মনিশংকর তাঁর পুত্ৰকে বান্ধবপুরে নিয়ে এসেছেন। তাঁর দোতলা বাড়ির বারান্দায় খাটের উপর পাটি পেতে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ছেলের পায়ের কাছে মনিশংকর মাথা নিচু করে বসে আছেন। ছেলের যন্ত্রণা তিনি সহ্য করতে পারছেন না, আবার উঠে চলেও যেতে পারছেন না। ছেলের মা ঠাকুরঘরে ঢুকেছেন। সেখানে পূজা চলছে। পূজার জন্যে দু’জন ব্রাহ্মণ এসেছেন কোলকাতা থেকে।

উঠানে নাম সংকীর্তন হচ্ছে। অনেক লোকজন ভিড় করেছে। দুর্গাপূজার মতো জমজমাট অবস্থা। গভীর বিষাদেও এক ধরনের উৎসবের ছোয়া থাকে।

শিবশংকরের বয়স মাত্র নয়। তীব্র ব্যথা সে নিতে পারছে না। ব্যথার একেকটা ধাক্কা আসে, ছেলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে— বাবা, ব্যথা কমায়া দাও। বাবা, ব্যথা কমায়া দাও। অসহায় বাবা হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।

খবর পেয়ে হরিচরণ এসেছেন। তাঁকে দেখে মনিশংকর ফুঁপিয়ে উঠে বললেন, আমাকে বিষ। এনে দেন। আমি বিষ খেয়ে মরে যাই। ছেলের যন্ত্রণা নিতে পারছি না।

হরিচরণ খাটের পাশে এসে দাঁড়ালেন। শিবশংকর বলল, হরিকাকু, ব্যথা! दgशों!

হরিচরণ বললেন, বাবা, কোথায় ব্যথা?

শিবশংকর তার পেটের দিকে ইশারা করল। হরিচরণ হাঁটু গেড়ে ছেলের পাশে বসলেন। তার পেটে হাত রেখে চোখ বন্ধ করলেন। মনে মনে ডাকলেন, হে পরম পিতা। হে দয়াময়। তোমার সৃষ্ট এই ক্ষুদ্রপ্রাণের প্রতি তুমি দয়া কর। হরিচরণ অতি দ্রুত প্রার্থনার গভীরে পৌঁছে গেলেন। তিনি কোথায় আছেন, কী করছেন কিছুই তাঁর মনে রইল না। তাঁর শুধুই মনে হলো, তিনি কোনো এক অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন। গৃহ মন্দিরের পূজার ঘন্টার শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসছে। লোকজনের চলাচল, কথাবাতাঁর কোনো শব্দই তার কানে আসছে না। তিনি গভীর বিশ্বাস থেকে বলে যাচ্ছেন- দয়া কর দয়াময়। দয়া করা। দয়া কর। হরিচরণের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। একসময় হঠাৎ তার কাছে মনে হলো, তিনি সাঁতরাতে শুরু করেছেন। কুল কিনারা নেই এমন কোনো দিঘি। যার জল স্বচ্ছ ও শীতল। একটি শিশু ড়ুবে যাচ্ছে। তাকে ধরতে হবে। এই তাকে আবছা দেখা যাচ্ছে, এই দেখা যাচ্ছে না। অনেক দিন আগে এরকম ঘটনা ঘটেছিল। তাঁর শরীর অবসন্ন। তিনি দম পাচ্ছেন না। জলের শীতলতায় তাঁর শরীর জমে যাচ্ছে। তিনি হাত-পা নাড়তে পারছেন না।

উঠান থেকে অনেকটা দূরে বাবলা গাছের নিচে শশী মাস্টার এবং মফিজ দাড়িয়ে। দু’জনের দৃষ্টি হরিচরণের দিকে। দোতলার রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে হরিচরণের মুখ দেখা যাচ্ছে। হরিচরণ সামান্য দুলছেন। শশী মাস্টার বললেন, দৃশ্যটার মধ্যে অলৌকিক কিছু আছে। যদিও আমি জানি অলৌকিকত্ব বলে কিছু নেই। প্রার্থনায় কিছু হয় না। প্রার্থনায় কিছু হলে পৃথিবীর মানুষ সব ফেলে প্রার্থনাই করে যেত।

মফিজ বললেন, প্রার্থনায় কিছু হয় না, তারপরেও আমরা কিন্তু প্রতিনিয়তই প্রার্থনা করি।

শশী মাস্টার বললেন, হরিবাবুর এই প্রার্থনা কতক্ষণ চলবে বলে তোর মনে হয়?

মফিজ বললেন, বুঝতে পারছি না। আমার ধারণা উনি Trance State-এ চলে গেছেন। Trance ভাঙতে সময় লাগবে।

শশী মাস্টার বললেন, যতক্ষণই লাগুক আমি অপেক্ষা করব।

হরিচরণ এসেছিলেন দুপুরের আগে আগে- সন্ধ্যা হয়ে গেল। মনিশংকরের বাড়িতে সন্ধ্যা প্ৰদীপ জ্বালানো হলো। পূজার ঘণ্টা এবং শাখ বাজতে লাগল। হরিচরণ ছেলের গা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। শিবশংকর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা জল খাব।

মনিশংকর কাসার গ্লাসে করে পানি নিয়ে এলেন। চামচ, আনলেন, চামচে করে খাওয়ানোর জন্যে। শিবশংকর বলল, বাবা আমাকে উঠারে বসাও, আমি হাত দিয়ে গ্রাস ধরে চুমুক দিয়ে জল খাব। আমার ব্যথা নাই।

মনিশংকর হতভম্ব গলায় বললেন, ব্যথা নাই? সত্যি ব্যথা নাই?

ছেলে না-সূচক মাথা নাড়ল।

মনিশংকর এই আনন্দ নিতে পারলেন না, অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। [মনিশংকরের পুত্র শিবশংকর পরিণত বয়সে যক্ষায় মারা যান। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলার এবং পরে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংলার।]

 

হরিচরণ বারান্দার বেতের চেয়ারে শুয়ে আছেন। তিনি ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত। তার চোখ বন্ধ। তিনি বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছেন। কিছুক্ষণ আগেও তীব্র মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল, এখন নেই। রাত অনেক হয়েছে। দ্বিতীয় প্রহরের শেয়াল ডাকাডাকি শুরু করেছে। হরিচরণের সামনে কাঠের চেয়ারে কাসার জগভর্তি পানি এবং গ্লাস। তিনি কিছুক্ষণ পরপরই পানির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। তাঁর পেছনে শশী মাস্টার বসে আছেন। মফিজ আছেন মনিশংকরের বাড়িতে।

শশী মাস্টার বললেন, এখন কি একটু ভালো বোধ করছেন? হরিচরণ বললেন, না।

মাথার যন্ত্রণা কমে নাই?

মাথার যন্ত্রণা কমেছে, বুকে চাপ ব্যথা।

পালংকে শুয়ে থাকবেন?

না।

শশী মাস্টার বললেন, যদি অনুমতি দেন তাহলে আপনার সঙ্গে রাতটা কাটাই।

হরিচরণ বললেন, আমি বারান্দাতেই বসে থাকব।

শশী মাস্টার বললেন, আমিও থাকব। অলৌকিক কোনো কিছুতে আমার বিশ্বাস নাই, কিন্তু আজকের ঘটনাটা নিতে পারছি না।

হরিচরণ বললেন, আমিও না। তবে প্রবল ঘোরের মধ্যে আমার বিশেষ এক ধরনের উপলব্ধি হয়েছে। হয়তো পুরোটাই ভ্ৰান্তি, মনের ভুল। জগৎ সৃষ্টি রহস্য, পরকাল- এইসব নিয়ে খুব চিন্তা করি বলেই হয়তো দেখেছি।

কী দেখেছেন?

আজ থাক। আরেকদিন বলব।

আচ্ছা।

অভিজ্ঞতা বলে বোঝাতে পারব সেরকমও মনে হচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটা অস্পষ্ট।

অস্পষ্ট?

হরিচরণ বললেন, অস্পষ্ট বলাটাও ঠিক না, খুব স্পষ্ট; তবে সেই স্পষ্টতার ধরন ভিন্ন।

কথাটা বুঝতে পারলাম না।

হরিচরণ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। সমস্ত বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডকে আমার কাছে হঠাৎ মাকড়সার জালের মতো মনে হলো। কেউ আলাদা না, সবাই যুক্ত এবং প্রত্যেকেরই প্ৰাণ আছে। ইট, কাঠ, বালুকণাসবই জীবন্ত। আরেকটা উপলব্ধি হয়েছে…

আপনি ক্লান্ত। বিশ্রাম করুন। আরেকদিন শুনব। তবে আজ না বললে আপনি আর কোনোদিন কথা বলতে পারবেন না।

হরিচরণ বললেন, কেন বলতে পারব না?

শশী মাস্টার বললেন, আমি যতদূর অনুমান করছি আপনার অভিজ্ঞতা স্বপ্নের মতো। স্বপ্নের স্মৃতি অতি অল্প সময়ের স্মৃতি। আপনি ভুলে যাবেন।

হরিচরণ গ্লাসে পানি ঢেলে চুমুক দিলেন। চেয়ারে শরীর এলিয়ে চোখ বন্ধ করলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। ঘুমের মধ্যে তিনি একটা সুখ স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নের মধ্যেও তিনি একই জায়গায় ঘুমুচ্ছেন, শিউলির মা রাণীবালা এসে তার ঘুম ভাঙালেন। তিনি উঠে বসতে বসতে বললেন, বউ কোনো সমস্যা?

রাণীবালা বললেন, আপনার কন্যার বিবাহ, আর আপনি এখানে শুয়ে আছেন!

শিউলির বিবাহ?

হুঁ। কিছুক্ষণের মধ্যে কন্যা সম্প্রদান হবে। নিন। গরদের চাদরটা গায়ে দিন।

তিনি অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে চাদর গায়ে দিতেই দৃশ্য বদলে গেল। তিনি দেখলেন বিয়ের আসরে পুরুতের পাশে তিনি দাঁড়িয়ে। তার সামনেই তাঁর বাবা প্রিয়নাথ। হরিচরণ বিস্মিত হয়ে বললেন, বাবা তুমি এসেছ!

প্রিয়নাথ বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি আসব না। কীভাবে ভাবলি? তুই ছোটবেলায় যেরকম গর্ধব ছিলি এখনো তো গর্ধবই আছিস। উন্নতি কিছুই তো হয় নাই।

বাবা, মা কি এসেছে?

তাকে ছাড়া আমি আসব। এটা ভাবলি কীভাবে? সবাইকে নিয়ে এসেছি। কেউ বাদ নাই। শুধু আমার মেজদা আসেন নি।

উনি আসেন নি কেন?

মেজদা সন্ন্যাস নিয়ে কোথায় যে চলে গেল। অনেক সন্ধান করেও খোঁজ পাই নি।

হরিচরণ অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকালেন। বাড়ি গমগম করছে। মৃতজীবিত সবাই উপস্থিত। প্রিয়নাথ ধমক দিলেন, হা করে দেখছিস কী? সবাইকে প্ৰণাম কর। কেউ যেন বাদ না থাকে। নারায়ণ। নারায়ণ।

হরিচরণের স্বপ্নভঙ হলো ‘নারায়ণ নারায়ণ’ শব্দে। খাটে শুয়ে আছেন। ঘুমের মধ্যেই কেউ তাঁকে ধরাধরি করে খাটে শুইয়ে দিয়েছে।

 

এশার নামাজ শেষ করে মাওলানা ইদরিস মনিশংকর বাবুর ছেলের খোঁজ নিতে।{क्लনা।

ছেলে ভালো আছে। আরাম করে ঘুমাচ্ছে। সারাদিন কিছু খায় নি। ঘুমানোর আগে এক বাটি দুধ খেয়েছে। মাওলানা বললেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।

মনিশংকর এখনো স্বাভাবিক হতে পারেন নি। কিছুক্ষণ পর পর ছটফট করে উঠেন, এদিক ওদিক তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, আমি নিশ্চয়ই কোনো না কোনো দিন এক পুণ্য করেছিলাম। সেই মহাপুণ্যটা কী? তোমরা কেউ আমাকে বলবে কী সেই মহাপুণ্য?

মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকেই এসেছেন। তারা উঠোনের এক কোনায় গোল হয়ে বসা। তাদের মধ্যমণি সুলেমান, এক সন্ধ্যায়। সে হরিচরণের বাড়ির দিঘির ঘাটে কী দেখেছিল। সেই গল্প নিচু গলায় বলছে। চোখ বড় বড় করে সবাই শুনছে। শ্রোতাদের মধ্যে কাউকেই শূন্যে ভাসার বিষয়টির অস্বাভাবিকতা স্পর্শ করছে না। মোহাম্মদ মফিজ বললেন, আপনি নিজে দেখেছেন?

সুলেমান বলল, অবশ্যই। আমি যদি মিথ্যা বলি আমার মাথায় যেন ঠান্ডা পড়ে। মাওলানা সাবও তার বিষয়ে একটা জিনিস দেখছেন, তারে জিজ্ঞাস করতে পারেন। মাওলানা, ঘটনাটা বলেন।

মাওলানা আসর ছেড়ে উঠে পড়লেন। তাঁর প্রচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে। বাড়িতে যাবেন, রান্না করবেন তারপর খাওয়া। ইদানীং রাতের খাওয়া তাকে কষ্ট দিচ্ছে। প্রায়ই মনে হচ্ছে, কেউ একজন যদি থাকত যে রান্না করে রাখবে। এবাদত বন্দেগি শেষ করে যাকে নিয়ে তিনি খেতে বসবেন। খেতে খেতে সুখ-দুঃখের কিছু গল্প। সবার ভাগ্যে সব কিছু হয় না। ভাগ্যকে দোষ দেওয়াও ঠিক না, কারণ আল্লাহপাক স্বয়ং বলেছেন, ‘ভাগ্যকে দোষ দিও না, কারণ আমিই ভাগ্য।’

মাওলানা রান্না চড়িয়েছেন। চাল ডালের খিচুড়ি। ঘরে ঝিংগা ছিল, কুচি কুচি করে ঝিংগা দিয়েছেন। খুঁজে পেতে দুটি আলু পাওয়া গেল। আলু দুটি দিয়ে দিলেন। খিচুড়ি নামাবার আগে আগে এক চামচ ঘি দিয়ে দেবেন। ঘিয়ের সুঘ্ৰাণে সমস্ত ত্রুটি ঢাকা পড়ে যাবে।

মাওলানা, বাড়িতে আছেন?

মাওলানা ঘর থেকে বের হয়ে দেখেন, মোহাম্মদ মফিজ।

আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।

মাওলানা আনন্দিত গলায় বললেন, অবশ্যই অবশ্যই।

কী করছিলেন?

রান্না বসায়েছি জনাব। আসেন রান্নাঘরে চলে আসেন। বাড়িতে কোনো স্ত্রীলোক নাই। পর্দা করার কেউ নাই।

কী রান্না করছেন?

সামান্য খিচুড়ি। দুই ভাই মিলে খেয়ে ফেলব।

দুই ভাইটা কে?

মাওলানা বললেন, আমি আর আপনি। জনাবের নিশ্চয়ই খাওয়া হয় নাই?

জি-না। আপনার সঙ্গে অতি আগ্রহের সঙ্গে খাব।

মাওলানা বললেন, আল্লাপাক আপনার আজ রাতের রিজিক আমার হাঁড়িতে দিয়েছেন। উনার অশেষ মেহেরবানি।

মোহাম্মদ মফিজ বললেন, আপনার মতো খোদাভক্ত মানুষ খুব বেশি আছে বলে আমি মনে করি না। এই ধরনের ভক্তি দেখাতেও আনন্দ।

দু’জন রান্নাঘরে বসেছেন। মাওলানা আরেক মুঠ চাল হাঁড়িতে দিয়ে দিয়েছেন। মাওলানা রান্নার প্রক্রিয়ায়ও একটা পরিবর্তন করেছেন। খিচুড়ি ডালের মতো বাগাড় দেবেন বলে ঠিক করেছেন। সিদ্ধ হয়ে গেলে অন্য একটা হাঁড়িতে ঘি’র সঙ্গে পেঁয়াজ ভোজ বাগাড়। অতিথির কারণে উন্নত ব্যবস্থা।

মাওলানা সাহেব!

জি জনাব?

সুলেমান নামের লোকটা বলছিল, আপনি হরিবাবুর একটা বিশেষ জিনিস आनन, 6না না?

উনি সাধু প্রকৃতির মানুষ। উচ্চশ্রেণীর সাধু। এর বেশি কিছু জানি না।

সুলেমান যে বলল, আপনি বিশেষ কিছু জানেন।

গ্রামের মানুষ অন্যকে সাক্ষী মেনে কথা বলতে পছন্দ করে। তাদের অনেক দোষের মধ্যে এটা বড় দোষ।

আজ যে ঘটনা ঘটল। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী?

মাওলানা বললেন, আল্লাহপাক মনিশংকর বাবুর পুত্রকে দয়া করেছেন। উনি যখন যাকে ইচ্ছা দয়া করেন।

হরিচরণ বাবুর এখানে কোনো ভূমিকা নাই?

আছে। আল্লাহপাক উনার মাধ্যমে দয়া করেছেন। উনার মাধ্যমে দয়া করেছেন বলে উনাকেও দয়া করা হয়েছে। আমাদের ঈসা নবির কথা মনে করেন, উনি অন্ধকে দৃষ্টি দিতেন, কুণ্ঠরোগী ভালো করতেন।

হরিচরণ বাবু নিশ্চয়ই ঈসা নবি না।

অবশ্যই না। আমরা কেউ কারো মতো না। সবাই আলাদা।

মোহাম্মদ মফিজ বললেন, আল্লাহপাকের কাছেও কি প্রতিটি মানুষ আলাদা, না-কি তার কাছে সবাই এক?

মাওলানা ইদরিস। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, অতি জটিল প্রশ্ন। এই প্রশ্নের জবাব দিবার মতো জ্ঞান আমার নাই। তবে কথাটা আমার মনে থাকবে। যদি কখনো কোনো প্রকৃত জ্ঞানী মানুষের সন্ধান পাই তাকে জিজ্ঞেস করব। খানা তৈয়ার হয়েছে, আসেন খানা খাই।

খাওয়া শেষ করে মোহাম্মদ মফিজ বললেন, আমি আমার এক জীবনে অনেক ভালো ভালো খাবার খেয়েছি- এত ভালো খাবার খাই নি। যত দিন বেঁচে থাকব আপনার হাতের রান্না মনে থাকবে।

মাওলানা বললেন, সবই আল্লাহপাকের খেলা, তিনি আমাদের মুখে রুচি দিয়েছেন। উনার দরবারে শুকরিয়া। আসেন। দুই ভাই মিলে আল্লাহপাকের দরবারে মোনাজাত করি।

মোহাম্মদ মফিজ বললেন, কিছু মনে করবেন না। এই দোয়াটা আপনি একা করুন। আমি পাশে বসে দেখি।

 

হরিচরণ পারুল গাছের নিচে বসে আছেন। তাঁর শরীর দুর্বল। রোজ রাতে নিয়ম করে জ্বর আসছে। সকালে জ্বর সেরে যায়। কিন্তু তার থাবা রেখে যায়। সারাটা দিন কাটে ক্লান্তিতে এবং রাতে জ্বর আসবে তার প্রতীক্ষ্ণয়।

কড়া রোদ উঠেছে। হরিচরণের গায়ে রোদ চিড়বিড় করছে। একটু সরে বসলেই রোদের হাত থেকে বাচা যায়। সরে বসতেও ইচ্ছা করছে না। হরিচরণের চোখ বন্ধ। তাঁর ঝিমুনির মতো এসেছে। কে যেন তার পায়ে হাত দিল। হরিচরণ চমকে উঠে চোখ খুললেন। কিশোরী এক মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে। শাড়ি পরায় তাকে বড় বড় দেখাচ্ছে। মেয়েটার মুখে অস্বাভাবিক মায়া। হরিচরণ বললেন, এই তুই কে?

আমার নাম যমুনা।

তুই করিরাজ সতীশ বাবুর মেয়ে না?

হুঁ।

এতবড় হয়ে গেলি কবে?

যমুনা খিলখিল করে হাসল। হরিচরণ বললেন, তুই যে আমার পায়ে হাত দিলি তোর তো জাত গেছে।

যমুনা বলল, কেউ দেখে নাই।

হরিচরণ বললেন, তাও ঠিক। জাত যাবার জন্যে কাউকে না কাউকে দেখতে হবে। তুই এত দূরে একা এসেছিস?

যমুনা বলল, আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আসছি।

বলিস কী! কী জন্যে?

যমুনা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, বলতে লজ্জা করে।

হরিচরণ হাসতে হাসতে বললেন, চোখ বন্ধ করে বল। চোখ বন্ধ করে বললো লজ্জা লাগবে না।

যমুনা চোখ বন্ধ করল না, অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনি আমার মাথায় হাত রেখে আশীৰ্বাদ করবেন।

কী আশীৰ্বাদ?

আমার যেন বিবাহ হয়।

বিবাহ তো এমনি হবে। এর জন্যে আশীৰ্বাদ লাগবে কেন?

যমুনা জবাব দিল না, গা মোড়ামুড়ি করতে লাগল। লজ্জায় তার গালে লালচে আভা দেখা দিল। হরিচরণ বললেন, বিশেষ কারো সঙ্গে বিবাহ?

হুঁ।

নাম কী? সুরেন। কলিকাতায় থাকে। কলেজে পড়ে।

তোর ধারণা আমি আশীৰ্বাদ করলেই সুরেনের সঙ্গে তোর বিয়ে হবে?

হুঁ।

হরিচরণ হাসতে হাসতে বললেন, কাছে আয়, আশীৰ্বাদ করে দিচ্ছি।

যমুনা তাঁর সামনে মাথা নিচু করল। হরিচরণ উচ্চস্বরে প্রার্থনা করলেন, হে ভগবান! হে পরমপিতা! তোমার এই সন্তানটির অন্তরের গোপন বাসনা তুমি পূর্ণ কর। সুরেনের সঙ্গে তোমার এই সন্তানের শুভবিবাহ যেন হয়। সেই বিবাহ যেন মঙ্গলময় হয়। তুমি তোমার এই অবোধ সন্তানকে দয়া কর।

যমুনা প্রার্থনা শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হরিচরণের হঠাৎ মনে হলো যমুনা কাঁদছে না। কাঁদছে। তাঁর কন্যা শিউলি। এই ধরনের ভ্রান্তি আজকাল তার ঘন ঘন হচ্ছে।

 

ন্যায়রত্ন রামনিধি কাশির এক পণ্ডিত নিয়ে এসেছেন। পণ্ডিতের নাম নগেন্দ্ৰনাথ ভট্টাচার্য তর্কালঙ্কার। তারা সরাসরি হরিচরণের বাড়িতে এসেছেন। হরিচরণ অতি সমাদরে তাদেরকে বসিয়েছেন। তাদের আগমনের হেতু বিচিত্র। হরিচরণ পতিত অবস্থা থেকে উদ্ধার পেয়েছেন। এখন তিনি আর জাতিচ্যুত না। তার বাড়িতে অতি উচ্চবর্ণের ব্ৰাহ্মণরাও জল গ্রহণ করতে পারবেন। বিধান এসেছে। সরাসরি কাশি থেকে।

রামনিধি বললেন, তোমার বাড়িতে ফলাহার করতেও এখন আর আমাদের আপত্তি নাই। এই মীমাংসা করতে অনেক পরিশ্রম হয়েছে। কয়েকবার কাশি যেতে হয়েছে। তুমি ইচ্ছা করলে এই খরচ দিতে পার, না দিলেও ক্ষতি নাই।

হরিচরণ বললেন, এত ঝামেলা করেছেন কী জন্যে? তোমার দিকে তাকিয়ে করেছি। তুমি বিশিষ্টজন। ভালো কথা, উড়া উড়া অনেক কথা তোমার বিষয়ে শুনি। তুমি শরীরে হাত দিলে নাকি রোগ সারে?

হরিচরণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন, কিছু বললেন না। রামনিধি গলা নামিয়ে বললেন, দীর্ঘ দিন শূল বেদনায় কষ্ট পাচ্ছি। দেখ কিছু করতে পার কিনা। তুমি হাত দিলেই কাজ হয়, না-কি মন্ত্র পাঠ করতে হয়? কী মন্ত্র পড়? নগেন বাবুর বাম হাঁটুতেও বিরাট সমস্যা। হাঁটতে পারেন না বললেই হয়। তাঁর বিষয়েও কিছু করা যায় কি-না দেখ।

হরিচরণ বললেন, আমি শরীরে হাত দিলে রোগ সারে না। আমি কোনো অবধূত না। আমি সাধারণ মানুষ। আপনার শরীরে হাত রাখতে আমার কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু আপনি ভেবে দেখেন হাত রাখা ঠিক হবে কি-না? আমার এই বাড়িতে একজন মুসলমান শিক্ষক থাকেন। তাঁর নাম মোহাম্মদ মফিজ।

রামনিধি এবং তর্কালঙ্কার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। হরিচরণ বললেন, তারচেয়েও বড় সমস্যা, এক ডোমের মেয়ে আমাকে বাবা ডাকে। সে মাঝে মাঝে এসে ঘরদুয়ার পরিষ্কার করে।

রামনিধি বললেন, সর্বনাশ! আগে বলবা না! তুমি দেখি আমাদের নরকবাসী করার বুদ্ধি করেছি। রাম রাম।

হরিচরণ বললেন, ডোম কন্যাদের সঙ্গে যৌন কর্মে বৰ্ণহিন্দুর সমস্যা নাই। এতে তাদের জাত যায় না, কিন্তু এরা বর্ণহিন্দুর বাড়িতে এসে ঘর ঝাঁট দিলে জাত যায়- এটা কেমন কথা?

তোমার সঙ্গে শাস্ত্ৰ আলোচনার জন্যে আমি আসি নাই। শাস্ত্ৰ বোঝার মতো জ্ঞান বুদ্ধি তোমার হয় নাই। আমরা উঠলাম। আজকাল হাড়ি ডোম মেথর নিয়া আছে আমাদের জানা ছিল না।

দুই শাস্ত্ৰ পণ্ডিত হরিচরণের বাড়ি থেকে বের হয়েই গঙ্গাজলে স্নান করে পবিত্র হলেন। বোতলভর্তি গঙ্গাজল তাদের সঙ্গেই ছিল। এই জলের কয়েক ফোঁটা স্নানের পানিতে মিশিয়ে নিলেই গঙ্গা স্নান হয়।

 

শশী মাস্টার চলে যাবেন, তার ডাক এসেছে। তাকে যেতে হবে চট্টগ্রামে। সূর্যসেন নামের একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। যাকে সবাই চেনেন ‘মাস্টারদা’ নামে। হরিচরণকে বললন, মা’র শরীর ভালো না। উনি আমাকে ক্ষমা করে কাছে ডেকেছেন। হরিচরণ বললেন, অতীব আনন্দ সংবাদ। রওনা হবার আগে আগে শশী মাস্টার হরিচরণের পা ছুঁয়ে প্ৰণাম করলেন। হরিচরণ আঁতকে উঠে বললেন, কর কী, কর কী, তুমি ব্ৰাহ্মণ!

শশী মাস্টার বললেন, আপনার চেয়ে বড় ব্ৰাহ্মণ তো আপাতত চোখে পড়ছে না।

তোমার পিতা-মাতাকে আমার প্রণাম দিও। তুমি কি এখনই রওনা দিচ্ছ?

শশী মাস্টার বললেন, আমি রাতে যাব। সন্ধ্যাবেলায় এক জায়গায় যাব। একজনের সঙ্গে দেখা করব। তাকে একটা জিনিস দেব। তার নাম যদি জানতে চান বলতে পরি।

হরিচরণ বললেন, নাম বলার প্রয়োজন নাই।

 

জুলেখার কাছ থেকে শশী মাস্টার বিদায় নিয়েছেন। কলের গান জুলেখাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। কীভাবে দম দিতে হয় কীভাবে পিন বদলাতে হয় শিখিয়ে দিয়েছেন।

হাসিমুখে বলেছেন, জুলেখা যাই?

জুলেখা বলল, একটু বসেন। শরবত দেই। শরবত খান।

শশী মাস্টার বসতে বসতে বললেন, বসতে যখন বলছি বসে যাই। তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ।

জুলেখা বলল, রাতটা থাকেন, আরাম করে ঘুমান। আমি সারারাত আপনার পায়ে হাত বুলায়ে দিব।

সেবা নেওয়ার অভ্যাস নাই জুলেখা।

জুলেখা বলল, মানুষ মানুষের সেবা নেয়। পশু পশুর সেবা নিতে পারে না।

সেবার প্রয়োজন নাই। একটা গান শোনাও। তুমি কি রবিবাবুর কোনো গান কখনো শুনেছ?

না।

উনার গান সম্পূর্ণ অন্য ধারার। শুনলে তোমার ভালো লাগত। আমার গলায় সুর নাই। তারপরেও শোন–

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না?
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যাবে পাই দেখিতে
হারাই-হারাই সদা হয়। ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে।।

জুলেখা বলল, আপনাকে একটা অদ্ভুত কথা বলব। কথাটা শোনার পর আপনি আমাকে খুব খারাপ ভাববেন। তারপরেও বলব।

বলো।

আমার মনে হয় আমার অনেক ভাগ্য যে রঙিলা বাড়িতে আমার স্থান হয়েছে।

বলো কী?

জুলেখা চাপা গলায় বলল, এইখানে আছি বইলাই আপনার মতো মানুষের সাথে পরিচয় হইছে। গান আমার অন্তরের জিনিস। গান গাইতে পারতেছি। শিখতেছি।

শশী মাস্টার বললেন, অতি কুৎসিত জীবনের বিনিময়ে যেটা পাচ্ছ সেটা কি অতি তুচ্ছ না?

জুলেখা বলল, আমার কাছে না।

শশী মাস্টার বললেন, তুচ্ছ না। তাহলে কাদছ কেন?

জুলেখা বলল, আপনারে আর দেখব না। এই দুঃখে কাঁদতেছি। রবিবাবুর আরেকটা গান করেন, আমি গলায় তুলব।

শশী মাস্টার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে গান ধরলেন–

চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে—
জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে।
স্খলিত শিথিল কামনার ভার বহিয়া বহিয়া ফিরি কত আর–
নিজ হাতে তুমি গেঁথে নিয়ো হার, ফেলো না আমারে ছড়ায়ে।।
চিরপিপাসিত বাসনা বেদনা বাঁচাও তাহারে মারিয়া।
শেষ জয়ে যেন হয় সে বিজয়ী তোমারি কাছেতে হারিয়া।

 

শশী মাস্টার মাস্টারদা সুর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় পুলিশের গুলিতে মারা যান। তারিখ ১৮ এপ্রিল ১৯৩০ সাল। অসীম সাহসী মাস্টারদা সূর্যসেনের কারণে ৪৮ ঘণ্টা চট্টগ্রাম শহর ছিল স্বাধীন শহর। ব্রিটিশ শাসনের আওতার বাইরের এক নগরী।

মাস্টারদা ধরা পড়েন অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের তিন বছর পরে। তারই জ্ঞাতি ভাই নেত্র সেন তাঁকে ধরিয়ে দেন। চট্টগ্রাম জেলে বাংলার বীর সন্তান সূর্যসেনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ