হোসেন সাহেব নিজেকে মনে মনে ইডিয়ট বলে গালি দিলেন। এরচেয়েও কোন খারাপ গালি দিতে পারলে ভাল হত। খারাপ গালি মাথায় আসছে না। আতাহার তার সামনে বিনীত ভঙ্গিতে চুপচাপ বসে আছে। তাকে সান্তনা দেবার জন্যে যে সব কথাবার্তা তিনি ভেবে রেখেছিলেন তার একটাও মনে পড়ছে না। মাথা পুরোপুরি শূন্য। বুক অব কোটেশন থেকে মৃত্যুর উপর তিনটা কোটেশন মুখস্থ করে রেখেছিলেন। তিনটার একটাও মনে আসছে না। স্মৃতিশক্তি মনে হচ্ছে পুরোপুরি গেছে। কিছুদিন পর হয়ত ছেলেমেয়েদের নামও মনে পড়বে না। এদেরকে ডাকতে হবে–এই যে। এই যে दgठन।

আতাহার বলল, চাচা, আপনি আমাকে খোঁজ করছিলেন?

এমি খোঁজ করছিলাম–অনেকদিন তোমাকে দেখি না। তোমার স্বাস্থ্যটাও খারাপ হয়েছে।

চুল কাটিয়েছি তো, এইজন্যেই খারাপ দেখাচ্ছে।

ভেরী ট্রু–চুল কটালে ছেলেদের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ব্যাহত হয়। আমি যতবার চুল কাটাতাম, তোমার চাচী রাগ করতেন। শেষে একবার ঠিক করলাম আর চুলই কটাব না। বাবড়ি চুলের মত হয়ে গেল। মাথায় উকুন হল। তোমার চাচী তাতেই খুশি। মেয়েরা নিজেরা চুল লম্বা রাখে তো, এইজন্যে পুরুষদের চুলও লম্বা দেখতে পছন্দ করে।

জ্বি, তাই হবে।

তোমার বাবার মৃত্যু সংবাদে খুবই দুঃখিত হয়েছি আতাহার। যদিও মৃত্যু হচ্ছে একটা শ্বাশত ব্যাপার। একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আমরা যে বেঁচে আছি এটাই একটা মিরাকল।

জ্বি।

হোসেন সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, তিনটা কোটেশনের একটা মনে পড়েছে। একটা যখন মনে পড়েছে তখন অন্য দুটাও মনে পড়বে।

আতাহার!

জ্বি।

মৃত্যু প্রসঙ্গে মহাকবি মিল্টনের একটা কথা আছে–আমার কাছে খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কবি মিল্টন বলেছেন–

Death is the golden key
That opens the palace of eternity.

কথাটা অদ্ভুত না আতাহার?

জ্বি অদ্ভুত। আবার কবি বায়রণ বলেছেন–

Heaven gives its favourites–early death.

আতাহার বলল, সব কোটেশন আপনার মুখস্থ নাকি চাচা?

হোসেন সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, এক সময় ছিল। স্মৃতিশক্তি ভাল ছিল, যা পড়তাম মনে থাকত। এখন স্মৃতিশক্তি পুরোপুরি গেছে। একটা জিনিস একশবার পড়লেও মনে থাকে না।

এত কিছু মনে রাখার দরকারই বা কি?

এটাও ঠিক বলেছ। ভুলে যেতে পারাই ভাল। যে মানুষ কোন কিছু ভুলতে পারে না, সে শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যায়।

চাচা, আজ উঠি।

বোস বোস, এখনি উঠবে কি? রাতে আমার সঙ্গে ডাল-ভাত খাও। বাসায় কেউ নেই, নীতু গেছে কামালের সঙ্গে। রেস্টুরেন্টে খাবে। কামালের সঙ্গে কি তোমার দেখা হয়েছে?

জি, একদিন দেখলাম।

ছেলেটাকে তোমার কেমন লাগল?

ভাল। খুব ভাল। খুব সুন্দর চেহারা।

কথাবার্তা কেমন মনে হল?

উনার সঙ্গে কথা তেমন কিছু হয়নি।

কামালের কথাবার্তা তেমন ইয়ে না— কমাশিয়াল ধরনের কথা। ওর বড় ভাই এসেছিল, বিয়ের খরচ চায়।

ও।

আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে। বিয়ের আগেই যদি এত টাকা টাকা করে, বিয়ের পরে কি হবে–চিন্তার কথা না?

চিন্তার কথা তো বটেই।

এদিকে পত্রিকা খুললেই দেখি যৌতুকের জন্যে খুন। যতবার দেখি, আঁৎকে উঠি।

আঁৎকে ওঠারই কথা।

নীতুর জন্যে আসলে তোমার মত একটা ছেলে দরকার ছিল।

চাচা, ছেলে হিসেবে আমি থার্ড ক্লাসেরও নিচে ফোর্থ ক্লাস। পরের বাড়ির গুদামে শুয়ে থাকি।

হোসেন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, গুদামে শুয়ে থাক মানে কি?

আমরা এখন বড় মামার সঙ্গে থাকি। উনার একটা গুদাম আছে নয়া বাজারে। সেখানে ম্যানেজার থাকে আর আমি থাকি।

বল কি? তোমার মা, ভাই-বোন তারা কোথায় থাকে?

মা থাকেন হাসপাতালে। ছোটভাই আর বোন থাকে বড় মামার বাসায়।

তোমার মাকে একদিন দেখতে যাব আতাহার।

জ্বি আচ্ছা।

রুম নাম্বার-টাম্বার–এইসব কাগজে লিখে রেখে যাও। আর শোনা–তোমার গোটা পাঁচেক বায়োডাটা অবশ্যই আমাকে দিয়ে যাবে। দেখি কি করা যায়–তথ্যমন্ত্রীকে দিয়ে কিছু একটা ব্যবস্থা করব। আমার খুবই ঘনিষ্ট জন। দুলু বলে ডাকতাম। নানাভাবে তাকে সাহায্য করেছি। তোমার বায়োডাটা নিয়ে দুলুর হাতে দিয়ে আসব।

বলতে বলতে তাঁর মনে হল–দুলু তাঁর সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেনি। তিনি তার অফিস থেকে লজ্জিত ও অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। তাতে কি! পুত্রের বন্ধুর জন্যে না হয় আরেকবার অপমানিত হবেন। নিজের স্বাৰ্থ উদ্ধারের জন্যে অপমানিত হওয়ায় লজ্জা আছে, কিন্তু অন্যের উপকারের জন্যে অপমানিত হওয়ায় কোন লজ্জা নেই।

আতাহার!

জ্বি চাচা।

হোসেন সাহেব অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বললেন, সাজ্জাদের ব্যাপারটা কি তুমি কিছু জান?

কোন ব্যাপারটা?

হুট করে চাকরিটা ছেড়ে দিল। তোমার সঙ্গে এইসব নিয়ে কোন আলাপ হয়েছে?

জ্বি না।

ও কোথায় আছে সেটা কি জান বাবা?

জ্বি না চাচা, জানি না।

ও কি ড্রাগ-ট্রাগ খায়?

শখ করে মাঝে মাঝে খায়। একে ঠিক ড্রাগ খাওয়া বলে না। কৌতূহল মেটানোর জন্যে।

অতিরিক্ত কৌতূহল কি ভাল আতাহার?

সবার জন্যে ভাল না। কিন্তু সৃষ্টিশীল মানুষদের প্রধান অস্ত্রই কৌতূহল। এরা জীবনকে নানানভাবে, নানান দিক থেকে দেখবে।

জীবনকে দেখার জন্যে ড্রাগ খেতে হবে? জীবনকে দেখার জন্যে চোখ পরিস্কার থাকা দরকার না? মাথাটা পরিষ্কার থাকা দরকার না? ঘোরের মধ্যে তুমি জীবন কি দেখবে?

আতাহার চুপ করে রইল। হোসেন সাহেব বললেন, আতাহার শোন–আমি সাজ্জাদকে নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় আছি। আমার মনে হয় ওকে কোন ভাল সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে দেখানো দরকার। তুমি কি বল? শুধু ওর একার চিকিৎসরই যে দরকার তা না, তোমার নিজেরো চিকিৎসা দরকার। ঠিক বলছি না আতাহার?

জ্বি চাচা, আজ উঠি। মাকে দেখার জন্যে আজ ভাবছিলাম একটু হাসপাতালে যাব।

তাহলে ভাত দিতে বলি। বেথুন ভাজতে বলেছি। খাবার সময় গরম গরম ভেজে দেবে। নতুন গাওয়া ঘি আছে। বেগুনভাজা, গাওয়া ঘি খেতে অপূর্ব। এর অবশ্যি বেগুনটা ঠিকমত ভজিতে পারে না। ন্যাত। ন্যা তা হয়ে যায়। তোমার চাচী চালের গুড়া দিয়ে মাখিয়ে কি করে যেন বেগুন ভাজতো। অপূর্ব লাগতো। শক্ত একটা খোসার মত থাকতো, ভেতরটা মাখনের মত মোলায়েম। স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। বুঝলে আতাহার, আমি মাঝে মাঝে রাতে স্বপ্নে দেখি ঐ বেগুন ভাজা দিয়ে ভাত খাচ্ছি। স্বপ্নে খাওয়ার কোন টেস্ট নাকি পাওয়া যায় না। আমি কিন্তু পাই। আরেকদিন স্বপ্নে দেখলাম, গরম গরম জিলাপি খাচ্ছি। তারও স্বাদ পেয়েছি। স্বপ্ন ভাঙার পরেও দেখি মুখ মিষ্টি হয়ে আছে। তারপর জেগে উঠে মুখের মিষ্টি ভােব কাটানোর জন্যে একটা পান খেলাম।

জিলাপি কি চাচীর খুব প্রিয় ছিল?

তুমি ঠিকই ধরেছ। জিলাপি। ওর খুব প্রিয় ছিল। গরম গরম জিলাপির জন্যে পাগল ছিল। একবার হয়েছে কি, শোন–ট্রেনে করে সিলেট যাচ্ছি, আখাউড়া স্টেশনে হঠাৎ সে দেখল— টিকিট ঘরের পাশে তোলা উনুনে জিলাপি ভাজা হচ্ছে–আমাকে বলল, জিলাপি খাব। আমি বললাম, জিলাপি খাবে কি? এক্ষুণি ট্রেন ছেড়ে দেবে। সে বলল, না ছাড়বে না। তুমি এক দৌড়ে যাও। কি আর করা–গেলাম। সত্যি সত্যি ট্রেন ছেড়ে দিল। আমি. আর দৌড়ে উঠতে পারলাম না। জিলাপির ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি–আমার সামনে দিয়ে ট্রেন চলে গেল। তোমার চাচী দেখি জানোলা দিয়ে মাথা বের করে হাত নেড়ে খুব টা-টা দিচ্ছে।

কাজের মেয়েটি এসে জানাল, ভাত দেয়া হয়েছে। হোসেন সাহেব আতাহারকে নিয়ে খেতে গেলেন। তাকে খুব আনন্দিত মনে হল। বেগুন ভাজা খেতে ভাল হয়েছে। এতটা ভাল হবে তিনি আশা করেননি। বেথুন এবং ঘিয়ের গন্ধ মিলে অপূর্ব গন্ধ বেরুচ্ছে।

আতাহার!

জ্বি চাচা।

বেগুনভাজা কেমন লাগছে?

অসাধারণ।

তোমার চাচীর হাতের বেগুনভাজা একদিন তোমাকে খাওয়াতে পারলে বুঝতে কি জিনিস। সেটা সম্ভব না। কেন সম্ভব না তা নিশ্চয়ই জান।

জ্বি জানি।

আমাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই। যোগাযোগ না থাকাই অবশ্যি ভাল। তবে ঠিক করেছি, নীতুর বিয়ের খবরটা তাকে টেলিফোনে দেব। হাজার হলেও সে মা। নিজের মেয়ের বিয়ের খবর জানার অধিকার তার আছে। তাই না?

জ্বি।

বিয়ের কার্ড হাতে নিজেই যদি যাই সেটা কি খারাপ হবে?

জ্বি না।

তাই করব। কার্ডটা দিয়ে চলে আসব। খুব বেশি হলে এক কাপ চা খাব। সাধারণ ভদ্রতার কিছু কথা–কেমন আছ, ভাল আছি। টাইপ। তারপর চলে আসা। তোমাকে নিয়েই না হয় যাব।

আমাকে নিয়ে যাবার দরকার কি চাচা?

তৃতীয় একজন ব্যক্তি থাকলে কথাবার্তা বলার সুবিধা হয়–এই আর কি। তুমি যেতে না চাইলে–থাক।

আপনি বললে আমি অবশ্যি যাব।

আতাহার!

জ্বি।

তুমি কি হাতদেখা-টেখা এইসবে বিশ্বাস কর?

কেন বলুন তো চাচা?

একজন খুব ভাল পামিস্টকে আমি হাত দেখিয়েছিলাম–নাম হল জ্যোতিষ ভাস্কর অভেদানন্দ। কথাবার্তা শুনে শুরুতে মনে হয়েছিল ফ্রড। পরে দেখলাম, ফ্রড না। ভাল জানেন। তিনি আমাকে বললেন, আফটার সিক্সটি সেভেন আমার জীবন খুবই আনন্দময় হবে।

তাই নাকি?

কিভাবে তা হবে কে জানে। উনি আমাকে একটা এমেথিস্ট পাথর ব্যবহার করতে বলেছেন।

ব্যবহার করছেন?

পাথর আনিয়েছি–ভাবছি। একটা আংটি করব। ক্ষতি তো কিছু নেই–তাই না? আমাদের নবী নিজেও না-কি আকিক পাথর ব্যবহার করতেন। পাথরের একটা গুণাগুণ তো থাকতেই পারে। পারে না?

জ্বি পারে।

বৃদ্ধের প্রতি গভীর মমতায় আতাহারের চোখ ভিজে উঠার উপক্রম হল। খাওয়া শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই সে চলে গেল না। চুপচাপ বসে হোসেন সাহেবের কথা শুনতে লাগল।

মৃত্যু সম্পর্কিত আরেকটি কোটেশন হোসেন সাহেবের মনে পড়ে গেছে। তিনি অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলছেন–

আতাহার শোন, বেকনের একটা প্রবন্ধ আছে মৃত্যু বিষয়ে। প্রবন্ধটার নাম–Essay on death. বেকন সেখানে বলছেন–Heaven gives its favourities—early death, অর্থটা হচ্ছে–অল্প বয়সে তারাই মারা যায় যারা প্রকৃতির প্রিয় সন্তান। তোমার বাবা অবশ্যি অল্প বয়সে মারা যাননি–পরিণত বয়সে মারা গেছেন। তবু সন্তানের কাছে এই মৃত্যুও গ্রহণযোগ্য না। কেউ দেড়শ বছর বাঁচার পরেও তার সন্তান কাঁদতে কাঁদতে বলবে–বাবা, কেন এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।

আতাহার একবার ভাবল বলে, চাচা, এটা কবি বায়রনের লাইন বলে একটু আগেই আপনি আমাকে শুনিয়েছেন। তারপর ভাবল, কি দরকার? কথাটাই আসল, কে বলল সেটা কোন ব্যপার না। এই জাতীয় কথা অন্যের মৃত্যুতে একজন রিকশাওয়ালাও বলে। যেহেতু সে রিকশা চালায়–তার কথা কোটেশন হিশেবে ব্যবহার করা হয় না।

আতাহার!

জ্বি চাচা।

তোমাকে আমি অত্যন্ত পছন্দ করি।

সেটা চাচা আমি জানি।

শুধু আমি একা না, এই পরিবারের সবাই তোমাকে পছন্দ করে। শুধু নীত্র ব্যাপারটা বলতে পারছি না। ও অবশ্যি খুব চাপা মেয়ে… আতাহার, কফি খাবে?

জ্বি না।

খাও, একটু কফি খাও। খাওয়া-দাওয়ার পর কফি হজমের সহায়ক। নিউজ উইক পত্রিকায় একবার পড়েছিলাম। অল্প পরিমাণে কেফিন হাটের জন্যেও ভাল। হাটের রক্ত সঞ্চালন এতে ভাল হয়।

নীতু ফিরে এসেছে। নীতুর পেছনে পেছনে আসছে কামাল। নীতুর হাতে একটা বেলীফুলের মালা। কামাল কিনে দিয়েছে। আতাহারকে দেখে কামালের ভুরু কুঁচকে গেল। চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। নীতু বলল, আতাহার ভাই, আপনি এত রাত পর্যন্ত আছেন? আপনার কি ঘর-সংসার বলে কিছু নেই? আশ্চর্য!

হোসেন সাহেব মেয়ের উপর খুব বিরক্ত হলেন। মেয়েটা আতাহারের সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করে কেন? মৃত্যুশোকে কাতর একটা মানুষের সঙ্গে মমতা ও ভালবাসা নিয়ে কথা বলা দরকার–এই সহজ সত্যটা তার মেয়ে জানবে না কেন?

হোসেন সাহেব কামালের দিকে তাকিয়ে বললেন, কামাল বাবা, দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস।

জ্বি না, আমি বসব না, চলে যাব।

তোমাদের ডিনার কেমন হয়েছে?

জ্বি ভাল হয়েছে।

আতাহারের সঙ্গে কি তোমার পরিচয় হয়েছে? অতি ভাল ছেলে।

কামাল শুকনো গলায় বলল, জ্বি, পরিচয় হয়েছে।

নীতু দোতলায় উঠে গেছে। কামালও চলে গেছে। পটে করে কফি দিয়ে গেছে। হোসেন সাহেব কফি ঢালতে ঢালতে বললেন, নীতুর কথায় তুমি কিছু মনে করো না আতাহার।

আমি কিছু মনে করিনি।

অল্প বয়সে মার আদর না পেলে ছেলেমেয়েগুলি অন্য রকম হয়ে যায়। নীতু, সাজ্জাদ এরা দুৰ্ভাগা। অল্প বয়সে এরা মারি ভালবাসা পায়নি।

আপনার ভালবাসা তো পেয়েছে।

সেটা এখনো পাচ্ছে। বাবার ভালবাসায় কোন একটা জিনিসের অভাব আছে। সেই ভালবাসায় কাজ হয় না। অনেকটা খাবারের ভিটামিনের মত। খাবার ঠিক আছে। কিন্তু পাটিকুলার একটা ভিটামিন নেই। তাই না?

আতাহার কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, হতে পারে।

সাইকোলজিস্টদের উচিত সেই ভিটামিনটা কি তা খুঁজে বের করা।

জ্বি।

আতাহার মনে মনে বলল, এই ভিটামিনটার নাম হবে–ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স এর মত ভিটামিন-ভি কমপ্লেক্স। ভালবাসা কমপ্লেক্স ভিটামিন।

 

নীতু তার কাপড় না ছেড়েই কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসেছে। আতাহারকে সে অতি দ্রুত একটা চিঠি লিখছে। চিঠিটা সে আজই তার হাতে দিয়ে দেবে। অনেক কথা মুখে বলা যায় না। চিঠিতে খুব সহজে বলে ফেলা যায়। সবচে ভাল হত চিঠিটা যদি ইংরেজিতে লিখতে পারত। ভাষার আড়াল পর্দার মত কাজ করত। I love you যত সহজে বলা যায়–আমি তোমাকে ভালবাসি। তত সহজে বলা যায় না। মুখের কাছে এসে আটকে যায়। ভালবাসাবাসির কথা বলার জন্যে অন্য এক ধরনের ভাষা থাকলে ভাল হত। সাইন ল্যাংগুয়েজের মত কোন ল্যাংগুয়েজ। যে ল্যাংগুয়েজে শুধু চোখ ব্যবহার করা হবে।

আতাহার ভাই,
খুব জরুরী কথা। খুব জরুরী। আপনি কি জানেন আমার ড্রয়ারে ২১৫টা ফনোবারবিটন ট্যাবলেট আছে? ট্যাবলেটগুলি আমি অল্প অল্প করে জমিয়েছি। যেদিন আমার গায়ে-হলুদ হবে সেদিন রাতে আমি ট্যাবলেটগুলি খাব। এর মধ্যে একটা তবে আছে। তবেটা হচ্ছে–আপনি যদি আমার ঘরে এসে আমাকে বলেন, নীতু, তোর ট্যাবলেটগুলি আমাকে দে। তাহলে আমি দিয়ে দেব এবং তখন অনেক রকম পাগলামি করব। যেমন আপনাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদব বা অন্য কিছু যা এই মুহুর্তে ভাবতে পারছি না। বা ভাবতে পারলেও বলতে পারছি না।

ইতি
নীতু

নীতুর হাত এত কাঁপছে যে হাতের লেখা হয়েছে জঘন্য। অক্ষরগুলি হয়েছে বড়ছোট। বানান ঠিক আছে কিনা কে জানে! নিৰ্ঘাত অনেকগুলি বানান ভুল হয়েছে। খুব সুন্দর একটা চিঠিও ভুল বানানের জন্যে জঘন্য হয়ে যায়। প্রথম বাক্যের দুটা বানানই তো মনে হচ্ছে ভুল–জরুরী বানান কি? হ্রস্ব-ইকার না। দীর্ঘ-ঈ কার?

তার শোবার খাটের কাছেই শেলফে চলন্তিকা থাকে। আজ সেটাও নেই। ডিকশনারি তো গল্পের বই না। কে নেবে ডিকশনারি? আশ্চর্য তো!

চিঠিটা নীতু চতুর্থবারের মত পড়ল। পুরো চিঠিতে ট্যাবলেট শব্দটা চারবার আছে। কি বিশ্ৰী লাগিছে! চিঠিটা কেমন ন্যাকা। ন্যাকা হয়ে গেছে। বাংলা ভাষাটা এমন যে আবেগ নিয়ে কিছু লিখলেই ন্যােকা ন্যাক ভােব চলে আসে। চিঠিটা বরং ইংরেজিতেই লেখা যাক। নীতু আরেকটা কাগজ নিল। কেন জানি তার সারা শরীর ঘািমছে। বুক ধক ধক করছে–। মনে হচ্ছে তার কঠিন কোন অসুখ করেছে—

Dear Ataha Bhai,
I have something important to discuss. Very important. Do you know I have 215 sleeping pills hidden somewhere in my drawer …

নীতু চিঠি হাতে নিচে নেমে এল। হোসেন সাহেব একা একা বসে আছেন। নীতু বলল, আতাহার ভাই কোথায়? হোসেন সাহেব বললেন, ওতো অনেক আগেই চলে গেছে।

নীতু বলল, ও আচ্ছা।

হোসেন সাহেব বললেন, তুই এরকম করছিস কেন? তোর কি হয়েছে? ঘেমে— টেমে কি অবস্থা। আজ তোদের ডিনার কেমন হয়েছে?

অসাধারণ হয়েছে বাবা।

বোস, গল্প করি।

নীতু বাসল, আবার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল। হোসেন সাহেব বললেন, কোথায় যাচ্ছিস?

নীতু বলল, বাগানে। আমার খুব গরম লাগছে। চিঠিটা সে কুচ কুচি করে ছুড়ে ফেলল। সাদা টুকরাগুলি কেমন যেন শিউলি ফুলের মত লাগছে। তাদের বাগানে প্রকাণ্ড একটা শিউলি গাছ ছিল। গাছটা কেটে ফেলা হয়েছে। শুয়োপোকার জন্যে কাটা হয়েছে। শিউলি গাছে খুব শুয়োপোকা হয়। নীতুর মনে হচ্ছে তার শিউলি ফুলের মত কাগজের টুকরোগুলির উপর দিয়ে শুয়োপোকা হেঁটে যাচ্ছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ