ওসমান সাহেব বাড়ি ফিরলেন রাত আটটায়। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটাবার সময় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। তাঁর ধারণা বৃষ্টির ফোঁটা যদি ছোট হয় এবং যদি খুব কাছাকাছি হয় তাহলে বৃষ্টি থামতে দীর্ঘ সময় লাগে। ফোঁটার ধরন দেখে তার মনে হল সারা রাত বৃষ্টি হবে। এবারে খুব শুকনো ধরনের বর্ষা গেছে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে বৃষ্টির শব্দ শোনা হয়নি। আজ হয়ত শোনা যাবে।

চার টাকা ভাড়া ঠিক করা ছিল। ওসমান সাহেব চকচকে একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে মনে মনে বললেন, বৃষ্টি আসার আনন্দে তোমাকে এক টাকা বিকশিস দেয়া গেল।

বসার ঘরে টিভি চলছে। আকবরের মা এবং তার ছেলে জিতু মিয়া পা ছড়িয়ে টিভি দেখছে। তারা দেখল ওসমান সাহেব ঢুকছেন। কিন্তু কেউ গা করল না। দুজনেই ভান করল–দেখতে পায়নি। ওসমান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন–সদর দরজা খোলা কেন আকবরের মা? আকবরের মা জবাবই দিল না। তাকিয়ে রইল।

অন্য কোনো ঘরে বাতি জ্বালাওনি কেন? যাও শোবার ঘরের বাতি জ্বালাও। টিভির সাউন্ড কমিয়ে দাও।

আকবরের মা বিরক্ত মুখে উঠে গিয়ে বাতি জ্বালাল। ওসমান সাহেব ঘরে ঢুকে দেখলেন বেশ পরিষ্কার করে বিছানা করা। লেখার টেবিলে নতুন টেবিল ক্লথ। কাচের জগে৷ পানি। পিরিচ দিয়ে ঢাকা একটা গ্ৰাস।

লেখার কাগজ। একটা লাল এবং একটা কাল বল পয়েন্ট পেন। হাতের বা পাশের বুকশেলফের বইগুলি চমৎকার করে গোছানো। শুধু তাই নয়, খাটের পাশে ছোট্ট টেবিলটায় একটা স্টেনলেস স্টিলের বাটিতে কিছুটাটকা বেলি ফুল। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন–কেউ এসেছিল আকবরের মা।

মিলা আফা আসছিল।

কিছু বলে গেছে?

বলছে কাইল আবার আসব।

এসেছিল কখন?

দুপুরের পরে, সাইন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল। কাইল সাইন্ধ্যার সময় আপনারে থাকতে কইছে।

মিলি ওসমান সাহেবের ছোট বোন। তার স্বামী সিভিল সাপ্লাইয়ে কাজ করে এবং বেশ ভালই মাইনে পায়। ঢাকা শহরে তাদের একটি বাড়ি আছে যার দোতলাটা ভাড়া দেয়া হয়। কিন্তু মিলির মাঝে মাঝে টাকার দরকার পড়ে। ওসমান সাহেব সেই দরকারটা মেটোন। আবার হয়ত এরকম কোনো প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

আকবরের মা।

জি।

চা দাও তো। লেবু চা।

আকবরের মা অপ্রসন্ন মুখে চা বানাতে গেল। ওসমান সাহেব বাথরুমে ঢুকলেন। রানুর অভাবটা বোঝা যাচ্ছে মেঝেতে সাবান গলে পড়ে আছে। বেসিনটা নোংরা। আয়নায় সাবানের ফেনা পড়ে জালের মত নকশা তৈরি হয়েছে। আকবরের মা এবং তার ছেলের কোনো দিকেই কোনো নজর নেই। অবিশ্যি বাজার করা হচ্ছে। রোজ দুবেলা রান্না হচ্ছে। এই বা কম কী!

গোসল সেরে বেরুতে তার অনেক সময় লাগল। টেবিলে ঢেকে রাখা চা ততক্ষণে জুড়িয়ে পানি হয়ে গেছে। ওসমান সাহেব মুখ বিকৃত না করে সেই ঠাণ্ডাচা খেলেন। ঠিক এই মুহুর্তে কোন লেখালেখি করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তবু বসলেন লিখতে। অনেক দিন ধরে একটা লেখা ঘুরছে। মাথায়। সারাক্ষণেই ভোতা একটা যন্ত্রণা দিচ্ছে লেখাটা। দশ/বার পৃষ্ঠা লিখে ফেলতে পারলে যন্ত্রণা একটু কমবে। এক বছর হয়ে গেল যন্ত্রণাটা পুষছেন।

কিছু কিছু লেখা বড় কষ্ট দেয়। এই কষ্ট দেয়া গল্পটির জন্ম গত বর্ষায়। ময়মনসিংহ থেকে বাসে করে ঢাকায় আসছেন। বাকুনিতে চমৎকার ঘুম এসে গেল। ঘুম ভাঙল ভাওয়ালের জঙ্গলে। সন্ধ্যা হব হব করছে। বনের মাথায় চাঁদ উঠেছে। বাস চলার শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। সেই শব্দও এক সময় থেমে গেল। কারবুরেটরে গোলমাল। ড্রাইভার রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে খুটখাট শুরু করেছে। যাত্রীরা সব নেমে গেছে বাস ছেড়ে। ওসমান সাহেব জানালা দিয়ে মুখ বের করে বসে আছেন। বিশাল অরণ্যে বৃষ্টির মত চাঁদের আলো ঝড়ছে। শুনশান নীরবতা। মাথায় ঠিক তখন গল্পটা এল। তিনি কল্পনা করলেন এই আরণ্য ক্রমেই বড় হচ্ছে। একটির পর একটি শহর এবং নগর গ্রাস করতে শুরু করেছে। ছোট্ট একটি শহর। শুধু বাকি। অল্প কিছু লোক থাকে। সেই শহরে। প্রতি রাতেই তারা শুনতে পায় অরণ্য এগিয়ে আসছে।

গল্পটি অনেকবার লিখতে চেষ্টা করেছেন। লিখতে পারেননি। সমস্ত ব্যাপারটা মাথায় সাজানো আছে কিন্তু কলমে আসছে না। একটি লাইনও নয়। তিনি রাতের পর রাত কাগজ কলম নিয়ে বসে। কাটিয়েছেন। দুবার এ নিয়ে রানুর সঙ্গে ঝগড়া হল। রানু বলল–এই গল্পটিই যে লিখতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। অন্য গল্প লেখ। তিনি গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন–একটা শেষ না করে অন্য কোনো লেখায় আমি হাত দেব না।

যদি এটা লিখতে না পার তাহলে আর অন্য কিছু লিখবে না?

না।

তুমি বড় অহঙ্কারী।

এখানে অহঙ্কারের কী দেখলে?

অনেক কিছুই দেখলাম। অক্ষমতা স্বীকার না করাটাও অহঙ্কার।

ওসমান সাহেব চুপ করে রইলেন। রানু মশারি ফেলতে ফেলতে বলল, কোনো মানুষই তার প্রতিভার বাইরে যেতে পারে না।

প্রকারান্তরে বলা, তাঁর তেমন কোনো প্রতিভা নেই। থাকলে অরণ্যের সেই গল্প লিখে ফেলতে পারতেন। পুরুষদের আহত করার কৌশল মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেলে এবং তা ব্যবহারও করে চমৎকারভাবে। কেউ তার প্রতিভার বাইরে যেতে পারে না। বইয়ের ভাষায় কয়েকটা কথা বলে রানু ঘুমুতে গেল। ঘুমিয়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যে। ওসমান সাহেব রােত তিনটা পর্যন্ত জেগে রইলেন। খাতার পাতায় শুধু কয়েক বার লেখা হল–অরণ্য এ পর্যন্তই। টগর যখন জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করেছে তখনো তিনি ঘুমুতে যাননি। রানু টগরকে নিয়ে বাথরুম করাল। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াল এবং খুব সহজভাবে বলল–শোবার সময় ফ্যানটা এক ঘর কমিয়ে দিও তো। যেন কিছুই হয়নি।

ওসমান সাহেব ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। বাইরে ভালই বৃষ্টি হচ্ছে। তার থিওরি সত্যি করবার জন্যেই বোধ হয় আজ সারা রাত বৃষ্টি পড়বে।

আপনার টেলিফোন।

তিনি চমকে তাকালেন। আকবরের মা নিঃশব্দে চলাফেরা করে। মাঝে মধ্যেই তাকে চমকে দেয়। তিনি বিরক্ত স্বরে বললেন।

কার টেলিফোন?

মিলা আফার।

তার চেয়ার ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছিল না। আকবরের মাকে বললেই সে হাতের কাছে রিসিভার এনে দেবে। কিন্তু শোবার ঘরে টেলিফোন রাখা তার পছন্দ নয়। টেলিফোন আসা মানেই হচ্ছে অপরিচিত একজন লোকের ঘরে ঢুকে পড়া। একজন অপরিচিত মানুষ রাত দুপুরে শোবার ঘরে ঢুকুক এটা তার পছন্দ নয়। কিন্তু মিলি অপরিচিত কেউ নয়।

টেলিফোন এই ঘরে আনুম?

না আমি যাচ্ছি।

ওসমান সাহেব টেলিফোনে দীর্ঘ সময় কথা বলতে পারেন না। মিলি ঠিক তার উল্টো, ঘণ্টা খানিকের আগে টেলিফোন ছাড়তে চায় না।

হ্যাঁলো ভাইয়া, কী করছ? লিখছিলে নাকি?

না।

তোমার অপেক্ষায় থেকে সারাটা দুপুর, সারাটা বিকাল এবং সারাটা সন্ধ্যা নষ্ট হল। আমি যে গিয়েছিলাম তোমাকে বলেনি?

বলেছে।

গিয়ে কী দেখি জানো? তোমাদের জিতু মিয়া সোফায় পা তুলে লাট সাহেবের মত বসে। আছে। এমন এক চড় দিয়েছি। চড়ের কথা তোমাকে বলেছে?

না।

আচ্ছা ভাইয়া, শোন, যে জন্যে তোমাকে টেলিফোন করলাম ভাবীকে গতকাল দেখলাম একটা ছেলের সঙ্গে রিকশায় করে যাচ্ছে। সুন্দর মত ছেলে। চেক চেক শার্ট গায়ে। দুজনে খুব হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছিল। ভাইয়া, তুমি শুনতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

কিছু বলছি না কেন?

দেখ মিলি রানুর সঙ্গে আমার বনিবনা হয়নি। আমরা আলাদা থাকছি। এখন সে যদি কোনো ছেলের সঙ্গে পরিচিত হয় তাহলে হবে। আমি এখানে কী বলব?

কিছুই বলবে না? ভাবীর সঙ্গে তোমার সেপারেশন তো এখনও হয়নি।

এখনও হয়নি। কিন্তু হবে। রানু কাগজপত্র জমা দিয়েছে। আচ্ছা মিলি আমি রাখলাম, ঘর গুছিয়ে দিয়ে যাবার জন্যে ধন্যবাদ।

শোন, ভাইয়া, আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।

বল কী বলছি।

তুমি নাকি বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছ?

বাড়ি বিক্রি করবে। কেন?

কেন করবে তা আমি কী করে জানিব। আমি যা শুনলাম তোমাকে বললাম।

ভুল শুনেছিস।

কার কাছে শুনলাম সেটা জিজ্ঞেস করলে না?

না গুজব শোনায় আমার আগ্রহ নেই। মিলি আমি রাখলাম।

এত রাখি রাখি করছি কেন?

ক্ষিধে লেগেছে। ভাত খাব।

ঠিক আছে তাহলে ভাত খাবার পর আমাকে টেলিফোন করবে।

কেন কথা এখনও শেষ হয় নি?

খুব একটা ইন্টারেস্টিং গল্প তোমাকে বলব ভাইয়া। আমার এক বান্ধবীর জীবনের সত্যি ঘটনা। তুমি এটা নিয়ে একটা গল্প লিখতে পাের। তবে বান্ধবীর নাম ব্যবহার করতে পারবে না। হ্যাঁলো, ভাইয়া, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

একটু ধরে রাখ। বাবু কী জন্যে ডাকছে শুনে আসি। আচ্ছা ভাইয়া শোন, হ্যাঁলো? বাবুর ভাল নাম রেখে দিলে না তো। খুব সুন্দর দেখে তিন অক্ষরে একটা নাম দাও তো। শুরু হবে ম দিয়ে। আমার সঙ্গে মিলিয়ে রাখতে চাই।

মৌসুমী রাখ।

না মৌসুমী না। মৌসুমী সিনেমার নায়িকার নাম।

মিতুল।

ওটা তো ছেলেদের নাম।

আজকাল ছেলেদের এবং মেয়েদের একই নাম হয়।

মিতুল শব্দের মানে কী?

আমি জানি না।

বল কী, তুমি এত বড় লেখক হয়ে মিতুল শব্দের মানে জানো না?

আমি বড় লেখক তোকে বলল কে? আচ্ছা এখন রাখলাম।

তিনি টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। আকবরের মা এবং জিতু মিয়া গভীর আগ্রহে টিভি দেখছে। জীবনের সমস্ত সুখ ও আনন্দ যেন এই যন্ত্রটিতে। রানু চলে যাওয়ায় এরাই বোধ হয় সবচেয়ে খুশি।

তিনি নিজেও কি খুশি হননি? সম্পূর্ণ নিজের মত করে থাকার একটা আলাদা আনন্দ আছে। স্বাধীনতার আনন্দ। রানুর অভাব তিনি যতটা বোধ করবেন ভেবেছিলেন ততটা করছেন না, তেমন কোন শূন্যতা তার মধ্যে তৈরি হয়নি। কিন্তু হওয়া উচিত ছিল। শুধু রানু কেন টগরের জন্যও কী তিনি তেমন কোন আকর্ষণ অনুভব করেন? মনে হয় না। কাউকে ভালবাসার ক্ষমতাই বোধ হয তার নেই।

আকবরের মা বলল—ভাইজান ভাত দিব?

দাও। কী রান্না আজকে?

কই মাছ।

ওসমান সাহেব তৃপ্তি করে ভাত খেলেন। খাওয়ার শেষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে দু’টি সিগারেট শেষ করলেন.। তাঁর পান খেতে ইচ্ছা হল। ঘরে পান ছিল না। জীতু মিয়া ছাতা মাথায় দিয়ে পান। কিনতে গেল। ওসমান সাহেবের মনে হল এই জীবনটাই বা নেহায়েত খারাপ কী। নিঃসঙ্গতারও তো এক ধরনের আনন্দ আছে। শূন্যতার মধ্যেও আছে পরিপূর্ণতা। নৈঃশব্দ্যের গান।

ভাইজান আপনার টেলিফোন।

তিনি রিং, শুনতে পেলেন। বেশ জোরেই শব্দ হচ্ছে। কিন্তু তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন না কেন? যা আমরা শুনতে চাই না। আমাদের মস্তিষ্ক সব সময় চেষ্টা করে তা যেন শুনতে না হয।

ওসমান সাহেব বললেন–আকবরের মা, তুমি বারান্দায় একটা মোড়া এনে দাও আর যে টেলিফোন করেছে তাকে বলে দাও আমি এখন ব্যস্ত, সকাল বেলা টেলিফোন করতে।

মিলা আফা ফোন করছে।

যা বলতে বললাম বল।

আমি কইছি, আপনে বারান্দায়।

অত্যন্ত বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে তিনি টেলিফোন ধরলেন–কী ব্যাপার মিলি?

ভাইয়া আমার কথা শেষ হবার আগেই তুমি খট করে টেলিফোন রেখে দিলে কেন?

কী বলতে চাস বল।

তুমি আমার সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার কর কেন?

ওসমান সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মিলি বলল–বাবার শরীর এত খারাপ তুমি একবারও তাকে দেখতে যাওনি। পরশু দিন তিনি দুঃখ করছিলেন। আগামীকাল আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব।

ঠিক আছে।

শোন ভাইয়া, তুমি বাবার সঙ্গে কয়েকদিন থাকবে। একা একা এই বাড়িতে পড়ে থাকার কোনো মানে আছে?

আচ্ছা সেটা দেখা যাবে।

মিলি আরো মিনিট দশেক কথা বলে টেলিফোন রাখল। ওসমান সাহেব নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ঘুম ঘুম লাগছে, আবার শুয়ে পড়তেও ইচ্ছা হচ্ছে না। রানু যখন ছিল দু’টা পুঞ্জ জেগে থাকতেন। এখন এগারোটা বাজােতই সুমে চোখ জড়িয়ে আসে। এর অন্তর্নিহিত রহস্যটি কী?

বৃষ্টির জন্য শীত করছে। পাতলা কোনো একটা জামা গায়ে দিয়ে ঘুমুতে হবে। আলনায় তেমন কিছু নেই। কোথায় থাকতে পারে? কাবার্ডে নিশ্চয়ই নেই। কাবার্ডে থাকত রানুর কাপড় এবং কোনো কারণে তিনি কাবার্ড খুললে রানু বিরক্ত হত। কঠিন স্বরে বলত।–আমার জিনিসে হাত দিচ্ছে কেন?

মজার ব্যাপার হচ্ছে রানু তার জিনিসের কিছুই সঙ্গে নিয়ে যায়নি। আসার সময। যেমন চটের একটা হ্যাঁন্ড ব্যাগ নিয়ে এসেছিল, যাওয়ার সময়ও ঠিক সেভাবেই গিয়েছে। তিনি মনে মনে ভাবলেন, আমাদের সবার মধ্যেই নাটক করবার প্রবণতা আছে। রানুর মধ্যে সেটা হয়ত ছিল বেশি মাত্রায় নয়ত বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় নীল রঙের শাড়ি পরার দরকার ছিল না। ওসমান সাহেবের ধারণা সে এই শাড়ি পরেছে। কারণ প্রথম যখন সে এ বাড়িতে আসে তার পরনে ছিল নীল শাড়ি। কিংবা সমস্ত ব্যাপারটা কাকতালীয়ও হতে পারে। রানু হয়ত সচেতনভাবে কিছু করেনি। তিনি অন্য রকম ব্যাখ্যা করছেন। যাবার সময় গায়ে নীল শাড়ি ছিল বলেই সেই শাড়ি পরেই গিয়েছে।

জিতু মিয়া পান নিয়ে এসে দরজায় ধাক্কা দিল। ওসমান সাহেব বললেন, এখন আর লাগবে না। সকালে খাব। জিতু বেচারী বৃষ্টি মাথায় হেঁটে হেঁটে পান আনতে গেছে–একটা নিয়ে খেলেই হত। কিন্তু তার উঠতে ইচ্ছা করছে না। শরীর জুড়ে আরামদায়ক একটা আসল্য।

বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। কী মাস এটা? ভাদ্র মাস না? বাংলা মাসের নামের মধ্যে ভাদ্র মাস নামটাই সবচেয়ে খারাপ। সবচে সুন্দর হল শ্রাবণ। চৈত্র নামটাও ভাল। ওসমান সাহেব হাত বাড়িয়ে শেলফ থেকে একটা বই নামালেন। পড়তে ইচ্ছে করছে না। চোখ বুলানোর জন্য নেয়া। এক সময় প্রচুর পড়তেন। রাতের পর রাত বই পড়ে কাটিয়েছেন। একবার জাম্প ইন্টু নাথিংনেস নামে একটা বই রাত তিনটায় পড়ে শেষ করলেন। তারপর নিজে চা বানিয়ে খেলেন এবং সেই বই-ই আবার গোড়া থেকে পড়তে শুরু করলেন। চমৎকার সময় ছিল সেটা। আনন্দও উল্লাসের সময়। মনে আছে একটি জাপানি ছোটগল্প একরাতে চারবার পরার পর অনুবাদ করতে বসলেন। তার সমগ্র জীবনে এই একটিই অনুবাদ কর্ম। সেই অনুবাদটি তিনি কখনো প্রকাশ করেননি। প্রকাশ না করার পেছনের যুক্তিটি ছিল ছেলেমানুষি যুক্তি আমি ঐ জাপানি লেখকের চেয়েও অনেক বড় লেখক হব। ওর গল্পের অনুবাদ আমি কেন করব?

তিনি বড় লেখক হতে পেরেছেন? অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু বড় লেখক হতে পেরেছেন কী? কেউ তার নিজের প্রতিভার বাইরে যেতে পারে না। খুব সত্যি কথা। বাতি নিভিয়ে ওসমান সাহেব জাপানি গল্পের কথা ভাবতে শুরু করলেন–

একটা ছোট্ট শহর। সেই শহরের নিয়ম হচ্ছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের শহরের রাস্তার পাশে পুঁতে রাখা। কোমর পর্যন্ত ঢুকানো থাকে গর্তে। শরীরটা বেরিয়ে থাকে। দিন যায়। ধীরে ধীরে এরা বদলে যেতে থাকে। এবং এক সময় এরা গাছ হয়ে যায়। এই রকম একজন অপরাধী পুরুষ ধীরে ধীরে গাছ হচ্ছে আর রোজ রাতে তার স্ত্রী আসে তার কাছে। জানতে চায় তোমার কেমন লাগছে? পুরুষটি ক্লান্ত স্বরে তার অভিজ্ঞতার কথা বলে। মেয়েটি জানতে চায়–তুমি কী এখনো আমাকে ভালবাস। পুরুষটি থেমে থেমে বলে আমি জানি না। আমি গাছ হয়ে যাচ্ছি, আমি বুঝতে পারছি না।

যখন মানুষ ছিলে তখন কী আমাকে ভালবাসতে?

একটি অসাধারণ গল্প। কিন্তু আজ এই বর্ষার রাতে তিনি এই গল্পটির কথা ভাবছেন কেন? নিজেকে কী তিনি গাছ হিসাবে ভাবছেন। রানু হচ্ছে সেই গাছের পাশে আসা মেয়েটি?

ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। গল্পটির প্রভাব। অন্য কিছু নয়। প্রতিভাবান জাপানি গল্পকার তার মধ্যে একটি বিশুদ্ধ আবেগ সৃষ্টি করেছেন। চোখ ভিজে ওঠার পেছনে রানুর কোন ভূমিকা নেই।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ