মনে হচ্ছে ফিরোজের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে।

বি. করিম সাহেবের বন্ধু তাকে সহকারী ডিজাইনার হিসেবে নিয়েছেন। ভদ্রলোক ছোটখাটো। মাগুর মাছের মত কালো রঙ। ফিটফাট বাবু সেজে থাকেন। তার কাছে গেলেই আফটার শেভ লোশনের কড়া গন্ধে মাথা ধরে যায়। তার নাম মন্তাজ মিয়া। ছবির লাইনে পনের বছর ধরে আছেন। এখন পর্যন্ত কোনো ছবি হিট করেনি। তাঁর ধারণা, এবারের ছবিটি করবে। ছবির নাম নয়া জিন্দেগি–ইংরেজিতে ফ্রেশ লাইফ, নিউ লাইফ নয়।

এই ছবি হিট করবে, এ-রকম আশা করার সঙ্গত কারণ আছে। ছবিতে তিনজন হিরোইন। দু’জন মারা যায়। শেষ পর্যন্ত একজন টিকে থাকে। হিরো এবং হিরোইন নয়া জিন্দেগি শুরু কবে। ছটা গান আছে। প্রতিটি গানই কলকাতার আর্টিস্টদের দিয়ে গাওযানো। ব্যালে ড্যান্স আছে, যা রেকর্ড করা হয়েছে কলকাতার এক ক্যাবারেতে। প্রিন্সেস সুরাইযা এমন এক ড্যান্স দিযেছে, যা দেখে এই বুড়ো বয়সেও মন্তাজ মিযার বুক ধবফড় করে। সেন্সার এই জিনিস কেটে দিলে সর্বনাশ হবে। ছবির অর্ধেক কাজ বিদেশে হয়েছে, বাকি অর্ধেক দেশে হবে। বেশির ভাগই আউটডোরে। ইনডোরে হিরোর বসার ঘর এবং বারান্দা। এমন সেট করতে হবে, যাতে বিকশাওযালা শ্রেণীব দর্শকদের চোখ কোটির থেকে ঠেলে বের হয়ে আসে। ক্রমাগত সিটি বাজাতে থাকে।

মন্তাজ মিয়ার সঙ্গে ফিরোজের নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল :

তুমি করে বললে আপত্তি আছে?

জি না।

গুড। সবাইকে আমি তুমি করে বলি। এ-দেশের যে টপ নায়িকা, যার সাইনিং মানি পঁচিশ হাজার টাকা, তাকেও তুমি করে বলি।

ফিরোজ তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না।

তুমি কাজে লেগে পড়। কীভাবে কী করতে হয়, আগে শেখ। আমি যা চাই সেটা হচ্ছে গ্ল্যামার। জি এল এ এম ও ইউ আর। বুঝলে?

জি, বুঝলাম।

বোম্বের ছবিগুলি দেখি। দেখে কাজ শেখ।

হ্যাঁ, তাই করব।

বি. করিম সাহেব বলেছেন, তুমি প্রতিভাবান লোক। সত্যি নাকি?

জি না, সত্যি না।

গুড। ভেরি গুড। জি ও ও ডি। প্রতিভাবান লোকদের দিয়ে কিছু হয় না। আমি চাই কাজ। ওয়ার্ক। ডাবলিউ ও আর কে। বুঝলে?

জি, বুঝলাম।

মদ্যপানের অভ্যাস আছে?

না।

অল্পসল্প খেতে পার। এতে দোষ নেই। অল্প খেলে মেডিসিনের মতো কাজ করে। ব্ৰেইন শার্প হয়। ওয়েস্টার্ন কাস্ট্রিগুলি যে এত দূর এগিয়ে গেছে জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, শিল্পে, সংস্কৃতিতে—এর পেছনে অ্যালকোহলের একটা ভূমিকা আছে বলে আমার ধারণা।

আপনার ধারণা সত্যি হবারই সম্ভাবনা।

নায়িকাদের সঙ্গে খাতির জমাবার চেষ্টা করবে না। দূর থেকে ম্যাডাম বলে স্নামালিকুম দেবে। তারপর ভ্যানিশ হয়ে যাবে। ফিল্ম লাইনে তোমার হবে বলে আমার ধারণা।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আমার ই এম পি ক্ষমতা আছে। আগেভাগে বলে ফেলতে পারি। মন্দিরা যখন প্রথম ফিল্ম লাইনে আসে, তাকে দেখেই আমি বললাম, তোমার হবে।

হয়েছে?

হয়েছে মানে! দু লক্ষ টাকার আর্টিস্ট এখন। শিডিউল নিতে হয় এক বছর আগে। আমাকে এখানে খুব মানে। সেদিন এক পত্রিকার ইন্টারভ্যুতে আমার নাম বলেছে।

মন্দিরা কাজ করছে নাকি আপনার ছবিতো? তুমি এখন ফিল্ম লাইনের লোক। নায়িকাদের নাম ধরে কথা বলবে না। এখন থেকে প্র্যাকটিস কর। বল–মন্দিরা ম্যাডাম।

ফিরোজ হেসে বলল, মন্দিরা ম্যাডাম।

হাসবে না। ফিল্ম লাইনে দাঁত বের করতে নেই। আচ্ছা, এখন যাও। কাল দুনম্বর স্টুডিওতে চলে আসবে।

ফিরোজ সেট তৈরি করে দিল। মন্তাজ মিয়া চোখ-মুখ কুঁচকে দীর্ঘ সময় সেই সেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ফিরোজ বলল, মনে হচ্ছে আপনার মনমত হয়নি?

মন্তাজ মিয়া তারও জবাব দিলেন না।

পছন্দ না হলে অদলবদল করে দেব। হাতে তো সময় আছে।

পছন্দ হয়েছে। ছোকরা, তোমার হবে।

সেই সপ্তাহেই মধুমিতা মুভিজ-এর ব্যানারে নতুন যে-ছবিটি হবে, তার চিফ ডিজাইনার পদেব অফার ফিবোজের কাছে চলে এল।

ফিরোজ বলল, ভেবে দেখি।

মধুমিতা মুভিজ-এর মালিক বললেন, ক’দিন লাগবে ভাবতো?

সপ্তাহখানেক লাগবে।

বেশ, ভাবুন। সপ্তাহখানেক পর আবার যোগাযোগ করব। আপনার টেলিফোন আছে?

জি না। একটা টেলিফোন নিয়ে নিন। ছবির লাইনে টেলিফোনটা খুবই দরকারি।

নিয়ে নেব। শিগগিরই নিয়ে নেব। তারপর একটা গাড়ি কিনব। লাল রঙের। টু-ডোর। গাড়ি সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে? মানে কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ?

 

পর পর দু’দিন ফিরোজ ঘুমিয়ে কাটাল।

এ-রকম সে করে। তার ভাষায়, দুঃসময়ের জন্যে ঘুম স্টক করে রাখা। সেই স্টক-করা ঘুমের কারণে ভবিষ্যতে কোনো রকম আলস্য ছাড়াই না-ঘুমিযে থাকতে পারে। উট যেমন দুঃসময়ের জন্যে পানি জমা করে রাখে, অনেকটা সে-রকম। শুধু দুপুরে খাবার সময় পাশের ইরাবতী হোটেলে খেতে গেছে। বাংলাদেশ হওয়ায় এই একটি লাভ, সুন্দর-সুন্দর নামের ছড়াছড়ি। পানের দোকানের নাম ময়ূরাক্ষী; জুতোর দোকানের নাম সোহাগ পাদুকা।

ইরাবতী রেস্টুরেন্টের নাম হওয়া উচিত ছিল–নালাবতী। পাশ দিয়ে কর্পোরেশনের নর্দমা গিয়েছে। নর্দমাগুলি বানানোর কায়দা এমন যে, পানি চলে যায়, কিন্তু ময়লা জমা হয়ে থাকে। সেই পূতিগন্ধময় নরকের পাশে খাবার ব্যবস্থা। তবে রান্না ভাল। পচা মাছও এমন করে রোধে দেয় যে দ্বিতীয় বার যেতে ইচ্ছে করে। ইরাবতী রেস্টটুরেন্টে ফিরোজের তিনশ টাকার মত বাকি ছিল। সে বাকি মিটিয়ে আরো দুশ টাকা অ্যাডভান্স ধরে দিল। দিনকাল পাল্টে গেছে। অ্যাডভান্স পেয়েও লোকজন খুশি হয় না। ম্যানেজার এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন কিছুক্ষণ আগে একটি জ্যান্ত ইদুর গিলে ফেলেছে। সেই ইন্দুর হজম হয়নি, পেটে নড়াচড়া করছে।

ফিরোজ বলল, আছেন কেমন ভাইসাব?

ভালই। আপনারে তো দেখি না।

সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত। সিনেমায় নেমে পড়েছি, বুঝলেন?

ম্যানেজার ফুস করে বলল, ভালই।

আপাতত হিরোইনের বড় ভাইয়ের রোল করছি। মোটামুটি একটা সেন্ট্রাল ক্যারেক্টার। বই রিলিজ হলে দেখবেন। পাস দিয়ে দেব।

নাম কী বইয়ের?

নয়া জিন্দেগি। হিট বই হবে।

ফিরোজ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে মিষ্টি পান। কিনল। রাতে আর খেতে আসবে না। ঘরেই যা হোক কিছু খেয়ে নেবে, কাজেই পাউরুটি, কলা এবং এক কৌটা মাখন। কিনল। বাজারে নতুন বরই উঠেছে, খেতে ইচ্ছা করছে। ভাংতি টাকা সব শেষ। একটা পাঁচশ টাকার নোট আছে, সেটা ভাঙাতে ইচ্ছা করছে না। বরই না কিনেই সে ফিরে এল। ছেলেমানুষি একটা আফসোস মনে জেগে রইল।

হাজি সাহেব বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছেন। ফিরোজ হাসিমুখে এগিয়ে গেল।

স্লামালিকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছেন ফিরোজ সাহেব?

জি, ভাল।

ক’দিন ধরে দেখি না আপনাকে?

দারুন ব্যস্ত! আজি একটু ফাঁকা পেয়েছি, ভাবলাম আপনাকে জরুরি কথাটা বলে যাই।

কী জরুরি কথা?

ঐ যে আপনার মেয়ের ছবি নিয়ে গেলাম যে!

ও, আচ্ছা। বসেন, চা খাবেন?

তা খাওয়া যায়।

হাজি সাহেব ভেতরে গিয়ে চায়ের কথা বলে এলেন। ফিরে এসে আগ্রহী চোখে তাকিয়ে রইলেন।

ঐ যে আপনার কাছ থেকে ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম, ছবি দেখে সবার এক কথা–মেয়ে কী ছবির মত সুন্দর? ফটোজেনিক ফেস ভাল থাকলে অনেক সময় এলেবেলে মেয়েকেও রাজকন্যার মত লাগে।

হাজি সাহেব ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়ে যদি ছবির কাছাকাছিও হয়, তাহলেও ওদের কোনো আপত্তি নেই। যেদিন বলবেন, সেদিনই বিয়ে।

আপনি কী মেয়ের অসুবিধার কথাটা বলেছেন?

পাগল হয়েছেন। এখন আমি এইসব বলব? কথাবার্তা মোটামুটি পাকা হয়ে যাবার পর খুব কায়দা করে…।

না, যা বলবার এখনই বলবেন। মেয়েকে আমি একটা বাড়ি লিখে দেব, এটাও বলবেন। ৪৩ কাঁঠাল বাগান। একতলা বাড়ি। ইচ্ছা করলে বাড়ি দেখে আসতে পারেন।

মেয়েই দেখলাম না, আর বাড়ি!

বাড়িটাই লোকে আগে দেখে, মেয়ে দেখে পরে। তবে মেয়েকে আপনি দেখবেন। আসতে বলেছি। আসুন, ভেতরে গিয়ে বসি।

তারা বসার ঘরে পা দেয়ামাত্র হাজি সাহেবের ছোট মেয়েটি ঘরে ঢুকাল। কী শান্ত স্নিগ্ধ, মুখ! গভীর কালো চোখে ডুবে আছে চাপা কষ্ট। সেই কষ্টের জন্যেই বুঝি এমন টলটলে চোখ।

ফিরোজ বলল, দাঁড়িয়ে আছ কেন, বস।

মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে বসল। তার আচার-আচরণে কিছুমাত্র জড়তা লক্ষ্য করা গেল না। সে সরাসরি তাকিয়ে আছে, চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না।

কী নাম তোমার?

লতিফা।

প্রায় চার বছর তোমাদের এদিকে আছি। নামটা পর্যন্ত জানি না। খুবই অন্যায়। তুমি কী আমার নাম জান?

জানি।

হাজি হাসেব বললেন, লতিফা, তুই এখন ভেতরে যা। চা দিতে বল।

লতিফা সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে গেল। ফিরোজ একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস চেপে ফেলল। তার ইচ্ছে করছে, বলে–পাত্র হিসেবে আমাকে আপনার কেমন লাগে?

বলা হল না। আধুনিক সমাজে বাস করার এই অসুবিধে। মনের কথা খোলাখুলি কখনো বলা যায় না। একটি মেয়েকে ভাল লাগলেও তাকে সরাসরি সেই কথা বলা যাবে না। অনেক ভনিতা করতে হবে। অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হবে।

হাজি সাহেব বললেন, আমার মেয়েটা বড় আদরের।

ফিরোজ কিছু বলল না। সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটার একটা আলাদা মজা আছে। যে-কোনো দিকে যাওয়া যায়, যেখানে ইচ্ছে সেখানে থেমে যাওয়া যায়। এই সৌভাগ্য কজনার হয়? সবাই ব্যস্ত। সবাই ছুটছে। এর মধ্যে দু’একজন অন্য রকম থাকুক না, যাদের ছোটার ইচ্ছে নেই, প্রয়োজনও নেই।

এখন প্রায় বিকেল! হাঁটতে-হাঁটতে অপালাদের বাড়ির সামনে চলে যাওয়া যায়। কেন জানি এই অহঙ্কারী মেয়েটিকে দেখতে ইচ্ছে করছে। তার কঠিন মুখ, চোখের তীব্র দৃষ্টিও কেন জানি মধুর। এর ব্যাখ্যা কী? কোনো ব্যাখ্যা নেই। এই রহস্যময় পৃথিবীর অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করা যায় না। কবি, দার্শনিক, শিল্পী.. এরা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। সেই চেষ্টা কত যুগ আগে শুরু হয়েছে, এখনও চলছে। ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ হয়নি।

ফিরোজ সাহেব, কী ভাবছেন?

কিছু ভাবছি না। শরীরটা খারাপ লাগছে।

সে কী!

আজ আর চা-টা কিছু খাব না। ডাক্তারের কাছে যাব। বমি-বমি লাগছে।

ফিরোজ বমির ভঙ্গি করে চোখ-মুখ উল্টে দিয়ে বলল, কাল রাতেও চার বার বমি হয়েছে। আমি উঠলাম।

 

অপালাদের বাড়ির সামনে ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে। এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন তাকে দেখা না যায়। মানুষের অদৃশ্য হবার ক্ষমতা থাকলে বেশ হত। মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে দেখা যেত সে কী করছে। এই মুহূর্তে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চেইনে বাধা ভয়াবহ কুকুর দু’টি চেইন ছিঁড়ে ফেলবার একটা কসরত করছে। মালীকে নিড়ানি হাতে দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া সব ফাঁকা।

স্যার।

ফিরোজ চমকে উঠল।

আপনাকে ডাকে স্যার।

কে ডাকে?

আপা আপনাকে যাইতে বলছে।

কোন অ্যাপা?

অপালা। আপা।

সে কী! কোথায় তিনি?

অপালাদের দারোয়ান তার উত্তর দিল না। দারোয়ান-শ্রেণীর লোকেরা কথা কম বলে।

 

মেয়েটিকে সম্পূর্ণ অন্য রকম লাগছে। ফিরোজ ভেবে পেল না একই মেয়েকে একেক দিন একেক রকম লাগে কেন। এর পেছনের রহস্যটা কী? সাজগোজের একটা ব্যাপার থাকতে পারে। তার ভূমিকা কতই-বা। আর হবে? চোখে কাজল দিয়ে চোখ দু’টিকে টানা-টানা করা যায়। চুল মাঝখানে সিঁথি না-করে বা দিকে করে খানিকটা বদলানো যায়। পার্ম করে চুলে ঢেউ খেলানো নিয়ে আসা যায়, কিন্তু তার পরেও তো মানুষটি ঠিকই থাকবে!

বসুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ফিরোজ বসল। বসতে-বসতে মনে হল অপালার গলার স্বরও এখন অন্য রকম লাগছে। একটু যেন ভারী। আগেকার তরল কণ্ঠস্বর নয়।

আপনি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এর আগেও এক’দিন এসে ছিলেন। বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যান। কেন বলুন তো?

ফিরোজ কী বলবে ভেবে পেল না। কিছু এই মুহুর্তেই বলা উচিত। মেয়েটি জবাব শোনবার জন্যে অপেক্ষা করছে। জবাবের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। জবাব যদি তার পছন্দ হয়, তাহলে সে ফিরোজের সামনের চেয়ারটায় বসবে, পছন্দ না-হলে বসবে না। অহঙ্কারী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকবে।

অপালা বলল, আপনার যদি আপত্তি থাকে তাহলে বলার দরকার নেই।

না, কোনো আপত্তি নেই। আপনার সঙ্গে দেখা হবে এই আশাতেই দাঁড়িয়ে থাকি। দু’দিন মাত্র নয়, তার আগেও কয়েকবার এসেছি।

ফিরোজ লক্ষ্য করল, মেয়েটির চেহারা কঠিন হতে শুরু করেছে। কী প্রচণ্ড রাগ এই মেয়ের! গাল কেমন টকটকে লাল হয়ে গেল–ঠোট কাঁপছে। মেয়েটি নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে। সামলাতে পারছে না। মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই মেয়ের তেমন অভ্যাস নেই। অভ্যাস থাকলে খুব সহজেই নিজেকে সামলাতে পারত। ফিরোজ বলল, আমার সব কথা না শুনেই আপনি রেগে যাচ্ছেন। সবটা আগে শোনা ভাল নয় কি?

বলুন, শুনছি।

আপনি বসুন, তারপর বলছি। আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন আর আমি বসে-বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কথা বলব, তা তো হয় না। আর আপনি যদি মনে করেন যে আমার স্তর আর আপনার স্তর আলাদা, তাহলে অবশ্যি ভিন্ন কথা।

অপালা বসল। সে তাকিয়ে আছে ফিরোজের দিকে, এক বারও চোখ ফিরেয়ে নিচ্ছে না। এটিও একটা মজার ব্যাপার। এই বয়সের অবিবাহিত মেয়েরা দীর্ঘ সময় পুরুষ মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না। অসংখ্য বার তারা চোখ নামিয়ে নেয়।

কী বলবেন, বলুন।

আমি নিজের মতো করে আপনাদের একটা ঘর সাজিয়ে দিয়েছি। সেটা আপনাদের পছন্দ হয়েছে কী হয়নি আমাকে কিছু বলেননি। আমার জানতে ইচ্ছা করে। জানবার জন্যেই আসি।

আসেন তো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন?

আপনাদের দু’টি বিশাল কুকুর আছে। আমি কুকুর ভয় পাই। ছোটবেলায় আমাকে দুবার পাগলা কুকুরে কামড়েছে।

অপালার কঠিন মুখ স্বাভাবিক হয়ে আসছে। গালের লাল রঙ এখন অনেকটা কম, নিঃশ্বাস সহজ।

আপনার কাজ আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি ম্যানেজার কাকুকে বলেছিলাম, চিঠিতে আপনাকে জানানোর জন্যে। তিনি বোধহয় জানাতে ভুলে গেছেন।

চিঠিতেই যখন জানানোর জন্যে বলেছেন, আপনি নিজেও তো জানাতে পারতেন। পারতেন। না?

হ্যাঁ, পারতাম।

কাজ আপনার ভাল লেগেছে শুনে খুশি হলাম। এখন তাহলে উঠি।

ফিরোজ উঠে দাঁড়াল। মনে ক্ষীণ আশা, মেয়েটি বলবে, বসুন, চা খেয়ে যান। সন্ধ্যাবেলা এইটুকু ভদ্রতা সে কী করবে না?

অপালা বলল, আপনি বসুন। আমার সঙ্গে চা খান।

ফিরোজ সঙ্গে-সঙ্গে বসে পড়ল। একবার ভেবেছিল রাগ দেখিয়ে বলবে চা লাগবে না। সেটা বিরাট বোকামি হত। এ যে-ধরনের মেয়ে, দ্বিতীয় বার অনুরোধ করবে না। দু’জন চুপচাপ বসে আছে। মেয়েটি চায়ের কথা বলার জন্যে ভেতরে যাচ্ছে না, কিংবা কাউকে ডেকেও কিছু বলছে না। এই পয়েন্টটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে হল, মেয়েটি তাকে ডাকতে পাঠাবার আগেই বলে দিয়েছে–আমরা খানিকক্ষণ গল্প করব, তখন আমাদের চাদেবে। অর্থাৎ কিছুক্ষণ সে গল্প করবে।

অপালা বলল, আসুন, আমরা বারান্দায় বসে চা খাই। আমার চা খাবার একটা আলাদা জায়গা আছে। বিকেলের চা বন্ধ ঘরের ভেতরে বসে খেতে ইচ্ছা করে না।

চা খাবার জায়গাটি অপূর্ব! যেন একটি পিকনিক স্পটা। চারদিকে ফুলের টব। বড় কসমিস ফুটে রয়েছে। দিনের সামান্য আলোতেও তারা আনন্দে ঝলমল করছে। টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম। সেই সরঞ্জাম দেখে ফিরোজ একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস চাপিল। কারণ একটিমাত্র চায়ের কাপ। ওরা একজনের চা-ই দিয়েছে।

অপালা টেবিলের পাশে দাঁড়ানো মেয়েটিকে বলল, অরুণা ও বরুণাকে বেঁধে রাখতে বল। আরেকটি চায়ের কাপ দিয়ে যাও।

কাজের মেয়েটি সন্দেহজনক দৃষ্টি ফেলতে-ফেলতে যাচ্ছে। কর্মচারীর মত যে ঢুকেছে, সে মুনিবের মেয়ের সঙ্গে চা খাচ্ছে, দৃশ্যটিতে সন্দেহ করার মত অনেক কিছুই আছে।

আমার চায়ের জায়গাটা আপনার কেমন লাগছে?

খুব ভাল লাগছে।

আপনার বোধহয় একটু শীত-শীত লাগছে। এ-রকম একটা পাতলা জামা পরে কেউ শীতের দিনে বের হয়!

আহ, কী সহজ-স্বাভাবিক সুরে মেয়েটি কথা বলছে! কী প্রচুর মমতা তার গলায়! ফিরোজের মন কেমন যেন অন্য রকম হয়ে গেল।

আপনার বিয়েটা এখনো হয়নি, তাই না?

কোন বিয়ে?

ঐ যে একটি মেয়ের ছবি দেখালেন। বলছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে হবে।

ও, আচ্ছা। না, এখনো হয়নি। সামনের মাসে হবার সম্ভাবনা। মেয়ের এক চাচা আমেরিকাতে থাকেন। ছুটি পাচ্ছেন না বলে আসতে পারছেন না। মেয়ে আবার খুব আদরের। কেউ চায় না যে, তার অনুপস্থিতিতে বিয়ে হোক। বাঙালি হচ্ছে সেন্টিমেন্টাল জাত, বুঝতেই পারছেন।

প্রচুর মিথ্যা বলতে হয় বলেই মিথ্যা বলা আর্ট ফিরোজের খুব ভাল জানা। মিথ্যা কখনো এক লাইনে বলা যায় না। মিথ্যা বলতে হয়। আঁটাঘাট বেঁধে। সত্যি কথার কোনো ডিটেল ওয়ার্কের প্রয়োজন হয় না, কিন্তু মিথ্যা মানেই প্রচুর ডিটেল কাজ।

অপালা বলল, আপনি যে এখনো বিয়ে করেননি, সেটা কিভাবে বুঝলাম বলুন তো?

কীভাবে বুঝলেন?

আপনার গায়ের পাতলা জামা দেখে। এই ঠাণ্ডায় আপনার স্ত্রী কিছুতেই এমন একটা জামা গায়ে বাইরে ছাড়তেন না।

ফিরোজ লক্ষ্য করল, মেয়েটি ছেলেমানুষি ভঙ্গিতে হাসছে, যেন এই বিরাট আবিষ্কারে সে উল্লসিত।

আপনি কী আরেক কাপ চা খাবেন?

হ্যাঁ, খাব। এক কাপ খেলে খালে পড়ার সম্ভাবনা।

আপনি নিশ্চয়ই আমাকে খুব অহঙ্কারী মেয়ে ভেবে বসে আছেন, তাই না? আমি কিন্তু মোটেই অহঙ্কারী না।

তাই তো দেখছি!

একা-একা থাকতে-থাকতে স্বভাবটা আমার কেমন অন্য রকম হয়ে গেছে।

এক-একা থাকেন কেন?

ইচ্ছা করে কি আর থাকি? বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। মা অসুস্থ। বাবা সারাক্ষণই বাইরে-বাইরে

ঘুরছেন।

অন্য আত্মীয়স্বজনরা আসেন না?

না।

কেন?

জানি না কেন। আমাকে বোধহয় পছন্দ করেন না।

আপনাকে পছন্দ না-করার কী আছে? আমার তো মনে হয় আপনার মত চমৎকার মেয়ে এই গ্রহে খুব বেশি নেই।

ফিরোজ লক্ষ্য করল, মেয়েটি আবার রেগে যাচ্ছে। তার মুখে আগের কাঠিন্য ফিরে আসছে।

ফিরোজের আফসোসের সীমা রইল না। অপালা বলল, আসুন, আপনাকে গোট পর্যন্ত আগিয়ে দিই।

অর্থাৎ অত্যন্ত ভদ্র ভাষায় বলা–বিদেয় হোন। ফিরোজের মন-খারাপ হয়ে গেল। আরেক বার আসার আর কোনো উপলক্ষ নেই। দিন সাতেক পর সে যদি এসে বলে ঐদিন একটা খাম কি আপনার এখানে ফেলে গেছি।–তাহলে তা কী বিশ্বাসযোগ্য হবে? মনে হয় না। এই মেয়েটি অসম্ভব বুদ্ধিমতী।

সে গেট পর্যন্ত ফিরোজের সঙ্গে-সঙ্গে এল, কিন্তু একটি কথাও বলল না। ফিরোজ যখন বলল, যাই তাহলে। সে তার জবাবেও চুপ করে রইল। শুধু দারোয়ানকে বলল, অরুণা এবং বরুণাকে এখন ছেড়ে দাও।

 

নিশানাথবাবু রাতের বেলা খবর নিতে এলেন। এই মানুষটি সাধারণত খুব হাসিখুশি। কিন্তু আজ কেমন যেন গম্ভীর লাগছে। মুখে খুব চিন্তিত একটা ভঙ্গি। অপালা, বলল, ম্যানেজার কাকু, আপনার কী শরীর খারাপ?

না, শরীর ভালই আছে।

বাবার কোনো খবর পেয়েছেন?

না। ইংল্যান্ডে পৌঁছেছেন, সেই খবর জানি। তারপর আর আমি কিছু জানি না। স্যার মাঝে মাঝে এ রকম ডুব মারেন, তখন সব সমস্যা একসঙ্গে শুরু হয়?

কোনো সমস্যা হচ্ছে কী?

না, তেমন কিছু না।

নিশানাথবাবু এড়িয়ে গেলেন। অপালার মনে হল, বড় কোনো সমস্যা হয়েছে। কারখানাসংক্রান্ত কোনো সমস্যা, যা এরা অপালাকে বলবে না। অপালারও এ-সব শুনতে ইচ্ছে করে না। সমস্যা থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল।

ম্যানেজার কাকু!

কী মা?

ফিরোজ বলে যে-ছেলেটি আমাদের ঘর ঠিক করে দিল, তাকে একটি চিঠি দিতে বলেছিলাম, দেননি কেন?

নিশানাথবাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, দিয়েছি তো!

ও, তাহলে উনি বোধহয় পাননি। রেজিস্ট্রি করে দেয়া দরকার ছিল।

রেজিস্ট্রি করেই তো দিয়েছি। চিঠির সঙ্গে একটা রেভিনিউ স্ট্যাম্প-বসানো রিসিট ছিল। উনি তো। সেখানে সই করে ফেরত পাঠিয়েছেন! কাজেই আমার চিঠি না-পাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। আমি বরং কাল তাকে জিজ্ঞেস করব।

না, জিজ্ঞেস করার দরকার নেই।

নিশানাথবাবু ইতস্তত করে বললেন, ছেলেটি আজ এখানে এসেছিল, তাই না?

হ্যাঁ।

এদের বেশি প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না, মা। কাজ করেছে টাকা নিয়েছে, ব্যস, ফুরিয়ে গেল। আবার এসে এত কিসের চা খাওয়াখাওয়ি!

অপালা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। নিশানাথবাবুর হঠাৎ এখানে আসার উদ্দেশ্য স্পষ্ট হচ্ছে। তিনি এমনি-এমনি আসনেনি। নিশ্চয়ই তাকে খবর দেয়া হয়েছে। টেলিফোনে জানানো হয়েছে।

মা অপালা।

জি।

তুমি একা-একা থাক, তোমার বোধহয় খারাপ লাগে।

না, আমার খারাপ লাগে না।

খারাপ না-লাগলেও লোনলি তো নিশ্চয়ই লাগে! আমি তোমার কাকিমাকে বলেছি, সে এসে থাকবে।

কোনো দরকার নেই।

না দরকার আছে।

বেশ, দরকার থাকলে তাকে নিয়ে আসুন। তবে আপনি কিন্তু কাকু শুধু-শুধু ভয় পাচ্ছেন। ঐ ছেলে আর এখানে আসবে না।

নিশানাথবাবুকে কোনো কথা বলার সুযোগ না-দিয়ে অপালা উঠে গেল। তার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।

 

ফখরুদ্দিন সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, আমি একটা টেলিফোন করব। দয়া করে ব্যবস্থা করে দিন।

যে-নার্স তাঁর মুখের ওপর ঝাঁকে আছে, সে বলল, আরো একটু ভালো হয়ে নাও, তারপর করবে।

আমি ভাল আছি।

তুমি মোটেও ভাল নও। খুবই অসুস্থ।

কতটা অসুস্থা?

অনেকটা তুমি কোথায় চলে গিয়েছিল ঈশ্বরের অনুগ্রহে ফিরে এসেছি।

এখন ঈশ্বরের অনুগ্রহে আমাকে একটি টেলিফোন করতে দাও।

নিশ্চয়ই করবে। আত্মীয়স্বজনকে খবর দিতে চাও তো? সে-ব্যবস্থা আমরা করেছি। তোমাদের এম্ব্যাসিকে জানানো হয়েছে। তারা নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।

আমাদের এম্ব্যাসির কাজকর্ম সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। ওরা কিছুই করেনি। যেনোট তোমারা পাঠিয়েছ, সেই নোট ওরা এখনো পড়েনি। খাম খোলা হয়নি বলেই আমার ধারণা।

নার্স কোনো কথা বলল না। ফখরুদিন সাহেবের বা হাতে একটি ইনজেকশন করল। ফখরুদ্দিন সাহেব। আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল রাত নটায়। টেলিফোনে প্রথম কথা বললেন অপালার সঙ্গে।

বাবা, তুমি! সবাই চিন্তায় অস্থির। তোমার কোনো খোঁজ নেই। মার সঙ্গে ঐ দিন কথা হল, মাও তোমার কোনো খোঁজখবর জানে না। তুমি আজ কেমন আছ?

খুব ভাল আছি।

গলার স্বর এমন লাগছে কেন?

সর্দি লেগেছে। কথাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এখন তো তাও কথা বলতে পারছি।

তুমি কথা বলছি কোথেকে?

লন্ডন থেকেই বলছি।

এতদিন ডুব মেরে ছিলে কেন?

দেখলাম ডুব মেরে থাকতে কেমন লাগে। এক’দিন ডুব মারতেই হবে। হা হা হা! তোমার খবর কি?

আমার কোনো খবর নেই। বসার ঘর ঠিক করা হয়েছে বাবা। এত সুন্দর করে সাজিয়েছে যে, দেখলে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

তোমার কথা বুঝতে পারছি না মা। কিসের ঘর?

ও-মা, ভুলে গেছ! বসার ঘরের ডেকোরেশন বদলানো হল না?

ও, আচ্ছা।

তোমার তো এটা ভুলে যাবার কথা নয় বাবা! তুমি তো কিছুই ভোলো না।

এখন মনে হয় কিছু কিছু ভুলে যাচ্ছি। বয়স হয়ে যাচ্ছে। গেটিং ওন্ড। বসার ঘরটা খুব সুন্দর হয়েছে বুঝি?

খুব সুন্দর! এক বার বসার ঘরে ঢুকলে তোমার বেরুতে ইচ্ছা করবে না।

তাহলে তো ডেকোরেশন ঠিক হয়নি। বসার ঘরে এমন হবে, যেন কেউ বেশিক্ষণ না বসে। যেন খুব অস্বস্তি বোধ করে। চট করে চলে যায়। হা হা হা।

दादा।

কি মা?

তোমার হাসিটাও কেমন যেন অন্য রকম লাগছে।

কী-রকম লাগছে?

মনে হচ্ছে হাসির তেমন জোর নেই।

আচ্ছা, দেখ তো এখন কেমন হয়–হা হা হা।

ফখরুদ্দিন সাহেব টেলিফোন নামিয়ে রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে চোখ মুছলেন। তাঁর আরো কয়েকটি কল করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সামর্থ্য ছিল না। মনে হচ্ছে শরীর একেবারেই গেছে। দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। দেশের মাটিতে মরতে হবে, এ রকম কোনো সেন্টিমেন্টাল চিন্তা-ভাবনা তার নেই। এ-রকম চিন্তা-ভাবনা থাকবে বড় বড় কবি-সাহিত্যিকদের, দেশপ্রেমিক-রাজনীতিবিদদের। তিনি তাদের কেউ নন। নিতান্তই এলেবেলে ধরনের একজন মানুষ। তার কোনো রোমান্টিক চিন্তা-ভাবনা থাকার কথা নয়। কিন্তু তবু রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তিনি বৃষ্টির শব্দ শুনলেন। ঝম-ঝম বৃষ্টি আষাড় মাসের প্রবল বর্ষণ। তিবি বেল টিবে নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন, বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে না?

নার্স অবাক হয়ে বলল, কই না তো!

হয়তো হচ্ছে, তুমি বুঝতে পারছি না। দয়া করে একটু বারান্দায় দেখে আসবে? এ-রকম বৃষ্টি শুধু আমাদের দেশেই হয়। তুমি বোধহয় জানো না, আমাদের দেশ হচ্ছে বৃষ্টির দেশ।

আমি তো শুনেছিলাম তোমাদের দেশ হচ্ছে অভাবের দেশ।

আমাকে দেখে কি খুব অভাবী লোক বলে মনে হচ্ছে?

তোমাদের দেশের সবাই তোমার মত?

হ্যাঁ। এখন দয়া করে একটু দেখে এস বৃষ্টি হচ্ছে কি না।

বললাম তো, হচ্ছে না।

আমি শুনতে পাচ্ছি, তুমি পাচ্ছ না? দয়া করে একটু দেখে এস না! বারান্দায় যেতে তোমার কী খুব কষ্ট হবে?

না, হবে না।

নার্স বারান্দায় গেল না, একজন ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এল। ডাক্তার রুগীর প্রেসার মাপলেন, গায়ের তাপ দেখলেন এবং কড়া মিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ