারা শুধু শুধুই ব্যস্ত হয়েছেন। ছেলে ভাল আছে। তাছাড়া আপনারা বার বার ডিপথেরিয়া ডিপথেরিয়াই বা করছেন কেন? ডিপথেরিয়া রুগী আমি আমার ক্লিনিকে কেন রাখব?

ওর কী হয়েছে?

ডিপথেরিয়ার মতই একটা মেমব্রেন। ফলস মেমব্রেন। কোন রকম টক্সিসিটি এখানে হয় না। আর আপনারা রাত তিনটায় ঢাকা শহরে সমস্ত লোক নিয়ে এসেছেন।

বুড়ো ডাক্তার অসম্ভব বিরক্ত হলেন। ওসমান সাহেব বললেন, পাশের রুমের মহিলার নাকি সিজারিয়ানের প্রয়োজন হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে। বাচ্চার হার্ট বিট বেড়ে একশ পঞ্চাশ হয়েছে। বাচ্চা বের না করলে দারুণ মুশকিল। এখন আপনি দয়া কের লোকজন নিয়ে বাড়ি যান শান্তিতে ঘুমুতে চেষ্টা করুন। আমাদের খানিকটা রিলিজ দিন, কবি-সাহিত্যিক মানুষ আপনারা, বেশি কিছু বলাও মুশকিল।

ডাক্তার সাহেব বিরক্ত মুখেই ঘর ছেড়ে গেলেন। ওসমান সাহেবের মনে হল রানু নিশ্চয়ই বেশ ফলাও করে টগরের বাবার পরিচয় ডাক্তার সাহেবকে দিয়েছে। নয়ত ডাক্তার সাহেব কবি সাহিত্যিক। এই শব্দ ব্যবহার করতেন না। চেহারায় তাকে চেনে এমন লোকের সংখ্যা খুব বেশি না।

ওসমান সাহেব রানুর দিকে তাকালেন। সে এখন বেশ স্বাভাবিক। পান চিতাবাচ্ছে। মিলি কী পানও নিয়ে এসেছিল নাকি? ওসমান সাহেব বললেন, রানু পাশের ঘরে যে মহিলা আছে তার সঙ্গে আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। পৌঁছে দিয়েই ফিরে আসব।

তুমি যাচ্ছ কেন?

তার হ্যাসবেন্ড খুব নার্ভাস ফিল করছে। তার ধারণা আমি থাকলে ভর্তির ব্যাপার খুব সহজ হবে।

নিজের ছেলের এত বড় অসুখে তুমি ওর কপালে হাত দিয়ে একবার টেম্পারেচার পর্যন্ত দেখনি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকেছা। আর অজানা অচেনা এক রুগীর জন্যে দরদ উথলে উঠছে?

দরদ-টারদের কোনো ব্যাপার না। একজন লোক একা একা হাসপাতালে যেতে ভয় পাচ্ছে।

সে ভয় পাচ্ছে তাতে তোমার কী?

আমার কিছুই না?

না, তোমার কিছুই না। মহাপুরুষ সাজতে যেও না। তুমি মহাপুরুষ না। সাধারণ মানুষ। লেখকরা মহাপুরুষ না।

রানুর চোঁচামেচিতে দরজার কাছে একটা ভিড় জমে গেল। তিনি ভেবে পেলেন না হঠাৎ রানুর কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেল কেন? টগর পর্যন্ত জেগে উঠেছে। ওসমান সাহেব। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। মজিদ সাহেব বারান্দায় অপেক্ষা করছিলেন। তার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বললেন চলুন যাই।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ