শেষ রাতের দিকে ওসমান সাহেব একটা দুঃস্বপ্ন দেখলেন, যেন ক্লাস নিতে গিয়েছেন। তিনি পড়াবেন আর্যদের আগমনের ইতিহাস। কিন্তু ক্লাসে ঢুকেই টের পেলেন তাকে পড়াতে হবে জ্যামিতি। দু’টি ত্ৰিভুজকে সর্বসম প্রমাণ করতে হবে। ত্রিভুজ দু’টির দুই বাহু ও অন্তঃস্থ কোণ সমান ম্যাট্রিকে পড়ে এসেছেন। তবু বোর্ডের সামনে দাঁড়ানোমাত্র সব গুলিয়ে গেল। তিনি হকচাকিয়ে তাকালেন ছাত্রদের দিকে। সবাই হাসছে। মেযেগুলি হেসে একজন অন্যজনের গাযে গড়িয়ে পড়ছে। এতো হাসির কী আছে? তিনি বিড়বিড় করে বললেন, এই হাসছ কেন? তারা আরো জোরে হেসে উঠল। তিনি কপালের ঘাম মুছবার জন্যে পকেটে হাত দিতে গিয়ে টের পেলেন তার গাযে কোন কাপড় নেই। কী ভয়াবহ ব্যাপার। ওসমান সাহেব গোঙানির মত শব্দ করতে কবতে জেগে উঠলেন। তার সারা গা ঘামে জড়িয়ে গেছে। তিনি ক্ষীণ স্বরে ডাকলেন রানু রানু। তিনি জানেন রানু এখানে নেই। তবুও প্রতিদিনই আধো-ঘুম আধো-জাগরণে মনে হয় সে পাশেই আছে, ডাকলেই সাড়া দেবে।

তিনি ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। হাতের কাছে কাচেব জগ কিন্তু পানি নেই। তিনি উঠে গিয়ে বাতি জ্বালালেন। গায়ে মুখে পানি ঢাললেন। রাত শেষ হয়ে এসেছে চারটা দশ বাজে। আবার ঘুমুতে যাবার কোন মানে হয না। চা খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। বানাবে কে? বিয়ের পর পর ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা বানিয়ে রাখত রানু। কোন ভাবে যদি লেখক স্বামীকে সাহায্য করা যায়। ডিকশনারি দেখে বানান ঠিক করা। লেখা কফি করে দেয়া। কত উৎসাহ। জীবনটাই অন্য রকম ছিল।

বিয়েব পরপর একবার এ রকম ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন। ভযে অস্তিব হয়ে ডাকলেন–রানু রানু। রানুহকচকিয়ে গেল। ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হয়েছে?

ভয় পেয়েছি। দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম একটা পাগল আমাকে তাড়া কবেছে।

বলতে বলতে তিনি শিউরে উঠলেন। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। রানু অবাক হয়ে বলল এত ভয় পাওয়ার মত কি দেখলে, এর চেয়ে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন তো আমি রোজই দেখি। ওসমান সাহেব নিচু গলায় বললেন না। এ রকম তুমি দেখ না। এটা একটা ভয়ানক স্বপ্ন। তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না। সম্পূর্ণ অন্য রকম ব্যাপার।

রানু তার হাত ধরে অনেক্ষণ পাশে বসে রইল। তারপর চা বানিয়ে আনল।

ওসমান সাহেব শিশুর মত তাকে জড়িয়ে ধরে বাকি রাতটা জেগে কাটালেন। বানু নিজেও ঘুমাল না। একজন বয়স্ক মানুষ সামান্য একটা স্বপ্ন দেখে এতটা ভয় পেতে পাবে তা তার ধারণার বাইরে ছিল। সে নিচু স্বরে বলল তুমি কী প্রায়ই এ রকম দুঃস্বপ্ন দেখ?

প্রায়ই না মাঝে মাঝে দেখি।

সব সময় এ রকম ভয় পাও?

হ্যাঁ।

বেশ কিছু সময় চুপচাপ থেকে রানু বলল, তোমার এক গল্পের নায়ক এ রকম দুঃস্বপ্ন দেখত। ওসমান সাহেব কিছু বললেন না। রানু বলল বেচারা অবশ্যি শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যায়।

তিনি রাগি গলায় বললেন ওর পাগল হওয়ার অন্য কারণ ছিল।

রাগ করছে কেন?

রাগ করছি না। লেখার সঙ্গে সবাই লেখককে মিশিয়ে ফেলে। এটা ঠিক না। লেখা এবং লেখক এক নয়।

আহ আমি ঠাট্টা করছিলাম।

ওসমান সাহেব থমথমে গলায় বললেন এই ব্যাপারটা নিয়ে ঠাট্টা আমার ভাল লাগে না।

তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? রাগ করার মত কিছু তো আমি বলিনি। দাও মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।–নাকি অন্য কিছু চাই?

ওসমান সাহেব জবাব দেননি। পাশ ফেরে ঘুমুতে চেষ্টা করেছেন। ঘুম আসেনি। দুঃস্বপ্ন দেখার পর সাধারণত তাঁর ঘুম হয় না। আজও হবে না। অবশ্যি আর রাতও খুব বাকি নেই। আকাশ ফর্স হতে শুরু করেছে। কাক ডাকতে শুরু করবে। লেখক হয়েও অলেখক সুলভ চিন্তা করলেন। কাক ডাকতে শুরু করবে না বলে উচিত ছিল পাখি ডাকতে শুরু করবে।

তিনি চটি পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তাঁর গল্পের নায়কের সঙ্গে একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। সেও দুঃস্বপ্ন দেখার পর বাকি রাতটা ঘুমুতে পারত না। বারান্দায় এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করত। সূর্য ওঠার পর ঘুমুতে যেত। একজন নিঃসঙ্গ মানুষের গল্প। শেষ পর্যায়ে সে স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবকে গুলিয়ে ফেলে। চমৎকার একটি গল্প। শুধু চমৎকার নয় একটি অসাধারণ গল্প। আশ্চর্যের ব্যাপার, সমালোচকরা এই গল্পটিকে গুরুত্ব দেননি। কেন দেননি? ওসমান সাহেব ঠিক করে ফেললেন আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো এই গল্পটি পড়বেন। স্বপ্ন দৃশ্যে বর্ণনাগুলি ভাল করে দেখা দরকার। এই গল্পে অতিপ্রকৃত আবহ তৈরির জন্যে প্রচুর তৎসম শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে কী গল্পের গাথুনি আলগা হয়ে গেছে?

সাদামাটা একটা সূর্য উঠল। ভোর হওয়া নিয়ে কবি সাহিত্যিকরা এত হৈচৈ করে কী জন্যে কে জানে? সূৰ্য ওঠার মধ্যে রহস্যময় কিছু নেই। জ্যোৎস্নায় কিছু রহস্য আছে। কাজেই চাঁদ নিয়ে কিছুটা মাতামাতি করা যেতে পারে। সূর্য নিয়ে নয়।

আকবরের মা উঠে পড়েছে। গ্যাসের চুলায় আগুন জ্বলছে চায়ের কেতলি বসানো হয়েছে। ভোর বেলার এই আয়োজনটি চমৎকার। দেখলেই মন ভাল হয়ে উঠতে শুরু করে।

আজ আমি লেখা নিয়ে বসব।

জি আইচ্ছা।

যেই আসুক বলবে আমি বাসায় নেই। কখন ফিরব তার ঠিক নেই। টেলিফোনেও একই কথা বলবে।

জি আইচ্ছা। ফেলাস্কে চা বানাইয়া দিমু?

না, চা-টা লাগবে না।

অনেক দিন পর লেখার টেবিলের কাছে এসেছেন। সাদা খাতা খোলা দেখলেই কিছু একটা লিখতে ইচ্ছা কবে। অরণ্য এগিয়ে আসছে এই গল্পটি লিখে ফেললে কেমন হয়?

অরণ্য এগিয়ে আসছে। ছোট শহরের সবাই বুঝতে পারছে পালানোর পথ নেই। প্রথম কযেক পৃষ্ঠায় এই বর্ণনাটিই থাকবে। কিন্তু লেখাটা আসছে না।

টেবিলে এক পাশে মিমির প্যাকেট। লাল লাল পিপড়া প্যাকেটটি ছেকে ধরেছে। টগরকে দেয়া হয়নি। কেন দেয়া হয়নি? হাতেই তো ছিল। তবু শেষ মুহূর্তে দেয়া হল না কেন? তিনি কী টগরকে ভালবাসেন না? কিন্তু তা কি করে হয়!

ওসমান সাহেব মিমির প্যাকেটটি তার লেখার কাগজের উপর এনে রাখলেন। পিপড়াদের মধ্যে একটি সাড়া পড়ে গেল। হঠাৎ বস্তুর অবস্থানগত পরিবর্তন কেন হল তারা বুঝতে পারছে না। ছোটাছুটি করছে পাগলের মত। ওসমান সাহেব মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন।

রানুর ঘুম ভাঙল খুব ভোরে।

অভ্যাস মত টগরের গায়ে হাত রাখল। গা গরম। টেম্পারেচার কত হবে? রাত দুটোর দিকে একবার টেম্পারেচার নেয়া হয়েছিল, নিরানব্বই। এখন বোধ হয় তার চেয়েও বেশি। রানু টগরকে নিজের কাছে নিয়ে এল। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে উত্তাপ যদি কিছু কমিয়ে দেয়া যায়। এত ভুগে কেন সে? দু’দিন পর পর অসুখ। হাম থেকে উঠবার পরই এক নাগাড়ে সাতদিন সর্দিজুর। সেই জ্বর সারল, সঙ্গে সঙ্গে হল আমাশা। একটা কিছু লেগেই আছে। শরীর শুকিয়ে কাঠির মত হয়েছেশুধু মুখটা শুকায়নি। বড়সড় একটি মুখে দু’টি বিশাল চোখ। ওর বাবার চোখ পেয়েছে। শুধু চোখ নয়। বাবার স্বভাব-চরিত্রও বোধ হয় কিছু পেয়েছে। কোনো ব্যাপারেই কোনো অভিযোগ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থাকতে পারে।

টগর ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠল। রানু ডাকল এই টগর!

সে তার ছোট হাত দু’টি দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। কেমন তাকাচ্ছে পিট পিট করে।

টগর, এই পাজী।

কী।

টগর মাথা নাড়ল। তার খারাপ লাগছে। কিন্তু মুখ হাসি হাসি। বলল দুধ খাবি?

বোতলে করে খাব।

এত বড় ছেলে বোতলে করে খাবি কি? মালটোভা দিয়ে বানিয়ে দেব। এক চুমুকে খেয়ে ফেলবি, ঠিক আছে?

টগর ঘাড় কাত করল, সে গ্লাসে করে দুধ খেতে রাজি আছে।

বেশি করে চিনি দিও।

দেব।

দুধ বানিয়ে এনে রানু দেখল টগর বালিশটা দুপায়ের ফাঁকে নিয়ে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, জ্বর কি কমে আসছে? রানু অনেক্ষণ ছেলের পাশে বসে রইল।

রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। আপলা জেগেছে নিশ্চয়ই। সেও খুব ভোরে ওঠে। হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসে। মেডিকেলে টেস্ট দেবে। এ্যালাউ হবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। রোজ ঘুমুতে যায় দেড়টা-দুটোর দিকে। রানু রান্নাঘরে এসে দেখল অপলা চায়ের কেতলি বসিয়েছে। সে হাসি মুখে বলল–তুমি আজ এত ভোরে উঠলে যে? ব্যাপার কী?

ব্যাপার কিছু না।

টগরের জ্বর আছে এখনো?

কম, গা ঘামছে।

রাতে বেশ কয়েকবার কাদল। তখনি বুঝেছি শরীর খারাপ। ওকে আজ একবাবা ৬াওক্লাবের কাছে নিয়ে যাও।

রাতে কেঁদেছে নাকি?

হ্যাঁ, তুমি টের পাওনি?

না।

রানুর কিছুটা মন খারাপ হল। টগর, কেঁদোছে সে টেবও পায়নি। ও অবশ্যি কেঁদো-কেটে পাড়া মাথায় করবে না। নিজে নিজেই শান্ত হয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করবে।

আপা চা খাবে?

খালি পেটে চা খাই না।

খালিপেটে হবে কেন। নোনতা বিস্কুট আছে, দেব?

দে।

অপলা চা ঢালতে ঢালতে বলল, তুমি চিন্তিত কেন? রাতে ভাল ঘুম হয়নি?

হয়েছে।

তাহলে? মুখ এমন শুকনো কেন?

টগরের আবার জ্বর আসল–এই জন্যই খারাপ লাগছে।

আপা তুমি একটা কাজ কর দুলাভাইকে খবর দাও। সে কযেকদিন ঘন ঘন আসুক। ছেলেকে নিয়ে ছোটাছুটি করুক, দেখবে জ্বর কমে যাবে।

রানু গম্ভীর হয়ে গেল। অপলা বলল কথা বলছি না কেন আপা? চুপ করে আছ কেন?

তুই সব সময় দুলাভাই দুলাভাই বলিস! সব জেনে-শুনেও কেন বলিস?

তাহলে কী বলব? টগরের বাবা? না ওসমান সাহেব?

রানু কিছু বলল না। নিঃশ্বাব্দে চায়ে চুমুক দিতে লাগল। অপলা বলল ঠিক আছে আর বলব না। কিন্তু তুমি তাকে আসতে বল। এক মাস ধরে আসছেন না।

আসতে না চাইলে আসবে না। ধরে নিয়ে আসতে হবে?

ঠিক তা-ও না। আপা। তুমিই আসতে নিষেধ করেছ।

নিষেধ করিনি। বলেছি, এত ঘন ঘন যেন না আসে। আমি জীবনটাকে বদলাতে চেষ্টা করছি। তুই কেন বুঝতে চেষ্টা করছিস না?

তোমার ধারণা উনি ঘন ঘন এলে জীবন বদলানো যাবে না?

এ নিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলতে চাই না।

রানু উঠে পড়ল। টগরের ঘুম ভেঙেছে। সে গম্ভীর মুখে রওনা হয়েছে। বাথরুমের দিকে।

বয়সের তুলনায় সে কি একটু বেশি গম্ভীর? রানু ডাকল দেখি টগর এদিকে আয় তো, জ্বর আছে কি না দেখি। টগর গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল।

এই তো জ্বর নেই। গুড বয়। যাও দাঁত মেজে আসা। নিজে নিজে মাজতে পারবে না?

পারব।

ভেরি গুড।

রানু শুনল–টগার, অপলার সঙ্গে কথা বলছে। ওর সঙ্গে তার বেশ ভাব। কথাবার্তা হচ্ছে বন্ধুর মত।

কেমন আছিস রে টগর?

ভাল।

তোর মার মত মুখটা এমন অন্ধকার করে আছিস কেন? কেমন করে হাসতে হয় মনে আছে?

আছে।

তাহলে বিরাট বড় একটা হাসি দে তো দেখি। বাহ বাহ চমৎকার। দেখি তোর নড়বগে দাঁতটার কী অবস্থা। কাছে আয়।

না।

না কেন?

তুমি ফেলে দেবে।

ফেলব না, হাত দিয়ে দেখব নড়ছে কি না। আয় কাছে আয়।

রানু, টগারের ছোট্ট একটি চীৎকার শুনল। তারপর আবার চুপ। অপলা বলছে–এইত ফেলে দিলাম, ব্যথা পেয়েছিস?

না।

তাহলে কাঁদছিস কেন? ব্যাটাছেলেদের এত কাঁদতে নেই, কাঁদবে মেয়েরা। তুই কী মেয়ে?

না।

যা, হাত-মুখ ধুয়ে আয়।

বাথরুমের কল দিয়ে পানি পড়ছে। টগর হাত-মুখ ধুচ্ছে নিশ্চয়ই। রানু অবাক হয়ে লক্ষ্য করল। দাঁত পড়ার মত একটা বড় ঘটনা সে তার মাকে বলতে এল না। যেন এটা বলার মত কিছু নয়। নাশতার টেবিলে খুব সহজভাবেই রানু জিজ্ঞেস করে–তোমার দাঁত পড়ে গেছে নাকি?

হ্যাঁ।

কই আমাকে তো কিছু বলনি। দেখি এখন তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে। বাহ সুন্দর লাগছে তো।

টগর ছোট্ট করে হাসল। রানু বলল আজ আমি বাইরে যাব। তুমি অপলার সঙ্গে থাকতে পারবে না?

পারব।

বিকেলে তোমার বাবা আসবেন তোমাকে দেখতে।

আজি কী বুধবার?

রানুর বুকে ছোট একটা ধাক্কা লাগল। টগর কী মনে মনে তার বাবার জন্যে অপেক্ষা করে? নয় তো বুধবার তার মনে থাকার কথা নয়।

হ্যাঁ, আজ বুধবার। নাও এই রুটিটা খাও।

আদেকটা খাই?

ঠিক আছে খাও।

বাবা যখন আসবে তুমি তখন থাকবে না?

থাকব। আমি পাঁচটার মধ্যে আসব।

রানু খানিক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–তুমি কী তোমার বাবার সঙ্গে ঐ বাড়িতে দু’একদিন থাকতে চাও?

টগর ঘাড় কাত করল। সে থাকতে চায়।

আমার জন্যে তোমার খারাপ লাগবে না?

টগর কিছু বলল না।

রাতে ঘুম ভাঙলেই কাঁদবে আম্মা কোথায়? আম্মা কোথায়? কাঁদবে না?

হ্যাঁ কাঁদব।

তাহলে যাবে কেন?

টগর জবাব দিল না! মায়ের দিকে সরাসরি তাকালও না।

রানু অনেকক্ষণ বসে থাকার পর তার ডাক পড়ল। সিদ্দিক সাহেব নিজে এসে ডেকে নিয়ে গেলেন। সহজ স্বরে বললেন–একটা বোর্ড মিটিং ছিল। তাই দেরি হল কিছু মনে করবেন না। আপনাকে চা-টা দিয়েছে তো?

হ্যাঁ দিয়েছে।

বসুন। এখানে। আরাম করে বসুন।

এই ঘরটি এয়ারকন্ডিশন্ড। হুঁম হুঁম একটা শব্দ হচ্ছে যন্ত্রটা হয়ত ভাল না। কিন্তু ঘর খুব সুন্দর করে সাজানো। অফিস মনে হয় না। মনে হয় অফিস নয় কারো ড্রয়িং রুম।

বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিল। কিন্তু কোনো কাগজ বা ফাইলপত্র নেই। টেবিলের মাঝখানে ধবধবে সাদা একটা ফুলদানি ভর্তি ফুল। ঘরের এক কোণায ছোট্ট একটা আলনা, সেখানে টাওয়েল ঝুলছে। অফিস ঘরে আলনা কেন কে জানে।

আপনি কেমন আছেন বলুন।

আমি ভালই আছি।

চা কফি কোনটাই খাব না।

সিদ্দিক সাহেব সিগারেট ধরিয়ে চিন্তিত মুখে টানতে লাগলেন। এখানে সম্ভবত কিছু হবে না। রানুর ধারণা ছিল হবে। গত সপ্তাহের কথাবার্তা এরকমই ছিল। সিদ্দিক সাহেব হাসিমুখে বলেছিলেন–পোস্ট না থাকলেও অনেক সময় পোস্ট তৈরি করা হয। আপনি আগে মন ঠিক করুন। রানু বলেছিল আমার মন ঠিক করাই আছে।

বেশ তাহলে আগামী সপ্তাহে আসুন। দশটার আগে আসতে পারবেন?

পারব।

সেদিন সিদিক সাহেবের যে হাসি-খুশি ভাব ছিল আজ তা নেই। গম্ভীর মুখে সিগারেট টানছেন। যেন কোনো একটি অস্বস্তিকর কথা বলতে দ্বিধা করছেন।

সিদ্দিক সাহেব একটি মুখবন্ধ খাম এগিয়ে দিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন। এখানে এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আছে। শর্তগুলি আপনার যদি পছন্দ হয়, তাহলে আপনি আগামী মাসের এক তারিখ থেকে জয়েন করতে পারেন।

কী পোস্ট, কী কাজ কিছুই তো বললেন না।

এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে সব বলা আছে। তিন মাস আপনি থাকবেন ট্ৰেইনি হিসাবে। বিভিন্ন সেকশনে যাবেন এবং কাজ শিখবেন। তিন মাস পর আমরা যদি মনে করি আপনার ট্রেনিং ভাল হয়নি তাহলে সেটি এক্সটেন্ড করে। ছ’মাস করা হবে। ট্রেনিং পিরিয়ড আপনার ভাতা হবে মূল বেতনের অর্ধেক। অন্য কোন ফেসিলিটিও থাকবে না।

খামটা এখানে খোলা উচিত হবে কি না রানু বুঝতে পারছে না। সিদ্দিক সাহেব বললেন আপনি কী কিছু বলবেন?

জি না। থ্যাংক ইউ।

এখন নিশ্চিয়ই বাড়ি যাবেন?

জি।

একটু বসুন।

রানু বসে রইল। সিদ্দিক সাহেব বেল টিপে বেয়ারাকে ডেকে বললেন ড্রাইভার সাহেবকে বল ইনাকে বাসায় পৌঁছে দিতে।

জুনিয়র অফিসার্স গ্রেড। বেতন সব মিলিয়ে দুহাজার টাকার মত। এই চাকরি নেয়াটা কী ঠিক হবে? ড্রাইভার বলল,

আপা কোন দিকে যাব?

আমি যাব নিউ পল্টন। নিউমার্কেটে নামিয়ে দিলেই হবে। কিছু কেনাকাটা করব।

রানু কথাটা বলেই একটু অস্বস্তি বোধ করল। নিউমার্কেটে কেনাকাটা করব এটা বলার দরকার ছিল না। সাফাই গাইবার কোনো ব্যাপার নয়।

ওসমান সাহেব রানুর বসার ঘরে একা একা বসেছিলেন। রানুকে ঢুকতে দেখে তিনি তাকালেন। রানুর হাতে এক গাদা জিনিসপত্র। দুহাতে সেগুলি ঠিক সামলানোও যাচ্ছিল না। ওসমান সাহেব সহজ স্বরে বললেন, অনেক কিছু কিনলে দেখি। রানু কিছু বলল না। জিনিসপত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

অপলা টগরের পাশে শুকনো মুখে বসে আছে। সে রানুকে দেখেই বলল-ওর তো বেশ জ্বর আপা। একশ দুইয়ের উপরে। তিন-চারবার বমি করেছে। রানু বলল–ও কখন এসেছে?

বেশিক্ষণ হয়নি। দশ-পনেরো মিনিট। আমি বলেছিলাম ভেতরে এসে বসতে। উনি আসেননি।

রানুটিগরের কপালে হাত দিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে জ্বর দেখল। শুকনো মুখে বলল–থার্মোমিটারটা আবার দে তো দেখি।

অপলা বলল, চল ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। দুলাভাই আছেন তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাব।

তাকে সঙ্গে করে নিতে হবে কেন?

অপলা চুপ করে গেল। থার্মোমিটার দেখল রানু বলল কত?

একশ এক। একটু কমেছে। জ্বর ছেড়ে যাবে বোধ হয়। ঘাম হচ্ছে।

রানু কিছু বলল না। অপলা বলল–তুমি বাইরের ঘরে গিয়ে বস। অনেকক্ষণ উনি একা বসে আছেন।

রানু মনে হল শুনতেই পেল না।

অপলা বলল–তুমি চা খাবে, চা দেব? পানি গরম আছে।

না, চা-টা কিছু খাব না।

রানু বসার ঘরে ঢুকল। ওসমান সাহেব বললেন, জ্বর কী খুব বেশি? বেশি হলে একজন ডাক্তার নিয়ে আসি। কাছেই আমার একজন চেনা ডাক্তার আছেন।

ডাক্তার আনতে হবে না। আমি নিয়ে যাব।

জ্বর কবে থেকে?

দু-তিন দিন থেকে।

আমাকে তো খবর দাওনি।

খবর দেওয়ার মত কিছু হয়নি। তাছাড়া আমার খবর দেবার লোক নেই। তুমি ভাল করেই জান।

তোমার খালার বাসায় টেলিফোন নাই?

আছে। তাদের টেলিফোন আমি আমার নিজের কাজের জন্য ব্যবহার করব কেন?

ওসমান সাহেব বিস্মিত হয়ে বলল–তোমার খালার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ভাল না নাকি?

সম্পর্ক খারাপ হবে কেন?

অপলা চা নিয়ে ঢুকল, লজ্জিত মুখে বলল, চা ছাড়া আর কিছুই নেই। শুধু চা দিলাম।

আর কিছু লাগবে না।

রানু বলল–অপলা তুই ঘরে যা আমি একটু কথা বলছি। অপলা বিব্রত ভঙ্গিতে ঘরে গেল। ওসমান সাহেব তাকালেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। রানু বলল আমি একটি চাকরি পেয়েছি। কাজেই তুমি মাসে যে টাকাটা দিতে সেটা আর দিতে হবে না।

চাকরিটা কী?

সেটা দিয়ে তোমার তো কোন দরকার নেই। তোমার স্ত্রী হিসাবে আমি যদি নিচু ধরনের কাজ করতাম তাহলে হয়ত তোমার অহংকারে লাগত। এখন তো অহংকারে লাগার কোনো প্রশ্ন নেই।

তুমি ভুল করছি রানু আমি অহংকারী না।

বাজে কথা বলবে না।

তিনি চুপ করে গেলেন। রানু থমথমে গলায় বলল, কেন তুমি আমাকে তোমার বাবার কাছে এ রকম একটা কায়দা করে পাঠালে?

কী কায়দা?

মিলি এসে বলল উনি খুব অসুস্থ। মৃত্যুশয্যায়। আমাকে এবং টগরকে দেখতে চান। আমি ঠিক সেই দিনই গেলাম দেখা করতে। গিয়ে দেখি দিব্যি সুস্থ মানুষ। বাগানে ফুলগাছ লাগাচ্ছেন। আমার সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলতে লাগলেন যেন আমাকে চেনেন না। এই প্রথম দেখলেন। টগর ফুল গাছে হাত দিয়েছিল বলে ধমক দিলেন। বিশ্ৰী গলায় ধমক।

উনি বুড়ো মানুষ। তুমি নিজেও জানো তার মাথা পুরোপুরি ঠিক না। তা ছাড়া যা ঘটেছে আমাকে বাদ দিয়েই ঘটেছে। মিলি প্রচুর মিথ্যা কথা বলে। তুমি তো মিলির স্বভাবও জানো। জানো না?

না। আমি তোমাদের কারোরই স্বভাব জানি না। তোমার নিজের স্বভাব বুঝতে আমার ছবছর লেগেছে।

বুঝতে পারলে কিছু?

হ্যাঁ, তোমারটা বুঝেছি।

ভাল। বুঝতে পারাই উচিত। তুমি বুদ্ধিমতি মেয়ে।

ওসমান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন আজ যাই। রানু তীক্ষু কণ্ঠে বলল খুব তাড়া মনে হয, কোথায় যাচ্ছ, মনিকার কাছে?

হ্যাঁ, ওর কাছে যাব একবার।

সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হবে? আজকেব। আলোচনার বিষযবস্তু কী? সতীনাথ ভাদুড়ি না মানিক বাবু?

তিনি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আজ তুমি নানা কারণে উত্তেজিত। কাজেই বেশিক্ষণ থাকতে চাই না।

মনিকা কখনো উত্তেজিত হয় না, তাই না?

হবে না কেন, সেও হয়। আমরা সবাই নানা কারণে উত্তেজিত হই।

ওসমান সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন রানু তার সঙ্গে সিঁড়ি পর্যন্ত এসেছে। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, টগারকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। রানু তার জবাব দিল না।

টগরের ঘুম ভাঙািল ছাঁটার দিকে। ভাল মানুষের মত কাঁপে করে মালটোভা খেল। তবে কিছুক্ষণ পরই ঘর ভাসিয়ে বমি করল। অপলা বলল খারাপ লাগছে নাকি টগর?

না!

চল আমরা ডাক্তারের কাছে যাব। আয় শার্টটা বদলে দেই। তার আগে চল মুখ ধুইযে দি।

টগর বাধ্য ছেলের মত অপলার সঙ্গে সঙ্গে গেল। বাথরুমে ঢুকেই গলাব স্বর নিচু করে বলল, আজ কী বুধবার খালামণি?

হ্যাঁ, কেন?

টগর, আর কোন কথা না বলে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে আয়নায় তার দাঁত দেখতে লাগল। উপবেব পাটির একটি দাঁত নেই। কেমন অচেনা দেখাচ্ছে তাকে। আঁপিলা বলল, দাঁত তোলার সময ব্যথা লেগেছিল? টগর তার জবাব না দিয়ে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করল আজ কি বার খালামণি? বুধবার?

মনিকার ওখানে যাবার কোন ইচ্ছা ওসমান সাহেবের ছিল না। তবু ওদিকেই রওনা হলেন। ঘরে ফিরে কিছু করবার নেই। ফিরতেও ইচ্ছা করছে না।

মনিকাদের বাড়ির সামনে নবীর লাল গাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় যেন পড়েছিলেন অন্ধকার বস্তুর কোন রঙ থাকে না। সব হয়ে যায় ধূসর বর্ণ। কিন্তু তিনি অন্ধকারেও গাড়ির লাল রঙ দেখতে পেলেন। কিংবা হয়ত এই গাঢ় লাল রঙ তার স্মৃতিতে ছিল। এখন যা দেখছেন তার কিছুটা আসছে স্মৃতি থেকে, কিছুটা সত্যি সত্যি দেখছেন।

গাড়ি গেটের বাইরে কেন? ওসমান সাহেব একধরনের অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। চিত্রটি ঠিক মিলছে না। নবী তার গাড়ি গেটের বাইরে রেখে মনিকার সঙ্গে দেখা করতে আসবে না। এই জিনিস ওর চরিত্রে নেই। বুড়ো দারোয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম করল। ওসমান সাহেব বললেন, রহমত ভাল আছ? রহমতের মাথা অনেকখানি নিচু হয়ে গেল।

মেম সাহেব আছেন?

জি আছেন।

তোমার শরীর এখন সেরেছে তো?

জি স্যার।

ব্যথা হয় না আর?

আগের মত হয় না।

রহমত তাঁর সঙ্গে হেঁটে বাড়ির সিঁড়ি পর্যন্ত এল। এই লোকটিও তাঁকে খুবই পছন্দ করে। কেন করে কে জানে। ওসমান সাহেব এসব ছোটখাটো ব্যাপার লক্ষ্য করেন। আজও লক্ষ্য করলেন রহমত এগিয়ে গিয়ে অসহিষ্ণুভাবে পর পর তিন বার কলিং বেল টিপল। তিনি ভাল জানেন ফেরার সময়ও সে হেঁটে হেঁটে তাঁর সঙ্গে বড় রাস্তা পর্যন্ত যাবে। কথাবার্তা বিশেষ কিছু বলবে না।

মানুষের ভালবাসা কখনো নিঃস্বাৰ্থ নয়। রহমতের ভালবাসা কী নিঃস্বাৰ্থ? তিনি কখনো এ ব্যাপারটি নিয়ে গভীরভাবে ভাবেননি। ভাবতে হবে।

মনিকা দরজা খুলে ছোট করে হাসল। যেন সে তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। মনিকার গায়ে হালকা নীল রঙের সুতির শাড়ি। গলায় লাল একটা মাফলার। আবার ঠাণ্ডা লেগেছে বোধ হয়। মনিকার ঘন ঘন ঠাণ্ডা লাগে।

ভাল আছি মনিকা?

ভালই ছিলাম। ঘণ্টাখানেক আগে থেকে আর ভাল নেই। নবী এসেছে বড্ড পাগলামী করছে। তিনি কিছুই বললেন না। মনিকা বলল আজি আমি ওকে স্ট্রেইট বলেছি আমার বাড়িতে আর আসবে না।

সে তো আগেও বলেছে।

আজ যেভাবে বলেছি সেভাবে আগে কখনো বলিনি। আজ সত্যি সত্যি বিরক্ত হয়েছি।

ওসমান সাহেব বসার ঘরে কাউকে দেখলেন না। একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করবেন নবী কোথায়? তাও করলেন না। মনিকা গভীর গলায় বলল তুমি খানিকক্ষণ একা একা বস। আমি চুল বেঁধে আসি।

তিনি প্রায় দুমাস পর এলেন। মনিকা একবারও জিজ্ঞেস করল না, এতদিন আসা হয়নি কেন? মনিকার কিছু বিচিত্র ব্যাপার আছে।

এই বসার ঘরটিতে ওসমান সাহেব ঠিক সহজ বোধ করেন না। সব কিছু বড় বেশি গোছানো। কাঁপেটের রঙ টকটকে লাল। এই রঙ রক্তের কথা মনে করিযে দেয়। রক্তের ওপর পা রাখতে তার ভাল লাগে না।

ওসমান সাহেব সিগারেট ধরাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজের মেয়েটি ট্রেতে করে এক গ্লাস পানি রেখে গেল। রুপোর গ্লাস। খুবই ঠাণ্ডা পানি। গ্লাসের চারদিকে বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে যা দেখা মাত্র তৃষ্ণা পায়। ওসমান সাহেব তৃষ্ণার্তের মত পানি খেলেন। কাজের মেয়েটি বলল, আর এক গ্ৰাস পানি আনি?

না, আর লাগবে না।

চা আনব?

চা আনতে হবে না।

ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন মেয়েটি হাসি চাপতে চেষ্টা করছে। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটির মুখে হাসি দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল। শঙ্কার ছাপ পড়ল। সে গ্লাস নিয়ে দ্রুত সরে পড়ল।

প্রথম যেদিন এ বাড়িতে এসেছিলেন সেদিন ওসমান সাহেব সোফায় বসে পানি খেতে চেয়েছিলেন।

দ্বিতীয়বারেও তাই। এরপর থেকে আর চাইতে হয় না। পানি আসে। তিনি ঘড়ি দেখলেন সাড়ে নটা। আর মনে হচ্ছিল রাত অনেক। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। কোন কোন বাড়িতে পা দেয়া মাত্র মনে হয় ঘড়ির কাটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

মনিকা আসতে খুব দেরি করছে। তিনি বসে আছেন একা একা। এটি নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নয়। মনিকার ব্যবহারে কোথায় যেন একটি অবহেলার ভাব আছে। প্রথম যখন এ বাড়িতে এলেন সেদিনই ব্যাপারটা চোখে পড়েছিল। যদিও সেদিন মনিকা এগিয়ে এসে সবাইকে হতচকিত করে পা ছুঁয়ে সালাম করল। নবী ছিল সঙ্গে। সে অবাক হয়ে বলল, একি কাণ্ড, সে কী রবি ঠাকুর নাকি? আমি তো জানি একমাত্র রবি ঠাকুরকেই লোকজন পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে। মনিকা বলেছিল, আমি স্কুলে পড়ার সময় ভেবে রেখেছিলাম। যদি কোনোদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। আমি সালাম করব। ওসমান সাহেব অত্যন্ত বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। মনিকা সহজ স্বরে বলল, ক্লাস টেনে যখন পড়ি ঠিক করলাম। যদি উনি অবিবাহিত হন তাহলে তাকে গিয়ে বলব।–আমাকে বিয়ে করুন। নবী ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগল। ওসমান সাহেবের মনে হল হাসি স্বতঃস্ফূর্ত নয়। কষ্ট করে হাসা। নবীকে তিনি কখনো এভাবে হাসতে দেখেননি।

সে রাতে মনিকার সঙ্গে গল্প উপন্যাস নিয়ে কোনোই আলাপ হয়নি। মনিকার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল তার সমস্ত উৎসাহ মিইয়ে গেছে। সে পাকা আমের আচার বানানোর কী একটি পদ্ধতি নিয়ে গল্প করতে শুরু করল। এবং এক সময় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা হচ্ছে কিছু মনে করবেন না, আমি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। ওসমান সাহেব অপমানিত বোধ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও আবার একদিন এলেন নবীর সঙ্গে। সেদিনই মনিকার এ রকম আলগা আলগা ভাব। তার পরেও তিনি এলেন। কেন এলেন? কেন বারবার আসেন?

ওসমান সাহেব দ্বিতীয় সিগারেটটি ধারাবারও অনেক্ষণ পর মনিকা এল অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম? কাজের মেয়েটি চুল টেনে দিচ্ছিল, আরাম লাগছিল খুব। তোমায় পানি দিয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

আরও লাগবে?

না, লাগবে না। নবী কোথায়?

গেস্ট রুমে ঘুমুচ্ছে। বমি-টমি করে বিশ্ৰী কাণ্ড। যে জিনিস সহ্য হয় না। সে জিনিস কেন খায়?

মনিকা বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকাল। ওসমান সাহেব বললেন, তোমার হ্যাসবেন্ডের কোন খবর পেয়েছে?

না।

তিনি আছেন কেমন?

আগের মতই আছে। লাংসটলারেন্স, ই সি জি সব কিছুই হয়েছে। শরীরে কোনো অসুখ নেই। ডাক্তাররা বলছেন সাইকে সিমেটিক। মনের রোগ। কিন্তু সে সেটা বিশ্বাস করছে না। আরও বড় ডাক্তার দেখাতে চায়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ মানসিক রোগীদের এই প্রবলেম। তারা কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না রোগটা মনে, শরীরে নয়। তুমি চা খাবে?

না।

খাও এক কাপ। সিলোনিজ টি। খুব চমৎকার ফ্লেভার।

তিনি হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। মনিকা কাজের মেয়েটিকে চায়ের কথা বলে তার সামনে এসে বসল। তার বসে থাকার ভঙ্গিতে কোন আড়ষ্টতা নেই। সে কোনো কথা বলছে না। কথা না বলে কোনো মেয়ে চুপচাপ বসে থাকলেও সমস্ত পরিবেশ আড়ষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু মনিকার বেলায় হয় না। কাজের মেয়েটি বলল–

উনার ঘুম ভাঙছে। আপনারে ডাকে। মনিকা কঠিন স্বরে বলল, তাকে এ ঘরে আসতে বল। বল তার বন্ধু এসেছে–ওসমান সাহেব।

নবী লম্বায় প্রায় ছফুট। গায়ের রঙ শ্যামলা। মেয়েলী ধরনের মুখ। চেহারায় কাঠিন্য আনবার জন্যে সে নানান সময় নানান কায়দা-কানুন করেছে। একবার জুলফি রেখেছে, একবার গোঁফ রেখেছে। কিছুদিন ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়িও ছিল। লাভ হয়নি। কোনো এক বিচিত্র কারণে তার চেহারা থেকে ছেলেমানুষি দূর হয়নি।

যৌবনে দুর্দান্ত কিছু কবিতা লিখেছিলেন। হঠাৎ এক রাতে ঠিক করল কবিতা মেয়েদের ভাষা, কবিতায় কাঠিন্য নেই। প্রতীক, উপমা এইসব ছেলেমানুষি ব্যাপার। কাজেই সে চলে এল গদ্যে। লিখল দুপুর নামের উপমা ও প্রতীক বিবর্জিত উপন্যাস। প্রচুর লেখালেখি হল দুপুর নিয়ে। সমালোচকদের কেউ কেউ উল্লেসিত হলেন। কেউ কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কোন বিদেশী ঔপন্যাসিকের ছাপ পড়েছে সেটা বের করবার জন্যে। কবিখ্যাতি তেমন না জুটলেও কথা-শিল্পীর স্বীকৃতি পাওয়া গেল। পুরোপুরি সাহিত্যে নিবেদিত না হলে কিছু লেখা যাবে না। এই ভেবে নবী চাকরি ছেড়ে দিল। পরবর্তী তিন বছর একটি লাইনও লিখল না। ইদানীং সে বলছে নাটক হচ্ছে সাহিত্যের সবচেয়ে পরিশীলিত রূপ। যে কোন এক শুভদিনে নাটক লেখা শুরু হবে এই ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে গত ছ’মাস ধরে। এখনও কিছু লেখা হয়নি। শুভ দিন এখনো আসেনি। নবী ঘরে ঢুকল অপ্রসন্ন মুখে, মনিকার আজকের ব্যবহারে সে খুবই বিরক্ত হয়েছে। মনিকা বলেছিল–তুমি হুঁট করে ভিতরের ঘরে ঢুকবে না। এটা ভাল দেখায় না। এ কেমন কথা মনিকা তার ফুফাতো বোন এ-বাড়িতে সে আসছে ছেলেবেলা থেকে। মনিকার স্বামী তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। নবী অবাক হয়ে বলল, তুমি চাও না। আমি এ বাড়িতে আসি?

আসতে ইচ্ছা হলে আসবে। তবে হুঁট করে শোবার ঘরে ঢুকবে না। এবং মাতাল অবস্থায় আসবে না।

নবী অবাক হয়ে বলল। মাতাল বলছি কাকে? মাতাল কাকে বলে জানো?

মনিকা ঠাণ্ডা, গলায় বলল, মাতালের ডেফিনেশন নিয়ে তোমার সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। তবে মাতাল আমার চেয়ে ভাল কেউ চেনে না। তোমার চাউনি দেখেই বুঝতে পারছি তুমি এক্ষুণি বমি করবে।

বমি করব?

হ্যাঁ।

তোমার ধারণা বমি করব?

একমাত্র মাতালরাই প্রতিটি কথা দুবার করে বলে। তুমি দযা করে বাথরুমে যাও।

আমি আরো দশ পেগ খেতে পারি, তা জানো?

খেতে পাবলে তো ভালই।

মনিকা তীক্ষা কণ্ঠে হেসে উঠল। এবং আশ্চৰ্য, নবীকে কিছুক্ষণেব মধ্যে সত্যি সত্যি বাথরুমে ছুটে যেতে হল। মনিকা মাতাল চেনে।

ওসমান সাহেব নবীর দিকে তাকালেন। নবী সে চাউনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মনিকাকে বলল, ক্ষিধে লেগেছে। কিছু খাব?

কিছুক্ষণের মধ্যেই টেবিলে ডিনার দেযা হবে। এখন একটু ভাল লাগছে?

নবী তার জবাব না দিয়ে ওসমান সাহেবেব পাশে গম্ভীর মুখে বসল। ওসমান সাহেব বললেন কেমন আছেন?

ভাল।

নাটকের কাজ কেমন এগুচ্ছে?

ধরিনি এখনো। আমি তো আপনার মত না যে এক সপ্তাহে দু’টা উপন্যাস নামিয়ে দেব। আমি কম লিখিব; কিন্তু যা লিখব ভাল লিখব।

মনিকা হালকা গলায় বলল তোমার ধারণা উনি ভাল লিখছেন না?

পাঠযোগ্য লেখা মানেই ভাল লেখা না। ডিটেকটিভ উপন্যাসও তরতর করে পড়া যায়।

তুমি এটা বলছ ঈর্ষা থেকে।

ঈর্ষা? কিসের ঈর্ষা? আমি ঈর্ষা করি মানিক বাবুকে, ওসমান সাহেবকে ঈর্ষা করব কেন? তা ছাড়া ঈর্ষা একটি মেয়েলি ব্যাপার। পুরুষ মানুষদের ঈর্ষা থাকে না।

ওসমান সাহেব ঘড়ি দেখে বললেন আমি আজ উঠি। নবীর মুখ গম্ভীর। মনিকা খানিকটা অপ্রস্তুত বোধ করছে। সে কিছু বলল না। নবী বলল, আমিও উঠব। মনিকা বলল, ক্ষিধে লেগেছে বলেছিলে।

এখন ক্ষিধে নাই।

ভাত খেয়ে বিশ্রাম নাও। ড্রাইভার তোমাকে পৌঁছে দেবে। তুমি নিজে নিজে ড্রাইভ করে যেতে পারবে না।

আমি ঠিকই পারব। তুমি সব ব্যাপারে আমাকে আন্ডারএস্টিমেট কর।

সব ব্যাপারে করি না। কিছু কিছু ব্যাপারে করি।

নবীর মুখ আরও গভীর হল। সে ওসমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল–আমার ওপর যদি ভরসা থাকে তাহলে আমি আপনাকে একটা লিফট দিতে পারি। মাতালের গাড়িতে চড়বেন?

ওসমান সাহেব হাসলেন। তিনি রাজি আছেন।

নেশাগ্রস্ত ড্রাইভারদের প্রবণতা হচ্ছে স্পিড বাড়ানো। সবাইকে দেখানো যে ঠিক আছে। গাড়ি চালানোর কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু নবীর গাড়ি চলছে খুব ধীরে। সে বড় রাস্তায় না উঠা পর্যন্ত কোনো কথা বলল না। তাকে দেখে মনে হল সে খুবই চিন্তিত। ওসমান সাহেব বসে আছেন। চুপচাপ। একবার শুধু বললেন, আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার দরকার নেই। রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিলেই চলবে। নবী তার জবাব না দিয়ে হঠাৎ গাড়ির গতি অনেকখানি বাড়িয়ে দিল।

নবীকে তিনি পছন্দ করেন? এই প্রশ্নটি অনেকবার নিজেকে করেছেন। কখনো ঠিক জবাব পাননি। আজও পেলেন না। ওসমান সাহেব দুপুর উপন্যাসটি পড়েছেন। এটি একটি প্রথম শ্রেণীর রচনা। এক মসজিদের পেশ ইমাম–জেনাব আলী, এক দুপুরে ঠিক করল একটি খুন করবে। সে সিন্দুকের ভেতর থেকে গরু কোরবানীর প্রকাণ্ড ছুরিটি বের করে ধার দিতে বসল। কাকে সে খুন করবে। উপন্যাসের কোথাও তা বলা হল না।

নানান চরিত্রকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল একে একে এবং মনে হল এদের সবাইকে খুন করা যেতে পারে। যে লোক এমন একটি জটিল বিষয়কে এত চমৎকার ভঙ্গিতে উপস্থিত করতে পারে তাকে পছন্দ করতেই হয়। ওসমান সাহেব হঠাৎ করে বললেন–নবী সাহেব, আপনি কী আমার কোনো লেখা পড়েছেন?

সেন্টিমেন্টাল লেখা আমি পড়ি না। আপনার একটা লেখা পড়তে চেষ্টা করেছিলাম, মেয়েলি জিনিসে এমন ঠাসা যে গা ঘিন ঘিন করে। মেয়েদের গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়।

মেয়েদের গায়ের গন্ধ খুব কী খারাপ?

না খারাপ না ভাল। কিন্তু উপন্যাসে উঠে এলেই খারাপ। আধুনিক কালের সাহিত্যে সেন্টিমেন্টের কোনো ব্যবহার থাকা উচিত নয়। একালের লেখা হবে জার্নালিস্টিক।

ওসমান সাহেব তর্কে গেলেন না। নবী বলল, আপনি রাগ করলেন নাকি?

না।

আমি যা বললাম তা কি স্বীকার করেন?

পুরোপুরি না করলেও কিছু করি।

আপনার জীবদ্দশাতেই যখন আপনার লেখা কেউ পড়তে চাইবে না, তখন পুরোপুরি স্বীকার করবেন।

নবী গাড়ি বাড়ির সামনে এনে রাখল। ওসমান সাহেব বললেন–নামবেন? ক্ষিধের কথা বলেছিলেন। আমার সঙ্গে খেতে পারেন। নবী থেমে থেমে বলল–আমি আপনার এখানে খাব না! আমি এখন আবার মনিকার ওখানে যাব।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আমি বের হয়ে এসেছি আপনাকে বের করে আনার জন্যে।

ওসমান সাহেব তাকিয়ে রইলেন। নবী বলল–ওকে আজ আমি একটা কথা বলব। সুস্থ অবস্থায় কথাটা বলার চেষ্টা করেছি। বলতে পারিনি। সে জন্যেই পাঁচ পেগ হুঁইস্কি খেয়ে গিয়েছিলাম। বুঝতে পারছেন?

পারছি।

জানতে চান?

না, আমি জানতে চাই না।

জানতে না চাইলেও আমি আপনাকে শুনাতে চাই। লিসন কেয়ারফুলি। আমি মনিকাকে বিয়ে করতে চাই। এই কথাটি আজ তাকে বলব। তার হ্যাসবেন্ড থাকুক না থাকুক তাতে কিছু আসে যায় না। বুঝতে পারছেন?

বুঝতে চেষ্টা করছি।

আপনার ধারণা মদের ঝোঁকে এসব বলছি?

বলতেও পারেন। অনেকে বলে। এ নিয়ে আমি ভাবছি না।

নবী হিসহিস করে বলল–

আমি ষাট মাইল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে যাব এবং মরব না। এতেই প্রমাণ হবে। আমি মাতাল নই। কি বলেন?

সে একসিলেটারে চাপ দিল। গাড়ি লাফিয়ে উঠল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ