অনেকক্ষণ থেকেই টেলিফোন বাজছে।

অপালা বারান্দায় ছিল, শুনতে পায়নি। ঘরের দিকে রওনা হওয়ামাত্র শুনল। টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে, আহা না জানি কে! টেলিফোনের বিং হলেই আপালার কেন জানি মনে হয়, কেউ ব্যাকুল হয়ে ডাকছে। তার খুব একটা বড় সমস্যা। এই মুহুর্তেই তার কথা শোনা দরকার। এক বার সত্যিসত্যিা হলও তাই। রিসিভার তুলতেই ভারি মিষ্টি গলায একটি মেয়ে বলল, সালাম ভাইকে কী একটু ডেকে দেবেন? আমার খুব বিপদ।

অপালা বলল, সালাম ভাই কে?

আপনাদের একতলায় থাকে। প্লিজ, আপনার পায়ে পড়ি।

আমাদের একতলায় তো সালাম বলে কেউ থাকে না।

তাহলে এখন আমি কী করব?

বলতে-বলতে সত্যি-সত্যি মেয়েটি কেঁদে ফেলল। অপালা নরম স্বরে বলল, আপনার রঙ নাম্বার হয়েছে, আবার করুন, পেয়ে যাবেন। আমি রিসিভার উঠিয়ে রাখছি, তাহলে আর এই নাম্বারে চলে আসবে না।

মেয়েটি ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, নাম্বার ঠিক হলেও লাভ হবে না। ওরা ডেকে দেয় না।

তাই নাকি? হ্যাঁ।

শুধু যূঁথী বলে একটা মেয়ে আছে, ও ডেকে দেয়। কে জানে, আজ হয়তো যূঁথী নেই।

থাকতেও তো পারে, আপনি করে দেখুন।

আমাকে আপনি-আপনি করে বলছেন কেন? আমি মাত্র ক্লাস টেনে উঠেছে। আমাকে তুমি করে বলবেন।

মেয়েটার সঙ্গে তুমি-তুমি করে কথা বলার আর সুযোগ হয়নি। তার টেলিফোন নাম্বার জানা নেই। মেয়েটিও অপালার নাম্বার জানে না। রঙ নাম্বারের একটি ব্যাপারে অল্প পরিচয়। কত দিন হয়ে গেল, এখনও সেই মিষ্টি গলার স্বর অপালার কানে লেগে আছে। টেলিফোন বেজে উঠলেই মনে হয়, ঐ মেয়েটি নয়ত?

না, ঐ মেয়ে না। সিঙ্গাপুর থেকে অপালার বাবা ফখরুদ্দিন টেলিফোন করেছেন।

কেমন আছ মা?

খুব ভাল।

তোমার মার কোনো চিঠি পেয়েছ?

আজ সকালেই একটি পেয়েছি। মা এখন প্রায় সুস্থ।

সেকেন্ড অপারেশনের ডেট পড়েছে?

সে-সব কিছু তো লেখেননি।

এই মহিলা প্রয়োজনীয় কথাগুলি কখনো লেখে না। তুমি সন্ধ্যা সাতটা-সাড়ে সাতটার দিকে টেলিফোন করে জেনে নিও। এখানে সন্ধ্যা সাতটা মানে লন্ডনে ভোর ছয়টা।

আচ্ছা, আমি করব।

খুব একা-এক লাগছে নাকি?

না, লাগছে না। তুমি আসছ কবে?

আরো দু’দিন দেরি হবে। কোনো খবর আছে?

না, কোনো খবর নেই।

বসার ঘরটা নতুন করে সাজাতে বলে গিয়েছিলাম। কিছু হচ্ছে?

হ্যাঁ, হচ্ছে। ভীষণ রোগা আর লম্বা একটা ছেলে রোজ এসে কি সব যেন করছে। তার সাথে মিস্ত্রি-টিস্ত্রিও আছে।

কাজকর্ম কত দূর এগোচ্ছে?

তা তো জানি না। বাবা! আমি নিচে বিশেষ যাই না।

একটু বলে দিও তো, যাতে আমি আসার আগে-আগে কমপ্লিট হয়ে থাকে।

আমি এক্ষুণি বলছি।

আর শোন, তোমার মাকে কিছু জানিও না। সে এসে সারপ্রাইজড হবে।

আচ্ছা।

ঐ ছেলেটার নাম কী?

কোন ছেলেটার?

কাজ করছে যে।

নাম তো বাবা জানি না। জিজ্ঞেস করিনি। নাম দিয়ে তোমার কী দরকার?

কোনো দরকার নেই। মতিন বলে একটা ছেলেকে দিতে বলেছিলাম। ওর কাজ ভাল। কিন্তু তুমি তো বলছি রোগা, লম্বা। ঐ ছেলে তো তেমন লম্বা নয়।

আমি নাম জিজ্ঞেস করব। যদি দেখি ও মতিন নয়, তাহলে কী করব?

কাজ বন্ধ রাখতে বলবে। আমি স্পেসিফিক্যালি বলেছি মতিনের কথা। তোমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে মা?

ভাল হচ্ছে না।

খুব বেশি খারাপ হচ্ছে?

কেমন যেন মাঝামাঝি হচ্ছে! মাঝামাঝি কোনো কিছুই আমার ভাল লাগে না।

ফখরুদ্দিন সাহেব উঁচু গলায় হাসতে লাগলেন। অপালার এই কথায় হঠাৎ করে তিনি খুব মজা পেলেন।

আচ্ছা মা, রাখলাম।

তুমি ভালো আছ তো বাবা?

অসম্ভব ভালো আছি। খোদা হাফেজ।

অপালা নিচে নেমে এল। ঐ ভদ্রলোক বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আছেন। তার সঙ্গে দু’জন লোক করাত দিয়ে কাঠ টুকরো করছে। অপালা বসার ঘরে উঁকি দিল। সমস্ত ঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। পেইনটিংগুলি নামিয়ে রাখা হয়েছে, শো-কেসটি নেই। কাঁপেট ভাজ করে এক কোণায় রাখা। অপালা বলল, আপনি কেমন আছেন?

ফিরোজ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ, আপনাকেই। আপনার নাম কী মতিন?

আমার নাম মতিন হবে কী জন্যে? আমার নাম ফিরোজ।

আপনার নাম ফিরোজ হলে বড়ো রকমের সমস্যা–কাজ বন্ধ।

কাজ বন্ধ মানে?

কাজ বন্ধ মানে হচ্ছে আপনি আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে বাড়ি চলে যাবেন।

ফিরোজের মুখ হাঁ হয়ে গেল। যেন এমন অদ্ভুত কথা এর আগে সে শোনেনি। অপালা হেসে ফেলল। সে অবশ্যি হাসি মুহূর্তের মধ্যেই সামলে ফেলল। শান্ত গলায় বলল, বাবা টেলিফোনে বললেন, মতিন নামের একজনের নাকি কাজটা করার কথা।

কিন্তু আমি তো ঠিক তার মতোই করছি।

আপনি করলে হবে না।

মতিন এখন ছুটিতে আছে। তার বড়ো বোনের অসুখ। বরিশাল গেছে।

বরিশাল থেকে ফিরে এলে আবার না-হয় করবেন।

ফিরোজ সিগারেট ধরাল। মেয়েটির কথা তার এখন বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে ঠাট্টা করছে। যদি ঠাট্টা না হয়, তাহলে তার জন্যে বড়ো ধরনের ঝামেলা অপেক্ষা করছে। এই কাজটি সে জোর করে হাতে নিয়েছে। করিম সাহেবকে বলেছে, কোনো অসুবিধা নেই, মতিনের চেয়ে কাজ খারাপ হবে না। করিম সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেছেন, আরে না। ভদ্রলোক মতিনের কথা বলেছেন।

আমি নিজে তার মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। সে বলেছে, আমি করলেও চলবে। কাজ ভাল হলেই চলবে।

দেখেন, পরে আবার ঝামেলা না হয়। বড়লোকের কারবার। মুডের ওপর চলে। মাঝখানে যদি বন্ধ করে দেয়…

পাগল হয়েছেন! কাজ দেখে চোখ ট্যারা হয়ে যাবে।

এখন অবস্থা যা দাড়িচ্ছে, তাতে ফিরোজেরই চোখ ট্যারা হয়ে যাবার জোগাড়। বি. করিম লোকটি মহা ত্যাদড়। হয়তো বলে বসবে, ফিরোজ সাহেব, এই ফার্মে আপনার কাজ ঠিক পোষাচ্ছে না। দু’দিন পর-পর ফার্মকে একটা ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলছেন। আপনি ভাই অন্য পথ দেখুন। করিম সাহেবের পক্ষে এটা বলা মোটেই অস্বাভাবিক নয়, বরং খুবই স্বাভাবিক। ব্যাটা অনেক’দিন থেকেই সুযোগ খুঁজছে। মাঝে-মাঝে ইশারা-ইঙ্গিতও করছে। গত সপ্তাহে বেতনের দিন বলল, খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে গেছে। কাজের চেয়ে মানুষ বেশি। বার হাত কাকুড়ের আঠার হাত বিচি।

ফিরোজ আধা-খাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে অপালার দিকে তাকাল। অপালা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসি-হাসি। মনে হচ্ছে কায়দা করে এই মেয়েটিকে রাজি করিয়ে ফেলা যাবে। উনিশ-কুড়ি বছর বয়সী মেয়েদের মন তরল অবস্থায় থাকে। দুঃখ-কষ্টের কথা বললে সহজেই কাবু হয়ে যায়। মুশকিল হচ্ছে বলাটাই। এই বয়সী মেয়েদের সঙ্গে ভিখিরির গলার স্বরে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তাতে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়।

আমি বরং কাজটা শেষ করি। আমার ধারণা, আপনার বাবা যখন দেখবেন একটা চমৎকার কাজ হয়েছে. মানে চমৎকার যে হবে এই সম্পর্কে….

অপালা হাসি মুখে বলল, না।

ফিরোজ স্তম্ভিত। হাসিমুখে কাউকে না বলা যায়।

এইভাবে আমি যদি চলে যাই তাহলে আমার নিজের খুব অসুবিধা হবে। চাকরিটা হয়ত থাকবে মা। আপনি আপনার বাবাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন। আমার ধারণা, আপনার কথা উনি শুনবেন।

আপনার ধারণা ঠিক নয়।

এই বাজারে আমার চাকরি নিয়ে সমস্যা হলে কী যে অসুবিধায় পড়ব, আপনি বোধহয় বুঝতে পারছেন না। আপনাদের বোঝার কথাও নয়। নিজ থেকে বলতে আমার খুবই লজ্জা লাগছে…

অপালা মৃদু স্বরে বলল, যাবার আগে ঘরটা আগের মতো করে যাবেন। এ-রকম এলোমেলো ঘর দেখলে বাবা খুব রাগ করবেন।

ফিরোজ দ্বিতীয় সিগারেট ধরাল। তার সঙ্গের লোক দু’টি চিন্তিত মুখে জিরোজের দিকে তাকাচ্ছে। ফিরোজ নিচু গলায় বলল, যাও, ঘরটা গুছিয়ে ফেল।

অপালা চলে যাচ্ছে। ফিরোজের গা জ্বালা করছে, মেয়েটি এক বার বলল না–সরি। মানবিক ব্যাপারগুলি কী উঠেই যাচ্ছে? গল্প-উপন্যাস হলে এই জায়গায় মেয়েটির চোখে পানি এসে যেত। সে ধরা গলায় বলত–আমার কিছু করার নেই। ফিরোজ ভাই। আমার বাবাকে তো আপনি চেনেন না–একটা অমানুষ!

ফিরোজ বলত, তুমি মন খারাপ করো না? তোমার মন খারাপ হলে আমারও মন খারাপ হয়। এই বলে সে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত।

কিন্তু জীবন গল্প-উপন্যাস নয়। জীবনে কুৎসিত সব ব্যাপারগুলি সহজভাবে ঘটে যায়। অপরূপ রূপবতী একটি মেয়ে হাসতে-হাসতে কঠিন-কঠিন কথা বলে।

চা নিন।

ফিরোজ দেখল, কাজেব মেয়েটি ট্রেতে করে এক কাপ চা নিয়ে এসেছে। ফিরোজ ঠাণ্ডা গলায় বলল, চা কেন?

আপা দিতে বললেন।

তার এক বার ইচ্ছা হল বলে–চা খাব না। কিন্তু এ-রকম বলার কোনো মানে হয় না। শীতের সকালবেলা এক কাপ চা মন্দ লাগবে না। সে হাত বাড়িয়ে চায্যের কাপ নিল। চা খাওযা শেষ হলে আছাড় দিয়ে কাপটা ভেঙে ফেললেই হবে।

 

বি. করিম সাহেব বেশ কিছুক্ষণ মুখ ছুঁচালো করে রাখলেন।

চেঁচামেচি হৈচৈ কিছুই করলেন না। কবলে ভাল হত। স্টিম বের হয়ে যেত। স্টিম বেব হল না–এর ফল মারাত্মক হতে পারে। ফিরোজ ফলাফলেব অপেক্ষা করছে। তার মুখ দার্শনিকেব মত। যা হবার হবে এই রকম একটা ভাব।

ফিরোজ সাহেব।

জি।

হাজার পাঁচেক টাকার ক্ষতি হয়ে গেল, কী বলেন?

ক্ষতি হবে কেন? মতিন এইগুলি দিয়েই কাজ করবে।

পাগল, মতিন এই সব ছোবে? সে সব কিছু আবার নতুন কবে করাবে।

তা অবশ্যি ঠিক।

বেকায়দা অবস্থা হয়ে গেল ফিরোজ সাহেব।

তা খানিকটা হল।

আপনাকে আগেই বলেছিলাম, যাবেন না। কথা শুনলেন না। রক্ত গবাম, কারো কথা কানে নেন না।

রক্ত এক সময় গরম ছিল, এখন ঠাণ্ডা মেরে গেছে।

আমার যা সবচেয়ে খারাপ লাগছে তা হচ্ছে, আপনি আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছেন। আপনি বলেছিলেন, ফখরুদিন সাহেবের মেয়ে্র সঙ্গে কথা হয়েছে। আপনার কথার ওপর ভরসা করে…

করিম সাহেব বাক্য শেষ করলেন না। পেনসিল চাঁছতে শুরু করলেন। এটি খুব অশুভ লক্ষণ।

পেনসিল চাঁছা শেষ হওয়ামাত্র বুলেটের মতো কিছু কঠিন বাক্য বের হবে। তার ফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে।

ফিরোজ সাহেব।

জি।

আপনি বরং সিনেমা লাইনে চলে যান।

অভিনয় করার কথা বলছেন?

আরো না! অভিনয়ের কথা বলব কেন? সেট-টেট তৈরি করবেন। আপনি ক্রিয়েটিভ লোক, অল্প সময়েই নাম করবেন। জাতীয় পুরস্কার একবার পেয়ে গেলে দেখবেন কাঁচা পয়সা আসছে।

ফিরোজ মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। কাঁচা পয়সা জিনিসটা কী, কে জানে? পয়সার কাঁচাপাকা নেই। পয়সা হচ্ছে পয়সা।

ফিরোজ সাহেব।

জি।

ঐ করুন।

সিনেমা লাইনে চলে যেতে বলছেন?

হ্যাঁ। আমরা বড়-বড় কাজটাজ পেলে আপনাকে ডাকব তো বটেই। আপনি হচ্ছেন খুবই ডিপেন্ডেবল। এটা আমি সব সময় স্বীকার করি।

শুনে অত্যন্ত খুশি হলাম। আগে জানতাম না।

সিনেমা লাইনের লোকজন আপনাকে লুফে নেবে।

কেন বলুন তো?

সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, আপনার আর্ট কলেজের ডিগ্রি নেই। ডিগ্রিধাৱী কাউকে এরা নিতে চায় না। ওদের তেল বেশি থাকে। ডিরেক্টরের ওপর মাতব্বরি করতে চায়। আপনি তা করবেন না।

ডিগ্রি না-থাকার তো বিরাট সুবিধা দেখছি! এই ফার্মের চাকরি কী আমার শেষ?

করিম সাহেব কথার উত্তর দিলেন না। তাঁর পেনসিল চাঁছা শেষ হয়েছে। তিনি সেই পেনসিলে কী যেন লিখতে শুরু করেছেন। ফিরোজ হাই তুলে বলল, আপনি কী আমাকে আরো কিছু বলবেন, না। আমি উঠব?

আমার পরিচিত একজন ডিরেক্টর আছে। তার কাছে আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। চিঠি নিয়ে দেখা করুন, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

আপনি তো দেখছি রীতিমত মহাপুরুষ ব্যক্তি! চিঠিটা পেনসিলে না লিখে দয়া করে কলম দিয়ে লিখুন।

ইচ্ছা করেই পেনসিল দিয়ে লিখছি। পেনসিলের চিঠিতে একটা পারসোনাল টাচ থাকে, যে জিনিসটা টাইপ–করা চিঠিতে বা কলমের লেখায় থাকে না।

গুড। এটা জানতাম না। এখন থেকে যাবতীয় প্ৰেমপত্র পেনসিলে লিখব।

 

ডিরেক্টর সাহেবের বাসা কল্যাণপুর। সারা দুপুর খুঁজে সেই বাড়ি বের করতে হলো। ডিরেক্টর সাহেবকে পাওয়া গেল না। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ বাড়িওয়ালার কাছে জানা গেল, ডিরেক্টর সাহেব ছমাসের বাড়ি-ভাড়া বাকি ফেলে চলে গেছেন। শুধু তাই নয়, যাবার সময় বাথরুমের দু’টি কমোড হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙেছেন।

ফিরোজ চোখ কপালে তুলে বলল, বলেন কী!

ফিল্ম লাইনের লোক। বাড়ি-ভাড়া দেয়াই উচিত হয়নি। আপনি তার কে হন?

আমি কেউ হই না। আমিও একজন পাওনাদার।

কত টাকা গেছে?

প্ৰায় হাজার দশেক।

ঐ টাকার আশা ছেড়ে দিন। ঐ টা আর পাবেন? টাকা এবং স্ত্রী–এই দুই জিনিস হাতছাড়া হলে আর পাওয়া যায় না।

ফিরোজ প্রায় বলেই বসছিল–আপনার স্ত্রীও কী তাঁর সাথে ভ্যানিশ হয়েছেন? শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলাল। এখন রসিকতা করতে ইচ্ছা করছে না। সে ক্লান্ত স্বরে বলল, এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারেন?

নিশ্চয়ই পারি। আসুন, ভেতরে এসে বসুন। এত মন-খারাপ করবেন না। কী করবেন বলুন, দেশ ভরে গেছে জোচ্চোরে। আমার মত পুরনো লোক মানুষ চিনতে পারে না, আর আপনি হচ্ছেন দুধের ছেলে!

শুধু পানি নয়। পানির সঙ্গে সন্দেশ ও লুচি চলে এল। ভদ্রলোকের স্ত্রী পর্দার ও-পাশে থেকে উঁকি দিচ্ছেন। দেখছেন। দেখছেন কৌতূহলী চোখে।

ভদ্রলোক ফুর্তির স্বরে বললেন, এই ছেলের কথাই তোমাকে বলছিলাম। একে ফতুর করে দিয়ে গেছে। কী-রকম অবস্থা একটু দেখ। হায়রে দুনিয়া!

দশ মিনিটের ভেতর এই পরিবারটির সঙ্গে ফিরোজের চূড়ান্ত খাতির হয়ে গেল। ভদ্রলোক এক পর্যায়ে বললেন, দুপুরবেলা ঘোরাঘুরি করে লাভ নেই। হাত-মুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে ফেল। বড়-বড় পাবদা মাছ আছে।

ফিরোজের চোখ প্রায় ভিজে উঠল। এই জীবনে সে অনেকবারই অযাচিত ভালবাসা পেয়েছে। এই জাতীয় ভালবাসা মন খারাপ করিয়ে দেয়।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ