মোহনগঞ্জের বরান্তর গ্রামের মসজিদের ইমাম আব্দুল হক আকন্দ এসেছেন বান্ধবপুরে। যেহেতু ইমাম মানুষ, লোকজনের কাছে তাঁর পরিচয় মুনসি। মুনসি সাহেবের ডাকনাম উকিল। বাবা-মা’র আশা ছিল এই ছেলে বড় হয়ে উকিল হবে। সেই থেকে তাঁর পরিচয় উকিল মুনসি। বড়ই আশ্চর্যের কথা, মুনসি মানুষ হয়েও তিনি গানবাজনা করেন। লোকজন তাঁর গানবাজনা খুব যে মন্দ চোখে দেখে তা-না। তখনকার মুসলিম সমাজে উগ্রতা ছিল না। মসজিদের ইমাম সাহেব ঢোল বাজিয়ে গান করছেন, বিষয়টাতে অন্যায় কেউ খুজে পায় নি। বরং তাঁর গান লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।

মাওলানা ইদরিস উকিল মুনসির আগমনের খবর পেয়ে নদীর ঘাটে গেছেন। আদর করে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসবেন। উকিল মুনসি বরান্তর মসজিদের ইমাম। তিনি নিজেও ইমাম। একজন ইমাম থাকবেন। আরেকজন ইমামের কাছে। এইটাই সহবন্ত।

বড়গাঙের বাজারের ঘাটে উকিল মুনসির নৌকা বাধা। নৌকার ছই সবুজ শাড়ি দিয়ে ঘেরাটোপ দেয়া। তার ভেতর বসে আছেন ‘লাবুসের মা’।

তিনি লাবুস নামের কারো মা না। তাঁর নামই লাবুসের মা। তিনি উকিল মুনসির স্ত্রী। জনশ্রুতি- লাবুসের মায়ের মতো রূপবতী কন্যা অতীতে কখনো জন্মায় নি। ভবিষ্যতেও জন্মাবে না।

লাবুসের মা’র জন্ম ভাটি অঞ্চলের জালালপুরে। একবার মাত্র এই মেয়েকে চোখের দেখা দেখে উকিল মুনসি আধাপাগল হয়ে যান। প্রথম গান লেখেন—

ধনু নদীর পশ্চিম পাড়ে
সোনার জালালপুর
সেইখানে বসত করে
লাবুসের মা
উকিলের মনচোর।

মাওলানা ইদরিস নদীর পাড়ে গিয়ে দেখেন, উকিল মুনসির নৌকা ঘিরে অনেক নৌকা। নৌকাভর্তি মানুষ। পাড়েও লোকজন দাঁড়িয়ে আছে।

উকিল মুনসি গান ধরেছেন—

আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে
পুবলি বাতাসে
বাদাম দেইখ্যা চায়া থাকি
আমার নি কেউ আসে রে।।

যেদিন হতে নতুন পানি
আসল বাড়ির ঘাটে
অভাগিনীর মনে কত
শত কথা উঠে রে।।

কত আসে কত যায়।
নায় নাইয়ারির নৌকা
মায়ে ঝিয়ে ভইনে ভইনে
হইতেছে যে দেখা রে।।

আমি যে ছিলাম ভাই রে
বাপের গলায় ফাঁস
আমারে যে দিয়া গেল
সীতা বনবাস রে।।

আমারে নিল না নাইয়র
পানি থাকতে তাজা
দিনের পথ আধিলে যাইতাম
রাস্তা হইত সোজা রে।।

ভাগ্য যাহার ভালো নাইয়র
যাইবে আষাঢ় মাসে
উকিলের হইবে নাইয়র
কাৰ্তিক মাসের শেষে রে।

মাওলানা ইদরিসের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। এত সুন্দর গান! এমন গলা! মাওলানা চোখের সামনে আষাঢ় মাসে নাইয়ারিদের নৌকার পাল দেখতে পাচ্ছেন। তিনি কয়েকবার গাঢ় স্বরে বললেন, আহা রে! আহা রে!

উকিল মুনসি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে মাওলানা ইদরিসের সঙ্গে কয়েকদিন থাকতে রাজি হলেন। উকিল মুনসি মুখভর্তি পান নিয়ে বললেন, আমি কিন্তু তাহাৰ্জ্জুদের নামাজের শেষে গানবাজনা করি। অসুবিধা হবে?

মাওলানা বললেন, আমার বাড়ি জঙ্গলের ভেতরে। কেউ শুনবে না।

উকিল মুনসি বললেন, আমি তো গান করি সবেরে শুনানোর জন্যে। কেউ না শুনলে ফায়দা কী?

আমি শুনব। আমাদের ভাবি সাব শুনবেন।

উকিল মুনসি বললেন, সেটাও খারাপ না। অধিকে শোনার চেয়ে মন দিয়া যদি অল্পে শুনে সেটা ভালো। আপনার ভাবি সাব বিরাট রাধুনি। সে সবচে’ ভালো রাধে রিঠা মাছ। রিঠা মাছ জোগাড় করেন।

যেভাবে পারি জোগাড় করব।

আপনার ভাবি সাবের রূপ বেহেশতের হুর বরাবর। তাকে দেখলে বেহেশতের হুর কেমন হবে এই বিষয়ে আন্দাজ পাবেন। আমি তাকে বলব, সে যেন আপনার সামনে পর্দা না করে। নবিজির স্ত্রীদের জন্যে পর্দা বাধ্যতামূলক। আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের স্ত্রীদের জন্যে পর্দা বাধ্যতামূলক না।

ইদরিসের বাড়িতে পা দিয়ে উকিল মুনসি মুগ্ধ গলায় গান ধরলেন—

আমি না বুঝিয়া কার ঘরে আসিলাম
কারে করলাম আমার নাওয়ের সাথি।

উকিল মুনসির স্ত্রী তাঁর পেছনেই ঘোমটা পরে দাড়িয়ে ছিলেন। উকিল মুনসি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘোমটা খুইলা দেখ— কী সুন্দর বাড়ি! কী সুন্দর জংলা! আহারে কী সৌন্দর্য! আমি স্বপ্নে দেখেছি বেহেশত এই রকম হবে। প্রত্যেকের জন্য থাকবে বেহেশতি জঙ্গল। সেই জঙ্গলে কাঠের বাড়ি। বাড়ির পাশে পানির নাহর। গাছে গাছে মনোহর পাখপাখালি।

মাওলানা ইদরিস রিঠা মাছের সন্ধানে মাছবাজারে গেলেন। আজ হাটবার। বাজারে প্রচুর মাছ থাকার কথা। রিাঠা মাছ পাওয়া গেল না, তবে বড় বড় বাছা মাছ পাওয়া গেল। এই অঞ্চলের বাছা মাছ বিখ্যাত। মাছের বাজারে দেখা হলো। হরিচরণের সঙ্গে। তিনি মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। তবে নিয়ম করে হাটের দিন তিনি মাছবাজারে আসেন। তাজা বড় বড় মাছ দেখতে তার ভালো লাগে। জমিদার মানুষ, পাইক বীরকন্দাজ নিয়ে চলাফেলা করার কথা। তিনি চলাফেরা করেন একা। চামড়ার এক জোড়া চটি, ধুতি হাঁটু পর্যন্ত তোলা। গায়ে ঘিয়া রঙের চাদর।

হরিচরণ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, শুনলাম বিখ্যাত গাতক বাউল সাধক উকিল মুনসি আপনার বাড়িতে এসেছেন?

ইদরিস বললেন, জি এসেছেন।

কয়েক দিন কি থাকবেন?

বলেছেন তো থাকবেন। তবে এরা ভাবের মানুষ। হুট করে যদি বলেন চলে যাব, তাহলে চলে যাবেন।

উনার স্বকণ্ঠে গান শোনার বাসনা ছিল। বিখ্যাত বিচ্ছেদি গান। সম্ভব কি হবে? নিমন্ত্রণ করলে আমার বাড়িতে কি উনি যাবেন? হাতির পিঠে করে উনাকে নিয়ে যেতাম।

বলে দেখব। নিরহঙ্কারী মানুষ। বললেই রাজি হবেন বলে আমার বিশ্বাস।

আমি উনার জন্যে একটা মাছ কিনে দেই। কী মাছ উনার পছন্দ জানেন?

রিঠা মাছ পছন্দ। আজ বাজারে রিঠা মাছ উঠে নাই।

হরিচরণ বললেন, রিঠা মাছের ব্যবস্থা আমি করব। আজ আমার পছন্দের মাছ নিয়ে যান।

হরিচরণ বাজারের সবচে’ বড় রুই মাছটা কিনলেন। প্ৰকাণ্ড লাল মুখের জ্যান্ত রুই। জীবনের আনন্দে ছটফট করছে। এমন এক মাছ যাকে দেখতেও আনন্দ।

ইদরিস বললেন, এত বড় মাছ কে খাবে? মাছ কুটাও তো মুশকিল।

কোনো মুশকিল না। মাছ কুটার লোক আমি পাঠাব। মাছ কুটে দিয়ে আসবে। আস্ত মাছ দেখে উকিল মুনসি সাহেব হয়তো খুশি হবেন। বড় মাছ দেখে খুশি হয় না। এমন মানুষ কম। আপনি নিয়ে যান।

 

উকিল মুনসি মাছ দেখে মুগ্ধ। তিনি নিজেই মাছ কুটিতে বসলেন।

ইদরিস বললেন, আপনার জন্যে মাছটা হরিচরণ বাবু পাঠিয়েছেন। অতি বিশিষ্ট মানুষ। লোকে তাঁর নাম দিয়েছে ঋষি হরিচরণ।

উকিল মুনসি বললেন, মানুষের মুখে জয়, মানুষের মুখে ক্ষয়। অনেক মানুষ যাকে জয় বলে, তার অবশ্যই জয়। এত বড় মাছ উনি পাঠিয়েছেন। তাকে দাওয়াত দেন। তার সঙ্গে খাই।

উনি মাছ-মাংস খান না। নিরামিষ আহার করেন।

ভালো, খুবই ভালো।

উনার খুব ইচ্ছা স্বকণ্ঠে আপনার বিচ্ছেদি গান শুনেন। আপনি রাজি হলে আপনার জন্যে হাতি পাঠায়ে দিবেন।

উনার হাতি আছে না-কি?

জি আছে। শশাংক পালের সাত আনি জমিদারি খরিদ করেছেন।

সইন্ধ্যাকালে উনারে হাতি পাঠাইতে বলেন। লাবুসের মারে নিয়া হাতির পিঠে চড়ব। এই বলেই উকিল মুনসি গান ধরলেন– মাছ কুটিতে কুটিতে গান। বারান্দায় ঘোমটা দেয়া লাবুসের মা হাসছেন। স্বামীর আনন্দ দেখে উনি আনন্দিত।

উকিল মুনসি হাতির পিঠে
লইড়া চইরা বসে।
সেই হাতি কদম ফেলে
লিলুয়া বাতাসে
ঘোমটা পরা লারুসের মা
ঘোমটার ফাঁকে চায়
তাহারে পাগল করছে
উকিলের মায়ায়।।

লাবুসের মা’র সঙ্গে মাওলানা ইদরিসের কথাবার্তা হলো। মাওলানা কখনোই সরাসরি তাকালেন না। যে-কোনো তরুণীর দিকে দৃষ্টি ফেলা অপরাধ। অথচ লাবুসের মা’র মধ্যে কোনো সঙ্কোচ নেই। যেন মাওলানা তার অনেক দিনের চেনা।

লাবুসের মা বললেন, আমার সাথে ধর্মের ভাইন পাতাইবেন। ও মাওলানা, আমার দিকে চায়া কথা বলেন। ভাই ভইনের দিকে তাকাইতে পারে।

আপন ভাই ভইনের দিকে তাকাতে পারে।

আপন ভাবলেই আপনা। আপন ভাইব্যা। আমার সঙ্গে কথা বলেন।

কী কথা বলব?

বয়স হইছে, শাদি করেন না কেন? আপনে মাওলানা মানুষ, শাদি যে ফরজ এইটা জানেন না?

জানি।

কইন্যা দেখব? আমার সন্ধানে ভালো পাত্রী আছে। ওমা, মাওলানা দেখি লইজ্যা পায়। নাক-মুখ হইছে লাল।

 

উকিল মুনসি এসেছেন। হরিচরণের বাড়িতে। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। মাওলানা ইদরিস আসেন নি।

লাবুসের মা স্বামীর সঙ্গে এলেও হরিচরণের বাড়িতে ঢুকে আলাদা হয়ে পড়েছেন। পুরুষদের গানের আসরে তিনি কখনো থাকেন না। লাবুসের মা হরিচরণের বাড়িঘর ঘুরে ঘুরে দেখছেন। বাগান দেখছেন। দিঘি দেখছেন।

হরিচরণ দামি কার্পেটে উকিল মুনসিকে বসতে দিয়েছেন। রুপার পানদানিতে পান দেয়া হয়েছে। ইকো প্রস্তুত। আম্বরী তামাকের সুগন্ধ বাতাসে। ইকোর নল হাতে অপেক্ষা করছে জহির। সে মাওলানার বাড়ি ছেড়ে হরিচরণের বাড়িতে চলে এসেছে। কোথাও থিতু হতে পারছে না।

উকিল মুনসি বললেন, এই ছেলে কে?

হরিচরণ বললেন, এর নাম জহির। আমার এখানে থাকে।

মুসলমান ছেলে?

জি।

অতি লাবণ্যময় চেহারা। সে কি ঘাটুগানের ছেলে?

হরিচরণ বললেন, না। সে আমার পুত্ৰসম।

উকিল মুনসি বললেন, গোস্তাকি মাপ হয়। আমি খারাপ কিছু ভেবেছিলেম। বড় মানুষদের এইসব দোষ থাকে। আমি কিশোর বয়সে ঘাটুর দলে ছিলাম। গানবাজনা সেখানে শিখেছি। শৌখিনদার মানুষ ঘাটুছেলে কীভাবে ব্যবহার করে আমি জানি। যাই হোক, আপনি কি গান শুনবেন?

বিচ্ছেদের গান শুনতে আমার আগ্রহ, তবে আপনি আপনার পছন্দের গান করেন।

উকিল মুনসি বললেন, আমারও পছন্দ বিচ্ছেদের গান। কী জন্যে জানেন?

হরিচরণ বললেন, জানি না কী জন্যে?

উকিল মুনসি বললেন, আল্লাহ বা ভগবান যে নামেই তাকে ডাকা হোক, তিনি থাকেন বিচ্ছেদে।

সুন্দর কথা!

উকিল মুনসি ঢোলে বাড়ি দিয়ে গান ধরলেন। তিনি এক পায়ে নূপুর পরেছেন। গানের সঙ্গে নূপুর বাজছে। নূপুরের শব্দ করুণ রস তৈরি করে না, কিন্তু এখন করল। হরিচরণের চোখ ছলছল করতে লাগল।

উকিল মুনসি গাইছেন—

সোনা বন্ধুয়া রে।
এত দুঃখু দিলি তুই আমারে
তোর কারণে লোকের নিন্দন, করেছি অঙ্গের বাসন রে।
কুমারিয়ার ঘটিবাটি, কুমার ঘরে পরিপাটি
মাটি দিয়া লেপ দেয়। উপরে।
ভিতরে আগুন দিয়া, কুমার থাকে লুকাইয়া
তেমনি দশা করলি তুই আমারে।

উকিল মুনসি গান শেষ করলেন। হরিচরণ চোখ মুছতে মুছতে বললেন, আরেকটা গান।

উকিল মুনসি বললেন, নিজের গান না। আমার শিষ্যের লেখা একটা গান করি। তার সমস্ত গানই কাটা বিচ্ছেদ। গান শুনলে কলিজা কাইটা যায়- এই জন্যেই এর নাম কাটা বিচ্ছেদ। শিষ্যের কাছে পরাজিত হওয়ায় আনন্দ আছে। আনন্দের জন্যে গানটা করব।

অবশ্যই করবেন।

আমার শিষ্যের নাম সিরাজ আলি। তার বাড়ি আটপাড়া।

উকিল মুনসি গান ধরলেন—

সোনা বন্ধুরে
অপরাধী হইলেও আমি তোর
আমি তোর পিরিতের মরা
দেখলি না এক নজর।
অপরাধী হইলেও আমি তোর।

অনেক রাতে গানবাজনা শেষ হলো। হরিচরণ বিনীত ভঙ্গিতে হাতজোড় করে বললেন, আপনার কোনো সেবা করতে পারি? এই সৌভাগ্য কি আমার হবে?

সেবা করতে চান?

চাই। অন্তর থেকে চাই।

আমি আপনাদের অঞ্চলে ঘুরতে আসি নাই। বিশেষ উদ্দেশ্যে এসেছি। যে উদ্দেশ্যে এসেছি মাওলানা ইদরিস তার কিছু করতে পারবে না। সে কঠিন মাওলানা।

হরিচরণ বললেন, কী উদ্দেশ্য বলেন। আমি ব্যবস্থা করব।

উকিল মুনসি বললেন, আমি শুনেছি আপনাদের রঙিলা বাড়িতে এক রঙিলা মেয়ে আছে, যার রূপ দেখে বেহেশতের হুররা লজ্জা পায়। তাকে এক নজর দেখব। সে কী লাবুসের মায়ের চেয়ে সুন্দর কি-না তার পরীক্ষা হওয়া দরকার। শুনেছি তার কণ্ঠ কোকিল পক্ষীর কণ্ঠের চেয়েও মধুর। সে না-কি উকিল মুনাসির গান ছাড়া অন্য গান করে না। তার কণ্ঠে আমার একটা গান শুনব।

হরিচরণ বললেন, ব্যবস্থা করে দেব। এই মেয়ের কথা কার কাছে শুনেছেন?

অনেকের কাছেই শুনেছি। মানুষের গুণ বাতাসের আগে যায়।

আর দোষ? দোষ কীভাবে যায়?

দোষ চলে না জনাব। দোষ থাকে নিজের অঞ্চলে। দোষের পা নাই। সে ছুটতে পারে না।

উঠানে হাতি প্ৰস্তৃত। উকিল মুনসি স্ত্রীকে নিয়ে হাতিতে ফিরবেন। ঘোমটা পরা লাবুসের মা হরিচরণের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললেন, আপনি দরিদ্র এক বাউলকে যে সম্মান করেছেন তার বিনিময়ে আল্লাহপাক আপনাকে আরো সম্মান দেবেন।

হরিচরণ বললেন, মাগো, আমি সম্মানের কাঙালি না। তারপরেও আপনার সুন্দর কথায় খুশি হয়েছি।

আপনি আমাকে মা ডাকলেন। সব মেয়েকেই কি আপনি মা ডাকেন?

হরিচরণ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। লাবুসের মা বললেন, আমি আপনার দিঘির ঘাটলা দেখতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে দেখি শিউলি গাছের নিচে অল্পবয়সি বাঁচ্চা একটা মেয়ে হাঁটাহাঁটি করতেছে। গোল মুখ, কোঁকড়ানো চুল। মেয়েটা কে?

হতভম্ব হরিচরণ কোনো জবাব দিলেন না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন। লাবুসের মা বললেন, আপনার কোনো কন্যা কি অল্পবয়সে মারা গিয়েছিল?

হরিচরণ বললেন, হ্যাঁ।

লাবুসের মা হতাশ গলায় বললেন, আমি মৃত মানুষজন মাঝে মাঝে দেখতে পারি। কেন যে পারি নিজেও জানি না।

লাবুসের মা হাতির দিকে রওনা হলেন।

 

জুলেখার ঘরে অতিথি এসেছে। আলাভোলা চেহারা, গায়ে চাদর। পরনে লুঙ্গি। রঙিলা বাড়িতে লুঙ্গি পরে কেউ আসে না। বাবু সেজে আসে। ক্যানের লতিতে আতর দেয়।

অতিথি বললেন, আপনার নাম কী?

জুলেখা বলল, সবার প্রথম প্রশ্ন আপনার নাম? নামের কি প্রয়োজন? আমার নাম ফুলবিবি হলেও যা চানবিবি হলেও তা, আবার জুলেখা হলেও ক্ষতি নাই। মনে করেন আমার নাম জুলেখা। পান খাবেন? ভালো জর্দা আছে। ময়মনসিংহের সাধুবাবা জর্দা।

পান খাব।

জুলেখা পানদান এবং পিক ফেলার পিকদান পাশে এনে রাখল। পিকদান পিতলের। কিছুদিন হলো কিনেছে। রোজ তেঁতুল দিয়ে মাজা হয় বলে ঝকঝাক করে। জুলেখার কাছে মনে হয় ‘সন্নের’ পিকদান।

অতিথি বললেন, জুলেখা, শুনেছি তোমার কণ্ঠস্বর মধুর। আমি দূরদেশ থেকে এসেছি তোমার গান শুনতে। বাদ্যবাজনার প্রয়োজন নাই। খালি গলায় গান করবে, আমি শুনব।

জুলেখা পান সাজতে সাজতে বলল, আমার গানের কথা শুনেছেন। রূপের কথা শুনেন নাই?

রূপের কথাও শুনেছি। স্বীকার পাইলাম তোমার রূপ আছে। শোনা কথা বেশির ভাগ সময় মিলে না। তোমার বেলায় মিলেছে।

জুলেখা অতিথিকে এক খিলি পান দিয়ে নিজে এক খিলি পান মুখে নিল। তার পানে খয়ের বেশি করে দেয়া, যাতে কিছুক্ষণের মধ্যে ঠোঁট টকটকে লাল হয়ে যায়। সে পান চাবাতে চাবাতে বলল, কী গান শুনবেন?

তুমি উকিল মুনসির গান ভালো জানো বলে শুনেছি। তাঁর একটা গান Qasirv8।

তাঁর গান আইজ গাব না। অন্য গান শুনেন।

তাঁর গান গাবা না কেন?

যেদিন আমার মন ভালো থাকে না, সেইদিন উনার গান করি। আইজ আমার মন ভালো।

আমি তোমার কাছে উকিল মুনসির গান শুনতে আসছি। অন্য গান না।

টাকা কত এনেছেন?

বিশটা রুপার টাকা এনেছি। চলবে?

হ্যাঁ, চলবে। জুলেখা পিকদানে চাবানো পান ফেলে ঠোঁট মুছেই গান ধরল—

আমার গায়ে যত দুঃখ সয়
বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়
নিঠুর বন্ধুরে
বিচ্ছেদের বাজারে গিয়া
তোমার প্ৰেম বিকি দিয়া
করব না প্ৰেম আর যদি কেউ কয়।

জুলেখার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। চোখের কাজল পানিতে ধুয়ে ধুয়ে যাচ্ছে। তার ফর্সা মুখে তৈরি হচ্ছে কালো রেখার আঁকিবুকি।

গান শেষ করে জুলেখা বলল, আরো কি গাইব?

অতিথি বললেন, বিশটা রুপার টাকায় যে কয়টা হয়। সেই কয়টা গান Crs

জুলেখা বলল, উকিল মুনসির একটা গানের দাম এক কলসি সোনার মোহর।

অতিথির ঠোঁটের কোনায় সামান্য হাসির আভাস দেখা গেল। তিনি দ্রুত সেই হাসি মুছে ফেলে বললেন, তোমার ঘরে ঢোল তবলা কিছু থাকলে আমারে দাও, গানের সাথে তাল দেই। তাল বিনা গান গাইতে তোমার অসুবিধা হইতেছে। আচ্ছা থাক, লাগবে না।

অতিথি পিকদান কাছে টেনে নিলেন। হাতের বাড়িতে পিকদান থেকে সুন্দর ধাতব শব্দ হলো।

জুলেখা হাসিমুখে বলল, আপনি তো বিরাট উনসুনি লোক (উনসুনি : সূক্ষ্ম কলাকৌশলে ওস্তাদ ব্যক্তি)। উকিল মুনসির গান পিয়ার করেন?

হুঁ।

জুলেখা দ্বিতীয় গান ধরল—

রজনী প্রভাত হলো ডাকে কোকিলা
কার কুঞ্জে ভুলিয়া ভুলিয়া…

অতিথি বললেন, তুলিয়া ভুলিয়া হবে না। হবে ভুলিয়া রহিলা।

রজনী প্ৰভাত হলো ডাকে কোকিলা
কার কুঞ্জে ভুলিয়া রহিলা।

জুলেখা বলল, আপনার পরিচয় কী?

অতিথি বললেন, আমার নাম উকিল মুনসি।

ঘরে যেন বজ্ৰাঘাত হলো। কিছুক্ষণ নিম্পলক তাকিয়ে থেকে হিন্দুদের প্ৰণামের ভঙ্গিতে জুলেখা উকিল মুনসির পায়ে মাথা রাখল। তার শরীর কেপে কেঁপে উঠছে। চাপা ফোঁপানির শব্দ আসছে।

উকিল মুনসি বললেন, তোমার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি। আমি তোমাকে দোয়া দিলাম।

জুলেখা বলল, কী দোয়া দিলেন?

সব কিছু তোমাকে ছেড়ে গেলেও গান কোনোদিন ছেড়ে যাবে না। পা থেকে মাথা সরাও, আমি এখন উঠব। ঘাটে নাও নিয়া আমি আসছি। নাও-এ। আমার স্ত্রী অপেক্ষা করতেছেন। আমাকে বেশিক্ষণ না দেখলে তিনি অস্থির বোধ করেন।

জুলেখা বলল, আমার মাথা সরাব না। আপনার যদি যেতে হয় পাও দিয়া আমার মাথায় লাথি দিবেন। মাথা সরবে। তারপর আপনি যাবেন।

উকিল মুনসি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। মেয়েটা এখন ঘোরের মধ্যে আছে। তাকে উঠে বসানোর চেষ্টা করা প্রয়োজন। ঘোরের মধ্যে যে আছে তার ঘোর ভাঙানো কঠিন। ঘোরের বিষয়টা তিনি জানেন।

জুলেখা!

জি।

আরো কয়েকটা গান করো শুনি।

জুলেখা উঠে বসতে বসতে বলল, আমি সারারাত গান করব। অল্প নাচ শিখেছি, যদি বলেন নাচ দেখাব।

নাচের প্রয়োজন নাই। গান করো। ঘাটুগান জানো? ঘাটুগানের সুর অতি মনোহর।

আপনার সামনে আমি আপনার গান করব। অন্য কোনো গান না। জুলেখা গানে টান দিল।

 

লাবুসের মা নৌকায় অপেক্ষা করছেন। তিনি একা না। নৌকার দু’জন মাঝি ছাড়াও জহির নামের ছেলেটা সঙ্গে আছে। এই ছেলের চেহারা দেবদূতের মতো। অতি রূপবতীদের যেমন বিপদ, অতি রূপবান বালকের তেমন বিপদ। ছেলেটির জন্যে তিনি মমতা বোধ করছেন। লাবুসের মা’র হাতে তসবি। তিনি তসবি টানতে টানতে নিচু গলায় ছেলেটির সঙ্গে গল্প করছেন।

বাংলা পড়তে শিখেছি?

জি।

আলহামদুলিল্লাহ। হাতের লেখা সুন্দর আছে?

হাতের লেখা সুন্দর।

আলহামদুলিল্লাহ। পিতামাতা জীবিত?

হুঁ।

শুকুর। আলহামদুলিল্লাহ। তোমার উপরে আল্লাহপাকের খাস রহমত আছে।

জহির স্পষ্ট গলায় বলল, রহমত নাই।

লাবুসের মা’র হাতের তসবি থেমে গেল। তিনি চমকে তাকালেন। পুতুলের মতো ছেলেটি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। তিনি বললেন, কেউ যদি বলে আমার উপরে আল্লাহর রহমত নাই, তাহলে সে নাফরমানি করে। এই কাজ আর করব না। বিলো, আল্লাহপাক আমাকে ক্ষমা করো।

বলব না।

লাবুসের মা বড়ই অবাক হলেন। ছেলেকে দেখে মনে হয় নরমসরম কিন্তু কথাবার্তায় কাঠিন্য আছে। বাঁশ নুয়ে পড়ে। এই ছেলে কিঞ্চির মতো সোজা। লাবুসের মা বললেন, তুমি অন্যদিকে তাকায়ে আছ কেন? আমার দিকে তাকাও। আসো আমরা গল্প করি।

জহির ফিরে তাকাল। লাবুসের মা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করলেন, ছেলেটার চোখ ভেজা। তিনি বললেন, আমার নাম লাবুসের মা। আমার যখন দুই বছর বয়স তখন থাইকা আমি লাবুসের মা। অথচ আমার কোনো সন্তানাদি নাই। কোনোদিন হইব তারো ঠিক নাই। তারপরও সবার মুখে লাবুসের মা। মজা না?

জহির হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। মাথা নাড়ার ফাঁকে চট করে চোখের পানি মুছে নিল।

তোমাকে এখন যদি আমি লাবুস নাম দেই, কেমন হয়?

জহির ফিক করে হেসে ফেলল। লাবুসের মা বললেন, আইজ থাইকা তোমার নাম লাবুস। ওই পুলা, লাবুস!

জহির হাসি চাপিতে চাপতে বলল, জি।

জি কিরে পুলা? আমি লাবুসের মা। তুই আমারে মা ডাকবি না? বল জি भी।

লইজ্যা লাগে।

মা’র কাছে পুলার কী লইজ্যা? ও লাবুইচ্যা!

কী মা?

তুই যাবি আমার লগে?

যাব।

সত্যি যাবি?

হুঁ যাব।

বল–

উপরে আল্লা নিচে মাটি
যে কসম কাটছি। সেই কসম খাঁটি।

জহির বলল—

উপরে আল্লা নিচে মাটি
যে কসম কাটছি। সেই কসম খাঁটি।

 

উকিল মুনসি যে রাতে জহিরকে নিয়ে রওনা হলেন, সেই রাতে বান্ধবপুরে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। জহিরের বাবা সুলেমান তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে তালাক দিল। এই স্ত্রীর নাম হালিমা। সে মোটাসোটা অল্পবুদ্ধির হাসি-খুশি মেয়ে। তার জীবনের একটাই শাখ- সারাদিন পান চিবানো। পান খাওয়ার মতো অতি তুচ্ছ ঘটনাই তালাকের কারণ। সুলেমান বলেছিল— তুই কি ঘোড়া? সারাদিন জাবর কাটস? পান খাইয়া আমার সংসার ড়ুবাইছস। আমারে পথের ফকির করছিস।

সুলেমানের কথায় অতি বিস্মিত হয়ে হালিমা বলেছিল, পান তো আপনের পয়সায় খাই না। পান। আর গুয়া আমার বাপের বাড়ি থাইক্যা আসে।

এই অপমানসূচক কথায় সুলেমানের মাথায় আগুন ধরে যায়। সে বলে, কী এত বড় কথা! বাপের বাড়ির খোটা? যা, বাপের বাড়িত গিয়া পান খাইতে থাক, তোরে তালাক দিলাম। আইন তালাক, বাইন তালাক, গাইন তালাক। তিন তালাক। তুই তোর বান্দি বেটি নিয়া বিদায় হ।

তিন তালাকের পর আর এই বাড়িতে থাকা যায় না। যে কিছুক্ষণ আগেও স্বামী ছিল, তার মুখ দর্শনও করা যায় না। সে এখন পরপুরুষ। হালিমা কাঁদতে কান্দতে শাড়ির আঁচলে লম্বা ঘোমটা দিয়ে বলল— হোসনার গর্ভ হয়েছে। সে কী করব? (হোসনা, হালিমার দাসী। সে-সময় স্বামী কর্তৃক দাসীদের গর্ভসঞ্চার স্বীকৃত ছিল।)

সুলেমান বলল, সন্তান হোক। সন্তান হইলে সন্তান নিয়া আসব। হোসনা থাকবে তোর সাথে। সে তোর বান্দি। আমার না।

হালিমা কান্দতে কাঁদতে দাসীকে নিয়ে নৌকায় উঠল।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা ঘটল ধনু শেখের বাড়িতে। ধনু শেখ তার বাড়িতে লাখের বাতি জ্বালালো। তখনকার নিয়মে নব্যধনীদের সঞ্চিত অর্থ এক লক্ষ অতিক্রম করলে সবাইকে তা জানানোর নিয়ম ছিল। এই জানান দেয়া হতো লাখের বাতি জ্বলিয়ে এবং বাড়িতে ঘাটুগানের আয়োজন করে। যে মানুষটি লাখের বাতি জ্বলিয়েছে, তাকে সমীহ করা দস্তুর ছিল।

ধনু শেখের বাড়ির উঠানে লম্বা বাঁশ টানিয়ে বাঁশের মাথায় হারিকেন ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রচুর লোকজন এসেছে। তাদের জন্যে মিষ্টির ব্যবস্থা হয়েছে। ঘাটুগান শুরু হয়েছে। এই গান সারারাত চলবে। সূর্য উঠার পর গান বন্ধ। তখন শিন্নির ব্যবস্থা। শিন্নি হচ্ছে খাসির মাংস এবং খিচুড়ি। লাখপতির উৎসবের জন্যে চারটা খাসি জবেহ হয়েছে।

ঘাটুগানের অধিকারী তিনটি ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। তিনজনই রূপবান। এরা মেয়েদের ফ্রক পরে মেয়ে সেজেছে। পায়ে নূপুর পরেছে। অধিকারীর ইশারায় গান শুরু হলো। একজন মঞ্চে এসে নারিকেলের মালার বুক চেপে ধরে গান ধরল—

আমার মধু যৌবন কে করিবে পান?

দোহার এবং বাদ্যযন্ত্রীরা বিপুল উৎসাহে বাজনা বাজাতে বাজাতে দোহার ধরিল–

কে করিবে পান গো? কে করিবে পান?

ধনুর একমাত্র স্ত্রী কমলা, চিকের পর্দার আড়াল থেকে ঘটু নাচ দেখছে। তার বুক কাঁপছে। কেন জানি মনে হচ্ছে এই ছেলেটাকে তার স্বামী রেখে দিবে। পালঙ্কে এখন সে আর তার স্বামী শুবে না। তাদের মাঝখানে ঘাটুছেলেটা শুয়ে থাকবে। কী লজ্জা! কী লজ্জা!

 

ঘাটুছেলেটা যখন নাচছে তখন ঠিক তার বয়সি একজন আসানসোলের এক রুটির দোকানে লেটো নাচের কাহিনী এবং গান লিখছে। আশ্চর্য কাণ্ড! গানে সুরও দিচ্ছে। (ঘাটু এবং লেটো নাচের মধ্যে পার্থক্য তেমন নেই।- লেখক)। তার বয়স এগারো। রুটির দোকানে তার মাসিক বেতন পাঁচ টাকা। কিশোরের নাম কাজী নজরুল ইসলাম। ডাকনাম দুখু মিয়া। কারণ দুঃখে দুঃখেই তার জীবন কাটছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ